: আধুনিক বংলা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯-১৯৫৪)। সারাজীবন তিনি বাংলার প্রকৃতিতে অবগাহন করেছেন এবং পাঠককেও সাথে সাথে সেই প্রকৃতিতে অবগাহন করিয়েছেন। পাঠক আজো বাংলার রূপ- মাধূর্যকে সন্ধান করেন জীবনানন্দ দাশের কাব্যকথায়; নিত্যই তাঁর কবিতা নবতর আত্মা-পাঠককে আকর্ষণ করে। সমালোচক অশোক মিত্র যথার্থই বলেছেন: “সেই যে জীবনানন্দ তাঁর জাদু দিয়ে আচ্ছন্ন করলেন, তার ঘোর কখনোই কাটলো না।” আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্যে চল্লিশের দশকের শুরু থেকে রবীন্দ্রযুগে-রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হয়ে যিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন- নিজেই যিনি মগ্নতন্ময়তার জগৎ সৃষ্টি করলেন- জনপ্রিয়তার উচ্চশিখরে যিনি অধিষ্ঠিত হলেন- তিনিই রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসি বাংলা’র রূপমুগ্ধতায় অবগাহন করে ‘ঝরা পালক’এর সাহায্যে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র রঙে গাঙুড়-ধলেশ্বরী-ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে বসে ইতিহাসের আলোকে-প্রকৃতির সান্নিধ্যে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’য় ‘সাতটি তারার তিমির’এ ‘মহাপৃথিবী’র রূপকল্প নির্মাণ করেছেন- ভেবেছেন ‘বনলতা সেন’, শঙ্খমালা, মণিমালাদের কথা।
শুধু বিষয়গত ও আঙ্গিকগত দিক দিয়ে নয়, জীবনানন্দের বিরাট কৃতিত্বের একটি প্রধান নির্ভর কাব্য প্রচলনকে বর্জন এবং নতুন কাব্য ভাষা সৃষ্টি। তিনি ছিলেন মূলত চিত্রকল্পের কবি। একটির পর একটি চিত্রকল্প জড়ো করে যে ভাষা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তা তাঁর একান্ত নিজস্ব। নান্দনিক ভাবনায় বৈশ্বিক শিল্প কুশলতায় সমৃদ্ধ তাঁর উপমা, রূপক ও চিত্রকল্প গুলো তাঁর কবিতাকে দিয়েছে নবতর ব্যঞ্জনা। সমালোচক দীপ্তি ত্রিপাঠী জীবনানন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন তাঁর উপমা-নির্মাণকে। তাঁর মতে জীবনানন্দের “উপমাগুলি বাংলা সাহিত্যের একটি প্রধান ঐশ্বর্য।” প্রবাদ আছে “উপমা কালিদাসস্য;”। তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘ঝরাপালক’ (১৯২৮), ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৬১) ও ‘সুদর্শনা’ (১৯৭৩)।
ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিবর্ণ-বিষণ্ণতা তাঁর কবিতার প্রধান সুর বা মর্মকথা। কবি বলেছেন- “সকলেই কবি নয়- কেউ কেউ কবি; কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতর চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা আছে।” সাধারণ মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জীবনানন্দের কবিচৈতন্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের যুগযন্ত্রণার প্রত্যক্ষদর্শী কবি। জীবনের বৃহৎ ও ব্যাপক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে কবি সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের ভুবন। কবি চিত্রিত করেছেন তরঙ্গক্ষুব্ধ যুগের হৃদয়হীনতা, স্বার্থপরতা, বিদ্বেষ, লোভ, নৈরাজ্য আর সাধারণ মানুষের জীবনে অস্তি ত্বের যন্ত্রণায় রক্তাক্ত ছবি। তিনি কবিতার মাধ্যমে এই অন্ধকার দূর করার জন্য কলম ধরেন। তাই অনেকে কবির কাব্যের এই বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে ‘বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কবি তাঁর প্রথম কাব্যেই নিজের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য জানিয়েছেন-
‘আমি কবি, সেই কবি,-
আকাশের কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি।
আন্মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিল মেঘের পানে।’
[আমি কবি, সেই কবি: ঝরা পালক।]
জীবনানন্দ দাশ কবিজীবনের শুরু থেকেই ছিলেন ইতিহাস সচেতন কবি। অম্বজ বসু তাঁর “একটি নক্ষত্র আসে” গ্রন্থে ‘জীবনানন্দের কবিতায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও পুরান প্রসঙ্গের একটি পরিচিতমূলক তালিকা দিয়ে দেখিয়েছেন যে সমকালের চেয়ে অতীত ইতিহাস দিকেই কবির ঝোঁক বেশি। কবি নিজেই “কবিতার কথা” রচনায় জানিয়েছেন- “মহাবিশ্বলোকের ইশারার মতো উৎসারিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতি সাধক অপরিহার্য সত্যের মতো”। জীবনানন্দের প্রথম কাব্য ‘ঝরা পালকে’র বিভিন্ন কবিতায় মিশর, গ্রীক, ইউরোপ ও এশিয়ার নানা দেশের কথা উল্লিখিত হয়েছে। ‘পিরামিড’, ‘মিশর’, ‘মরুবালু’, ‘চাঁদনীতে’ প্রভৃতি কবিতায় দূর ইতিহাসকে তিনি স্পর্শ করেছেন। ‘পিরামিড’ কবিতায় রয়েছে ‘অতীতের শোভা যাত্রা’র বর্ণময়তা ও বিষন্নতা। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যে কবির ইতিহাস-চেতনার রূপ বিবর্ণ। এখানে তিনি মৃত্যু চেতনার মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেছেন। ‘বনলতা সেন’ কাব্যে কবি আবার ইতিহাস চেতনাকে আশ্রয় করেছেন। ‘বনলতা সেন’ কাব্যকে কোন প্রেমের কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা যথাযথ হবে না। এ কাব্যের কবিতার পর কবিতায় যে ইতিহাস চেতনা জাগ্রত তা সমগ্র বাংলা কাব্যে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনানন্দ প্রাণদায়িনী উৎসের সন্ধানে যাত্রা করেছেন, খুঁজেছেন তাকে বিভিন্ন ঐতিহ্যের মধ্যে-পেগান, গ্রীস, কনফুশিয়াসের চীন, ধর্মাশোকের ভারতবর্ষে। এছাড়া মহেন্দ্র, ভূমধ্যসাগর, হিন্দু, ফিনিশিয় প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার করে তুলেছেন বিশ্বের। ধ্বংস প্রাপ্ত সুপরিচিত নানা সভ্যতার নান বিষয় তিনি বার বার উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন সভ্যতা, ঐতিহ্য, পুরাণ, ইতিহাস থেকে উপমা সংগ্রহ করেছেন। ইতিহাস বোধের ফলেই এই বিশ্বাসে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ইতিহাস চেতনা কবির প্রেমিকাকে মানবিকতায় পৌছে দিয়েছিল। যুদ্ধোত্তর কালের জীবন যুদ্ধে রক্তাক্ত কবি হৃদয় শান্তি সন্ধানী ইতিহাসের মধ্যেই। কবি জানাচ্ছেন-
“ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত শত
শত জল ঝর্নার ধ্বনি।”
[হে হৃদয়: বেলা অবেলা কালবেলা।]
জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতি প্রেমিক-প্রকৃতির রূপকার। প্রকৃতি সখ্যতা নির্জনতা তাঁকে কিছুটা অন্তর্মুখী করলেও জীবনের রসোপলব্ধিতে সাহায্য করেছে তার প্রত্যয়, যা অভিজ্ঞতা ও সংবেদনশীলতা থেকে উদ্ভূত। আর এ কারণেই শান্ত মাটির নিবিড় একাত্মতায় তাঁর কাব্যে শোনা যায় অসীম অন্তরঙ্গতার সুর। কবির সংবেদন মনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠরূপ প্রতিবিম্বিত হয়েছে বাংলার রূপে। এ বাংলাদেশের স্থল, জল, আকাশ, নক্ষত্র; এই বাংলার পশুপাখি, তরু-লতা-ফুল-ফল; এই বাংলার নরনারী, রূপকথার নারী- সবাই মিলে শতাব্দীর পরে শতাব্দী দেশকে ধন্য করেছে। তাই তিনি অন্যত্র পৃথিবীর রূপের সন্ধান করেননি। কবির ভাষায়-
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাইনা আর; অন্ধকারে জেগে ওঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড় পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েল পাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ।”
[বাংলার মুখ আমি: রূপসী বাংলা]
‘রূপসী বাংলা’য় কবি বাংলার রূপে পরম পরিতৃপ্ত। শেষ পর্যায়ে কবির প্রকৃতি চেতনা বিশ্ব চেতনায় রূপ লাভ করেছে। অবশ্য একটি পর্যায়ে গিয়ে জীবনানন্দের কাছে নারী ও প্রকৃতি সমার্থক হয়ে উঠেছে।” বনলতা সেনের শরীরকে কবি সবুজ ঘাসের দেশে প্রতীকায়িত করেছেন, দারুচিনি দীপের ভেতরে অন্ধকারে তাকে দেখেছেন। ‘হরিণেরা’, ‘হায়চিল’, ‘শঙ্খমালা’ প্রভৃতি কবিতায় প্রকৃতির অনুষঙ্গে কবি, নান্দনিক সৌন্দর্যে বিগত নারীকে স্মরণ করেছেন। ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে নারীর রূপ বর্ণনায় কবি আভা দীপ্তি প্রতিভার মতো উজ্জ্বল্যদ্যোতক শব্দগুলোকে বেছে নিয়েছেন যা আলোকদেশি তাই তিমির হন্তারক। জীবনানন্দের সব কাব্যের প্রেমিকারা সব সময়ই প্রকৃতির পটভূমিকায় উপস্থাপিত। তাইতো কবি বলেছেন-
কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে;
আমার চোখের ‘পরে আমার মুখের ‘পরে চুল তার ভাসে;
পৃথিবীর কোন পথ এ কন্যারে দেখেনিকো- দেখি নাই অত
অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত,
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে
পৃথিবীর কোন পথে।
[আকাশে সাতটি তারা: রূপসী বাংলা]
কবি জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রযুগে আবির্ভূত হয়ে স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত হয়েছেন; হারিয়ে যাননি ধূসর পাণ্ডুলিপির বিষণ্ণ নির্জনতায়। জীবনানন্দের “ঝরাপালক” [১৯২৭] কাব্য থেকে “সাতটি তারার তিমির” [১৯৪৮] পর্যন্ত সব কাব্যেই রয়েছে। ঐতিহ্য চেতনার পরিচয়। “ঝরা পালক” এবং “ধূসর পাণ্ডুলিপি” [১৯৩৬) যুগে শুধু তৎকালীন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা নতুন সমাজ চেতনায় কবিকে উদ্বুদ্ধ করেনি। এ সম্পর্কে নিখিলেশ্বর সেনগুপ্ত বলেন: “এর পিছনে ছিল সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংসের মন্ত্র- সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। সাধারণ মানুষের প্রতি জীবনানন্দের একাত্মণুভূতি বিশেষকরে এই সময়েই জেগে ওঠে। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি নিবিড় ভালোবাসা তাঁর কবিসত্তাকে আলোকিত করে। সমসাময়িক বোধ-যন্ত্রণা ও সমস্যার প্রকাশে ঝরা পালকের কবিতা আধুনিক হয়ে উঠতে পেরেছে।” তবে মগ্নচৈতন্যের কবি জীবনানন্দের জীবন তন্ময়তার নিবিড় রূপ ধরা পড়েছে ‘ঝরা পালক’ গ্রন্থে।
জীবনানন্দের প্রথম পর্বের কাব্যগুলোতে নারীদের তিনি মূর্ত থেকে বিমূর্তরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ঝরাপালক” কবির অস্পষ্ট, অনির্দেশ্য প্রেমব্যাকুলতার প্রকাশ পরিলক্ষিত; যা বাস্তবতা থেকে বহুদূরের কল্পনার জগতে কবিকে নিয়ে যায়। সে কারণে এ কাব্যের নারীরা বাস্তবের জগতের বাসিন্দা নয়। তারা অনেকটা কল্পনাশ্রয়ী, অতীতচারী। অতীত ইতিহাস, পুরাণ, রূপকথা, লোককথায় এই নারীরা বিরাজ করে-
মেঘ বৌ’র খোঁপাখসা জ্যোৎস্না ফুল চুপে চুপে ঝরে,
চেয়ে থাকি চোখ তুলে-যেন মোর পলাতক প্রিয়া।
[অস্তচাঁদে ঝরাপালক]
“ঝরা পালক” কাব্য-ভাবনার সম্প্রসারিত প্রকাশ লক্ষ করা যায় “ধূসর পাণ্ডুলিপি” কাব্যে। কাব্যদুটির নামকরণে বিষণ্ণতা, বেদনা, দুঃসময়, নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যের মনোভাব বিদ্যমান। আধুনিক যুগে জীবনের মূল্যবোধগুলি যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে জীবনানন্দ দাশ সে-কথা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন “ধূসর পাণ্ডুলিপি” কাব্যপর্বে।
জীবনানন্দ দাশের বহুল আলোচিত ও কবিখ্যাতি দ্যোতক কাব্যগ্রন্থ “বনলতা সেন” (১৯৪২]। এ কাব্যে ইতিহাস- ঐতিহ্য-নারী-প্রকৃতি যেন হাত ধরাধরি করে আছে। এ কাব্যের মোট কবিতার সংখ্যা ত্রিশটি। সবগুলো কবিতাই কবির স্বতন্ত্র প্রতিভার মহিমায় দেদীপ্যমান। কবিতাগুলোতে ধরা পড়েছে সংশয় যুগের ক্ষত-বিক্ষত চিহ্ন। দুঃসহ জীবনবোধ, রোমান্টিক ভাবনায় জীবনের জটিলতা, অচরিতার্থতা, প্রেম নৈরাশ্য, ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতা। কবি জীবনের সবৈধ সুখের খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে মুখ লুকিয়েছেন প্রকৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কখনো বা পরাবাস্তববাদে। জীবনানন্দ দাশের “ঝরাপালক” থেকেই ইতিহাসচেতনার পরিচয় পরিস্ফুট। জীবনানন্দের ইতিহাসচেতনা তাঁর সমকালীন যুগের মূল্যবোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার মধ্যে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব সমগ্র যুগ-যুগান্তর, রয়েছে আবিষ্কৃত, অনাবিষ্কৃত সভ্যতা, উর, ব্যাবিলন, নিনেড, মিশর, বিদিশা। জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় সময় বা কালকে প্রয়োগ করেন একটি চলমানতার সমগ্র মানব ইতিহাসের জীবন ধারার প্রবহমানতার প্রতীক স্বরূপ। যেমন-
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মালয়, সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে।”
[বনলতা সেন। বনলতা সেন।]
“মহাপৃথিবী” (১৯৪৪] কাব্যটি যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর কাব্যিক দলিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে যান্ত্রিক সভ্যতার নির্মমতার পরিচয় লাভ করল পৃথিবী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৌঁছে যেতে জীবনানন্দ দাশও উপলব্ধি করেছেন-পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো নিভে গেছে; এবং- “পৃথিবী আজ সৌন্দর্যেরে ফেলিতেছে ছিড়ে।” -(মনোবীজ)। এ কাব্যে কবি জীবনানন্দ দাশের চিন্তা-চেতনার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে। একাব্যে স্বপ্ন ও বাস্তব দুই’ই বিমিশ্র রূপায়িত।
বস্তুত বিশ্বযুদ্ধোত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিপর্যয় কবিকে বিচলিত করেছে। ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের তীব্রতর দ্বন্দ্বের যুগ-মন্ত্রণা তিনি অনুভব করেছেন নিবিড়ভাবে। ফলে তাঁর কাব্যে বিষয়গতভাবে যেমন প্রকৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনা ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয়ে গেছে; তেমনি আঙ্গিকে এসেছে অভিনবত্ব। “জীবনানন্দ প্রকৃতিকে তাঁর জীবন সত্তা দিয়ে গ্রহণ করেছেন, আর তা প্রকাশ করেছেন সমগ্র কবিসত্তা দিয়ে। আর একারণেই তাঁর ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যে তিক্ত, ক্লান্তিকর, গ্লানিময়, অসহ ভারাতুর বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে। কবি এ কাব্যে মানুষের বিকৃত জীবন ও বুদ্ধিকে যেমন শনাক্ত করেছেন- তেমনি একইসাথে তুলে ধরেছেন স্বপ্ন ও বাস্তব দুই-ই বিমিশ্র রূপ।”
“সাতটি তারার তিমির”-এ নামের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিনাশী সময়ের অশনি সংকেত। আলোকিত তারার ভুবনে আসে তিমিরাত্মক অন্ধকার। দুটি বিশ্বযুদ্ধ মানুষের জীবনে যে সামূহিক বৈনাশিক বিপর্যয় ডেকে আনে, সভ্যতার ও সমাজ বাসিন্দাদের মুখোমুখি হতে বাধ্য করে পৃথিবীর; সে পৃথিবীরই ভাব-ভাবনার বাস্তব কাব্যরূপ এ কাব্যটি।
জীবনানন্দ দাশ বেড়ে উঠেছেন পূর্ব বাংলায় বরিশালের ধানসিঁড়ি নদীর তীরে যেখানে তিনি প্রকৃতির মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন জীবনের চরম আনন্দ এবং পরম তৃপ্তি। তিনি বাংলার প্রাকৃতিক রূপ-রসকে আস্বাদন করেছেন; আর তার ফসলই তাঁর কাব্যসমূহ। প্রকৃতিও তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছে সাহিত্যের উপকরণ। তিনি এই পরিবেশ থেকে গড়ে তুলেছেন তাঁর মানস-বৈশিষ্ট্য। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যে কবি জীবনানন্দ দাশের চিন্তা-চেতনার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে। একাব্যে স্বপ্ন ও বাস্তব দুই’ই বিমিশ্র রূপায়িত। সমকালীন বৈশ্বিক টানাপোড়েনের সাথে আত্মগত রক্ত হৃদয়ের করুণ স্বাক্ষর এ কাব্যটি। ‘সাতটি তারার তিমির’-এ নামের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিনাশী সময়ের অশনি সংকেত। আলোকিত তারার ভুবনে আসে তিমিরাত্মক অন্ধকার। জীবনানন্দ দাশ প্রকৃত অর্থেই একজন অতি আধুনিক কবি এবং আধুনিক রীতির প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিবর্ণ-বিষণ্ণতা তাঁর কাব্যের মূল সুর ও মর্মকাহিনি। সাধারণ মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জীবনানন্দের অপরিসীম। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের নাটকীয়তা ও বীভৎসতার প্রত্যক্ষদর্শী কবি। জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্পগুলিতে পঞ্চেন্দ্রিয় গ্রাহ্য অনুভূতির লক্ষণ প্রকাশমান। দৃশ্য, গন্ধ ও স্পর্শানুভূতির সঙ্গে তাতে ইতিহাস চেতনার মিশ্রণে এক ইন্দ্রিয়ঘনতা দানা বেঁধেছে। জীবনানন্দ বিরূপ সমাজের, যুগের প্রেমের অচরিতার্থতার রূপ দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন, সৌন্দর্যহীনতায় দীর্ণতা অনুভব করেন। এ কারণেই তিনি প্রেমের ও সৌন্দর্যের প্রকৃত স্বরূপকে খুঁজেছেন ভূগোল ও ইতিহাসের বৃহত্তর পটে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে বনলতা সেন, অরুণিমা, সান্যাল, সুদর্শনা, শ্যামলী, শঙ্খমালা, সুরঞ্জনা, সবিতা, সুচেতনা ইত্যাদি নাম। তাঁর কবিতার প্রেম ও প্রকৃতি, তাঁর কবিতার ইতিহাস-চেতনা ও সমাজ- রাজনীতি চেতনা, তাঁর কবিতার ব্যক্তি ও স্বদেশ, তাঁর জীবন ও মৃত্যুচিন্তা সমস্ত মিলে তাঁর কবিতার এক আলাদা ও একক পৃথিবী তৈরি করেছে। যে পৃথিবী রবীন্দ্রনাথের মতো কল্যাণময়ী নয়, নজরুলের মতো আশাবাদী নয়; সে পৃথিবী আমাদেরই যেখানে আশা নিরাশার হাত ধরাধরি করে চলে। বস্তুত তাঁর কবিতায় আধুনিক যন্ত্রযুগের হতাশা, শূন্যতা, অস্তিত্বের সঙ্কট ঈত্যাদি নিয়ে এক স্বতন্ত্র ভুবন সৃষ্টি করেছে। তবে অন্ধকারের চিত্র নির্মাণের সাথে সাথে মুক্তিরও সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় হতাশা-ক্লান্তি-অন্ধকার বৈশ্বিক অস্থিরতা- ধ্বংস থাকলেও কবি সেগুলোকে বিনাশ করতে চেয়েছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment