রাজনীতিক ক্ষমতা এবং রাজনীতিক কর্তৃত্ব এক ও অভিন্ন নয়। আবার উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টিও মোটেই সহজ-সরল নয়। সমকালীন কর্তৃত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে ক্ষমতা প্রয়োগ বা অপ্রয়োগের ঘটনা ঘটতে পারে বা ঘটে। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক ক্ষমতার প্রয়োগ এবং রাজনীতিক কর্তৃত্বের ধারণা সমার্থক নয়। এই কারণে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনীতিক কর্তৃত্বের ধারণাগত আলোচনা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়।
(১) ধারণাগত পার্থক্য: সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও কার্যপদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ক্ষমতা ও রাজনীতিক কর্তৃত্বের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতিক ক্ষমতা বলতে এক বিশেষ সম্পর্ককে বোঝায়। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই সম্পর্কের মাধ্যমে নিজের উদ্দেশ্য অনুসারে অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজকর্মকে প্রভাবিত ও পরিচালিত করে। এই সম্পর্কের মাধ্যমে ক্ষমতাধিকারী তার ইচ্ছা প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে অনিচ্ছুক ব্যক্তিকেও বিশেষ কোন কাজ করতে বাধ্য করে। এ ধরনের ইচ্ছা প্রয়োগের সঙ্গে শাস্তি প্রদানের ভয় ও পুরস্কার প্রদানের প্রলোভন সংযুক্ত থাকে। অপরদিকে কর্তৃত্বের উদ্ভব হয় ক্ষমতা ও বৈধতার একত্রিত উপস্থিতির ভিত্তিতে। রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার জনসাধারণের দ্বারা স্বীকৃত হলে রাজনীতিক কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়।
(২) বলপ্রয়োগের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক কর্তৃত্বের নয়: রাজনীতিক ক্ষমতা ও রাজনীতিক কর্তৃত্বের মধ্যে পার্থক্য অত্যন্ত মৌলিক প্রকৃতির। রাজনীতিক ক্ষমতার সঙ্গে বলপ্রয়োগের উপাদান ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু বলপ্রয়োগের উপাদানের সঙ্গে রাজনীতিক কর্তৃত্ব সম্পর্কহীন। রাজনীতিক কর্তৃত্বের আদেশ মান্য করার পিছনে জনসাধারণের ঔচিত্য বোধ কাজ করে। রাজনীতিক কর্তৃত্বের আদেশের সঙ্গে মূল্যবোধ সংযুক্ত থাকে বলেই জনগণ তা মান্য করা উচিত বলে মনে করে।
(৩) ওয়েলডনের অভিমত: ওয়েলডন তাঁর The Vocabulary of Politics শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে পার্থক্য প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে বলপ্রয়োগের ব্যবস্থা কর্তৃত্বসম্পন্ন। কারণ যথাযথ ও ন্যায়সঙ্গত ভাবে প্রযোজ্য বলপ্রয়োগে । সঙ্গে কর্তৃত্ব সংযুক্ত থাকে। স্বাভাবিকভাবে সেই ক্ষমতা কর্তৃত্ব হিসাবে প্রতিপন্ন হয় যা সংশ্লিষ্ট সকলের সাধারণ স্বীকৃতি-সহ প্রযুক্ত হয়। তবে ওয়েলডন এও বলেছেন যে অধিকাংশ মানুষ যদি দুষ্ট প্রকৃতির হয়, তা হলে নিকৃষ্ট কর্তৃত্বের সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক কর্তৃত্ব অনিষ্টকর হওয়ার আশংকা থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ওয়েলডন হিটলারের কর্তৃত্বের কথা বলেছেন।
(৪) ক্ষমতা স্থায়ী হয় বৈধতার মাধ্যমে: রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী নিছক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আনুগত্য লাভ করতে পারেন। কিন্তু এই আনুগত্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Obedience secured solely by the threat of sanctions is unstable.” ক্ষমতা কার্যকর ও স্থায়ী হয় বৈধতার মাধ্যমে।
(৫) কৰ্তৃত্বহীন ক্ষমতা: বাস্তবে রাজনীতিক কর্তৃত্বহীন রাজনীতিক ক্ষমতার অস্তিত্ব সম্ভব। রাজনীতিক কর্তৃত্বের অধিকার না হয়েও রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগের ঘটনা ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে কোন সামরিক অভ্যুত্থানের কথা বলা যায়। এ রকম অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৈন্যবাহিনীর প্রধান রাজনীতিক ক্ষমতা কায়েম করতে পারেন। শাস্তি প্রদানের ভয় দেখিয়ে তিনি দেশবাসীর আনুগত্যও আদায় করতে পারেন। কিন্তু তাঁর ক্ষমতা বৈধতাযুক্ত হয় না। কারণ তাঁর শাসন ক্ষমতা দেশবাসীর ব্যাপক স্বীকৃতি পায় না। তাই তাঁর ক্ষমতা হল কর্তৃত্ববিযুক্ত। তবে কোন কোন সামরিক শাসক নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের সমর্থন ও স্বীকৃতি প্রমাণ করে তাঁর ক্ষমতার বৈধতা ও কর্তৃত্বকে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। যাইহোক বাস্তবে রাজনীতিক ক্ষমতা ও রাজনীতিক কর্তৃত্ব এক ও অভিন্ন নয়।
(৬) ক্ষমতাবিযুক্ত কর্তৃত্ব অর্থহীন: উপরিউক্ত যুক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে রাজনীতিক কর্তৃত্বহীন রাজনীতিক ক্ষমতার অস্তিত্ব সম্ভব। নিছক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজের ইচ্ছানুসারে অপর কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কোন কার্য সম্পাদনে বাধ্য করতে পারে। অর্থাৎ কর্তৃত্বকে বাদ দিয়েও ক্ষমতার সৃষ্টি ও অস্তিত্ব সম্ভব। কিন্তু এ কথা কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে খাটে না। ক্ষমতাকে বাদ দিয়ে কর্তৃত্বের সৃষ্টি ও অস্তিত্ব অসম্ভব। রাজনীতিক কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয় রাজনীতিক ক্ষমতা ও বৈধতার সমন্বিত উপস্থিতির মাধ্যমে। ক্ষমতাবিযুক্ত কর্তৃত্ব অর্থহীন। তবে এও ঠিক যে বৈধতা ও কর্তৃত্ব ছাড়াও ক্ষমতা তেমন ফলপ্রসু বা স্থায়ী হয় না।
(৭) আপৎকালীন অবস্থায় ক্ষমতা: রাজনীতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক কর্তৃত্বহীন রাজনীতিক ক্ষমতার প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে এই ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক বা শাসনতান্ত্রিক বিচারে সরকারী ক্ষমতার অধিকারী না হয়েও রাজনীতিক কোন নেতা বা ব্যক্তি রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন যে তাঁর রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আপৎকালীন অবস্থা বা সংকটকালীন পরিস্থিতির মত অস্বাভাবিক রাজনীতিক পরিস্থিতিতে এ রকম ঘটনা ঘটে। জরুরী অবস্থা জারি করে এই ধরনের ক্ষমতার অধিকারকে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়।
বলের অভিমত: প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে রাজনীতিক ক্ষমতা সব সময় রাজনীতিক কর্তৃত্বযুক্ত হবে, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। রাজনীতিক কর্তৃত্বহীন রাজনীতিক ক্ষমতার অস্তিত্বও পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ রাজনীতিক ক্ষমতার প্রয়োগ জনসাধারণের দ্বারা স্বীকৃত নাও হতে পারে। বল বলেছেন: “We have noted that political power may be divorced from political authority in that right to exercise political power not be recognised.” আবার বিপরীতক্রমে এমন অবস্থাও অসম্ভব নয় যে রাজনীতিক কর্তৃত্বযুক্ত রাজনীতিক নেতা আছেন, কিন্তু এই রাজনীতিক কর্তৃত্বকে রাজনীতিক ক্ষমতায় রূপান্তরিত করতে সংশ্লিষ্ট নেতা অসমর্থ বা অপারগ। বল এ ধরনের অবস্থার একটি উদাহরণ দিয়েছেন। জার্মান অধিকৃত ফ্রান্সে জেনারেল দ্য গ্যল (General de Gualle) – এর কর্তৃত্ব স্বীকৃত ছিল। কিন্তু দ্য গালের এই কর্তৃত্বকে ক্ষমতায় রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা করেছে জার্মান এবং জার্মানদের অনুগামী ফরাসী সরকার। রাজনীতিক কর্তৃত্বের পরিচর্যা ও প্রবাহ জাতীয় পতাকার মত বিভিন্ন প্রতীক এবং অভিষেক উৎসবের মত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “Political authority is buttressed and perpetuated by the use of symbols such as the use of national flag or a coronation ceremony, but an important basis of political authority can be found in pattern of political ideas.”
Leave a comment