রবীন্দ্রবিরোধী কবি হিসাবে যে পাঁচজন কবি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা কাব্যক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা এতটাই অপ্রতিরোধ্য ছিল যে তা উত্তরকালের কবিসমাজকে খুব সহজেই মায়াবী সুরে মোহাচ্ছন্ন করে তুলেছিল। ফলে রবীন্দ্রানুসারী একদল অক্ষম কবিসমাজ রবীন্দ্রনাথের জীবীতকালেই বাংলা কাব্যকলাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল। ফলে রবীন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যধারায় যে উচ্ছ্বলতা এনেছিলেন তা আবার বিলম্বিতলয়ে বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু কেন এমন হল—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু নিজেই এর দুটি কারণ দেখিয়েছেন। প্রথমত, রবীন্দ্রকাব্য মারাত্মককরূপে প্রতারক তা সম্মোহন করে কিন্তু সতর্ক করে না। দ্বিতীয়ত, উত্তরপর্বের কবিসমাজ শুধু বাঁশি শুনে মজেছিল, কিন্তু তার সত্যাসত্য বিচার করবার প্রয়োজনবোধ করেননি। তবে এই সবরকম যুক্তিতর্কের পরে বুদ্ধদেব বসুকে আপাত অর্থে রবীন্দ্র বিরোধী মনে হলেও নানা চিঠিপত্র, ব্যক্তিগত সম্পর্কের উম্মুতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি তিনি অনেক বেশি রবীন্দ্র আপ্লুত কবি। নতুন সাহিত্যপথের সন্ধানে অথবা নতুনতর সাহিত্যরচনার ঝোঁক থেকেই তিনি রবীন্দ্রবৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।

প্রথম শৈশবের দিনগুলিতেই বুদ্ধদেব মানসিকভাবে রবীন্দ্রনাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’ পড়ার সুখস্মৃতি বর্ণিত হয়েছে বুদ্ধদেবের বিভিন্ন লেখায়। শৈশবে কৈশোরের দিনগুলিতে এভাবেই রবীন্দ্র আপ্লুত ছিলেন বলেই পরবর্তী দিনগুলিতেও রবীন্দ্রনাথেই শান্তির ছায়া, বিশ্বাসের পরম আশ্রয় পেয়েছিলেন। তাই প্রথম যৌবনে কল্লোলের প্রবল কোলাহল মনে রেখেও লিখতে পেরেছিলেন— 

“রবীন্দ্রঠাকুর শুধু আজি হতে শতবর্ষ পরে 

কবিরূপে রহিবেন কুমারীর প্রথম প্রেমিক, 

প্রথম ঈশ্বর বালকের, বৃদ্ধের যৌবনঋতু,

সকল শোকের শান্তি, সব আনন্দের সার্থকতা 

শক্তির অশেষ উৎস, জীবনের চিরাবলম্বন।”

রবীন্দ্রনাথের মহিমার অন্যান্য দীপ্তি এভাবেই বুদ্ধদেব বসু গ্রহণ ও স্বীকরণ করেছিলেন। বুঝেছিলেন এক জীবনে বহুবার নতুন জন্মান্তর দিতে পারেন একমাত্র রবীন্দ্রনাথ। আধুনিকতার প্রথম লক্ষণ যদি মুক্ত চিন্তা হয়, তবে তা রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। রবীন্দ্র পরবর্তী বহু কবির কাব্য রচনার প্রগলভতা ছাড়িয়েও তিনি রবীন্দ্রনাথে হয়ে উঠেছেন অবিচল প্রত্যয়নিষ্ঠ। “শীতের প্রার্থনা বসন্তের উত্তরে’ বুদ্ধদেবকে তাই বলতে শুনি,

আজ মধ্যবয়সের প্রান্তে এসে 

আজও দেখি জীবন-সর্বস্ব তুমি। তোমারি গভীর

উৎস হতে আমি উৎসারিত।

রবীন্দ্র বিরোধিতার ব্রাক্ষ্মলগ্নে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসু যথার্থই বুঝেছিলেন আধুনিক কবিদের প্রতিষ্ঠা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে কখনই সম্ভব নয়। আবার রবীন্দ্র অনুবৃত্তির মধ্য দিয়েও আধুনিক কবির প্রতিষ্ঠালাভ অসম্ভব। রবীন্দ্রসৃষ্টির মোহজালে বাঁধা পড়ে যদি তাঁরা কাব্যক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য না আনেন, তবে অচিরেই তাদের অবলুপ্তি ঘটবে। সেই সময়ের অনুভূতিগুলোকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “গুরুদেবের কাব্যকলা মারাত্মকভাবে প্রতারক; সেই মোহিনী মায়ার প্রকৃতি না বুঝে বাঁশি শুনে ঘর ছাড়লে ডুবতে হবে ‘চোরাবালি’তে।” আবার কল্লোলযুগের কবিদের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, “যাকে কল্লোল যুগ বলা হয় তার প্রধান লক্ষণই বিদ্রোহ, আর সেই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্যই রবীন্দ্রনাথ। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অভাববোধ জেগে উঠল বন্ধ্যা প্রাচীনের সমালোচনার ক্ষেত্রে নয়, অর্বাচীনের সৃষ্টির ক্ষেত্রেই, মনে হল তাঁর কাব্যে বাস্তবের ঘনিষ্ঠতা নেই, সংরাগের তীব্রতা নেই, নেই জ্বালা-যন্ত্রণার চিহ্ন, মনে হল তাঁর জীবনদর্শনে মানুষের অনস্বীকার্য শরীরটাকে তিনি অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করে গেছেন।”

আসলে প্রথমে মহাযুদ্ধোত্তর যুগের চিন্তা-ভাবনা, ধারণা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, চেতনার দূর সঞ্চারি, সৌন্দর্য কল্পনায় নিমগ্ন থাকতে দেয়নি এযুগের কবিদের। বুদ্ধদেব বসুও এই একান্ত দীর্ণ সময়ের শিকার। তবে তিনি রবীন্দ্রপ্রভাবের অনুবর্তী হননি ঠিকই, কিন্তু রবীন্দ্র কাব্যধারায় স্নাত হয়ে স্নিগ্ধতা অর্জন করেছেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতাটিও বুদ্ধদেব বসুর এই ভাবনার ব্যতিক্রম নয়। কবিতাটি লেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর একবছর পর তাঁর প্রথম জন্মদিনে। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করার প্রয়োজন সমগ্র জাতির কাছেই তখন সবিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। ইউরোপের ফ্যাসিস্ট শক্তি তখন মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সকল প্রকার সৌন্দর্যের ধ্বংসসাধনে নিমগ্ন। যুদ্ধবাজ শক্তির সেই মর্মান্তিক অবক্ষয়ের দিনগুলিতেই রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র কবি বুদ্ধদেব বসুর কাছে নয়, সমগ্র দেশ ও জাতির কাছেও একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল সাহিত্যকীর্তি, কাব্যের ফসল মানবতাবাদী কবি শিল্পীদের কাছে তখন প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি হয়ে উঠেছিল।

এই পর্বের আধুনিক কবিদের রচনায় সমাজ-ইতিহাস একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ পর্বে পৌঁছেও এই বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুটা দ্বিধান্তিত মনের পরিচয় দিয়েছিলেন। এই পর্বে তিনি নিজে মানবতার গভীর সঙ্কটদীর্ণ পরিস্থিতি দেখে বিষণ্ণতার আবিলতায় ডুবে গিয়েছিলেন। ফ্যাসী বিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের প্রভাব সমস্ত বাংলা কবিতায় তখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এমন একটি সময়েই রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটে। সভ্যতার আগ্রাসী মনোভাবে, ধ্বংসের চূড়ান্ত পটভূমি দেখতে দেখতে, ফ্যাসিজম সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর একটি ধারণা গড়ে ওঠে। তিনি বলেছেন, “আমরা যারা সংস্কৃতিতে, বিশ্বমানবের ঐতিহাসিক প্রগতিতে আস্থাবান, আমাদের এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। ফ্যাসিজম শুধু রাজনৈতিক পদ্ধতি নয়, একটা মনোভাব।”

সংক্রামিত দেশকাল সময়ের তীব্র প্রেক্ষাপটে ১৯৪২-এর ৮ই মার্চ ঢাকার প্রকাশ্য রাজপথে ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতে সোমেন চন্দর নিহত হবার ঘটনা ঘটে যায়। রবীন্দ্রনাথে ফিরে যাওয়া, রবীন্দ্র বিশ্বাসে ক্রমশ আস্থাবান হতে শুরু করেন কবি বুদ্ধদেব। রবীন্দ্রনাথ যে কত বড়ো আশ্রয়স্থল হয়ে রয়েছে তাঁর জীবনে, কবিতাটি তারই এক অপরূপ বাক্‌প্রতিমা। বিয়াল্লিশের সেই উত্তাল সময়গুলির সামনে দিশাহীনতার প্রবল অন্ধকার। জীবনের সেই প্রবল সঙ্কটময় মুহূর্তগুলিতে তাঁর মনে হয়েছিল—

প্রাণে মোর আনো তব বাণী, গানে মোর আনো তব সুর

রবীন্দ্র ঠাকুর !


মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, সমস্ত প্রকার শুভবোধ বা মঙ্গলময় অনুভূতিগুলি যেন সভ্যতার শ্মশান শয্যায় হারিয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পাশব প্রবৃত্তি, মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার অহমিকাকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে তুলেছে। মনুষ্যত্বের অপমান করে এইসব সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগুলি দুর্বল দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের মানুষের বাঁচার অধিকারটুকুও কেড়ে নিচ্ছে।

প্রাণলক্ষ্মী নির্বাসিতা, রক্তপায়ী উদ্ধত সঙিনে 

সুন্দরেরে বিদ্ধ করে, মৃত্যুবহ পুষ্পকে উড্ডীন

বর্বর রাক্ষস হাঁকে, আমি শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বড়ো

মানুষের জীবনের সহজ সরল সুস্থতা, আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত অবনমন ঘটে চলেছে। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের হাসি আনন্দ ভালোলাগা ভালোবাসার সূক্ষ্মতম বোধ। উন্মত্ত জন্তুর মুখে জীবনের সোনার হরিণ যেমন আহত-ক্ষতবিক্ষত ঠিক তেমনিভাবেই মানুষের প্রাণের আবেগ-উত্তাপ উষ্মতা হারিয়ে যাচ্ছে লোলুপ, হিংস্র সভ্যতার নামধারী আপাত অমানবিকতার চোরা স্রোতে। কবি লিখেছেন,

“দেশে দেশে সমুদ্রের তীরে তীরে কাঁপে থরোথরো 

উন্মত্ত জন্তুর মুখে জীবনের সোনার হরিণ।”

চারিদিকের এই অনন্ত লোভ-লালসা-হিংসার তাণ্ডবলীলা দেখে, চৈতন্যের অন্ধকার তমিস্রা পেরিয়ে কবি বুদ্ধদেব বসুর মনে হয়েছে চারিদিকের এই প্রচণ্ড মারের মধ্যে মানুষ বাঁচতে পারে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-দর্শন, চিন্তা-সাহিত্যের মধ্যে। এই দুঃসহ বিবমিসার মাধ্যমে মানুষের জীবন সহজ পথে চলবার শক্তি কখনও পেতে পারে না। প্রণয়ের সব গ্রন্থিগুলি যদি ক্রমশই ভঙ্গুর হয়ে যায়, তাহলেও প্রাণের অফুরন্ত শক্তিকে নিরন্তর পূর্ণ করে রাখেন অনন্ত জ্যোতিপ্রভা সমন্বিত বাণীরূপী রবীন্দ্রনাথ। যিনি বহুবার মানবের পূণর্জন্ম ঘটাতে পারেন। আসলে পরাম্পরাগত বিশ্বাস উপলব্ধির স্থির সত্যে এই চরম দুর্দিনেও কবি যে বেঁচে উঠছেন, তার যন্ত্রণায় অসহ জীবনেও রবীন্দ্রনাথ যে প্রজন্মবাহিত হয়ে রয়েছেন এইটাই ছিল রবীন্দ্র আপ্লুত বুদ্ধদেবের কবি প্রণামের মূল বিষয়। জীবন বিমুক্তভাবে, প্রাণকে রুদ্ধ করে ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যের লীলাভূমিতে, স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের উপকূলে বহুবার বহু জাতি তাদের লোভ লালসার উন্মত্ত দোলাচলতা দেখিয়েছে। কবি লিখেছেন, 

“প্রাণরুদ্ধ, প্রাণ স্তব্ধ, ভারতের স্নিগ্ধ উপকূলে

লুব্ধতার লালা ঝরে।”

আসলে সভ্যতার সর্বগ্রাসী পটভূমিতে, আসন্ন বিলুপ্তির ধ্বংসজাত অন্ধকার রবীন্দ্রবাণী সুষমার উজ্জল আলো নিঃসীমভাবে সঞ্চারিত হয়ে চলে। জীবনকে পূর্ণতার শেষতম সার্থকতাটুকু দিয়ে যায়। শতাব্দীর সন্ধিলগ্নে দাঁড়িয়ে পূর্বসূরি রবীন্দ্রনাথও ছিলেন আর্ত, ধ্বংসের স্তম্ভিত প্রকরণ বুকে নিয়ে নীলকণ্ঠ। কিন্তু মনুষ্যত্বলোপী সেই সময়ের বুকে দাঁড়িয়েও রবীন্দ্রনাথ মনুষ্যত্বের উত্তরণের স্বপ্নই দেখেছেন। ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই স্বপ্নকে উত্তরসূরির ভাবনা-চিন্তায়। আকাঙ্ক্ষার সেই বীজ পার হতে হতে অপ্রাপ্তির বেদনায় রিক্ত-শূন্য হয়ে যায়নি কখনও বরং আরও বেশি দৃঢ় হয়েছে কবির চেতনার পরতে পরতে।

“……এত দুঃখ, এ দুঃসহ ঘৃণা

এ নরক সহিতে কি পারিতাম, হে বন্ধু, যদি না

লিপ্ত হতো রক্তে মোর, বিদ্ধ হতো গূঢ় মর্মমূলে

তোমার অক্ষয়মন্ত্র।………..”

এই উত্তরাধিকার প্রাপ্তিই জীবনের চরম সঙ্কটে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিল ত্রিশ-চল্লিশের দশকের কবি ও তরুণ সমাজকে। বুদ্ধদেবের ভাবনায় সেই তরুণ প্রশান্তিই বারবার ফিরে এসেছিল নানা ভাবনা, রূপকল্প-চিত্রকল্পকে আশ্রয় করে। 

“যায় না এমন দিন যেদিন তোমারে আমি করিনা স্মরণ

কভু বন্ধুজন সঙ্গে কাব্যালাপে বার বার আসে ফিরে ফিরে

তোমার অমর নাম।”

জীবনের অক্ষয় মন্ত্র, প্রাণের আত্মস্থতার আশ্রয় অন্তরে পেয়েছিলেন বলেই ভয়শূন্য দ্বিধাহীন চিত্তে জীবনের জয়ের উপলব্ধি ঘটেছিল কবি জীবনে।

বুদ্ধদেব বসুর প্রথম কাব্য ‘মর্মবাণী’তেই রবীন্দ্র প্রভাবের গভীর অনুসরণ লক্ষ করা গিয়েছিল। এ কাব্যের প্রায় ত্রিশটি কবিতার ভাব-ভাষা-ছন্দ এমনকি নামকরণ ও রবীন্দ্র অনুষঙ্গ’কে মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য এ সম্পর্কে কখনই অগ্রজের প্রতি অনুজ কবির অন্ধমোহমুদ্ধ আনুগত্য ছিল না। নানা কারণে বুদ্ধদেব বসু ও রবীন্দ্রনাথের অন্তসম্পর্ক নিয়ে জলঘোলা করেছেন সমালোচক গবেষকেরা। হয়তো এ সমালোচনার পিছনে তথ্যগত অজস্র কারণও ছিল। কিন্তু সেখানে অভিমানজনিত যে দূরত্বের ইতিহাসটি ছিল অনেক ক্ষেত্রেই তাকে বিকৃত রূপ দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রআপ্লুত কবি বুদ্ধদেবকে রবীন্দ্র বিরোধী কবির তক্‌মাই বেশি পেতে হয়েছে জীবনে। হয়তো ‘বাইশে শ্রাবণে’র কবিতাগুচ্ছে রবীন্দ্রস্মরণ সেই অপব্যাখ্যা ঘোচানোর এক সচেতন প্রয়াস। তবে একেই একমাত্র কারণ ভাবাটা নিশ্চই ঠিক হবে না। সভ্যতার অন্তঃসারশূন্য পটভূমিতে মনুষ্যত্বের অবমূল্যায়ন, ধ্বংসাত্মক চেহারা, আত্মার বিনষ্টি কবিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রাণীত করে তুলেছিল।

সমস্ত জীবন ধরেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি বুদ্ধদেবের শ্রদ্ধা সমীহের ধারণাটি অক্ষুণ্ণ ছিল। বিপুল বিতর্কের মুহূর্তেও একাধিকবার তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে। একাধিক রবীন্দ্র বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে বয়সের সীমারেখা মুছে ফেলে অদ্ভূত সখ্যতার নৈকট্যও তৈরি হয়েছিল দুজনের মধ্যে। বুদ্ধদেবের এই নিকট সান্নিধ্য রবীন্দ্রনাথেরও ভালো লেগেছিল। তাকে স্বীকৃতি জানাতেও ভোলেননি কবি। লিখেছেন, “তোমাদের কদিন এখানে ভালো লেগেছিল। ভালোলাগা জিনিসটা ফুল ফোটার মতো রমণীয় সেটাতে চারদিকের লোকেরই লাভ, সেইজন্য আমরাও তোমার আনন্দ সম্ভোগের প্রতি কৃতজ্ঞ আছি।” (৪.৬.১৯৪১-এ লেখা বুদ্ধদেবের প্রতি রবীন্দ্রনাথের চিঠি) এই রবীন্দ্রনাথ একটু একটু করে তখন এগিয়ে চলেছেন ২২শে শ্রাবণের দিকে। আর বুদ্ধদেব তার অস্তিত্ব-স্মৃতি-সম্ভাবনা উজাড় করে প্রাণের পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে চলেছেন অগ্রজের প্রতি। ‘বাইশে শ্রাবণ-এর কবিতাগুচ্ছে সেই প্রীতি-মমত্ব আর শ্রদ্ধার অকুণ্ঠ সম্মিলন ঘটে গেছে। আসলে শুধু ‘বাইশে শ্রাবণ’ বা ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতাতেই নয়, যে আঁধার আলোর অধিকেও ফিরে আসতে দেখি রবীন্দ্রনাথকে। ক্রমশ কিংবদন্তী হয়ে ওঠা এই মানুষটিকেও অনেক ত্রুটি-দুর্বলতা-অসহায়তা নিয়ে আর পাঁচ জন মানুষের মতোই পথে চলতে হয়েছিল। বিভ্রান্ত সময়ের দাবী রক্ষা করতে গিয়ে যুগের অবক্ষয় ও ধ্বংস দেখতে দেখতে বুদ্ধদেব পথহারা নাবিকের মতোই পরম শান্তির আশ্রয় রূপে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পেয়েছেন, তাই তাঁর নিমগ্ন উচ্চারণ,

“পরপারে, বিশ্রামে শুভ্রতাময়, যেন তুমি কখনো করোনি 

চেষ্টা, কিংবা যেন কলস গিয়েছে ভেসে, তুমি শুধু জল।”