“রসের মানসিক উপাদান যে, ‘ভাব’, তা দুঃখময় হলেও তার পরিণাম যে ‘রস’, তা নিত্য আনন্দের হেতু।”
সহৃদয় সামাজিকের সুকাব্যজনিত চিত্তের অনুভূতিবিশেষকেই প্রাচীন আলঙ্কারিকগণ ‘রস’ নামে অভিহিত করেছেন। দার্শনিকপ্রবর কান্ট মানুষের জ্ঞানের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে বাহ্যিক উপাদানই মনোগত সাধারণ কার্যকারণ তত্ত্বকে বিশেষ কার্যকারণের জ্ঞানে পরিণত করেছে। রসের বিশ্লেষণেও তেমনি বাহ্যিক ও মানসিক দুপ্রকার উপাদানেরই সন্ধান পাওয়া যায়। তবে রসের বাহ্যিক উপাদান বাইরের লৌকিক জগৎ থেকে আসে না, এটি আসে কবির সৃষ্ট কাব্যের জগৎ থেকে। কাব্যজগতের ঐ বাহ্যিক উপাদানের ক্রিয়াতেই মনের ‘ভাব’ নামে চিত্তবৃত্তি বা ইমোশনগুলি ‘রসে’ পরিণত হয়। অতএব দেখা যাচ্ছে, কাব্যজগৎ থেকে আহূত উপাদান মানুষের মনে যে ‘ভাবের’ সৃষ্টি করে, সেই সকল ভাব লৌকিক হলেও তা যখন ‘রসে’ পরিণতি লাভ করে, তখন সেই ‘রস’ কিন্তু আর লৌকিক থাকে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অতি পরিচিত জগতেই ভাবের অবস্থান, কিন্তু ‘ভাব’ বা ‘ইমোশন’ মাত্রই তো আর রস নয় এবং মানুষের মনে যে কোনো ভাব জাগিয়ে তুলতেই তা কাব্য বলে বিবেচিত হয় না। যেমন, লৌকিক জগতের নানা ঘটনা সংঘাতে যে সকল বাহ্যিক কারণ সৃষ্টি হয়, তা একটি মানসিক ‘ভাব’ বা ‘ইমোশন’ এবং এটি একান্তভাবেই লৌকিক। এই লৌকিক শোক ঐ শোকার্ত ব্যক্তির নিকট কিংবা অপর কোনো ব্যক্তির নিকটই রস নয় কিংবা শোকের কারণটিও কাব্য নয়। এই লৌকিক শোক এবং তার লৌকিক কারণকে যদি কোনো কবি তাঁর অঘটন ঘটনপটীয়সী প্রতিভার সহায়তায় অলৌকিক চিত্ররূপ কাব্যে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তখনই সহৃদয় পাঠকের চিত্তে ঐ লৌকিক শোকই ‘অলৌকিক করুণ রসে’ পরিণত হয়। অতএব ‘রস’ও কখনো লৌকিক বস্তু হতে পারে না। একটি দৃষ্টান্ত দ্বারা ব্যাপারটি বিশদ করা যেতে পারে। নিষাদ-শরাহত ক্রৌঙের মৃত্যুতে ক্রৌঞ্ঝীর শোক ছিল একান্তই তার ব্যক্তিগত, অতএব লৌকিক। ঘটনাটির প্রত্যক্ষদ্রষ্টা বলে বাল্মীকির মনেও এই শোক সঞ্চারিত হয়েছিল, যতক্ষণ এই শোক তাঁর নিজের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, ততক্ষণ তা-ও ছিল লৌকিক শোকমাত্র। কিন্তু এক অভিনব মানসপ্রক্রিয়ায় এই লৌকিক শোকই যখন ‘রামায়ণ’ কাব্য-রূপে পরিণত হয়ে সহৃদয় পাঠকচিত্তে আস্বাদনীয় ‘রস-রূপ ধারণ করলো, তখন সেই ‘রস’ আর লৌকিক রইলো না, তা সার্বজনীনতা প্রাপ্ত হয়ে অলৌকিক হয়ে উঠলো। অতএব আলোচ্য ক্ষেত্রে ‘করুণ-রসে’র উপাদান ‘শোক’-রূপে ‘ভাব’ বা ‘ইমোশন’ লৌকিক হলেও যখন তা রস-রূপ প্রাপ্ত হয়, তখন আর লৌকিক নয়। তবে এই প্রসঙ্গে একটু সতর্ক বিচার প্রয়োজন।
এই করুণ রসের পশ্চাতে লৌকিক শোকের কারণ থাকলেও তা কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই শোকের ‘ভাব’ বা ‘ইমোশন’ নয়। কারণ, শোক দুঃখদায়ক, কিন্তু শোকের কাব্যপাঠে সহৃদয় পাঠকের মনে যে করুণরসের সৃষ্টি হয়, তা চোখে জল আনলেও পাঠকের মনকে আনন্দে পূর্ণ করে দেয়। এখন করুণ রস কেন বা কেমন করে পাঠকচিত্তে আনন্দ সঞ্চার করে, প্রমাণ করে দেখানো কঠিন, এটি একান্তই অনুভূতিসাপেক্ষ ব্যাপার। হৃদয়বান লোক নিজের চিত্তের অনুভূতি থেকেই শুধু এর প্রমাণ পেতে পারেন (‘করুণাদাবপি রসে জায়তে যৎ পরং সুখম্। সচেতনামনুভবঃ প্রমাণং তত্র কেবলম্’)।
করুণ রসমাত্রই যে দুঃখদায়ক নয়, এ বিষয়ে প্রাচীন আলঙ্কারিকগণ বিশেষভাবেই অবহিত ছিলেন। ‘সাহিত্যদর্পণ ‘কার বলেন, ‘কিঞ তেষু যদা দুখং ন কোহপি স্যান্ডদুন্মুখঃ। তথা রামায়ণাদীনাং ভবিতা দুঃখহেতুঁতা।’ অর্থাৎ করুণরস মাত্রই যদি দুঃখের কারণ হতো তবে রামায়ণাদি কাব্যপাঠে কেউ উন্মুখ হতো না। আবার লৌকিক শোকমাত্রই যে অলৌকিক রসে পরিণত হয় না, তারও বিশেষ ক্ষেত্র রয়েছে, তারও প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে রামায়ণকার বাল্মীকির কাহিনী থেকে। ক্রৌঞ্ঝীর লৌকিক দুঃখে অবশ্যই বাল্মীকির মনেও লৌকিক দুঃখের সৃষ্টি করে থাকবে, কিন্তু বাল্মীকি যদি শুধু শোকার্ত হয়েই থাকতেন, তবে হয়তো ঘটনাটি তাঁর অশ্রুজলেই সমাপ্ত হতো। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাল্মীকি তাঁর অসাধারণ প্রতিভা বলে এই লৌকিক শোককে ব্যক্তি-সম্পর্ক-বর্জিত লোকোত্তরতা দান করায় সেই শোকই অলৌকিক রসমূর্তি পরিগ্রহ করে।
বস্তুতঃ করুণ রসের মূলে লৌকিক শোকের কারণ থাকলেও তা যে পরিণামে আনন্দদায়ক হয়, এ বিষয়ে সব দেশেরই রসপ্রমাতাগণ অভিন্নমত পোষণ করেন। দার্শনিকোত্তম আরিস্তোতল ট্র্যাজিডি-আলোচনা-প্রসঙ্গে যে ‘ক্যাথারসিস’ (Catharsis) বা ‘পারগেশানে’র (Purgation) কথা বলেছেন, সেখানেও আনন্দের সঙ্কেত রয়েছে। তাঁর মতে ‘ভীতি’ বা ‘করুণা’র মিশ্রণে যে ‘ক্যাথারসিস্’ বা মোক্ষণ ঘটে, তাঁকে ‘ট্র্যাজিক প্লেজার’ বলে অভিহিত করা চলে। কবি শেলীও বলেছেন যে, মানুষের আত্মার ভিতর যে জৈবিক সত্তা এবং অন্তরতম সত্তার দুই ভাগ থাকে, তাদের সামঞ্জস্য থেকেই সৃষ্টি হয় আনন্দের আর তীব্রতম দুঃখই মহত্তম আনন্দের কারণ (“Our sweetest songs are those that tell of saddest thought”)। ফতেঁল্ল বলেন, দুঃখের ও আনন্দের মধ্যে হেতুগত কোনো পার্থক্য নেই—এই দুটির অনুভূতির মধ্যে রয়েছে একটি সূক্ষ্ম মায়াযবনিকার ‘অন্তরাল’ মাত্র। এমন কি সংশয়বাদী শোপেনহাওয়ারও বলেন যে কাব্যপাঠের ফলে প্যাশনের বড় দুঃখ ও ভীতির অসহনীয় চাপের উপশম ঘটে, অহং চেতনা বিলুপ্ত হয় ও সর্বোপরি লাভ হয় আনন্দ।
ভারতীয় আলঙ্কারিকগণ বস্তুজগৎ ও কাব্যজগতের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে পরিষ্কার বলেছেন যে বস্তুজগৎ লৌকিক জগৎ, কিন্তু রস ও কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ। বস্তুজগতের শোকহর্ষাদি লৌকিক কারণ মানুষের মনে তাদৃশ লৌকিক ভাবের জন্মদান করে। এই সকল লৌকিক ভাব এবং লৌকিক কারণই কাব্যজগতে অলৌকিক রূপ লাভ করে ভাবের বৃত্তি বা বাসনাকে অলৌকিক রসে রূপায়িত করে। তাই রসের মানসিক উপাদান যে ‘ভাব’, তা দুঃখময় হলেও তার পরিণাম যে রস, তা নিত্য আনন্দের বস্তু। ‘সাহিত্যদর্পণ’কার বলেন যে লৌকিক ভাবসমূহ ‘অলৌকিক-বিভাবত্বং প্রাপ্তেভ্যঃ কাব্যসংশয়াৎ। সুখং সঞ্চায়তে তেভ্যঃ সর্বেভ্যোহপীতিকা ক্ষতি।’
Leave a comment