বাংলা কাব্য সাহিত্যের জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অদ্বিতীয় শিল্পীরূপে রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি। রবীন্দ্র সমকালে, রবীন্দ্র ভাবপরিমণ্ডলে যে সমস্ত কবির আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে কেউই রবীন্দ্র সমকক্ষ হতে পারেননি। কেবল রবীন্দ্র সমকালে কেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যে অদ্যাবধি রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্র সমকালে আরও কয়েকজন কবিশিল্পীর নাম অনিবার্যভাবে এসে যায়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। রবীন্দ্র প্রতিভার পাশাপাশি সত্যেন্দ্র প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি স্পষ্টরূপেই বলেছেন— ‘রবীন্দ্রনাথ পড়া থাকলে আজকের দিনে সত্যেন্দ্রনাথের আর প্রয়োজন হয় না। বুদ্ধদেব বসুর এ জাতীয় মন্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে সমীক্ষা করাই এক্ষেত্রের অভিপ্রেত বিষয়।

অনুভূতিপ্রবণ মানবচিত্র। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে অনুভূতি আছে, আছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের উপলব্ধি। এ সবের প্রকাশ আশ্চর্যভাবে কবিতা হয়ে ওঠে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নিতান্ত সোজাসুজিভাবে এসবের রূপায়ণ ঘটিয়েছেন বলে তাঁকে বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন কবিশিল্পী রূপে প্রাবন্ধিক সম্মানিত করতে চান। রবীন্দ্রনাথ সমসাময়িক সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে এ বিষয়ে বেছে নিয়ে বুদ্ধদেব বসু তাঁর অভিমত সুযৌক্তিকভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি আসলে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের মধ্যে ছোটো ও বড়ো কবির তফাত দেখাতে চাননি, খাঁটিত্ব প্রসঙ্গে মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর সুস্পষ্ট অভিমত তাঁর ভাষা দিয়েই উপস্থাপন করছি—“অনেকের মধ্যে তাঁকে বেছে নিলুম সুপষ্ট কারণে ; সমসাময়িক কাছাকাছি বয়সের কবিদের মধ্যে রচনাশক্তিতে শ্রেষ্ঠ তিনি, সর্বতোভাবে যুগপ্রতিভূ, এবং রবীন্দ্রনাথের পাশে রেখে দেখলেও তাঁকে চেনা যায়। চেনা যায়, আলাদা একটা চেহারা ধরা পড়ে, কিন্তু সেই চেহারাটা কীরকম ভাবলেই আমরা বুঝতে পারবো, কেন রবীন্দ্রনাথ পড়া থাকলে, আজকের দিনে সত্যেন্দ্রনাথের আর প্রয়োজন হয় না। তফাতটা জাতের নয়, তা বলাই বাহুল্য ; একই আন্দোলনের অন্তর্গত জ্যেষ্ঠ এবং অনুজ কবির ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যও নয় এটা ; আবার বড়ো কবি ছোটো কবির তফাৎ বলতে ঠিক যা বোঝায় তাও একে বলা যায় না। ইনি ছোটো কবি না বড়ো কবি, কিংবা কত বড়ো কবি– সমালোচনার কোনো এক প্রসঙ্গে এসব প্রশ্ন অবান্তর; ইনি খাঁটি কবি কিনা সেইটাই হল আসল কথা। সত্যেন্দ্রনাথে এই খাঁটিত্বই পাওয়া যায় না।”

রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত উপাদানকে নিয়ে কাব্যে সরস্বতীর সাধনা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সেই ঋতুরঙ্গ, পল্লিচিত্র এবং দেশপ্রেমকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন তাঁর কাব্যজগৎ। তবুও দুজনের মধ্যে ব্যবধান আছে দুস্তর। রবীন্দ্রকাব্য পাঠে আমরা যে আবেগের গভীরতা দেখি, অকৃত্রিমতা প্রত্যক্ষ করি, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো তা দেখি না। রবীন্দ্রনাথ পড়ার পর তাই আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যপাঠের প্রয়োজন হয় না। বাস্তবিকপক্ষে, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা ষোলোকলাই পেয়ে গিয়েছিলাম ; সত্যেন্দ্রনাথ আমাদের আর নূতন কিছুই দিতে পারেননি; তাই রবীন্দ্রনাথ পড়া থাকলে একালে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আর কোনো প্রয়োজনই হয় না। তবু সত্যেন্দ্রনাথ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন একটা সময়। কী কারণ এই জনপ্রিয়তা সে নিয়েও প্রবন্ধকার স্পষ্ট ধ্যানধারণা প্রদান করেছেন। বুদ্ধদেব বসুর ভাষা দিয়েই শোনা যাক তার সুযৌক্তিক বিশ্লেষণ—“রবীন্দ্রনাথের ছন্দের যে মধুরতা, যে মদিরতা তার অন্তলীন, শিক্ষা, সংযম, রুচি, সমস্ত উড়িয়ে দিয়ে যে ধরনের লেখার প্রবর্তন হল তাতে থাকলো শুধু মিহি সুর, ঠুনকো আওয়াজ, আর এমন একরকম চঞ্চল কিংবা চটপটে তাল, যা কবিতার অ-পেশাদার পাঠকের কানেও তক্ষুণি গিয়ে পৌঁছায়। এইজন্যই সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে এত জনপ্রিয় হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যকে তিনি ঠিক সেই ‘পরিমাণে ভেজাল করে নিয়েছিলেন, যাতে তা সর্বসাধারণের উপভোগ্য হতে পারে। তখনকার সাধারণ পাঠক রবীন্দ্রনাথে যা পেয়েছিল, বা রবীন্দ্রনাথকে যেমন করে চেয়েছিল, তারই প্রতিমূর্তি সত্যেন্দ্রনাথ, শুধু কর্ণসুযোগ ছাড়া আর কিছুই তিনি দাবি করলেন না পাঠকের কাছে। তাই তাঁর হাতে কবিতা হয়ে উঠল লেখা-লেখা খেলা বা ছন্দঘটিত ব্যায়াম।”

প্রকরণগত দিক থেকে রবীন্দ্র সমকালে কিছুটা ছেলেমানুষি দেখা গিয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মধ্যে এর প্রাবল্য চোখে পড়ে। বাস্তবিকপক্ষে এসব কবিতার মান এমন কিছু উন্নত হয়নি। রবীন্দ্রকাব্যে ভেজাল দিয়ে সর্বসাধারণের উপভোগ্য করে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। জনসাধারণ এই প্রকরণগত ছেলেমানুষিকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চেয়েছিল বলে সত্যেন্দ্রনাথ তাঁদের কাছে খ্যাতির চরমে উন্নীত হন। এ খ্যাতি—এ প্রভাব রবীন্দ্রনাথকেও একটা সময় ছাপিয়ে গিয়েছিল। মহাকাল এইসব সৃষ্টিকে বেশিদিন ধরে রাখেনি। ফলে সত্যেন্দ্রনাথ, শিষ্য প্রশিষ্যগণ ছেলেবেলার ঝুমঝুমি কিংবা লজেন্ধুসের মতো পদ্য রচনায় ব্যাপৃত হলেন। প্রকৃত কবিতা লিখতে গেলে রবীন্দ্রনাথেই যে ফিরতে হবে এ সত্যটা উপলব্ধি করতে খুব বেশি দেরি হয়নি।

রবীন্দ্র প্রতিভা গগনচুম্বী। তুলনারহিত এ প্রতিভার মূল্যায়নে বুদ্ধদেব বসুর লেখনী যথার্থ দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলা কাব্য সরস্বতীর সম্ভার রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র রাগিণীতে যেভাবে সুমধুর ও সমৃদ্ধতর করেছেন তার পরে আর কোনো কবি তা করতে পারেননি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্র প্রতিভার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেননি। সবদিক থেকে সমীক্ষা করে বুদ্ধদেব বসু তাই ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে যথার্থ সত্যের স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন—’রবীন্দ্রনাথ পড়া থাকলে আজকের দিনে সত্যেন্দ্রনাথের আর প্রয়োজন হয় না।