রাজনীতিক উন্নয়ন বা বিকাশের ব্যাখ্যাকারক হিসাবে লুসিয়ান পাই-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর Aspect of Political Development শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তিনি তাঁর আগের ধারণা থেকে সরে এসেছেন। রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পাই-এর মতবাদ উন্নয়নের গুচ্ছ (Development System) হিসাবে পরিচিত। তিনি এ ক্ষেত্রে সমতা (equality), সামর্থ্য (capacity) এবং বিশেষীকরণ (differentiation)-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অধ্যাপক পাই রাজনীতিক উন্নয়নের লক্ষণ হিসাবে এই তিনটি বিষয়ের কথা বলেছেন। অর্থাৎ রাজনীতিক উন্নয়নের নির্ধারক হিসাবে অধ্যাপক পাই বৈশিষ্ট্যসূচক তিনটি লক্ষণের উল্লেখ করেছেন। অন্যতম আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কোলম্যান (Coleman) এগুলিকেই বলেছেন ‘উন্নয়নের গুচ্ছ বা ‘Development Syndrome’।
(1) সমতা (Equality): রাজনীতিক ক্ষেত্রে গণ-অংশগ্রহণের বিষয়টিকে অনুপ্রাণিত করার পরিপ্রেক্ষিতে সমতার ধারণাটির কথা বলা হয়েছে। রাজনীতিক উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসূচক লক্ষণ হল রাজনীতিক কার্যাবলীতে গণ-অংশগ্রহণ। গণ-অংশগ্রহণের ধারণাকে সফল করার ক্ষেত্রে গণ-সংযোগের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই গণ-সংগঠন ও গণ-অংশগ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক উন্নতি বা রাজনীতিক অনুন্নতি সূচিত হয়। এ প্রসঙ্গে মহাজন মন্তব্য করেছেন: “The first characteristic is a general spirit or attitude towards equality. The subject of political development involves man participation and popular involvement in political activities.” অধ্যাপক পাইয়ের মতানুসারে সমতা হল একটি গুণ। এই গুণের দ্বারাই প্রভাবিত হয় কার্যকরী নাগরিকতার ধারণা। এ হল উন্নত নৈতিক মানের অভিব্যক্তি। আবার সমতা প্রসঙ্গে তিনি আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকারের কথাও বলেছেন। আইনের চোখে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-নির্ধন, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সমান। সমতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক পাই-এর আরও অভিমত হল যে, পদ বা মর্যাদার নির্ধারক হবে গুণগত যোগ্যতা, বংশগত বিচার-বিবেচনা নয়। অর্থাৎ সমতার ভিত্তি আরোপিত হবে না, হবে অর্জিত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে অধ্যাপক পাই-এর সমতার ধারণার সঙ্গে অ্যালমন্ড ও পাওয়েলের ‘রাজনীতিক অংশগ্রহণ’ (political participation) ও ‘বণ্টন’ (distribution)-এর ধারণার সাদৃশ্য বর্তমান। অধ্যাপক পাই-এর মতানুসারে রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর সমতা নির্ভরশীল।
(২) সামর্থ্য (Capacity): সামর্থ্য হল রাজনীতিক উন্নয়নের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যসূচক লক্ষণ। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক ব্যবস্থার সামর্থ্যের কথা বলা হয়েছে। রাজনীতিক ব্যবস্থার কার্য সম্পাদনের কৃতিত্বই হল তার সামর্থ্য। কোন রাজনীতিক ব্যবস্থা সমকালীন সমাজ ও অর্থনীতিকে কী পরিমাণে প্রভাবিত করতে সক্ষম তাঁর দ্বারাই প্রকাশিত হয় সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার সামর্থ্য। আবার সরকারী সিদ্ধান্তকে যথাযথ এবং কার্যকরভাবে প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতেও সামর্থ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কোন রাজনীতিক ব্যবস্থা গৃহীত সিদ্ধান্তকে কত দ্রুতগতিতে কার্যকর করতে পারে তাও রাজনীতিক উন্নয়নের নির্ধারক হিসাবে বিবেচনা করতে হয়। সরকারী কার্যকলাপ ও নীতির লোকায়তকরণ বা জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও রাজনীতিক উন্নতির পরিচায়ক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে মহাজন মন্তব্য করেছেন: “Capacity is closely associated with governmental performance and the conditions which affect that performance…capacity also means effectiveness and efficiency in the execution of public policy.” অধ্যাপক পাই এর অভিমত অনুযায়ী সরকারের কাঠামোসমূহের কার্য সম্পাদনের উপর রাজনীতিক ব্যবস্থার সামর্থ্য নির্ভরশীল।
(৩) বিশেষীকরণ (Differentiation): রাজনীতিক উন্নয়নের তৃতীয় বৈশিষ্ট্যসূচক লক্ষণ হিসাবে অধ্যাপক পাই বিশেষীকরণের কথা বলেছেন। রাজনীতিক ক্ষেত্রে উন্নতির অন্যতম শর্ত হিসাবে বিশেষীকরণ বা কর্মবিভাগের কথা বলা হয়। রাজনীতিক কার্যাবলী ও ভূমিকাসমূহ সুনির্দিষ্ট হলে দ্রুতগতিতে এবং দক্ষতার সঙ্গে কার্য সম্পাদন সুনিশ্চিত হয়। বিভিন্ন রাজনীতিক কাঠামো এবং প্রত্যেক কাঠামোর বিশেষীকৃত কাজকর্মের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ব্যবস্থা স্বচ্ছন্দভাবে পরিচালিত হয়। এ প্রসঙ্গে মহাজন মন্তব্য করেছেন: “An important theme running through much of the discussion on political development in that of differentiation and specialisation.” প্রসঙ্গত অধ্যাপক পাইয়ের বিশেষীকরণ সম্পর্কিত বক্তব্যের সঙ্গে অ্যালমন্ড ও পাওয়েলের ‘রাষ্ট্র গঠন’ (State Building) সম্পর্কিত ধারণার সামঞ্জস্য লক্ষণীয়। সুতরাং রাজনীতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে অ্যালমন্ড ও পাওয়েলের ধারণার সঙ্গে পাই-এর ধারণার তুলনামূলক বিচারে কেবল সামর্থ্য (capacity)-র উপাদানটি নতুন প্রতিপন্ন হয়। পাইয়ের মতানুসারে সাধারণভাবে রাজনীতিক প্রক্রিয়ার উপর বিশেষীকরণ নির্ভরশীল।
পাইয়ের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্যসূচক উপরিউক্ত তিনটি লক্ষণ সর্বদা একই সঙ্গে প্রতিপন্ন হবে, এমন কথা বলা যায় না। প্রতিটি রাজনীতিক ব্যবস্থাকে পর্যায়ক্রমে উন্নয়নের এই গুচ্ছকে কার্যকর করতে হবে। সমতার চাপ মাত্রাতিরিক্ত হলে বিশেষীকরণের ক্ষেত্রে বাধা দেখা দেয় এবং সামর্থ্যের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে আবার মাত্রাতিরিক্ত বিশেষীকরণ সমতার পথে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। পাইকে অনুসরণ করে মহাজন এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…in recognising the three dimensions of equality, capacity, and differentiation, we do not suggest that they necessarily fit easily together. Historically, tendency has usually been that there are acute tensions between the demand for equality, requirements for capacity and the process for greater differentiation.”
রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত সমালোচনা:
রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত উপরিউক্ত আলোচনা বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। বিরুদ্ধবাদীরা রাজনীতিক উন্নয়ন বা বিকাশের ধারণার বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন।
- (১) রাজনীতিক উন্নয়ন কেবল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সম্ভব এমন কথা স্বীকার করা সম্ভব নয়। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় শাসক গোষ্ঠীই রাজনীতিক উন্নতির ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
- (২) আবার এ কথাও সর্বাংশে সত্য নয় যে পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলিই সর্বপ্রথম রাজনীতিক উন্নয়নের ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই সমগ্র পৃথিবীতে কেবলমাত্র এই দেশগুলিই উন্নয়নের মূল্যমান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এমন দাবি অমূলক।
- (৩) পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলিতেও আর্থ-রাজনীতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সমস্যা আছে এবং এই সমস্ত সমস্যা সমাধানের বিষয়টিও কম জরুরী নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পশ্চিমের সমৃদ্ধ দেশসমূহের সমস্যাদিকে অনুধাবন করা যায়নি।
- (৪) অ্যালমন্ড ও পাওয়েল এবং লুসিয়ান পাই-এর রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত আলোচনা অনৈতিহাসিক। কারণ রাজনীতিক ব্যবস্থা, কাঠামো, সামর্থ্য, বিশেষীকরণ প্রভৃতি ধারণাগুলি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করা হয়নি।
- (৫) তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসর বা উন্নতিশীল দেশগুলির আর্থ সামাজিক অবস্থা, দারিদ্র্য এবং অন্যান্য সংকট-সমস্যা সম্পর্কে সম্যকভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তা না করে রাজনীতিক উন্নয়নের ধারণাটিকে এই সমস্ত দেশের উপর আরোপ করা অসঙ্গত।
- (৬) রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি হল পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট। এই শ্রেণীর অত্যাধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা শুরুতেই স্থায়ী ও স্থির একটি নির্ধারককে স্বীকার করে নিয়েছেন। এবং এই নির্ধারকের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক উন্নয়নের বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।
Leave a comment