“কাব্যের আত্মা ‘ধ্বনি’ বলে যাঁরা আরম্ভ করেছেন, কাব্যের আত্মা ‘রস’ বলে তাঁরা উপসংহার করেছেন। বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্।”
‘কাব্য’ কী—এই প্রশ্ন জেগেছিল আদিকবি বাল্মীকির মনে। ক্রৌট্টীশোকে বাল্মীকির মুখে ‘মা নিষাদ’ শ্লোকটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল—’কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া’। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই প্রাচীন ভারতে সৃষ্টি হয়েছিল ‘কাব্যতত্ত্ব’, যার অপর পারিভাষিক নাম ‘অলঙ্কারশাস্ত্র’। এই শাস্ত্রের প্রাচীনতম প্রবক্তা ভরতমুনি তাঁর ‘নাট্যশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থে ‘রস’কেই কাব্যের মূল বলে গ্রহণ করেছিলেন এবং কাব্যের ভাব-অলঙ্কারাদিকে ফুল-ফল-রূপে এই রসেরই স্ফূর্তি বলে অভিহিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে আচার্য ভামহ, আচার্য দণ্ডী, আচার্য বামন, আচার্য কুম্ভক, আচার্য মন্মটভট্ট, আচার্য আনন্দবর্ধন, আচার্য অভিনব গুপ্ত, চক্রবর্তী বিশ্বনাথ এবং আরো অনেকেই অলঙ্কারশাস্ত্রকে পরিপুষ্টি দান করেন ও বহু বিভিন্ন মতবাদের প্রবর্তন করেন। এদের মধ্যে প্রধান প্রধান মতবাদ—’অলঙ্কার প্রস্থান’ (‘কাব্যং গ্রাহামলঙ্কারাৎ’), ‘রীতি-প্রস্থান’ (‘রীতি-রাত্মা কাব্যসা’), ‘বক্রোক্তি-প্রস্থান’ (‘বক্রোক্তি কাব্যজীবিতম্’) ‘ধ্বনি-প্রস্থান’ (‘ধ্বনি-রাত্মা কাব্যস্য’), এবং ‘রস-প্রস্থান’ (‘বাক্যৎ রসাত্মকং কাব্যম্’)। এই সমস্ত মতবাদে কোথাও বা অলঙ্কারকেই প্রধান করে তোলা হয়েছে, কোথাও বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনাই প্রাধান্য লাভ করেছে। তবে এ বিষয়ে ধ্বনিবাদীরা যে বিচার-বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য করেছেন, এ বিষয়ে একালের অন্যতম রসজ্ঞ সমালোচক মনীষী অতুল গুপ্ত বলেন, “কাব্য-সম্বন্ধে তার চেয়ে খাঁটি কথা কোনো দেশে কোনো কালে আর কেউ বলেনি।”
প্রাগুক্ত মতবাদগুলির কোনোটিই একেবারে বর্জনীয় নয়—কাব্য নির্মাণে এদের প্রত্যেকটিরই উপযোগিতা স্বীকৃত হয়ে থাকে। আচার্য মন্মটভট্ট শৌদ্ধোদনির উক্তিরূপে কথিত একটি কথা তাঁর ‘কাব্যালঙ্কার’ গ্রন্থে উদ্ধার করেছেন—’কাব্যস্য শব্দার্থে শরীরং, রসাদিশ্চাত্মা, গুণাঃ শৌর্যাদিবৎ, দোষাঃ বাণত্বাদিবৎ রীতয়োহবয়বসং স্থানবিশেষবৎ অলঙ্কারাঃ কটককুণ্ডলাদিবৎ।’ এখানে রসকে কাব্যের আত্মারূপে স্বীকৃতি দান করলেও শব্দার্থ, গুণ, দোষ, রীতি বা অলঙ্কার কোনোটিকেই অগ্রাহ্য করা হয় নি। মোটামুটি এরই প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় কবিরাজ বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কণ্ঠে। তিনি কাব্যতত্ত্ব বিষয়ে বলতে গেলে, চরম কথাটি বলে গেছেন তাঁর ‘সাহিত্য-দর্পণে’—সাহিত্য বিচারে সাধারণভাবে এটিকে মাপকাঠি-রূপে গ্রহণ করা হয়। তিনি বলেন—
‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যং দোষাস্তস্যাপকর্ষকাঃ।
উৎকর্ষহেতবঃ প্রোক্তাঃ গুণালঙ্কার-রীতয়ঃ।।
এখানেও রসকেই কাব্যের আত্মারূপে গ্রহণ করে গুণ, অলঙ্কার ও রীতির উপযোগিতার কথা বলা হয়েছে।
লক্ষণীয় এই যে, উপরের উদ্ধৃতি দুটির কোথাও ‘ধ্বনি’র কথা উল্লেখও করা হয়নি। বস্তুতঃ ধ্বনির সঙ্গে রসের এমন অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক যে, এদের একটিকে অপরটি থেকে পৃথক করে দেখা নিষ্প্রয়োজন, কারণ এখানে সর্বত্র রস’ বলতে ‘রসধ্বনি’কেই বোঝাচ্ছে, সম্ভবতঃ তাই তাঁরা আর পৃথকভাবে ধ্বনির কথা উল্লেখ করেন নি। শব্দ ও অর্থ যখন নিজ প্রাধান্য ত্যাগ করে বাচ্যাতিরিক্ত এক প্রতীয়মান অর্থ প্রকাশ করে, তাকে বলা হয় ‘ধ্বনি’। বাচ্যার্থকে অবলম্বন করেই ধ্বনি প্রকাশিত হয়, তবে ধ্বনি বাচ্যার্থ অপেক্ষা প্রধান হয়ে ওঠে। ধ্বনির এই প্রাধান্য বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম গ্রন্থ ‘ধ্বন্যালোক’। এর ‘কারিকা’ অর্থাৎ মূলসূত্র অংশটি কার রচিত তা জানা যায় না, তবে এর ‘বৃত্তি’ রচনা করেছেন আচার্য আনন্দবর্ধন এবং ‘কারিকা’, ‘বৃত্তি’র ‘লোচন’ নামক টীকা রচনা করেছেন আচার্য অভিনব গুপ্ত। বস্তুতঃ এই দুই আচাৰ্যই ‘ধ্বনিবাদ’ বিষয়ে যাবতীয় প্রশ্নের মীমাংসা করে গেছেন। ‘ধ্বনালোকেই উক্ত হয়েছে যে, মহাকবিদের কাব্যে দেহাতিরিক্ত একটি প্রতীয়মান বস্তু থাকে, এটি অঙ্গনাদেহে লাবণ্যের মতই কাব্যাবয়বে ঝলমল করে—এই যে প্রতীয়মান অতিরিক্ত বস্তু, এটিই ধ্বনি, এটিই কাব্যের আত্মা। এই ধ্বনি রসের ধ্বনি, রস নামেও একে অভিহিত করা চলে।
কোনো কোনো অলঙ্কারের সুকৌশল ব্যবহারে এক বস্তুর দ্বারা অপর ব্যঞ্জনা অথবা এক অলঙ্কার দ্বারা অপর অলঙ্কারের ব্যঞ্জনাকে ‘ধ্বনি’ বলে ভ্রম হতে পারে। এ বিষয়ে সতর্ক করে দেবার জন্য ‘ধ্বনি’ সমাসোক্তি এবং সংকর অলঙ্কারের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে এদের মধ্যে বাচ্যাতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনা না। থাকায় এগুলিকে ধ্বনি-রূপে গ্রহণ করা চলে না। ব্যঞ্ঝনামাত্রই কাব্য নয়, শব্দের ও অলঙ্কারের ব্যঞ্জনা যদি বাচ্যাতিরিক্ত বিষয়ের ব্যানা না হয়, তবে তা কাব্য হতে পারে না। বাচ্যার্থ-অতিক্রমী রসের ব্যানাই বাক্যকে কাব্যে উন্নীত করতে পারে। আচার্য অভিনব গুপ্ত তাঁর ‘লোচন’ টীকায় স্পষ্টতঃই উল্লেখ করেছেন যে অসংলক্ষ্যক্রমধ্বনি অর্থাৎ যেখানে বাচ্যার্থ এবং ব্যঙ্গ্যার্থের যুগপৎ প্রকাশ ঘটে, সেই ধ্বনিই শ্রেষ্ঠ ধ্বনি এবং রসধ্বনিই ধ্বনিসম্রাট্, এটিই কাব্যের আত্মা—‘রসধ্বনেঃ এর সর্বত্র মুখ্যভূতমাত্মত্বম্।’ ব্যঙ্গার্থ অসংলক্ষ্যক্রমে সাক্ষাত্তাবে রসকে জাগালেই তা হয় ‘রসধ্বনি’। বস্তুতঃ ধ্বনিবাদীরাও কাব্যের আত্মারূপে স্বীকৃতি দান করেছেন রসকেই এবং ধ্বনিকে বলেছেন রসের প্রকাশ। যাবতীয় ধ্বনির পর্যাবসান ঘটে রসধ্বনিতে। এমন কি সংলক্ষ্যক্রম ‘বস্তু-ধ্বনি’ এবং ‘অলঙ্কারধ্বনি’—যা দ্বারা যথাক্রমে বাচ্যাতিরিক্ত বস্তু ও অলঙ্কার ব্যঞ্ছিত হয়, তারাও শেষ পর্যন্ত রসে পর্যবসিত হয়।
আচার্য অভিনব গুপ্ত মদনভস্মের পর তার প্রভাব-বিষয়ে দুটি শ্লোক উদ্ধার করেছেন, একটির বক্তব্য—সেই এক কুসুমধন্বা যিনি ত্রিলোক জয় করেছিলেন, শম্ভু তাঁর দেহ হরণ করতে পারেন নি।’ অপরটির বক্তব্য—“যিনি কর্পূরের মতো দগ্ধ হয়েও জনে জনে তাঁর গুণ জানাচ্ছেন, সেই অবার্যবীর্য পুষ্পধন্বাকে নমস্কার।’ প্রথম দৃষ্টান্তটিতে মদনের শক্তির কারণ যে অচিন্ত্য, এই ভাবটি মাত্রই প্রকাশিত হয়েছে, তার অতিরিক্ত কিছু নয় ; দ্বিতীয়টিতে কর্পূরের সঙ্গে মদনের স্বভাবের সাদৃশ্যমাত্র প্রদর্শিত হয়েছে, তদতিরিক্ত কিছু নয়। এ দুটি কবিতার কোথাও বাচ্যাতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনা না থাকায় আচার্য অভিনব গুপ্ত এদের কাব্য বলে স্বীকার করেন নি। আলোচ্য প্রবন্ধের লেখক অতুলচন্দ্র গুপ্ত অনুরূপ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতাংশ উদ্ধার করে মন্তব্য করেছেন যে অভিনব গুপ্ত এটি পড়লে হয়তো বলতেন যে’ এ কবিতার কাব্যত্ব হচ্ছে এর ‘করুণ বিপ্রলম্ভের ধ্বনি।’ কবিতাংশটি এরূপ—
‘পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কি সন্ন্যাসী,
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে ওঠে নিশ্বাসি
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।
এই তিনটি দৃষ্টান্ত থেকেই দেখা গেল যে বাচ্য কিংবা কথা নয়, কাব্যের আত্মা হচ্ছে ব্যানা বা ধ্বনি। এবং এই ধ্বনি বস্তুধ্বনি বা অলঙ্কারধ্বনি নয়, রসধ্বনি।
‘রস’-বিষয়ে ‘সাহিত্যদর্পণ’কার বিশ্বনাথ-রচিত ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’ উক্তিটি বহুল প্রচলিত হলেও তৎপূর্বেই ধ্বনিবাদী আনন্দবর্ধন এবং অভিনব গুপ্ত উভয়েই রস-প্রাধান্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন। অভিনব গুপ্ত ‘রস’কে বলেছেন ‘স্বসংবিদানন্দ চর্বণব্যাপার-রসমীয়-রূপো রসঃ’ অর্থাৎ রস নিজের আনন্দময় সম্বিতের (চেতনার) আস্বাদ স্বরূপ। এই রস একপ্রকার লোকোত্তর আনন্দঘন প্রতীতি যা একমাত্র সহৃদয় ব্যক্তির চিত্তেই আস্বাদ্যমান। এই রস-বিশ্লেষণের ব্যাপারেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন ‘লোচন’-টীকাকার আচার্য অভিনব গুপ্ত, যিনি ধ্বনিবাদেরও অন্যতম প্রবক্তা। ইনিই দেখিয়েছেন যে কাব্যের ধ্বনি এবং এই রস-সংযোগেই অতিপরিচিত সাধারণ কথা ও কাব্য হয়ে উঠতে পারে। ‘ধ্বন্যালোকে’ বলা হয়েছে—“পূর্বপরিচিত অর্থ ও রসের যোগে কাব্যত্ব লাভ করে বসন্তের নবকিশলয়-খচিত বৃক্ষের মতো নতুন বলে প্রতীয়মান হয়।” অতএব দেখা যাচ্ছে, ধ্বনিবাদীরা ‘ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য’ বলে আরম্ভ করলেও উপসংহারে দেখিয়েছেন—’বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্।’—এর তাৎপর্য কিন্তু ধ্বনি এবং রসের পৃথক্-করণ নয়, বরং কাব্য যে রসধ্বনিময়, এর আরম্ভ থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত বাচ্যাতিরিক্ত ধ্বনিরই প্রকাশ ঘটে এবং তাতেই হয় রসের উদ্বোধন—এই সত্যই এখানে প্রকাশ পেয়েছে।
Leave a comment