ক্ষমতার ধারণার গুরুত্ব:
অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক আলোচনার ক্ষমতা হল কেন্দ্রীয় ধারণা। রাজনীতি বলতে বিরোধের মীমাংসাকে বোঝায়। এবং বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমেই স্থিরীকৃত হয় কীভাবে বিরোধের মীমাংসা হতে পারে। এবং এই ক্ষমতার বণ্টন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝা যায় সংশ্লিষ্ট সকলে বিরোধের মীমাংসাকে যথাযথভাবে কার্যকর করবে কিনা। বল বলেছেন: “It (political power) is a key concept in the study of politics, for if politics is the resolution of conflict, the distribution of power within a political community determines how the conflict is to be resolved; and whether the resolution is to be effectively observed by all parties.” প্রকৃত প্রস্তাবে প্রত্যেক রাষ্ট্রেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি ও কর্মসূচী নির্ধারণ ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে এই ক্ষমতার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাজনীতিক আচার-আচরণ যে সমস্ত বিষয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয় তার মধ্যে ক্ষমতা হল মুখ্য। এই সমস্ত কারণের জন্য আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ক্ষমতার ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
রাজনীতিক ক্ষমতার প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতামত:
ক্ষমতার সংজ্ঞা প্রদান সহজ নয়। কারণ এ বিষয়ে কোন সর্বজনীন তত্ত্ব নেই। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ক্ষমতার সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। তাই সর্বসম্মত কোন সংজ্ঞার সৃষ্টি হয়নি। এই কারণে ক্ষমতার ধারণাটি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জটিলতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “… from the beginning we are in terminological difficulties as there is little agreement on the definitions of such terms as ‘power’, ‘influence’ and ‘authority’. এ প্রসঙ্গে বল, ম্যাকেঞ্জি এবং উট্রন-এর মনোজ্ঞ মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। ম্যাকেঞ্জি তাঁর Politics and Social Science শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “.devastating confusion in the use of terminology….” উট্রন তাঁর Interest Groups শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতার ধারণা সম্পর্কে বলেছেন: “… a real Irish bog of a subject that has claimed many victims, not all of them innocent.”
ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক – ইষ্টনের ব্যাখ্যা:
ব্যাপক অর্থে বিচার করলে সকল রকম সম্পর্কের পরিস্থিতিই হল ক্ষমতার পরিস্থিতি। সকল সমাজবিজ্ঞানেই সম্পর্ক বিষয়ক ঘটনা বা পরিস্থিতির আলোচনা থাকে। এ দিক থেকে সকল সমাজবিজ্ঞানকে ক্ষমতার আলোচনা বলা যেতে পারে। রাজনীতিক ক্ষমতা হল সম্পর্ক বিষয়ক এক ধরনের ঘটনা বা পরিস্থিতি। ইস্টন তাঁর The Political System শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতার ধারণাকে সম্পর্কের ধারণা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতানুসারে ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক। এই সম্পর্কের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অপর কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজকর্মকে নিজের উদ্দেশ্য অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ অপরের কাজকর্মের উপর প্রভাব কায়েম করার সামর্থ্যই হল ক্ষমতা। এক ধরনের সম্পর্কের ভিত্তিতে এই সামর্থ্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে ক্ষমতা ও প্রভাব সমার্থক নয়। সকল প্রভাবকে ক্ষমতা বলা যায় না। যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রভাবিত হয়, সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার দায়িত্ব পালন করতে না পারলে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে বা তাদের শাস্তি দিতে পারে। রাজনীতিক ক্ষমতার ব্যাপকতার মাত্রা নির্ভর করে শাস্তি বিধানের ভীতির মাধ্যমে অপরের কাজকর্ম ও সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণের মাত্রার উপর।
রাজনীতিক ক্ষমতা একটি সম্পর্ক – বলের ব্যাখ্যা:
বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক ক্ষমতা হল একটি সম্পর্ক। তিনি বলেছেন: “Political power is a relationship.” তাঁর আরও অভিমত হল, রাজনীতিক ক্ষমতা বলতে বোঝায় শাস্তির ভয় দেখিয়ে অপরের আচরণকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য। তাঁর কথায় “Political power is, then the capacity to affect another’s behaviour by the threat of some form of sanction.” সুতরাং এই ভীতি প্রদর্শনের সামর্থ্য যত বেশী ব্যাপক ও কার্যকর হবে, রাজনীতিক ক্ষমতাও তত বেশী হবে। এই ভীতি প্রদর্শনের বিষয়টি নেতিবাচক বা ইতিবাচক হতে পারে। ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সম্পদ ও সম্মান প্রদানের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সমর্থকদের তাঁর ইচ্ছার অনুবর্তী করতে পারেন। অথবা তিনি তাঁর বিরোধীদের এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার ভয় দেখাতে পারেন। অর্থাৎ অধ্যাপক বল রাজনীতিক ক্ষমতা বলতে যে সম্পর্কের কথা বলেছেন, তার সঙ্গে আদেশের অনুগামী হওয়ার জন্য পুরস্কার প্রাপ্তির প্রলোভন বা আদেশ অমান্য করার কারণে শাস্তি ভোগের ভীতি সংযুক্ত থাকে। বল বলেছেন: “The greater the sanction, or the more numerous the sanctions, the greater will be the political power. The sanctions may be negative or positive.” সুতরাং সম্মান ও সম্পদের প্রলোভন এবং এর থেকে অপসারিত হওয়ার ভীতি প্রদর্শন—উভয়ই রাজনীতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং রাজনীতিক ক্ষমতার প্রয়োগ পর্যালোচনা করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্রলোভন বা ভীতি প্রদর্শনের নজির পাওয়া যাবে। রাজনীতিক ক্ষমতাধিকারীর বিরোধিতা করার শাস্তি অধিকতর কঠোর হতে পারে। এমনকি কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “These latter penalties are usually reserved for the state, and those also control the state often wield the strongest political power.” সাধারণত রাজনীতিক ক্ষমতার প্রতি আনুগত্যের উৎস হল শাস্তির ভয়। এই কারণে প্রায়শই দেখা যায় রাজনীতিক ক্ষমতাধিকারীরা আনুগত্য আদায়ের জন্য ভীতি প্রদর্শন বা শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেন। তবে অধ্যাপক বল এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট সকলকে একটি বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে আনুগত্য আদায়ের জন্য যত বেশী শাস্তি প্রদানের ভীতি প্রদর্শন বা দণ্ডবিধানের ব্যবস্থা করা হবে রাজনীতিক ক্ষমতার দুর্বলতা তত বেশী করে প্রতীয়মান হবে। আনুগত্য স্বাভাবিক বা স্বতঃস্ফূর্ত হলে রাজনীতিক ক্ষমতা অধিকতর দৃঢ়ভিত্তিক হয়। বল এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “… indeed a too frequent use of these penalties may be an indication of the weakening of that political power.”
রাজনীতিক ক্ষমতার প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামত:
প্রকৃত প্রস্তাবে ক্ষমতার ধারণা সম্পর্কিত এখনকার অধিকাংশ সংজ্ঞাই ক্ষমতার সম্পর্কগত প্রকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অরগানস্কি তাঁর World Politics শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতার ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনিও ক্ষমতাকে একটি সম্পর্ক হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে ক্ষমতা হল নিজের উদ্দেশ্য অনুসারে অপরের আচরণকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য। এবং এই কারণে ক্ষমতা কোন বস্তু নয়; এ হল একটি সম্পর্কের অংশ। সকল সম্পর্কের মধ্যেই একটি ক্ষমতার ধারণা নিহিত থাকে। তিনি বলেছেন: “Indeed, there is a power aspect to every relationship.” Constitutional Government and Democracy শীর্ষক গ্রন্থে ফ্রেডরিক (Karl Friedrich)-এর অভিমত অনুসারে ক্ষমতা হল এক ধরনের মানবিক সম্পর্ক (kind of human relationship.”)। মরগেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে রাজনীতিক ক্ষমতার ধারণাকে সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতানুসারে রাজনীতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক। যাঁরা ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং ক্ষমতা যাঁদের উপর প্রযুক্ত হয় তাঁদের মধ্যেই এই সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। মরগেনথাউ বলেছেন: “Political power is a psychological relations between those who exercise it and those over whom it is exercisd.” ফ্রাঙ্কেল তাঁর International Politics শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতার ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতানুসারে অন্য মানুষের মন ও ক্রিয়াকলাপের উপর রাজনীতিক ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়ে থাকে।
রাজনীতিক ক্ষমতার আচরণগত উপাদান:
রাজনীতিক ক্ষমতার সম্পর্কগত প্রকৃতির উপর যদি জোর দেওয়া হয়, তা হলে এই সম্পর্কের সঙ্গে আচরণগত দিকটির সংযোগকেও অস্বীকার করা যাবে না। কারণ রাজনীতিক ক্ষমতার উদ্ভব হয় অপরের আচরণকে সুস্পষ্টভাবে প্রভাবিত করতে পারলে। সুস্পষ্ট আচরণের মাধ্যমেই ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবন করা যায়। রাজনীতিক ক্ষমতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আচরণগত উপাদান সম্পর্কযুক্ত। কারণ ক্ষমতা হল এক ব্যক্তি কর্তৃক অপর ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার সম্পর্ক। অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তির অস্তিত্ব ছাড়া ক্ষমতা প্রয়োগের কথা ভাবা যায় না। এই কারণে জনহীন কোন অঞ্চলে নিঃসঙ্গ ব্যক্তির ক্ষমতা প্রয়োগের প্রশ্ন অর্থহীন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে অধ্যাপক বল রবিনসন ক্রুসো (Robinson Crusoe)-র নিঃসঙ্গ অবস্থার কথা বলেছেন।
রাজনীতিক ক্ষমতার সম্পর্ক নিরূপণের সমস্যা:
তবে রাজনীতিক ক্ষমতার সম্পর্কগত দিকটির উপর যদি গুরুত্ব আরোপ করা হয়, তা হলে ক্ষমতার সম্পর্ক নিরূপণের ক্ষেত্রে কতকগুলি সমস্যার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যাবে না।
(১) রাজনীতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক এবং এই সম্পর্ক সব সময় সুস্পষ্ট নয়। বল বলেছেন: “Political power is a relationship…. However, it is relationship that is not always clear.” বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য বল একটি উদাহরণের অবতারণা করেছেন। তাঁর মতানুসারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যদি ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের কোন মন্ত্রীকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন এবং নির্দেশ প্রদানকারী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন থাকাকালীন সংশ্লিষ্ট ক্যাবিনেট মন্ত্রী যদি পদত্যাগ করেন, তা হলে বুঝতে হবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু কোন ক্যাবিনেট মন্ত্রী যদি অন্য কোন কারণের জন্য একান্তভাবে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পদত্যাগ করেন, আবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও সেই সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর পদত্যাগ মনে মনে কামনা করেছিলেন, এরকম ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতিক ক্ষমতা নির্ধারণ মুশকিল। এ প্রসঙ্গে বল মন্তব্য করেছেন: “Usually in a power relationship situation it is very difficult to discover why a change in individual’s or group’s behaviour has been effected.”
(২) রাজনীতিক ক্ষমতাকে একটি সম্পর্ক হিসাবে বিবেচনা করলে দেখা দরকার যে, কার উপর এবং কী সম্পর্কে কোন ব্যক্তির ক্ষমতা বর্তমান। বল বলেছেন: “If political power is a relationship, it is necessary to discover exactly who or what has power in relation to whom or what.” এ বিষয়টি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও বল একটি উদাহরণের অবতারণা করেছেন। যদি বলা হয় যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের শিক্ষা বিষয়ক কমিটির সভাপতির থেকে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি অধিকতর ক্ষমতাযুক্ত, তা হলে এই দুই পদাধিকারীর মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার সম্পর্ক প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু যদি বলা হয় যে মার্কিন রাষ্ট্রপতির থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন, তা হলে এই দুই পদাধিকারীর মধ্যে অন্য ধরনের এক ক্ষমতার সম্পর্ক প্রতীয়মান হয়। প্রথম মন্তব্যটির মাধ্যমে গ্রেট ব্রিটেনের শিক্ষা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ক্ষমতা সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মন্তব্যটির মাধ্যমে বোঝান হতে পারে যে তৃতীয় কোন পক্ষের আচরণকে প্রভাবিত বা পরিবর্তিত করার ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রপতির থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বেশী। এই আলোচ্য তৃতীয় পক্ষ অন্য কোন দেশের রাজনীতিক কর্তাব্যক্তি হতে পারেন, আবার তাঁদের যে যার নিজের দেশের মন্ত্রিসভা, আইনসভা বা রাষ্ট্রকৃত্যক হতে পারেন। আবার ক্ষমতা হল পরিবর্তনশীল। এই কারণে কোন রাজনীতিক পদাধিকারীর ক্ষমতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমকালীন ব্যক্তিবর্গের আচরণকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সামর্থ্যের বিষয়টি আলোচনা করা আবশ্যক।
রাজনীতিক ক্ষমতার প্রয়োগ পদ্ধতি পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল:
অনেক সময় মন্তব্য করা হয় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্যাবিনেটের মত আধুনিককালের ব্রিটিশ ক্যাবিনেট আধুনিক সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে ততটা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আগে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ ক্যাবিনেট স্তরে বিচার-বিবেচনা করা হত। এই মন্তব্যের মাধ্যমে সম্ভবত সেই সময় ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকার সীমাবদ্ধতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অধ্যাপক বলের অভিমত অনুসারে তৎকালীন সময়ে সরকারের দায়-দায়িত্ব প্রধানত পররাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। এখনকার মত সমাজকল্যাণমূলক ব্যাপক ক্ষেত্রে সরকারের দায়-দায়িত্ব সম্প্রসারিত ছিল না। এই কারণে বল মন্তব্য করেছেন। “Therefore to postulate a decline in the power of cabinets ignores the necessity of comparing like with like.” বিদ্যমান রাজনীতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আচরণ ও কাজকর্মের সঙ্গে রাজনীতিক ক্ষমতা সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতি সমকালীন পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে রাজনীতিক ক্ষমতা নির্দিষ্টভাবে প্রযুক্ত হয়ে থাকে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে রাজনীতিক ক্ষমতার প্রয়োগ পদ্ধতিও পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
রাজনীতিক ক্ষমতা পরিমাপের পদ্ধতি ও তার সমস্যা:
রাজনীতিক ক্ষমতা যথাযথভাবে পরিমাপের ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। প্রথমত, ক্ষমতা পরিমাপের পদ্ধতির ক্ষেত্রে সমস্যা আছে এবং দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার প্রয়োগ প্রসঙ্গে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদির ব্যাপারে সমস্যা আছে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “The measurement of political power has many pitfalls, and the methodology or techniques used may determine the conclusion.” রাজনীতিক ক্ষমতা পরিমাপের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি বর্তমান। ক্ষমতা পরিমাপের পদ্ধতিগত পার্থক্য উপনীত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পার্থক্য সূচিত করে। ক্ষমতা পরিমাপের পদ্ধতিকে সাধারণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সমষ্টিকেন্দ্রিক এই দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম পদ্ধতির ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে বাছাই করা হয়। তারপর স্থির করা হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তারা প্রভাব কার্যকর করেছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় কিভাবে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এইভাবে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রাধান্য তাদের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ব্যাখ্যা করা হয়। ক্ষমতা পরিমাপের দ্বিতীয় পদ্ধতি বা সমষ্টিকেন্দ্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে আগে কতকগুলি সিদ্ধান্তকে বাছাই করা হয় এবং তারপর দেখা হয় যে সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন্ কোন্ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে দেখা যায় যে অধিক সংখ্যক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত। এই সমষ্টিকেন্দ্রিক পদ্ধতি অধিকতর ব্যাপক। যাইহোক্ রাজনীতিক ক্ষমতা যথাযথভাবে পরিমাপের স্বার্থে প্রামাণিক পরিসংখ্যান ও তথ্যাদির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। রাজনীতিক ক্ষমতার পরিমাপের জন্য প্রয়োজন হল প্রাথমিক সূত্রে প্রাপ্ত প্রামাণ্য পরিসংখ্যান ও তথ্য। কিন্তু প্রায়শই তা পাওয়া যায় না। সরকারী কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও বৃহত্তর স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে পরিসংখ্যান ও তথ্যাদির গোপনীয়তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সরকারী ও প্রাথমিক সূত্রে পর্যাপ্ত তথ্যাদি অপ্রতুল প্রতিপন্ন হয়। তখন বে-সরকারী ও গৌণ সূত্রে তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই সমস্ত সংবাদ ও তথ্য অনুমাননির্ভর ও প্রমাণসাপেক্ষ। তাই নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এখনকার রাজনীতিক ব্যবস্থায় যে-কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বা যে কোন ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণ বিভিন্ন ও বহুমুখী প্রভাবের অধীন। ব্যক্তিমাত্রেই এখন বিভিন্ন সংঘ-সমিতি ও বহু ব্যক্তির স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই অবস্থায় কোন বিশেষ ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কার প্রভাব কতখানি কার্যকর হয় বা হয়েছে তা সঠিকভাবে পরিমাপ করা মুশকিল। অর্থাৎ বিশেষ কোন আচরণ বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রভাবে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠনের ক্ষমতার কার্যকারিতা বা ব্যাপকতা পরিমাপ করা কঠিন। এই সমস্ত কারণের জন্য বলের অভিমত হল: “Political power cannot be quantified satisfactorily…..” এতদসত্ত্বেও বলের মতানুসারে রাজনীতিক ক্ষমতার বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সহায়ক ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদির পরিমাণের চেষ্টা করা যায়।
Leave a comment