অথবা, বাংলাদেশের রাখাইন উপজাতির জীবনধারা বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ নৃ-বিজ্ঞানীগণ এক ধরনের সমাজকে প্রণালিবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে, সাধারণভাবে একটি বিবর্তন মাত্রায়। এটি হচ্ছে ট্রাইব বা উপজাতি। উপজাতি বলতে এমন এক জনগােষ্ঠি বা সামাজিক গােষ্ঠিভুক্ত দলকে বুঝায়, যাদের নিজস্ব একটি বিশেষ ভাষা এবং সংস্কৃতি রয়েছে। এরা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বসবাস করে। বাংলাদেশে প্রায় ২০টির মত উপজাতি বাস করে। যেমনঃ চাকমা, গারাে, সাঁওতাল, মুরং, ত্রিপুরা, খাসিয়া, রাখাইন, মারমা উল্লেখযােগ্য। এদের বেশির ভাগের বসবাস পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও বগুড়ায়।
বাংলাদেশের রাখাইন উপজাতির জীবনধারাঃ বাংলাদেশে রাখাইন উপজাতিদের জীবনধারা আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নিম্নে সংক্ষেপে আলােচনা করা হলােঃ
সাধারণ পরিচিতি/রাখাইন উপজাতির আগমনঃ রাখাইনরা হচ্ছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত একটি জনগােষ্ঠি। রাখাইন শব্দটির ব্যুপত্তিগতভাবে ‘আরকান’-এর সাথে সম্পর্কিত। রাখাইন শব্দটি বাংলায় ‘রাক্ষাইন’ হিসেবেও অনেকে লিখে থাকেন। রাখাইনরা মনে করেন, আরাকান রাজ্য বার্মা কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সময় তাদের পূর্বসূরিরা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল। এভাবে নিজেদের ইতিহাসকে কারা কীভাবে মনে রেখেছে বা দেখেছে তার ওপর নির্ভর করেই সম্ভবত রাখাইনদের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে ওঠে।
রাখাইনদের আবাসস্থান/বাসস্থানঃ রাখাইনরা পটুয়াখালী জেলায় বসবাস করে। এই জেলার আমতলী, কলাপাড়া ও গলাচিপা থানার বিভিন্ন এলাকায় তাদের সংখ্যা বেশি। তবে ইদানিং পার্বত্য অঞ্চলসহ নদীর পার ও সমুদ্র। উপকূল ঘেঁষে সমতল ভূমিতে রাখাইন জনগােষ্ঠি গড়ে ওঠেছে। রাখাইনদের বাড়িঘরগুলাে স্থানীয় বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুদের বাড়িঘরের স্টাইল বা নির্মাণরীতি থেকে আলাদা ধাঁচের। অন্যান্য অনেক মঙ্গোলীয় নৃ-গােষ্ঠীর মতােই এরা মাচা পেতে ঘর তৈরি করে বসবাস করে। শ্রেণিভেদে এদের কারও কারও ঘরে গােলপাতার আচ্ছাদন; আবার কারও ঘরে টিনের। তবে ষাটের দশকের আগের সাধারণত ঢেউটিনের স্থলে টালি দেখা যেত।
গােষ্ঠীগত পরিচয়/নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়ঃ বাংলাদেশের রাখাইনরা মঙ্গোলীয় নৃ-গােষ্ঠিভুক্ত এক ক্ষুদ্র জনসমাজ। এদের উচ্চতা মাঝারি ধরনের। মাথার আকার সাধারণত গােল। এদের চুল হয় খাড়া, সােজা, খড়খড়ে ও কালাে। নাক মাঝারি হতে চ্যাপ্টা, চোখ ধূসর বা কালাে এবং গায়ের রং বাদামি। এদের দাড়ি-গোঁফ থাকে না বললেই চলে।
আচার-অনুষ্ঠান/উৎসবঃ বাংলাদেশের রাখাইন জনগােষ্ঠি তাদের সাদামাটা সরল জীবনযাপনে নানা পূজা পার্বণে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এর মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের জন্মবার্ষিকী, বৈশাখী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, বসন্ত উৎসব অন্যতম। তা ছাড়াও শিশুর নামকরণ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, গৃহ প্রবেশ, নবান্ন উৎসব উল্লেখযােগ্য। এদের সর্ববৃহৎ উৎসব চৈত্রসংক্রান্তিতে। তিন দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠান সুন্দর বর্ণাঢ্য পােশাক পরে দলবেঁধে নেচে গেয়ে পরস্পরের উদ্দেশ্যে পানি ছিটায়।
রাখাইনদের ভাষাঃ রাখাইনদের নিজস্ব ভাষা আছে। মঙ্গোলীয় স্রোতধারায় ভােট-ব্ৰহ্ম শাখার ভাষা। এই ভাষা ইন্দো-আর্য বা দ্রাবিড়ীয় আর্য ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। রাখাইন ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তাদের চেতনা সম্পর্কে প্রণিধানযােগ্য এক ভক্তিতে বলা হয়েছে যে, তারা এতই অদম্য যে, বাঙালিদের সাথে দীর্ঘ ঐতিহাসিক কালব্যাপী সংস্পর্শ বজায় রেখেও রাখাইনরা স্বকীয়তা ও স্বপরিচয় হারিয়ে ফেলেনি, বরং সাম্প্রতিককালে পার্শ্ববর্তী জনগােষ্ঠির চাপের মুখেও তাদের সাথে সন্নিবেশিত থেকেও রাখাইনরা নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাগত দাবী উত্থাপনে আগ্রহ অভিনিবেশ ও ঋজুতা প্রদর্শন করেছে।
রাখাইনদের শিক্ষাঃ রাখাইন, শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বৌদ্ধ মন্দিরের পাঠশালায়। এই পাঠশালাকে বলা হয় কিয়ং। তাদের ভাষা শিক্ষা ও বৌদ্ধ ধর্মের নানা প্রকার শিষ্টাচার মূলত এখানে শেখানাে হয়। প্রায় সকল নারী-পুরুষ রাখাইন ভাষায় সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। শিশুরা একটু বড় হলে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পাঠানাে হয়। কিন্তু তা যথেষ্ট উন্নত নয়। তাই রাখাইনরা মােটামুটি শিক্ষাবঞ্চিত।
রাখাইনদের ধর্মঃ বাংলাদেশের রাখাইন জাতিগােষ্ঠির প্রায় একশত ভাগই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি। তারা বৌদ্ধ ধর্মের বিধান মতাে শাস্ত্রীয় শিষ্টাচার পালন করে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন দুই ধারার; যথাঃ মহাযান ও হীনযান এর মধ্যে এরা হীনযান এর থেরােবাদী তথা পালি ত্রিপিটকে বর্ণিত বৌদ্ধ মতের অনুসারী। এই ধারার অনুসারীরা যথেষ্ট অগ্রগামী ও আধুনিক বৌদ্ধদর্শন মতাবলম্বি। তবে রাখাইনরা কিছু প্রাচীন সংস্কারে আস্থাশীল এবং বিভিন্ন কিংবদন্তীতে বিশ্বাসী।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতার স্পর্শ সর্বত্র লাগলেও রাখাইনদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অনেক কিছু এখনও বর্তমান। তবে রাখাইন সমাজ ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
Leave a comment