রবীন্দ্রনাথ বর্তমান থাকা কালেই যে বন্দ্যোপাধ্যায়-ত্রয়ী বাঙলা কথাসাহিত্যের প্রাঙ্গণে ভাস্বর হয়ে উঠেছিলেন, তাদের মধ্যে বয়ঃকনিষ্ঠ ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬ খ্রীঃ)। মানিকের পিতৃদত্ত নাম ছিল প্রবােধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্রজীবনেই (১৯২৮) তিনি ‘অতসী মামী’ নামক গল্পটি রচনা করে তার ডাক নামে (মানিক) একটি সাময়িকপত্রে পাঠালে তা মুদ্রিত হয় এবং তদবধি তিনি এই নামটিই সাহিত্য রচনায় ব্যবহার করে থাকেন। মানিকের জীবন ছিল স্বল্পায়ু, মাত্র ৪৮ বৎসর, তার শেষ ২৮ বৎসর তিনি সাহিত্য সাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন। প্রথমে অসুস্থতা, পরে মাদকাসক্তির কবলে পড়ায় মানিককে ক্লিষ্ট জীবন-যাপন করতে হয়েছিল। তাই তার রচনায় এক ধরনের বিষন্নতাবােধ বা মবিডিটির পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২৮ খ্রীঃ থেকেই সাহিত্য-রচনা শুরু করলেও মানিকের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ খ্রীঃ ‘জননী’ নামক উপন্যাস, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাস এবং ‘অতসী মামী’ ও ‘অন্যান্য গল্প’ সঙ্কলন। বলা প্রয়ােজন রচনাকালের হিশেবে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ই তাঁর প্রথম উপন্যাস। মানিক- রচিত মােট উপন্যাসের সংখ্যা ৩৯টি, তাদের মধ্যে প্রধান ও ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ (১৯৩৮), ‘সহরতলী’ (১ম পর্ব-১৯৪০, ২য় পর্ব-১৯৪১), ‘অহিংসা’ (১৯৪১), ‘চিহ্ন’ (১৯৪৭), ‘চতুদ্কোণ’ (১৯৪৮), ‘সােনার চেয়ে দামী’ (১৯৫১), ‘ইতিকথার পরের কথা’ (১৯৫২), ‘পাশাপাশি’, ‘সর্বজনীন’ (১৯৫২), ‘আরােগ্য’ (১৯৫৩), ‘পরাধীন প্রেম’ (১৯৫৫), ‘মাশুল’ (১৯৫৬) এবং ‘প্রাণেশ্বরের উপাখ্যান’ (১৯৫৬)।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত গল্পের সংখ্যাও বিস্তর। অন্ততঃ ১৬ খানা গল্প-সংকলন গ্রন্থ ছাড়াও অনেকগুলি ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়েছে। গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য- ‘প্রাগৈতিহাসিক’ (১৯৩৭), ‘মিহি ও মােটা কাহিনী’ (১৯৩৮), সরীসৃপ (১৯৩৯), ‘সমুদ্রের স্বাদ’ (১৯৪৩), ‘আজ-কাল-পরশুর গল্প’ (১৯৪৬), ‘খতিয়ান’ (১৯৪৭), ‘মাটির মাশুল’ (১৯৪৮), ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ (১৯৪৯), ‘লাজুকলতা’ (১৯৫৪) প্রভৃতি। এ ছাড়া ‘ভিটেমাটি’ (১৯৪৬) নামে তার একখানি নাটক এবং ‘লেখকের কথা’ (১৯৫৯) নামক প্রবন্ধ গ্রন্থিও আছে।
রবীন্দ্রোত্তর যুগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একজন বিশেষ শক্তিমান লেখক রূপে স্বীকৃতি হলেও তার সাহিত্যমূল্য বিচারে প্রচুর মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। তবে এক বিষয়ে সকলেই প্রায় একমত যে, তার সাহিত্য-জীবনকে পরিধি এবং উত্তরার্ধরূপে চিহ্নিত করা হয় তাঁর সাহিত্যের মূল্যমানের ভিত্তিতেই। মানিক একজন বাস্তবতাবাদী বা রিয়্যালিস্ট সাহিত্যিক, অনেকেই এ বিষয়ে তাকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায়ও ভূষিত করেন। এই উভয় পর্বেই কিন্তু বাস্তব চেতনা সমানভাবে সক্রিয়। মােটাদাগে এই দুই পর্বের বিশিষ্টতা এমন ব্যাখ্যা করা চলে- প্রথম পর্বে ছিল ফ্রয়েডীয় প্রভাববশতঃ জৈব-প্রবৃত্তির আতিশয্য, দ্বিতীয় পর্বে ছিল মার্ক্সীয় প্রভাববশতঃ প্রকট উদ্দেশ্যপ্রবণতা।
একদল সমালােচনা মনে করেন, “প্রথম পর্যায়ে কল্লোলের উত্তরাধিকার লইয়া তিনি মানব চৈতন্যের গভীর তলদেশে বিচরণ করিয়া ফিরিয়াছেন। সমাজ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নাগরিক জীবনকে কতখানি নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করিয়াছে, তাহারই নিপুণ চিত্র তিনি আঁকিয়াছেন দ্বিতীয় পর্যায়ে” (ভবতােষ দত্ত)। কিন্তু এই দ্বিতীয় পর্যায়ের উপন্যাসে তাঁর স্বতস্ফূর্ততা এবং সহজতা অনেকখানি শৈথিল্যপ্রাপ্ত হয়েছে এবং শিল্পগুণের বিচারে তার প্রথম পর্বের উপন্যাসগুলি, জৈব তাড়নার বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে অনেক বেশি রসসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। আবার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নমতাবলম্বী সমালােচকও রয়েছেন যথেষ্ট।
বিশেষতঃ মার্ক্সবাদী সমালােচকগণ মনে করেন যে মানিক প্রথম জীবনে যে ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়েছিলেন, সেই “ফ্রয়েডবাদ আসলে একটি অপবিজ্ঞান। এবং যেহেতু অপবিজ্ঞান, সেইহেতু সাহিত্যে অপসংস্কৃতির একটি মূল কারণ।…মানিক এই ফ্রয়েডীর আবেশে বহুদিন আচ্ছন্ন ছিলেন যা তার সাহিত্যের প্রভৃত ক্ষতিসাধন করেছিলেন।…’সহরতলী’র পর থেকে মানিকের লেখায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক অন্তনিবেশের পরিবর্তে ক্রমশঃ বহির্মুখিনতার ঝোক বাড়তে থাকে। এটি একটি সুস্থ দিকবলয়, শুভ পরিবর্তন” (নারায়ণ চৌধুরী)।
বিষয়বস্তু এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে মানিকের উপন্যাসসমূহকে রচনাকাল অনুযায়ী তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। প্রথম পর্যায়ের বিশেষ উল্লেখযােগ্য রচনা ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ও ‘পদ্মানদীর মাঝি’। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে যে এই তিনটি গ্রন্থকেই অনেকে মানিকের শ্রেষ্ঠ রচনার স্বীকৃতি দান করে থাকেন। তার প্রথম রচনা ‘দিবারাত্রির কাব্যে যে প্রতিশ্রুতি ছিল, দুঃখের বিষয় তা কখনাে পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠবার সুযােগ পায় নি। মানিকের প্রায় সমস্ত রচনাতেই ফ্রয়েডীয় মনােবিকলনের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকলেও এই প্রথম পর্যয়ে তিনি সচেতন বাস্তবতাবােধ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি-বিষয়ে বিশেষভাবে অবহিত ছিলেন। জীবনের প্রেক্ষাপটেই তিনি এই বাস্তবতাকে বুঝতে চেয়েছিলেন। রােম্যান্টিকতা এবং রূপকের বহুল প্রশ্রয় সত্ত্বেও এটি লেখকের গভীর বাস্তব সচেতনতার শিল্পরূপ।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ এবং ‘পদ্মানদীর মাঝি’—এ দুটির মধ্যে কোটি মানিকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, এ বিষয়ে মতভেদের অবকাশ রয়েছে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রধানতঃ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাববাদের দ্বারা প্রভাবিত এবং সমষ্টিচেতনা বর্জিত হলেও গঠনপরিকল্পনা এবং চরিত্র রূপায়ণ ও তার উপস্থাপনা অনেক বেশি শিল্পসম্মত। জনৈক বিজ্ঞ সমালােচক বলেন- “এই উপন্যাসে এ ধরনের বাস্তব সমস্যার রূপায়ণ তার কাম্য নয়—এখানে লেখক পরিচিত জগতের বাস্তব রূপকে স্বীকার করেও তার উপর যেন অন্যতর এক অধিবাস্তবতার বা ‘সুপাররিয়েলিটি’র আবরণ ছড়িয়ে দিতে চান।”
‘পদ্মানদীর মাঝি’ লেখকের মহত্তম না হলেও যে অন্ততঃ সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস এ তথ্য অস্বীকার করবার উপায় নেই। পূর্ব বাঙলার আঞ্চলিকতার লক্ষণযুক্ত এইটিই প্রথম উপন্যাস; বাস্তবতার বহিরঙ্গ উপাদানবিন্যাসগুণে এটি একটি পূর্ণায়ত বাস্তবধর্মী এবং শিল্পাদর্শসম্মত উপন্যাসে পরিণত হয়েছে। অধিকন্তু সামূহিক জীবন-চেতনাও এতে সুস্পষ্ট রূপ লাভ করেছে। দরিদ্র শ্রমজীবীদের জীবনালেখ্য এতে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মানিকের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তারই প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনায়। তিনি ফ্রয়েডীয় মােহ থেকে কিছুটা মুক্ত হয়ে আর্থনীতিক এবং সমাজবাদী বাস্তবতার দিকে মুখ ফেরালেন। বিপর্যস্ত জীবনবােধের কঠিন বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় এই পর্বের ‘চিহ্ন’, ‘স্বাধীনতার স্বাদ’, ‘সর্বজনীন’ প্রভৃতি উপন্যাসে। সমকালীন জীবনের বিশ্বাস্য চিত্ররূপে গৃহীত হলেও এ পর্যায়ের উপন্যাসগুলি যথার্থ শিল্প সফলতা লাভ করতে পারেনি।
তৃতীয় পর্যয়ের সূচনা ‘আরােগ্য’ উপন্যাস থেকে। সমাজ বাস্তবতার প্রত্যয়ে অবিচল থেকেও তিনি যেন আবার প্রথম পর্যায়ের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও মনােবিশ্লেষণের যুগে ফিরে গেলেন। কিন্তু এই পর্যায়ে তার ব্যক্তি-জীবনের উন্মা্গামিতা তাঁর শিল্পবােধকেও অনেকখানি ক্ষুন্ন করেছে। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন- “শেষ জীবনে তিনি বিশৃঙ্খল জীবনে ঘূর্ণির তলে তলিয়ে গিয়েছিলেন, এ যুগে লেখা তাঁর উপন্যাস ও ছাটগল্পে তাই সেই উন্মত্ত ঘূর্ণিবেগের স্পর্শ আছে, যা যথার্থ শিল্পসৃষ্টির পরিপন্থী।”
মানিকের সাহিত্য যেখানে এসে মােড় ঘুরেছিল, সেখানেই প্রথম সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘সহরতলী’ উপন্যাসের দু’টি খণ্ড। মার্কসবাদে দীক্ষিত হবার পূর্বেই তিনি যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবােধে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এইখানেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। তার শ্রেষ্ঠ রচনাসমুহের মধ্যে এটিকেই অন্যতম বলে স্বীকার করতে।
ছােটগল্পের বাস্তবতাবাদী বা রিয়্যালিস্ট লেখকরূপে মানিকের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তবে তার ছােটগল্পের ধারায় লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই-তার প্রথম পর্বের রচনায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, অস্তর্মুখিতা এবং বিশ্লেষণাত্মক অথচ মর্বিড দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিচয় পাওয়া যায়, উত্তরপর্বের রচনায় তা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বহির্মুখী সামূহিক চেতনায় দীপ্ত এবং প্রতিবাদী শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন। তার প্রথম পর্বের ‘সরীসৃপ’ আর ‘টিকটিকির জগৎ’ থেকে পরবর্তী পর্বের ‘মাসিপিসি’, ‘হারানের নাতজামাই’ বা ‘পেটব্যথা’ গল্পে পৌছুলেই বুঝতে পারবাে, কীভাবে তিনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক মর্বিড জগৎ থেকে বহির্মুখী সমষ্টি জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সাধারণভাবে বলা যায়, প্রথম পর্বের ছােটগল্পে মানিক প্রধানতঃ মধ্যবিত্ত জীবনের মনস্তত্ত্বকে শিল্পসম্মত উপায়ে রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন এবং পরবর্তী পর্বে শ্রমজীবী ও কৃষকদের সামূহিক জীবনবােধ ও গণচেতনা সঞ্চার করতে চেষ্টা করেছেন তার ব্যক্তি-জীবনের রূপান্তরই এতে প্রতিফলিত হয়েছে।
Leave a comment