রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বলতে সাধারণত দু-ধরনের অবস্থা বা ঘটনার সমন্বয়কে বোঝায়। (১) নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ডে অবস্থিত একটি জনসমাজ কর্তৃক নির্দিষ্ট বিধি-ব্যবস্থা ও নিয়ম-কানুন মেনে চলা এবং (২) এমন একটি চরম শক্তি (সার্বভৌম শক্তি) গড়ে তোলা যে শক্তির বলে ঐসব নিয়ম-কানুন জনসমাজে প্রত্যেকের উপর প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গঠন ও পরিবর্তনের মূলে রয়েছে মানুষের একটি বিশেষ কর্মকাণ্ড। একে বলা হয় ‘রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ’ (Political Activity)।

রাজনীতি বিজ্ঞান: রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ বলতে আবার দু-ধরনের কার্যপ্রক্রিয়া বোঝায়: (ক) শাসনতন্ত্র ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের নিয়ম মাফিক (Legal and Constitutional) ক্রিয়াকলাপ এবং (খ) শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক এবং পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকার থেকে উদ্ভুত বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা, আন্দোলন ও সংগ্রামজনিত ক্রিয়াকলাপ। প্রথম ধরনের ক্রিয়াকলাপে সরকার কর্তৃক জনগণের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টাকে বোঝায়। দ্বিতীয় ধরনের ক্রিয়াকলাপে জনগণের দিক থেকে শান্তিপূর্ণ বা অল্পবিস্তর উগ্র প্রকৃতির আন্দোলন বা সংগ্রামের মাধ্যমে সরকারী ক্রিয়াকলাপ প্রভাবিত করা বা সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালানো বোঝায়। যে শাস্ত্র বা যে বিশেষ ধরনের জ্ঞান-শৃঙ্খলা রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের সংগঠন ও বিস্তারের বিজ্ঞানসম্মত বিচার-বিশ্লেষণ করে তাকে রাজনীতি বিজ্ঞান বলা যায়।

সমাজজীবন নিয়ন্ত্রণের একটা স্তরে দ্বন্দ্ব-সমস্যা তীব্রতর হয়। তার ফলে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। সমাজ গঠনের আদিমতম স্তরে বয়স্ক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নির্দেশ অনুসারে বিভিন্ন প্রথা ও রাজনীতির প্রচলন ঘটে। ধর্মীয় বাধা-নিষেধ, নৈতিক বিধি, রক্ত-সম্পর্কের আবেদন এবং অপেক্ষাকৃত বলশালী ও বুদ্ধিমান নেতৃত্বের বল প্রয়োগের ক্ষমতা প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজজীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সম্পদ-উৎপাদন ও বণ্টনজনিত সমস্যার জন্য মানুষে মানুষে সম্পর্কের জটিলতা বৃদ্ধি পায়। তার ফলে এইসব বাধা-নিষেধ ও দলপতির বলপ্রয়োগ অপর্যাপ্ত, অপ্রতুল ও অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সমাজের বিশেষ বিশেষ অংশ বিশেষ বিশেষ স্বার্থ ও আগ্রহ (interest) অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ হয়ে অপেক্ষাকৃত আনুষ্ঠানিক (formal) নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গঠনে আত্মনিয়োগ করে। এইভাবে আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গঠন প্রচেষ্টার এক অপেক্ষাকৃত উন্নত স্তরে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র-ব্যবস্থার উদ্ভব হয়।

তবে এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কোন অবস্থাতেই সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্বমতের সমন্বয় সাধনে সমর্থ হয় নি। তার ফলে রাজনীতিক প্রক্রিয়া (political process) নিত্য নতুন রূপ ধারণ করেছে। সমাজজীবন যেমন বিবর্তিত হয়েছে, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ও রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপও তেমনি পরিবর্তিত হয়েছে। গতিশীল এই সমাজজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনশীল রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র ও রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের ধারা ও ধারণার বিশ্লেষণই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য বিষয়।

গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল (Aristotle)-ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদি গুরু হিসাবে পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হল ‘পলিটিক্স’ (Politics)। অ্যারিস্টটলের আমলে গ্রীসে নগর-রাষ্ট্র (city state) বর্তমান ছিল। এগুলিকে বলা হত ‘পোলিস’ (Polis)। অ্যারিস্টটল তাঁর Politics গ্রন্থে এই ‘Polis’ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তারপর বহু শতাব্দী ধরে একই ধারায় রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনা অব্যাহতভাবে চলেছে। লিপসেট (S. M. Lipset)-এর মতানুসারে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Faculty of Political Science’ খোলা হয়। ঐ সময় ১৮৯০ সালে ‘American University Catalogue’-এ ‘Political Science’ কথাটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। জার্মান দার্শনিক ব্লুণ্টস্‌লি (Bluntschli) তাঁর Theory of State গ্রন্থে রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনাকে ‘Politics’ ও ‘Political Science’ এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। তাঁর মতানুসারে প্রথম কথাটি মূলত কলা অর্থে ব্যবহার করা হয়। এই অর্থে রাষ্ট্রের পরিচালন পদ্ধতি ও তার বাস্তব প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political Science) অর্থে রাষ্ট্রের ভিত্তি, গঠন, অন্তর্নিহিত চরিত্র এবং তার প্রকাশ ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস (Burgess) ও উইলোবি (Wiloughby) এবং ইংলণ্ডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্রাইস (Bryce) ও সীল (Seeley) সমমত পোষণ করেন। অনেকে আবার ‘রাষ্ট্রনীতির বিজ্ঞান’ (Science of Politics) কথাটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। কেউ কেউ আবার ‘রাষ্ট্রের তত্ত্ব’ (Theory of the State) কথাটি ব্যবহার করতে চান। জেলিনেক (Jellinek) রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনাকে ‘তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতি’ (Theoretical Politics) এবং ‘ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতি’ (Applied Politics) এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। তাঁর মতানুসারে তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি, সংগঠনের নীতি, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য প্রভৃতি। অপরদিকে ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত হল সরকারের প্রকৃত শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়। যাইহোক এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গীগত ব্যাপক পার্থক্য আছে। এতদ্সত্ত্বেও বর্তমানে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দটি বহুল প্রচলিত এবং মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত।