রাজনীতিক তত্ত্বের শ্রেণীবিভাগ

ইস্টন: ডেভিড ইস্টন রাজনীতিক তত্ত্বকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই দুটি ভাগ হল: (১) মূল্যবোধযুক্ত তত্ত্ব (Value Theory) এবং (২) হেতু সংক্রান্ত তত্ত্ব (Causal Theory)। ঐতিহ্যগত রাজনীতিক তত্ত্বগুলি হল মূল্যবোধযুক্ত। মানুষের অগ্রাধিকার (preference)-এর উপর এই ধরনের তত্ত্বে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিভিন্ন রাজনীতিক ঘটনাবলীর সম্পর্ক বিষয়ে যে সমস্ত রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব আলোচনা করে ইস্টন সেগুলিকে সাময়িক তত্ত্ব বলেছেন। মানুষের জ্ঞানকে নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে এই ধরনের তত্ত্বের অবদান অনস্বীকার্য।

রোল্যাণ্ড পেনক: রাজনীতিক তত্ত্বকে রোল্যাণ্ড পেনক (Ronald Pennock) পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। এই পাঁচটি ভাগ হল— 

(1) কাল্পনিক তত্ত্ব (Speculative Theory): এই ধরনের মতবাদে কল্পনার ভিত্তিতে আদর্শ সামাজিক কাঠামো ও ব্যবস্থাদি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। প্লেটোর সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত তত্ত্ব এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য 

(২) নৈতিক তত্ত্ব (Ethical Theory): এই তত্ত্বে রাষ্ট্র ও রাজনীতিক জীবন সম্পর্কিত যাবতীয় আলোচনা ন্যায়-নীতি এবং ঔচিত্য-অনৌচিত্যের প্রশ্নের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনায় অবরোহমূলক পদ্ধতি অনুসৃত হয়। প্লেটো, কাণ্ট, হেগেল, গ্রীণ, বোসাংকেত প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকদের তত্ত্ব এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। 

(৩) আইনগত তত্ত্ব (Legal Theory): এই তত্ত্বে রাষ্ট্রকে মূলত একটি আইনগত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা হয় এবং রাজনীতিক জীবনের সকল সম্পর্ককে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করা হয়। 

(৪) সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব (Sociological Theory): এই তত্ত্বে রাষ্ট্রকে মূলত একটি সামাজিক সংগঠন হিসাবে দেখা হয় এবং অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 

(৫) বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব (Scientific Theory): এই তত্ত্বে সংগৃহীত তথ্যাদি ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ প্রভৃতি পদ্ধতির মাধ্যমে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে।

রাজনীতিক দর্শনের অর্থ

দর্শন-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: রাজনীতিক দর্শনের অর্থ আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথম ‘দর্শন’ বলিতে কি বোঝায় তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দরকার। ‘দর্শন’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ’ বা ‘Love of Wisdom’। দর্শন-এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হল ‘Philosophy’। ‘Philosophy’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে দুটি গ্রীক্ শব্দের সমাহারে। এই দুটি গ্রীক শব্দ হল ‘Phile’ ও ‘Sophia’। এই দুটি গ্রীক্ শব্দের প্রথমটির অর্থ হল অনুরাগ বা ভালবাসা (loving) এবং দ্বিতীয়টির অর্থ হল প্রজ্ঞা (wisdom)। প্রাচীনকালে ‘দর্শন’ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন গ্রীকগণ।

দর্শনের অর্থ: দর্শনের বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। অনেকের মতে তত্ত্বগত জ্ঞানের প্রথম ঐতিহাসিক রূপ হল দর্শন। দর্শনের উদ্ভব হয়েছে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সূত্রপাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আবার অনেকের মতানুসারে সব রকম জ্ঞান ও বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত সত্যের বিজ্ঞান বা পর্যালোচনা হল দর্শন। ব্যাপক অর্থে দর্শন হল ব্যাপক ধরনের জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি। বস্তুত ব্যাপক অর্থে দর্শন হল একটি বিশ্ববীক্ষ্যা বা ‘worldview”। বিশ্ববীক্ষ্যা বলতে এক নিয়ন্ত্রণকারী নীতিকে বোঝায়। এই নীতি ঐতিহাসিক বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সামাজিক গোষ্ঠীর যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার দর্শন অনুসন্ধান পদ্ধতির এক সমন্বিত রূপ। চেতনার সঙ্গে বাস্তবের (consciousness to being) বা আত্মিকের সঙ্গে বৈষয়িক (spiritual to the material)-এর সম্পর্ক নির্ধারণই হল দর্শনের মূল।

ভাববাদী দর্শন ও বস্তুবাদী দর্শন: উপরিউক্ত ধারণার ভিত্তিতে দর্শনকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়। দর্শনের এই দুটি ভাগ হল—ভাববাদী দর্শন এবং বস্তুবাদী দর্শন। এক দল দার্শনিকের মতে বস্তুজগৎ হল। ভাবজগতের প্রতিফলন। এই দর্শন হল ভাববাদী দর্শন। ভাববাদী দর্শন অনুসারে চেতনাই হল প্রধান। ভাববাদী দর্শনে ‘ভাব’ (Idea)-কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এবং বলা হয় যে বস্তুজগৎ হল চেতনা ও ভাবজগতের প্রতিফলন বিশেষ। ভাববাদী দার্শনিকদের মধ্যে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো, অ্যারিস্টটল, জার্মান দার্শনিক কান্ট, ফিক্‌টে, হেগেল, ব্রিটিশ দার্শনিক গ্রীণ, ব্রাড়লে, রোসাংকেত প্রমুখ চিন্তাবিদদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর একদল দার্শনিকের মতানুসারে ভাবজগৎ হল বস্তুজগতের দ্বারা জ্ঞাত। এই দর্শন হল বস্তুবাদী দর্শন। বস্তুবাদী দর্শনে বস্তুকে চেতনা ও ভাবের উৎস হিসাবে গণ্য করা হয় এবং বস্তুর উপর প্রাধান্য আরোপ করা হয়। মার্কসবাদের মাধ্যমে বস্তুবাদী দর্শনের সর্বোচ্চ বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।

রাজনীতিক দর্শন: রাজনীতিক দর্শন হল দর্শনেরই একটি শাখা। র‍্যাফায়েল (D. D. Raphael) তাঁর Problems of Political Philosophy শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সামাজিক ও রাজনীতিক দর্শন হল দর্শনেরই একটি শাখা বিশেষ। রাজনীতিক জীবনের তাত্ত্বিক জ্ঞানসমূহের সমাহার হল রাজনীতিক দর্শন। রাজনীতিক জীবনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও যুক্তির তাত্ত্বিক জ্ঞান হিসাবে রাজনীতিক দর্শনের কথা বলা হয়। অর্থাৎ রাজনীতিক জীবনের বিশ্ববীক্ষ্যা হল রাজনীতিক দর্শন। আপটার (David Apter) -এর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক দর্শন হল মানবিক বিষয়ে প্রযোজ্য যুক্তিসমূহের আলোচনা। রাজনীতিক দর্শনে উদ্দেশ্যসমূহ, নৈতিক লক্ষ্যসমূহ ও অভিপ্রায়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আপটার তাঁর Introduction to Political Analysis শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Political Philosophy is the study of reason applied to human affairs…. The emphasis of political philosophy was on purposes, moral ends and intentions.”

রাজনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান: অনেকের মতে রাজনীতিক দর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়মাত্র। আবার বলা হয় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছে রাজনীতিক দর্শন থেকে। স্ট্রাউস (Leo Strauss) তাঁর What is Philosophy শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তার মতানুসারে রাজনীতিক দর্শন হল মূলত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সমার্থক। তিনি রাজনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে কোনরকম পার্থক্য নির্ধারণের পক্ষপাতী নন। তত্ত্বগত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের দার্শনিক তাৎপর্য বিশ্লেষণই হল রাজনীতিক দর্শনের উদ্দেশ্য।

রাজনীতিক দর্শনের বিষয়বস্তু: রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিবর্তন, কার্যাবলী, প্রকৃতি, রাষ্ট্রীয় সংগঠন, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিক সম্পর্ক, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য প্রভৃতি তত্ত্বগত আলোচনার মধ্যেই রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনার পরিধি সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র ও তার মৌলিক সমস্যাদি সম্পর্কিত রাজনীতিক দর্শনের এই আলোচনা হল মূল্যবোধযুক্ত এবং উদ্দেশ্যমূলক। তা ছাড়া রাজনীতিক দর্শনের আলোচনা হল ভাবভিত্তিক। এই আলোচনায়। ঔচিত্য-অনৌচিত্যের বিষয়ও বর্তমান থাকে। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ভাল ও মন্দের দিক, রাষ্ট্রের কি করা উচিত, আর কি করা উচিত নয়, নীতিশাস্ত্রের মত এইরকম নির্দেশমূলক (prescriptive) আলোচনাও রাজনীতিক দর্শনে থাকে।

রাজনীতিক দর্শনের বৈশিষ্ট্য: ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গির অনুগামীরা রাজনীতিক জীবনের কোন বিষয় পর্যালোচনার ক্ষেত্রে কতকগুলি পূর্ব সিদ্ধান্তের দ্বারা পরিচালিত হতেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতিক জীবন সম্পর্কে একটি সাধারণ মূল্যবোধ নির্ধারণ করে, সেই মূল্যবোধের মাধ্যমে রাষ্ট্র, আইন, নাগরিক অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে সর্বজনীন নীতি নির্ধারণ করাই হল রাজনীতিক দর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই কারণে রাজনীতিক দর্শনকে আদর্শ স্থাপনকারী (normative) বলা হয়ে থাকে। এই আলোচনা অনুসারে রাজনীতিক দর্শনের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা যেতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল: 

  • (১) রাজনীতিক দর্শনে রাষ্ট্র ও রাজনীতিক জীবনের বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আদর্শ স্থাপনকারী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করা হয়; 

  • (২) অবরোহমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনীতিক দর্শন বিশেষ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়; 

  • (৩) রাজনীতিক মূল্যবোধ ও ধারণার ক্ষেত্রে রাজনীতিক দর্শনের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সীমিতভাবে হলেও রাজনীতিক দর্শন রাজনীতির স্বরূপ এবং মানবজীবনে তার ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করে।

রাফায়েল: র‍্যাফায়েল (D. D. Raphael) কিন্তু রাষ্ট্রদর্শনকে কেবলমাত্র আদর্শবাদ হিসাবে স্বীকার করতে চান না। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্র দর্শন সমাজ দর্শনেরই অঙ্গীভূত। কারণ মানুষের রাজনীতিক জীবন সমাজজীবনেরই অংশবিশেষ। সুতরাং রাষ্ট্রদর্শন সমাজ দর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত। কারণ সমাজজীবনেরই একটি অংশ হল রাজনীতিক জীবন। র‍্যাফায়েলের মতানুসারে সামাজিক ও রাজনীতিক দর্শন হল দর্শনেরই একটি শাখা। র‍্যাফায়েল তাঁর Problems of Political Philosophy গ্রন্থে রাজনীতিক দর্শনের প্রকৃতি পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সাবেকী দর্শনের অন্যতম লক্ষ্য হল ধারণার বিশ্লেষণ। দর্শনের ধারণার বিশ্লেষণ, সমন্বয় সাধন ও উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়। মূলত সাধারণভাবে প্রযোজ্য ধারণা নিয়ে দার্শনিক সমস্যার আলোচনা করা হয়।

সমালোচনা: বিরুদ্ধবাদীরা নানাভাবে রাজনীতিক দর্শনের সমালোচনা করে থাকেন। তাঁরা রাজনীতিক দর্শনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন। এই সমস্ত যুক্তির মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। 

  • (১) রাজনীতিক দর্শনমূলক আলোচনায় ঘটনাকে উপেক্ষা করা হয়। 

  • (২) সুনির্দিষ্ট মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক দর্শনে ঔচিত্য-অনৌচিত্যের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাই এই আলোচনা হল আদর্শস্থাপনকারী (Normative)। 

  • (৩) রাজনীতিক দর্শনের আলোচনা হল মূল্যবোধজনিত বিচার বিশ্লেষণ। কিন্তু এ ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ হল অবৈজ্ঞানিক। তাই রাজনীতিক দর্শন হল অবৈজ্ঞানিক (unscientific)। 

  • (8) তা ছাড়া রাজনীতিক দর্শনের আলোচনা হল কাল্পনিক (speculative)। অথচ বিজ্ঞানের আলোচনার বিষয় হল বাস্তব ঘটনা।

সমালোচনার জবাব: কিন্তু উপরিউক্ত আলোচনা সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। (ক) রাজনীতিক দর্শনের আলোচনায় ঘটনার গুরুত্বকে অস্বীকার করা হয়, এ কথা ঠিক নয়। (খ) ঔচিত্য ও অনৌচিত্যের ধারণা ঘটনার থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে। (গ) ঔচিত্য-অনৌচিত্যের ধারণা বৈজ্ঞানিক আলোচনার সঙ্গেও যুক্ত থাকতে দেখা যায়। (ঘ) আধুনিককালের অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দর্শনহীনতা (philosophy-lessness) -র উপর জোর দেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তাত্ত্বিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে তাঁরা দর্শনহীনতার কথা বলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁদেরও একটি দর্শন আছে। স্ট্রাউস-এর মতানুসারে এই অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও তার্কিক যুক্তিবাদকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন।