রাজনীতিক কাঠামোর শ্রেণীবিভাগের সীমাবদ্ধতা আছে : আইনানুগ ও প্রাতিষ্ঠানিক পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি-শাসিত এবং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের মধ্যে তারতম্য সম্পর্কিত আলোচনা তাৎপর্যপূর্ণ। বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The division between presidential and parliamentary regimes can be most useful. There are numerous example of political scientists using a comparison of, say, the United States and Britain, in terms of this division in order to emphasise significant aspects of both system.” তবে সঙ্গে সঙ্গে বল এই অভিমতও ব্যক্ত করেছেন যে রাষ্ট্রপতি শাসিত এবং মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্যমূলক আলোচনা বা রাজনীতিক কাঠামোর শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি বলেছেন: “…there are serious limitations to this approach.”

এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসিত ও সংসদীয় সরকারের সম্পর্ক নেই : যুক্তরাষ্ট্রীয় ও এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি-শাসিত ও মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত সরকারের কোন সুনির্দিষ্ট এবং স্থায়ী সম্পর্ক দেখা যায় না। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন-কাঠামোর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত রাজনীতিক কাঠামো বর্তমান। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন-কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার প্রবর্তিত আছে। গ্রেট ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত। কিন্তু এককেন্দ্রিক কাঠামোর মধ্যেই এক সংসদীয় সরকার গঠিত হয়েছে। ফ্রান্সের শাসন-কাঠামো হল এককেন্দ্রিক। কিন্তু ফ্রান্সের বর্তমান সরকারকে পুরোপুরি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বলা যায় না।

রাষ্ট্রপতি-শাসিত ও মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত ব্যবস্থার মধ্যে আনুষ্ঠানিক পার্থক্যের পরিবর্তে, রাজনীতিক দলীয় ব্যবস্থা রাজনীতিক ব্যবস্থার ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়। বল বলেছেন: “…the party system may be of far greater significance for the working of the political system than the formal distinctions between presidential and parliamentary system.” একদলীয় ব্যবস্থা সাধারণত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে পরিলক্ষিত হয়। তবে অ-সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও এক-দলীয় ব্যবস্থা দেখা যায়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক এবং অ-সমাজতান্ত্রিক একদলীয় শাসনে কাঠামো কার্যগত এবং মতাদর্শগত মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আবার অ-সমাজতান্ত্রিক একদলীয় শাসনাধীন বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়।

সকল সরকারকে সুনির্দিষ্ট রাজনীতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা যায় না: কোন কোন দেশের সরকারী ব্যবস্থায় এমন সব বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকে যে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সরকারকে কোন সুনির্দিষ্ট রাজনীতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসাবে ফরাসী সরকারের কথা বলা যায়। তৃতীয় সাধারণতন্ত্রের সংবিধান বলবৎ থাকা পর্যন্ত (১৯৪৬) ফ্রান্সের শাসনব্যবস্থা ছিল সংসদীয়। ফ্রান্সে চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধান বলবৎ থাকাকালীন সময়ে (১৯৪৬-১৯৫৮) প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পরিধি প্রসারিত হয়। ১৯৫৮ সালে ফ্রান্সে পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের সংবিধান প্রবর্তিত হয়। এই সংবিধানের মাধ্যমে দ্য গল (De Gaulle) সরকারী ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করেন। ফরাসী রাষ্ট্রপতির রাজনীতিক ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এখন তিনি রাষ্ট্রের কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক প্রধান নন। তাঁর প্রকৃত ক্ষমতার পরিধি বর্তমানে অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত। নতুন সংবিধানে জাতীয় সভার (National Assembly) ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি জাতীয় সভার সমর্থনের উপর নির্ভরশীল নন। তিনি সমগ্র নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্দিষ্ট কার্যকালের জন্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে ফরাসী আইনসভার প্রভাব-প্রতিপত্তির হানি ঘটেছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জাতীয় সভার একাধিপত্য এখন আর নেই। বর্তমানে শাসন-বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে ফরাসী রাষ্ট্রপতিই তাঁর কর্তৃত্ব কায়েম করেছেন। তিনি মন্ত্রিদের পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারেন; তিনি জাতীয় সভাকে ভেঙে দিতে পারেন প্রভৃতি। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শাসিত রাজনীতিক কাঠামোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ফ্রান্সের সরকারী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ফ্রান্সের সরকারী ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ অর্থে রাষ্ট্রপতি শাসিত বলা যায় না। বল বলেছেন: “French political institutions are no longer parliamentary, but the political structure can not be clearly classified as a presidential type of system on the American model.” 4 প্রসঙ্গে বল লিপসেট এবং অ্যাভরিলের অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। লিপসেট মন্তব্য করেছেন: “…the American elements introduced into French politics by de Gaulle…..” Politics in France শীর্ষক গ্রন্থে অ্যাভরিল পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বলেছেন: “…a fundamentally ambiguous regime, as it appears to constitute the logical outcome of the crisis which destroyed the traditional model and an attempt to evolve a new system.” এ প্রসঙ্গে অন্যতম উদাহরণ হিসাবে বল পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনা অর্থহীন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে সুইজারল্যান্ডের সরকারী ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি শাসিত ও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত উপাদান উপস্থিত। এই কারণে একেও সুনির্দিষ্টভাবে কোন একটি রাজনীতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা অসম্ভব।

রাজনীতিক কাঠামোর শ্রেণীবিভাজনের সীমাবদ্ধতা: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে রাজনীতিক কাঠামোর শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। এই কারণে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থা ও তাদের অংশসমূহের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই সমস্ত সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা প্রতিপন্ন হয়। খুব কম রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সরাসরি এবং সুনির্দিষ্টভাবে কোন একটি রাজনীতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। প্রতিটি রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে বিশেষ ধরনের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকে। তাই সাধারণভাবে রাজনীতিক কাঠামোর যে শ্রেণীবিভাজন করা হয়, তা সাধারণ প্রকৃতির। এই কারণে অভিনব বা বিশেষ প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য বা উপাদানযুক্ত কোন সরকারী ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে এর অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। বল যথার্থই বলেছেন: “Few political system fit nearly into one pigeon hole. Categories are elaborate in terms of general abstract characteristics, while each political system is in some respects a unique combination of particular features. Thus the more general a category, the more difficult is the problem of empirical fit.” শ্রেণী-বিভাজনের এই সীমাবদ্ধতাজনিত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরও বিস্তারিতভাবে ভাগ ও উপভাগের দিকে এগিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে Comparative Government শীর্ষক গ্রন্থে ফাইনারের শ্রেণীবিভাজনের কথা বলা হয়। এখন এইভাবে রাজনীতিক কাঠামোগুলিকে যত বেশী বিশ্লেষণমূলক শ্রেণী ও উপ-শ্রেণীর মাধ্যমে বিভক্ত করার ব্যবস্থা হবে, রাজনীতিক কাঠামোর শ্রেণী-বিভাজনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। কারণ তখন কার্যত প্রতিটি রাজনীতিক ব্যবস্থার জন্য পৃথক একটি করে শ্রেণী বা ভাগের কথা বলতে হবে। পরিশেষে বলের একটি দীর্ঘ মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “It seems more useful, then, to accept the utility of various types of classification, recognising their fluid nature and accepting that for some purposes it will be useful to treat certain countries as having crucial similarities, which for others the systems concerned will appear diametrically opposed to one another.”