কর্তৃত্ব বলতে বৈধ ক্ষমতাকে বোঝায়। বস্তুত দুটি উপাদানের সমন্বয়ে রাজনীতিক কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়। এই দুটি উপাদান হল ক্ষমতা ও বৈধতা। অর্থাৎ রাজনীতিক কর্তৃত্ব হল বৈধ রাজনীতিক ক্ষমতা। শাসনের ক্ষমতা বৈধতার মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করে। এই ক্ষমতা ও বৈধতার পারস্পরিক সম্পর্ক ওতপ্রোত। ক্ষমতা ব্যতীত বৈধতার প্রশ্ন অবান্তর। আবার ক্ষমতা ছাড়া কর্তৃত্বের কথাও আসে না। অনুরূপভাবে বৈধতা ব্যতিরেকে ক্ষমতা স্থায়িত্ব লাভ করে না। বৈধতা বিযুক্ত ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া অসম্ভব। ক্ষমতাকে কোন প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য বৈধতা অপরিহার্য বিবেচিত হয়। জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর The Theory of Social and Economic Organisations শীর্ষক রচনায় রাজনীতিক কর্তৃত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ওয়েবারের অভিমত অনুসারে কর্তৃত্ব হল বৈধ ক্ষমতা। তাঁর মতানুসারে বৈধতা হল নাগরিকদের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের স্বীকৃতি। বস্তুত আদেশের সঙ্গে মানুষের মূল্যবোধের সামঞ্জস্য সাধন এবং আদেশ মান্য করানোর দক্ষতার ভিত্তিতে কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতা বৈধতাযুক্ত হলে প্রতিষ্ঠিত হয় ও কর্তৃত্বে রূপান্তরিত হয়। এবং দুটি উপায়ে তা হয়ে থাকে। এই উপায় দুটি হল: (এক) সাংবিধানিক আইনের স্বীকৃতি ও (দুই) ব্যাপক জন স্বীকৃতি। এ প্রসঙ্গে অ্যালান বলের অভিমত আলোচনা করা আবশ্যক। তাঁর মতানুসারে যথার্থ রাজনীতিক কর্তৃত্ব বলতে শাসন করার অধিকারের স্বীকৃতিকে বোঝায়। রাজনীতিক কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয় শাসনের অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতে। শাসক এই স্বীকৃতি ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অথবা পুরস্কার প্রদানের প্রলোভনের মাধ্যমে অর্জন করতে পারেন। এবং এইভাবে শাসক তাঁর অভিপ্রায় ও সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন। বল বলেছেন: “Political authority is the recognition of the right to rule irrespective of the sanctions the ruler may possess.”
রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত: নিজের থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্ষমতা কার্যকর হয় না। ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন হয় যে কোন ধরনের কর্তৃত্বের। সুতরাং কর্তৃত্ব সহযোগে ক্ষমতা কার্যকর প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ কর্তৃত্বহীন ক্ষমতা অর্থহীন প্রতীয়মান হয়। রাজনীতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। রাজনীতিক ক্ষমতা মূর্ত হয়ে উঠে রাজনীতিক কর্তৃত্বের মাধ্যমে। রাজনীতিক কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে রাজনীতিক ক্ষমতা বিমূর্ত থাকে। বস্তুত সকল রাজনীতিক ব্যবস্থারই অন্যতম সর্বজনীন উপাদান হল রাজনীতিক কর্তৃত্ব। অর্থাৎ রাজনীতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে রাজনীতিক ক্ষমতা অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ প্রসঙ্গে বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Political power usually accompanied by authority.” সুতরাং রাজনীতিক ক্ষমতা সম্পর্কিত আলোচনাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য রাজনীতিক কর্তৃত্বের আলোচনা একান্তভাবে অপরিহার্য।
ক্ষমতার বৈধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: রাজনীতিক ক্ষমতা স্থায়ী ও কার্যকর হওয়া দরকার। রাজনীতিক ক্ষমতা যদি স্থায়ী না হয়, অর্থাৎ পরিবর্তনশীল হয়, তা হলে তা কার্যকর হতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে রাজনীতিক ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য বজায় থাকে না। আবার ক্ষমতাকে স্থায়ী ও কার্যকর করার জন্য শুধুমাত্র ভীতি প্রদর্শন, বলপ্রয়োগ বা পুরস্কার প্রদানের প্রলোভন যথেষ্ট বিবেচিত হয় না। ক্ষমতা স্থায়ী ও কার্যকর হয় যদি জনগণ ক্ষমতার বৈধতায় (legitimacy) বিশ্বাসী ও আস্থাশীল হয়। অর্থাৎ ক্ষমতা বৈধ বলে বিবেচিত হওয়া আবশ্যক। সাধারণভাবে ক্ষমতার বৈধতার ধারণা বিমূর্ত। ক্ষমতার বৈধতার ধারণা মূর্ত হয়ে উঠে একটি সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে। এই কাঠামোটিই হল কর্তৃত্ব। ক্ষমতা বৈধতাযুক্ত হলে কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ কর্তৃত্বের উদ্ভব হয় ক্ষমতা ও বৈধতার সমন্বয়ে। বৈধতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করা দরকার। লিপসেট (S. M. Lipset) তাঁর Political Man শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে বৈধতা বলতে বোঝায় বিদ্যমান রাজনীতিক পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানই যে সমকালীন সমাজের স্বার্থে সর্বাধিক উপযোগী সে বিষয়ে বিশ্বাস গড়ে তোলা ও আস্থা বজায় রাখা। রাজনীতিক কর্তৃপক্ষের শাসনাধিকার এবং সঙ্গে সঙ্গে শাসিতের আনুগত্যের নীতির প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বৈধতা হিসাবে বিবেচিত হয়। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতাকে বৈধ বলে স্বীকার করে যখন তাদের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনীতিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে ক্ষমতা প্রয়োগের সুসামঞ্জস্য প্রতিপন্ন হয়। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার দীর্ঘকালীন অস্তিত্বের স্বার্থে বৈধতার স্বীকৃতি একান্তভাবে অপরিহার্য। তা না হলে রাজনীতিক ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
রাজনীতিক কর্তৃত্বের সূত্র
রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস সম্পর্কিত আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ:
রাজনীতিক কর্তৃত্বের সূত্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ নয়। তবে রাজনীতিক কর্তৃত্বের সূত্রাদি সম্পর্কিত আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনীতিক কর্তৃত্বের সূত্র উৎসের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এই কারণে রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস এবং কিভাবে এই কর্তৃত্ব উৎসারিত হয় সে বিষয়ে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আবার সমকালীন সমাজব্যবস্থায় চেহারা-চরিত্রের উপর রাজনীতিক কর্তৃত্বের সূত্র ও স্বরূপ বহুলাংশে নির্ভরশীল। বস্তুত এ ক্ষেত্রে কোন একক উৎসের উল্লেখ অসম্ভব। সমকালীন সমাজব্যবস্থায় আকৃতি-প্রকৃতির ক্ষেত্রে পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎসের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তা ছাড়া রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে অল্পবিস্তর মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অ্যালান বল এ প্রসঙ্গে তাঁর Modern Government and Politics শীর্ষক গ্রন্থে আলোচনা করেছেন।
রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস সম্পর্কিত ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ:
ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ (Theory of Divine Origin) অনুসারে রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। রাজার আদেশ হল ঈশ্বরের নির্দেশ। সুতরাং রাজার কর্তৃত্বের উৎস হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। রাজার আদেশ অমান্য করার অর্থ হল ঈশ্বরের নির্দেশ অগ্রাহ্য করা। রাজদ্রোহিতা ধর্মদ্রোহিতার সামিল। এইভাবে ঈশ্বর ও ধর্মীয় বিচার-বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজার কর্তৃত্বকে স্বীকার করার কথা বলা হয়েছে। New Testament-এ এই মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “Thus a ruler may be obeyed because of the belief that he was chosen by divine authority, and obedience to the ruler is obedience to God’s laws. Supporters of the theory of the Divine Right of Kings could seek verification in the New Testament.”
রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস সম্পর্কে হবসের অভিমত:
চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। চুক্তিবাদী ইংরেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হস্ সরকারের বল প্রয়োগের ক্ষমতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাজা অবাধ, অপরিসীম ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাজার স্বৈরী ক্ষমতার কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে রাজাকে অমান্য করলে মানুষকে আবার প্রাকৃতিক অবস্থার অমানবিক পরিবেশের মধ্যে ফিরে যেতে হবে। রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস সম্পর্কিত হবসের অভিমত প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “Thomas Hobbe’s prescription of strong government to end the civil wars was a concentration on the coercive powers of governments.”
রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস সম্পর্কে রুশোর অভিমত:
এ প্রসঙ্গে চুক্তিবাদী ফরাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশোর অভিমতও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বল বলেছেন: “…Rousseau was nearer the truth underlying political stability….” রুশো জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ‘সাধারণের ইচ্ছাতত্ত্ব’ (Theory of General will)-এর ভিত্তিতে রাজনীতিক কর্তৃত্বের বৈধতা ও স্থায়িত্বের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে The Social Contract শীর্ষক গ্রন্থ থেকে বল রুশোর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন: “The strongest is never strong enough to be always master, unless he transforms strength into right, and obedience into duty.”
তিন শ্রেণীর রাজনীতিক কর্তৃত্ব – ওয়েবার:
জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর The Theory Economic Organisations শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক কর্তৃত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা of Social and করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎসকে ওয়েবার তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। বল বলেছেন: “The German Sociologist Max Weber suggested a threefold classification of the sources of political authority in the modern state.” রাজনীতিক কর্তৃত্ব হল:
-
(১) সাবেকী কর্তৃত্ব,
-
(২) সম্মোহনী কর্তৃত্ব এবং
-
(৩) আইনানুগ-আমলাতান্ত্রিক বা আইনানুগ-যুক্তিবাদী কর্তৃত্ব।
(১) সাবেকী কর্তৃত্ব: সাবেকী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যের বৈধতার স্বীকৃতির ভিত্তিতে। বংশানুক্রমিক শাসনের একটা ঐতিহ্য থাকে এবং সেই ঐতিহ্যের পিছনে অনুমোদন থাকে। ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতাকে এই অনুমোদন প্রতিষ্ঠিত করে। শাসকের মর্যাদা ঐতিহ্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং ব্যক্তিগতভাবে শাসকের প্রতি জনগণ তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করে থাকে। সুতরাং সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্যই হল সাবেকী কর্তৃত্বের উৎস। এ হল কর্তৃত্বের এক সর্বজনীন রূপ। বংশগত শাসনের ঐতিহ্যের ভিত্তিতেই সাবেকী কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “…traditional authority, the right to rule resulting from the continuous exercise of political power. Hereditary ruling families fit into this classification.”
(২) সম্মোহনী কর্তৃত্ব: অনন্যসাধারণ ব্যক্তিগত গুণাবলীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে বলা হয় সম্মোহনী কর্তৃত্ব। এ হল কর্তৃত্বের অত্যন্ত প্রাচীন এক রূপ। ব্যক্তিগতভাবে আনুগত্য অর্জনের সামর্থ্যই হল সম্মোহনী কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ কোন ব্যক্তির এক ধরনের নিজস্ব সম্মোহনী আকর্ষণ থাকতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মতাদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি মানুষের অবিচল আস্থা ও দ্বিধাহীন বিশ্বাস থাকতে পারে। এইভাবে আলোচ্য ব্যক্তির রাজনীতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ এ ধরনের রাজনীতিক কর্তৃত্বের মূল উৎস হল ব্যক্তির অসাধারণ ব্যক্তিগত গুণাবলী। ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত গুণাবলীর মাধ্যমে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত অসাধারণ গুণাবলীর জন্য অনেক সময় বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে সাদরে সর্বজনস্বীকৃত নেতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই অবস্থায় সম্মোহনী কর্তৃত্বের উদ্ভব হয়েছে বলা যায়। সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে এ ধরনের কর্তৃত্বের সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ শুধুমাত্র রাজনীতিক ক্ষেত্রেই এ ধরনের কর্তৃত্বের উদ্ভব সীমাবদ্ধ নয়। তবে সম্মোহনী রাজনীতিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ রূপে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এ ধরনের রাজনীতিক কর্তৃত্বকে কার্যকর করার জন্য ব্যক্তিগত গুণাবলী ও সামর্থ্যকে একটা আনুষ্ঠানিক আকার বা প্রাতিষ্ঠানিক আকার বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া দরকার। এই উদ্দেশ্যে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও আইন আবশ্যক। সম্মোহনী কর্তৃত্বের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার জন্য ব্যক্তিগত গুণাবলীর সঙ্গে সরকারী ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। সম্মোহনী রাজনীতিক কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “… charismatic authority which results from exceptional personal characteristics of the political leader, e.g. Hitler.”
(৩) আইনানুগ-আমলাতান্ত্রিক বা আইনানুগ যুক্তিবাদী কর্তৃত্ব: সাম্প্রতিক কালে সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনানুগ যুক্তিবাদী কর্তৃত্ব পরিলক্ষিত হয়। আইনের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট নির্দেশ ও পদ্ধতির ভিত্তিতে আইনানুগ-যুক্তিবাদী কর্তৃত্বের উদ্ভব হয়। এখানে আইনই হল ক্ষমতার উৎস। যাঁরা ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, আইনের উৎস থেকেই তাঁরা ক্ষমতা লাভ করেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রয়োগ বৈধ ও ন্যায্য প্রতিপন্ন হয় এই কারণের জন্য যে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় প্রচলিত আইন অনুসারে। অর্থাৎ আইনানুগ-যুক্তিবাদী কর্তৃত্ব আইনের উপর এবং আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের আনুগত্য প্রদর্শনের বিষয়টি নির্ধারিত হয় নির্দিষ্ট আইন ও বিধি-ব্যবস্থার মাধ্যমে। কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে ব্যক্তিগত গুণাবলীর বিচার-বিবেচনা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন। এই ব্যবস্থায় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ নির্বাচিত হয় অথবা নিযুক্ত হয় এবং সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে আইন প্রণীত ও পরিবর্তিত হয়। আইনের দ্বারাই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেই আইনানুগ-যুক্তিবাদী কর্তৃত্বের যথাযথ বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে এই কর্তৃত্বকে আইনানুগ আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বও বলা হয়। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “… legal bureaucratic or legal rational, in which authority emanates from the political office the individual holds, not from the individual who holds the office.” বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক বল একটি উদাহরণের অবতারণা করেছেন। তাঁর মতানুসারে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আনুগত্য অর্জন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবেই। মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদে কে আসীন আছেন তা এ ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় বলে বিবেচিত হয় না। বল বলেছেন: “Here the emphasis is on the acceptance of constitutional rules.”
মিশ্র রাজনীতিক কর্তৃত্ব:
ওয়েবার উপরিউক্ত তিন ধরনের রাজনীতিক কর্তৃত্ব এবং রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎসের উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি এও বলেছেন যে, বিশুদ্ধ বা অবিমিশ্র আকারে উল্লিখিত রাজনীতিক কর্তৃত্বের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না। বাস্তবে তাদের মিশ্রিত রূপেই দেখা যায়। ওয়েবার রাজনীতিক কর্তৃত্বের মিশ্রিত রূপের উপরই জোর দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বল মন্তব্য করেছেন: “Weber recognised that none of these categories existed in pure form. ” ওয়েবারের অভিমত অনুসারে গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় যে রাজনীতিক কর্তৃত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তা হল সাবেকী কর্তৃত্ব এবং আইনানুগ-আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের এক সংমিশ্রিত রূপ। আবার মার্কিন রাষ্ট্রপতির মধ্যে সম্মোহিনী কর্তৃত্ব এবং আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেছেন: “The British system would provide an example of a mixture of a traditional and legal-bureaucratic sources of authority. American presidents often combine charismatic authority with legal-bureaucratic.” ব্রিটিশ রাজতন্ত্র হল বংশানুক্রমিক ও ঐতিহ্যমণ্ডিত এক রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং ব্রিটিশ রাজতন্ত্র হল এক সাবেকী রাজনীতিক কর্তৃত্বের পরিচায়ক। পাশাপাশি গ্রেট ব্রিটেনের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল ও ঘোষণাপত্র এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সুতরাং ব্রিটিশ রাজনীতিক কর্তৃত্ব হল এক যথার্থ মিশ্র রাজনীতিক কর্তৃত্বের উপযুক্ত উদাহরণ। অনুরূপভাবে কোন মার্কিন রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত অনন্য সাধারণ গুণাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে সম্মোহনী রাজনীতিক কর্তৃত্বের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হলেন সম্মোহনী রাজনীতিক কর্তৃত্ব এবং আইনানুগ আমলাতান্ত্রিক রাজনীতিক কর্তৃত্বের সমন্বয়ের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিককালে যে-কোন রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় আপৎকালীন অবস্থায় বা সংকটকালীন পরিস্থিতিতে সম্মোহনী রাজনীতিক কর্তৃত্বের সৃষ্টি হতে পারে। তারপর, কালক্রমে এই সম্মোহনী রাজনীতিক কর্তৃত্ব আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে। এবং অবশেষে সম্মোহনী রাজনীতিক কর্তৃত্ব এবং আইনানুগ-আমলাতান্ত্রিক বা আইনানুগ-যুক্তিবাদী রাজনীতিক কর্তৃত্বের মধ্যে সমন্বয় ও সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয়।
Leave a comment