প্রথমে নীতি নির্ধারণকারী রাষ্ট্রনেতা বা রাষ্ট্রের কর্ণধাররাই রাজনীতিক উন্নয়ন বা বিকাশ কথাটি ব্যবহার করেন। পরবর্তী কালে আর্থনীতিক ও সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাবিদরা এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। তখনই বিষয়টি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হয়। সাম্প্রতিককালেই বিষয়টি ‘তুলনামূলক রাজনীতি’ (comparative politics)-র এলাকায় এসেছে। এবং তার ফলে তুলনামূলক রাজনীতির আলোচনা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। তুলনামূলক রাজনীতিতে রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করেন মার্কিন চিন্তাবিদরা। আফ্রো-এশীয় ও ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলি স্বাধীনতা লাভের পর সকল ক্ষেত্রে সামগ্রিক উন্নতির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এই অবস্থায় অত্যাধুনিক মার্কিন চিন্তাবিরা রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত তত্ত্বগত আলোচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেন।
রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত আলোচনার পটভূমি:
রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত ধারণাগত আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই ঔপনিবেশিকতাবাদ হীনবল হতে থাকে। এশিয়া ও আফ্রিকার বহুদেশ ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। সদ্য স্বাধীন এই সমস্ত দেশ ও তাদের অধিবাসীরা দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এই সময় উন্নতি বা বিকাশের ধারণাগত আলোচনা তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়। এই সময়ই এ বিষয়ে একটি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পটভূমি গড়ে উঠে। সুতরাং রাজনীতিক বিকাশ বা উন্নতির ধারণাটি উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশ ও জাতির পরিপ্রেক্ষিতেই অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়। বিশ্বের বিভিন্ন অনগ্রসর দেশের সমস্যাদি ও অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক উন্নয়ন বা বিকাশ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করেছেন। তবে পশ্চিমী দেশসমূহের অভিজ্ঞতার আলোকে উন্নয়নের ধারণাগত প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছে। এবং রাজনীতিক উন্নয়ন বা বিকাশের ধারণা রচিত হয়েছে মূলত মার্কিন আচরণবাদ, কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব, ব্যবস্থাপক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে। আবার প্রধানত অত্যাধুনিক মার্কিন তুলনামূলক রাজনীতির কিছু অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তাঁরা রাজনীতিক উন্নয়নের ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত একাধিক মডেল তুলে ধরেছেন। আধুনিককালের এই সমস্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন রবার্ট ডাল, লুসিয়ান পাই, অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল, স্যামুয়েল হানটিংটন, ড্যানিয়েল লার্নার, মাইরণ ওয়েনার, ডেভিড আপতার প্রমুখ।
রাজনীতিক পরিবর্তনের ধারণা সম্পর্কে মতপার্থক্য:
রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত ধারণা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। রাজনীতিক উন্নয়নের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার ফলাফল ও কাম্যতা প্রসঙ্গেও ব্যাপক মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক চিন্তাবিদ ও মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের মধ্যে এই পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। তা ছাড়া উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদের অনুগামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে রাজনীতিক উন্নয়নের ধারণাকে নিয়ে মতামতের অনৈক্যের অভাব নেই। রাজনীতিক পরিবর্তনের ধারণা সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদ বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। এ বিষয়ে এখন আলোচনার অন্ত নেই। এতদ্সত্ত্বেও রাজনীতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে ঐকমত্যের অভাব অনস্বীকার্য। এ বিষয়ে চিন্তাবিদদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা বর্তমান। লুসিয়ান পাই-এর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে এখনও ব্যাপক বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা বর্তমান।
রাজনীতিক উন্নয়নের ধারণা:
সাধারণভাবে বলা যায় যে রাজনীতিক জীবন, কাঠামো কার্যাবলী ও প্রক্রিয়ার পরিবর্তনই হল রাজনীতিক উন্নয়ন। পরিবর্তন উন্নয়নের একটি ধাপ। প্রত্যেক পরিবর্তন উন্নয়ন হিসাবে বিবেচিত হয় না। এই পরিবর্তনের মধ্যে প্রচলিত অবস্থা থেকে সরে আসার প্রবণতা বর্তমান থাকে। সমকালীন সামাজিক-রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অসন্তোষ সূত্রে পরিবর্তনের এই প্রবণতার সৃষ্টি হয়। রাজনীতিক উন্নয়ন হল এক গতিশীল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অবস্থা থেকে আর একটি অবস্থায় উপনীত হওয়া যায়। অনেকের মতানুসারে রাজনীতিক উন্নয়ন হল সরকার প্রভাবিত বাঞ্ছিত ও পরিকল্পিত পরিবর্তনের কার্যক্রম। রাজনীতিক উন্নয়ন বা বিকাশ বলতে যে পরিবর্তনকে বোঝায়, তা সাধারণত বিশেষ একটি পথে ও আনুপাতিক হারে সংঘটিত হয়। রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকে রাজনীতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আর্থনীতিক নির্ধারণকেই গুরুত্ব প্রদানের পক্ষপাতী। বাস্তবে এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক ও সামাজিক কারণগুলিও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণভাবে উন্নয়ন বলতে সামগ্রিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। রাজনীতিক উন্নয়ন বলতেও উন্নয়নমূলক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এ হল রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রকৃতি ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।
রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সংজ্ঞা:
রসটো ও পাই-এর অভিমত অনুসারে ‘জাতীয় রাজনীতিক ঐক্য এবং রাজনীতিক অংশগ্রহণের বিস্তারই হল রাজনীতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য। তাঁদের কথায়: (“Political development seeks national unity and broading of the base of political participation.”)।
এডওয়ার্ড শিলস (Edward Shils) ও তাঁর On the Comparative Study of New States শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে রাজনীতিক বিষয়ে ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ হল রাজনীতিক উন্নয়নের একটি বিশেষ লক্ষণ।
রসটোর মতানুসারে শিল্পোন্নত দেশগুলি অন্যান্য দেশের সামনে রাজনীতিক উন্নয়নের মান স্থাপন করে। এই সমস্ত দেশের রাজনীতিক উন্নয়নের ভিত্তি রচিত হয় শিল্পোন্নত দেশসমূহে উদ্ভাবিত রাজনীতিক আচরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-নীতির মাধ্যমে।
এ প্রসঙ্গে কার্ল ডয়েটসও অনুরূপ অভিমত পোষণ করেন। Social Mobilization and Political Development শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন যে সমকালীন রাজনীতিক ব্যবস্থার উন্নয়নের উপায় বলতে পশ্চিমী শিল্পোন্নত দেশসমূহের রীতি-নীতি ও পন্থা-পদ্ধতিকে বোঝায়। তিনি সকল সমাজের রাজনীতিক বিকাশ বা উন্নয়নের উদাহরণ হিসাবে পাশ্চাত্যের শিল্প-সম্পদের আধুনিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কথা বলেছেন।
ড্যানিয়েল লার্নার তাঁর The Passing of the Traditional Socities শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, পাশ্চাত্যের উন্নয়ন সম্পর্কিত মডেলটি হল সর্বজনীন। পাশ্চাত্যের এই মডেলের মাধ্যমে উন্নয়নের কতকগুলি লক্ষণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। সকল সমাজ সম্পর্কেই এই সমস্ত লক্ষণ প্রযোজ্য। অনেকে আবার সামাজিক এবং আর্থনীতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পর্যালোচনার পক্ষপাতী।
হেগানের মতানুসারে রাজনীতিক উন্নয়ন বা বিকাশ হল রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান বা প্রক্রিয়ার বিকাশ যার ফলে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সমকালীন মৌলিক সমস্যাদির সঙ্গে অধিকতর সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করতে পারে এবং দীর্ঘকালীন বিচারে রাজনীতিক জমানা জনসাধারণের চাহিদার প্রতি সুবিচার করতে পারে। তিনি বলেছেন: (“Political development is the ) growth of institutions and practices that allow a political system to deal with its own fundamental problems more effectively in the short run, while working towards more responsiveness of the regime to popular demand in the long run.”
অ্যালফ্রেড ডায়ামন্টের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক উন্নয়ন হল এমন এক প্রক্রিয়া যা ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমস্যাসমূহের সমাধানের স্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো গড়ে তোলে। তিনি বলেছেন: “…Political development is not a process which aims at achieving a particular political condition, but one which creates an institutional framework for solving an ever-widening range of social problems.”
আইজেনস্টাড্ (Eisenstadt) ও অনুরূপভাবে মনে করেন যে, সব রকম নতুন ধরনের রাজনীতিক চাহিদা ও সংগঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের ব্যাপারে রাজনীতিক ব্যবস্থার সক্ষমতাই হল রাজনীতিক বিকাশ বা রাজনীতিক উন্নয়ন। তিনি বলেছেন: (“Political development is the ability of a political system to sustain continuously new types of political demands and organisation.”
এ প্রসঙ্গে অ্যালমন্ডের অভিমত হল: (“Political development is the acquisition of new capability, in the sense of a specialised role, structure and differentiated orientation which together give a political system the range of problems.” উন্নয়নের লক্ষণ হিসাবে তিনি ব্যক্তিবর্গের বিশ্বাস বা মনোভাব, সামর্থ্য, পরিবেশ প্রভৃতির কথা বলেছেন।
রাজনীতিক জীবন, কাঠামো-কার্যাবলী ও প্রক্রিয়ার পরিবর্তন রাজনীতিক উন্নয়ন হিসাবে বিবেচিত হয়। রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত মতবাদগুলি হল পাশ্চাত্যের মতবাদ। এই সমস্ত মতবাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি (Development Approach) সম্পর্কিত অ্যালমন্ড ও পাওয়েল-এর মতবাদ এবং উন্নয়নের গুচ্ছ (Development Syndrome) সম্পর্কিত লুসিয়ান পাই-এর মতবাদ।
Leave a comment