রবীন্দ্র সাহিত্য এবং তাঁর মননশীল প্রজ্ঞাদৃষ্টি কবি বিষ্ণু দেকে বাল্যকাল থেকেই প্রভাবিত করেছিল। ‘সাহিত্য চিন্তা’ পত্রিকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বিষ্ণু দে নিজেই জানিয়েছিলেন সাহিত্যজীবনে “মোহিতলালের চেয়ে সত্যেন্দ্রনাথ আমায় সাহায্য করেন বেশি। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই এবং বরাবর।” বাস্তবিকই কবি বিষ্ণু দে-র সমগ্র সাহিত্যজীবন এবং অন্তর্জীবনে কেউ যদি সাহিত্যসঙ্গী থাকেন তো তিনি রবীন্দ্রনাথ। ‘উব্বশী ও আর্টেমিস থেকে শুরু করে শেষ কাব্য ‘উত্তরে থাকো মৌন’ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি কাব্যেই রবীন্দ্রনাথ তার বিস্তৃত উজ্জ্বল পটভূমি উন্মুক্ত করে রয়েছেন। এমন প্রবন্ধ বা কাব্যগ্রন্থ বিষ্ণু দে-র খুব কমই আছে যেখানে রবীন্দ্র ভাবনা স্থান পায়নি। আসলে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্রে রেখেই এই শতকের তিনের দশকের অধিকাংশ বাঙালি কবির মতো বিষ্ণু দে-রও কাব্যবৃত্ত পরিক্রমার শুরু। যদিও সমাপ্তিতে তিনি উপনীত হয়েছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিণতিতে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিষ্ণু দে-র স্বীকৃতি অনেকখানি। এই আত্মস্বীকৃতির গভীরেই নিহিত রয়েছে কবি জীবনের প্রথম পর্বের নানা বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধানের মূল সূত্র। এই স্বীকৃতি অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ তাকে সাহায্য করেছেন বরাবর। কিন্তু কী অর্থে এবং কোনো বিবেচনায় তা বিচার করা প্রয়োজন। শুধুই কি প্রভাব, রচনাকর্মের সরলীকরণ। অথবা কাব্যের আদর্শগত পরম্পরা ? আমাদের মনে হয় পথ প্রদর্শনের স্বাভাবিক সরলতার প্রভাব সত্ত্বেও মানসিক উদ্দীপিত করণের প্রভাবটিও ছিল বিষ্ণু দে-র ক্ষেত্রে অপরিহার্য। কাব্যরচনার প্রথম পর্বেই তিনি রাবিন্দ্রীক। পরবর্তী পর্বে নয়। পরবর্তী পর্বগুলিতে তিনি যথেষ্ট পরিবর্তিত এবং আত্মদীপিত। অবশ্য একথা বিতর্কের ঊর্ধ্বে যে মধ্য ও অন্ত্যপর্বে যতই তিনি এলিয়ট প্রভাবিত এবং মার্ক্স উদ্দীপিত হোন না কেন, তাঁর কবিতায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি রবীন্দ্র আবহ বিরাজমান ছিল। যতই তা অস্পষ্ট ও অপ্রত্যক্ষ হোক না কেন নিজের কবিতার শরীরে মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো পংক্তিবিশেষ যোজনার প্রবণতা বিষ্ণু দে-র ছিল। অংশত নিজের কাব্যাদর্শের নির্বাচনে এবং সামগ্রিকভাবে নিজের মানসিক উজ্জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার গভীর ঋণকে শিরোধার্য করেই তিনি বারবার তাঁর কাছে ফিরে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে বিষ্ণু দে-র এই পৌনঃপুনিক প্রত্যাবর্তনে সহজ সত্যের একটা সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি ছিল। তিনি বুঝেছিলেন, বাংলা কাব্যের দেহ-মন-আত্মা, তার নিত্যনূতন ভাষাবিভঙ্গ সম্পূর্ণভাবেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতাই সকল কালের আধুনিকতা। সেই আধুনিকতা অনেক কাল পরেও টিকে থাকবে। কেননা ধ্রুপদী শিল্পের সেটাই রীতি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিষ্ণু দে-র মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে, রবীন্দ্রনাথকে বজর্ন করে নয় এবং তাঁকে বিনীত শ্রদ্ধায় গ্রহণ করেই বাংলা কাব্যের অগ্রগতি অব্যাহত রাখা সম্ভব। পাশ কাটিয়ে তাঁকে এড়িয়ে গেলে চলবে না, তাঁর মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। সমগ্র মানব সমাজের কাছেই তিনি অমূল্য সম্পদ। আমাদের নানা চিন্তাভাবনার পথ-প্রদর্শকরূপে, বহু নির্বাক অনুভূতির উন্মোচক ও রূপকার হিসাবেই রবীন্দ্রনাথের জ্যোতি প্রভা সমন্বিত চিরভাস্বর রূপ বর্তমান। এই শুভ ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন বলেই, বিষ্ণু দে নিজের কাব্যকৃতির পথটিকে সঠিকভাবে চিনে নিতে পেরেছিলেন। এই প্রতিকূল পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ মানবতার শিখাটিকে আমৃত্যু সন্তর্পণে রক্ষা করার ব্রত নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পে সাহিত্যে আধুনিকতার সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবি নিজেই বলেছেন, “আমাদের দুর্ভাগা দেশের আত্ম অপমানকর বহু বঞ্চনার মধ্যেও সৌভাগ্যবশত এই পর্বের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার স্বর্গমর্ত্য পাতালে অভিযান করে গেছেন অন্তত কয়েকজন মহীয়ান পুরুষ। রাজনীতির চারিত্রিক ক্ষেত্রে যেমন গান্ধিজি, সংস্কৃতির ব্যক্তিক ও সামাজিক সর্বক্ষেত্রে তেমনি রবীন্দ্রনাথ … বস্তুত রবীন্দ্রনাথই আমাদের দেশে শিল্পসাহিত্য তো বটেই, দেশের সমস্ত সংস্কৃতি, মানবজীবন ও কর্মের আধুকিতার আদি ও মৌলিক দৃষ্টান্ত। তাঁর মতো আত্মপরিচয় লাভের আকুতি অথবা সত্তা সংকটের তীব্রতা ও ব্যাপ্তি বৈচিত্র্য বোধহয় বিশ্বে তুলনারহিত…”
বিষ্ণু দে-র ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘দামিনী’ কবিতাটিতে রবীন্দ্র সাহিত্য অনুধ্যানের স্পষ্ট স্বাক্ষর প্রতীকায়িত। কবিতাটির রচনাকাল ১৯৬০-এর ১১ই জানুয়ারি। রবীন্দ্র উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’ পাঠ করে দামিনী কবিতাটির ভাবনা এসেছিল বিষ্ণু দে-র মনে। ‘চতুরঙ্গ’ পাঠে কবি তার মুগ্ধতার কথাও জানিয়েছিলেন। এই উপন্যাসে দামিনী চরিত্রটির মধ্যে বিষ্ণু দে পিপাসার যে অগ্নিমূর্তি দেখেছিলেন, জীবনের যে প্রাণময় বিষণ্নতাকে অনুভব করেছিলেন সেই জীবন-ভাবনা একদিকে যেমন দামিনীর অন্তর্লীন চেতনায় আচ্ছন্ন, অন্যদিকে তা কবি বিষ্ণু দে’র ও অন্বিষ্ট। এইভাবে উভয় কবির ভাবনা যখন একবিন্দুতে এসে মিশে যায় তখনই একজন রবীন্দ্র বিরোধী কবি হয়েও বিষ্ণু দে হয়ে ওঠেন রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্যের একজন সার্থক উত্তরসূরি। তাই ‘দামিনী’ কবিতাটির মর্মবস্তু অনুধাবনের জন্য আবশ্যিকভাবেই রবীন্দ্রসৃষ্ট ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটির পাঠ প্রয়োজন।
‘সবুজ পত্র’ পত্রিকায় ‘চতুরঙ্গ’ ‘উপন্যাসটি ১৩২১ বঙ্গাব্দে চারটি অধ্যায়ের ভিন্নধর্মী নামকরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসটির গঠন শৈলীর মধ্যেই রয়েছে বিবিধ পন্থায় জীবনের সত্যস্বরূপ আবিষ্কারের একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা । শচীশ-দামিনী-শ্রীবিলাস এই ত্রিকোণ সম্পর্কের অন্তগূঢ় সম্পর্ক ও তার পরিণতিই ‘চতুরঙ্গ’ ‘উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় বিষয়। উপন্যাসের নায়ক শচীশ নির্ভেজাল বুদ্ধিবাদ, ভক্তিসর্বস্ব রসবাদ প্রভৃতির মাধ্যমে জীবনকে খুঁজেছে। নায়ক শচীশের জীবন অনুসন্ধানের কার্যকরণের মতো উপন্যাসের গঠনটিও এক বৃত্ত থেকে আর এক বৃত্তান্তরে যাত্রা করেছে। তবে সর্বক্ষেত্রেই দেখানো হয়েছে চলমান জীবনের অনুসরণ। উপন্যাসের তৃতীয় অধ্যায়টির নাম দামিনী। দামিনীকে উপন্যাসে আমরা প্রথম দেখি লীলানন্দ স্বামীর আশ্রমে। এই আশ্রমে একমাত্র বিদ্রোহী সত্তা সে। অন্ধ ভক্তিরসের উন্মত্ত জীবন প্রবাহের মধ্যে সে এসেছিল রক্ত মাংসের জৈবিক দাবী নিয়ে। প্রকৃত অর্থেই সে ছিল জীবন রসের রসিক। লীলানন্দ স্বামী ও তার ভক্তদের মতো জীবনকে মায়ামাত্র মনে করার ঘোর বিরোধী সে। তার মতে এই জীবন অপ্রাকৃত একটি ধারণামাত্র নয়, অন্ধ ভক্তিরসের মদমত্ত প্রবাহে দামিনী কখনও আত্মসমর্পণ করেনি। আবার ননীবালার মতো অনিশ্চিত ভবিতব্যকে একমাত্র জেনে তার পায়ে আত্মসমর্পণও করেনি। লীলানন্দের আশ্রমের গতানুগতিক অন্ধ জীবন প্রবাহের অনুবৃত্তি ভেঙেছিল বলেই শচীশ মনে করে, “দামিনীর মধ্যে নারীর আর এক বিশ্বরূপ দেখিয়াছি। সে নারী মৃত্যুর কেহ নয়, সে জীবন রসের রসিক।…..সে সন্ন্যাসীকে ঘরে স্থান দিতে নারাজ, সে উত্তুরে হাওয়াকে সিকি পয়সা খাজনা দিবে না পণ করিয়া বসিয়াছে।”
দামিনী একদিকে যেমন পতিহীনা অন্যদিকে তেমন ভক্তিহীনা। শচীশের ভাবনায় ‘দামিনী যেন শ্রাবণের মেঘের ভিতরকার দামিনী। বাহিরে পুঞ্জপুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ।” দামিনী চেয়েছিল শচীশকে প্রিয়জ্ঞানে কাছে পেতে। কিন্তু শচীশ বিশ্বাস করে নারী সাধনার পথের সবথেকে বড়ো অন্তরায়। তাই বারবার কঠিন প্রত্যাখ্যানে সে দামিনীকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপর দামিনী শ্রীবিলাসকে বিবাহ করেছে। যদিও সে জানে সমস্ত সত্তা দিয়ে শ্রীবিলাসকে সে গ্রহণ করেনি । দামিনী শচীশকে লীলানন্দ স্বামীর আশ্রমের উন্মত্ত ভক্তিস্রোত থেকে বাইরে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন সে দেখেছে মর্ত্য কামনার আগুন দামিনীর সাথে সাথে শচীশকেও দগ্ধ করেছে, তখন সে চায়নি নিতান্ত হীন কামনার বশে শচীকা তার সাধনার পথ থেকে বিচ্যুত হোক। শচীশের পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত হয়ে শেষ পর্যন্ত দামিনী তাকে গুরুপদেই বরণ করে নিয়েছে। শচীশের সাধনার পথকে অমিলন রাখতেই সে শ্রী-বিলাসকে বিবাহ করেছে।
পশ্চিম সমুদ্রতীরে একদিন এক গুহার অন্ধকারে শচীশ দামিনীর বুকে আঘাত করেছিল। সেই আঘাতের স্থায়ী চিহ্ন বুকে নিয়ে দামিনী অসুস্থ হয়ে পড়ে। আঘাতের সেই বেদনায় ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসে দামিনীর শরীর। হারিয়ে যেতে থাকে তার লাবণ্য। শ্রীবিলাস ও দামিনীর দাম্পত্য জীবন যখন কূলপ্লাবী হয়ে জীবনরস সম্ভোগের বাসনাকে পূর্ণ করে তুলেছে, তখনই বুকের সেই গোপন ব্যথায় মৃত্যুমুখী হয়ে পড়েছে দামিনী। প্রায় ফুরিয়ে আসা জীবনের তীরে দাঁড়িয়ে দামিনীর বাঁচবার আকুলতা নিঃসীম কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। পশ্চিম সমুদ্রের উপকূলে যেখানে শচীশ তাকে আঘাত করেছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় মৃত্যুর অমৃত পাত্রে জীবনরস সম্ভোগের প্রবল বাসনা বুকে নিয়ে দামিনী জন্মান্তরে প্রেমের পূর্ণ স্বরূপে পৌঁছাবার আর্তি প্রকাশ করেছিল। উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “যেদিন মাঘের পূর্ণিমা ফাল্গুনে পড়িল, জোয়ারে ভরা অশ্রুর বেদনায় সমুদ্র ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, সেদিন দামিনী আমার পায়ের ধুলা লইয়া বলিল সাধ মিটিল না, জন্মান্তরে আবার যেন তোমাকে পাই।” দামিনী বুঝেছিল তার জীবন বর্ণনায় ভরা। শচীশের উপেক্ষা আর শ্রীবিলাসের প্রতিদানহীন ভালোবাসাকে অবহেলা করাই তাকে জীবন সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে। তাই জন্মান্তর চেয়েছে দামিনী। আকণ্ঠ জীবনতৃষ্ণা বুকে চেপে রেখে সে বলেছে, ‘সাধ মিটিল না’।
এখান থেকেই শুরু হয়েছে বিষ্ণু দে’র কবিতা দামিনী। তিনটি স্তবকে বিন্যস্ত এ কবিতার প্রথম স্তবকে রয়েছে দামিনীর ব্যথাদীর্ণ অন্তরের দীর্ঘশ্বাস। দ্বিতীয় স্তবকে রয়েছে বিষ্ণু দে র দামিনীর স্বরূপ। আর তৃতীয় স্তবকে দামিনী আর কবি একান্ত হয়ে বলছেন, একই জীবন যন্ত্রণার কথা। সেই সঙ্গে দামিনী হয়ে উঠেছে কবি বিষ্ণু দে-র চোখে প্রেমের পূর্ণতার একই প্রতিনাম। রবীন্দ্রনাথের নায়িকা দামিনী অবশ্য শ্রীবিলাসের প্রতিদানহীন প্রেমকেই পূর্ণতার একমাত্র অভিজ্ঞান রূপে চিনেছিল। কিন্তু বিষ্ণু দে-র চোখে শ্রীবিলাস নয়, দামিনীই এক অখণ্ড প্রতীকী সত্তা, প্রেমের পূর্ণতার প্রতীক। বিষ্ণু দে শ্রীবিলাসের সীমাবদ্ধ প্রেমের ভুবন অতিক্রম করে যেতে চেয়েছিলেন। আর এখানেই রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবি হিসাবে বিষ্ণু দে-র রবীন্দ্র ঐতিহ্য স্বীকরণের প্রত্যয় নিহিত।
‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটির শেষে রবীন্দ্রনাথ দামিনীর জন্মান্তর আকাঙ্ক্ষা ও প্রেমের পূর্ণস্বরূপে পৌঁছাবার আকুলতাকে যে স্থান কাল প্রতিবেশের স্পর্শে সার্থক করে তুলেছেন, প্রায় অনুরূপ ঘটনা চরিত্র পরিবেশ বিষ্ণু দেও ব্যবহার করেছেন,
“যেদিন সমুদ্র ফুলে ফুলে হল উন্মুখর মাঘী পূর্ণিমায়
সেদিন দামিনী বুঝি বলেছিল—মিটিল না সাধ।
পুণর্জন্ম চেয়েছিল জীবনের পূর্ণচন্দ্রে মৃত্যুর সীমায়
প্রেমের সমুদ্রে ফের খুঁজেছিল পূর্ণিমার নিলীমা অগাধ।”
মৃত্যুময় এক উপত্যকায় জীবনরস সম্ভোগের আকুলতা নিয়ে দামিনীকে চলে যেতে হয়েছিল। দামিনীর এই অতৃপ্তি, আকাঙ্ক্ষিত জীবনকে না পাওয়ার যন্ত্রণা—এই বিষয়টিই বিষ্ণু দে-কে ভাবিয়ে তুলেছিল। একই সঙ্গে কবি বুঝেছিলেন, প্রেম ভালোবাসার সমুদ্র মন্থনেই জীবনের পূর্ণচন্দ্রের স্বরূপ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ‘তুমি সমুদ্র’ কবিতাটির কথা এ প্রসঙ্গে মনে আসে।
“তুমি সমুদ্র জানি, আমি অন্তরীপ
খুঁজি না তোমার শেষ কোথা, কোথা তল
তোমার রহস্য তাই করি না জরিপ,
আমাদের জীবনে শুধু তরঙ্গ উচ্ছল
সমুদ্রের নীল তুমি, আমার সম্বল”
ভালোবাসার মধুরতম উচ্চারণ তুমি। এই ‘তুমিই’ বিষ্ণু দের কবিতার ‘ঝুলন পূর্ণিমা’ কখনও বা ‘রাসপূর্ণিমা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। দামিনীর প্রেমের সমুদ্রে ডুবে মরতে চেয়েছেন কবি। এই মৃত্যু জীবনেরই অন্য নাম। বেঁচে ওঠার নামান্তর।
“আমারও মেটে না সাধ তোমার সমুদ্রে যেন মরি
বেঁচে মরি দীর্ঘ বহু আন্দোলিত দিবস-যামিনী দামিনী?”
ফাল্গুনী পূর্ণিমার উন্মুখর সমুদ্র, দামিনী-প্রেমের যে অন্য প্রতিনাম আর কবির আকাঙ্ক্ষিত প্রেম সমুদ্র এখানে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বিষ্ণু দে-র চেতনায় প্রেম এখানে তার নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিগত ভূমিতে সীমাবদ্ধ নয়, সীমার প্রান্তভূমি ছড়িয়ে বহু ব্যাপ্ত হয়ে যাওয়ার জন্যই দামিনী হয়ে উঠেছে প্রেমের প্রতিমা। সীমায়িত প্রান্তভূমিতে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিকে প্রেমের উপলব্ধি বিষ্ণু দে-র কাব্যে এর আগেও শোনা গেছে,
“শ্রাবণে তোমার স্মৃতি, মাঘে থাকো চেতনায় মিলে
তোমার সত্তার সত্য, তোমাতে বা তোমাতে আমাতে
শেষ নয়, সে বরং ব্যাপ্ত হয়ে শব্দের তরঙ্গ যেন।”
দামিনী কবিতাটির মর্মবিন্দুতে পৌঁছাবার জন্য রবীন্দ্র উপন্যাস ‘চতুরঙ্গের’ পাঠ একান্তই প্রয়োজন। রবীন্দ্র প্রভাব বিষ্ণু দের কবিতায় বিষয় নির্মাণের অন্তপ্রেরণা হিসাবে কতখানি কাজ করেছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘দামিনী’ একথা বলা যায়।
Leave a comment