ভারতের দুই মনীষী রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির শিক্ষাচিন্তার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু পার্থক্যও লক্ষ করা যায়। নীচে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজির শিক্ষাচিন্তার তুলনামূলক আলােচনা করা হল一
(১) শিক্ষাদর্শন: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন প্রধানত ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অপরদিকে ভাববাদ ও প্রয়ােগবাদ গান্ধিজির শিক্ষাদর্শনকে প্রভাবিত করে।
(২) শিক্ষার লক্ষ্য: রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজি উভয়েই ব্যক্তির সম্পূর্ণ বিকাশকেই শিক্ষার লক্ষ্য বলে মনে করেন। কবিগুরুর মতে, ব্যক্তির দৈহিক, বৌদ্ধিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক গুণাবলির বিকাশই শিক্ষার লক্ষ্য। গান্ধিজি বলেছেন, মানুষ বা শিশুর মধ্যে যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তার পরিপূর্ণ বিকাশ— তার দেহ, মন ও হৃদয় বা আত্মার সম্পূর্ণ বিকাশই শিক্ষার লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে গান্ধিজি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন শুধু পার্থিব সম্পদ নয়, আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশই হবে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।
শিক্ষার অন্যান্য লক্ষ্যের ক্ষেত্রেও গান্ধিজির শিক্ষার লক্ষ্য অপেক্ষাকৃত মূর্ত, সেখানে কবিগুরুর উল্লিখিত শিক্ষার লক্ষ্য কিছুটা বিমূর্ত। গান্ধিজির শিক্ষার লক্ষ্য জাতীয় চেতনাসমৃদ্ধ, আন্তর্জাতিকতা সেখানে অনুপস্থিত। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার লক্ষ্যের মধ্যে জাতীয় চেতনা ভীষণভাবে পরিস্কুট হলেও আন্তর্জাতিক চেতনার মিলন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ ও, গান্ধিজি উভয়েই ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছেন; যদিও কবিগুরু ব্যক্তিতান্ত্রিকতার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, যেখানে গান্ধিজি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সমাজতান্ত্রিকতাকে।
পাঠক্রম
রবীন্দ্রনাথের মতে, শিশুর জীবনের সবদিককে স্পর্শ করে এমন পাঠক্রম প্রণয়ন করা উচিত। সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তােলার জন্য তাকে ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগােল, বিজ্ঞান, অঙ্কন, শিল্পকলা, নৃত্য, সংগীত, নাটক প্রভৃতি সব বিষয়েরই শিক্ষা দিতে হবে। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য পাঠক্রমে সংস্কৃত ভাষাশিক্ষা এবং মহাভারত, রামায়ণকে অন্তর্ভুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এ ছাড়া তিনি পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার ওপরেও গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। গান্ধিজিও শিশুর জীবনের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য পাঠক্রম রচনার কথা বলেছেন। তাঁর উল্লিখিত পাঠক্রমে জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজকে ভিত্তি করে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করার কথা বলা হয়। এই প্রয়ােজনীয় বিষয় হিসেবে তিনি একটি ‘ক্রাফট’ বা কারিগরি শিল্পকে বেছে নেওয়ার কথা। বলেছেন। ভাষা, ইতিহাস, ভূগােল, গণিত, সাধারণজ্ঞান, সমাজবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা সবই গৃহীত ‘ক্লাফটু ‘কে কেন্দ্র করেই রচিত হবে।
গান্ধিজি পাঠক্রম প্রণয়নে গ্রামীণ আর্থিক বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, এমনভাবে পাঠক্রম রচিত হবে যাতে গ্রামের এবং বিদ্যালয়ের আর্থিক বিকাশ সম্ভব হয়। শিক্ষার্থীরা পড়াশােনার মধ্য দিয়ে এমন সব জিনিস উৎপাদন করবে বিক্রি করে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়ার খরচ চালাতে পারবে| রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাঠক্রম পরিকল্পনায় এই তাৎক্ষণিক আর্থিক উপার্জনের কথাবলেননি কৃষি ও কুটিরশিল্পের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী অর্থ উপার্জনে সক্ষম হবে এ কথাই তিনি বলেছেন।
শিক্ষার মাধ্যম: উভয় শিক্ষাবিদই শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হওয়া উচিত বলে মত পোষণ করেন।
শিক্ষণ পদ্ধতি: রবীন্দ্রনাথ বিশেষ কোনাে একটি শিক্ষাপদ্ধতির কথা বলেননি। তাঁর মতে, শিক্ষক যদি উৎসাহী এবং গুণসম্পন্ন হন তবে প্রয়োজনমতো তিনি নিত্যনতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে শিক্ষা দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপদ্ধতির মূলকথা হল, শিশুকে স্বাধীনতা দিতে হবে, তাকে সব সময় বিধিনিষেধের গন্ডির মধ্যে আটকে রাখলে চলবে না। সক্রিয়তা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপদ্ধতির মূলকথা। তিনি আরও বলেন যে, প্রকৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রেখে শিক্ষা দিলে তা বেশি কার্যকরী হয়। তাঁর মতে গাছে চড়া, ফুল-ফল পাড়া, বাগান পরিচর্যা, সাঁতার কাটা প্রভৃতির মাধ্যমে দেহ-মনের সুস্থ বিকাশ ঘটে।
গান্ধিজি প্রচলিত পুস্তককেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতির কঠোর সমালােচনা করেছেন।ব্যক্তির দেহ, মন ও হৃদয় বা আত্মার বিকাশের জন্য তিনি একটি হস্তশিল্প (ক্ৰাক্ট) এবং ওই হস্তশিল্পকে কেন্দ্র করে অনুবন্ধ প্রণালীতে শিক্ষাদানের কথা বলেছেন। অনুবন্ধ প্রণালীর মধ্য দিয়ে যে শুধু বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানার্জন হবে তাই নয়, শিশুর চরিত্রও গঠিত হবে। তার অবসর বিনােদনের সুযােগ থাকবে। শিল্পশিক্ষার ভিতর দিয়ে শিশুদের মধ্যে আত্মসংযম, স্বাবলম্বিতা, সহযােগিতা, দায়িত্ববােধ এবং অহিংসার মানসিকতার বিকাশ ঘটবে।
শৃঙ্খলা: রবীন্দ্রনাথের মতে, কঠোর শাসন ও নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে শিশুকে কাজের অবাধ স্বাধীনতা দিলে শৃঙ্খলা রক্ষার কোনাে সমস্যা থাকবে না। উপরন্তু তার চিন্তা ও বিচার শক্তির উন্মেষ ঘটবে। শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে তিনি প্রকৃতিবাদের সমর্থক।
শৃঙ্খলা আনার ক্ষেত্রে গান্ধিজি আত্মসংযমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ এ ব্যাপারে তিনি ভাববাদীদের সঙ্গে একমত। শিশু তার নিজস্ব আবেগে চালিত হােক, তা তিনি চাননি। তাঁর মতে আবেগ, কল্পনা, ইচ্ছাকে যদি যথাযথভাবে সংযত করা না যায়, তাহলে গঠনমূলক কাজ করা সম্ভব নয়। অবশ্য শৃঙ্খলাকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার কথা তিনি বলেননি। তিনি চেয়েছেন এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে যাতে শিশু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আত্মসংযমে ব্রতী হয়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক: রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুশিষ্যের সম্পর্ক হবে মধুর। এই প্রসঙ্গে তিনি ভারতের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ও গ্লুরুকুলের কথা উল্লেখ করেছেন। গান্ধিজিও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে মধুর সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে তাঁর মতে শিক্ষার্থীরা যাতে কঠোর পরিশ্রম করে সে ব্যাপারে শিক্ষক বিশেষ নজর দেবেন, প্রয়ােজন হলে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
Leave a comment