যে সাহিত্য ধারায় পত্র এবং সাহিত্য দুয়েরই গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম পরিলক্ষিত হয়। তাঁকে পত্রসাহিত্য বলে। অর্থাৎ পত্র যেখানে সাহিত্য মূল্য ও সাহিত্য রসের বাহক হয়। সেখানেই যথার্থ পত্রসাহিত্যের রসময় রচনা। এই সাহিত্য ধারার বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ—

  • (ক) প্রথমত, পত্রসাহিত্য সাধারণভাবে ব্যক্তিগত ভাবনার বাহক। দ্বিতীয়ত, সেই ভাবনার সর্বজনীনত্ব প্রাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ পত্রের ভাব ব্যক্তিকতার আধারে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্বজননীত্বে উত্তীর্ণ হয়। এক্ষেত্রে পত্রের বিষয় শুধু ব্যক্তিক প্রয়োজন মেটায় না।

  • (খ) পত্রসাহিত্যে পত্র লেখকের অন্তর মানস ও রসলোকের উন্মোচন ঘটে। এক্ষেত্রে পত্রের রস ব্যক্তিক সীমাকে ছাড়িয়ে রসের জগতে সঞ্চারণ করে।

  • (গ) সাহিত্য যেমন সময় সমাজ চরিত্রের অন্তলোক বহির্লোকের দর্পণ, পত্র যদি সেই স্তরে উত্তরিত হয় তবে তাকে পত্র সাহিত্য বলা হয়। সমস্ত কিছু মিলিয়ে যেসব পত্রের সাহিত্যিক মূল্য যুগ যুগ ধরে স্বীকৃতি পাবার অধিকারী হয় সেইসব পত্রকেই পত্রসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এই নিরিখে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলি পত্রসাহিত্য হিসাবে নন্দিত হবার যোগ্যতা রাখে। এটি রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা হলেও নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে লিখিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা কবির ব্যক্তিক ভাবনার স্তর ছাড়িয়ে বিশ্বগত হতে পেরেছে। ফলে ব্যক্তি জীবনের পত্র হয়ে উঠেছে যেন কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্য-কীর্তি। দু’একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার বিশ্বগত সাহিত্যিক অভিব্যক্তিকে পরিণত হওয়ার এই ব্যাপারটাকে স্পষ্ট করা যায়। ছিন্নপত্রের ১০৮ নং পত্রের ব্যক্তিক রবীন্দ্রনাথের মানসিক ভাবনার পরিচয়টি এইরকম—

“……অন্ধকারের আবরণের মধ্য দিয়ে এই লোকালয়ের একটি যেন সজীব হৃদস্পন্দন আমার বক্ষের উপর এসে আঘাত করতে লাগল।….বৃহৎ জনতার সমস্ত ভালোমন্দ সমস্ত। সুখ দুঃখ এক হয়ে তরুলতা বেষ্টিত ক্ষুদ্র বর্ষানদীর দুই তীর থেকে একটি সকরুণ সুন্দর সুগম্ভীর রাগিণীর মতো আমার হৃদয়ে এসে প্রবেশ করতে লাগল। আমার শৈশব সন্ধ্যা কবিতায় বোধ হয় কতটুকু এইভাব প্রকাশ করতে চেয়েছিলুম।”

ব্যক্তিক এই অভিজ্ঞতা আসলে বৃহত্তর জীবনের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহমানতার সত্য এবং সৌন্দর্য উপলব্ধির স্তরে উন্নীত হয়েছে। এখানেই এই চিত্র যেন সূর্যাস্তের আলোয় পদ্মাতীরের দৃশ্যের পটভূমিতে গীতি-কবিতার আবহে মেজাজে অভিব্যক্ত হয়েছে।

আসলে এই বর্ণনা ও কবিতার মধ্যে কোনো ফারাক খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। এই অর্থে এই বিবরণই আর একটু পূর্ণ রূপ পেয়ে যেন সোনার তরীর শৈশব সন্ধ্যা নামক কবিতাটিতে রসমূর্তি লাভ করেছে।

ব্যক্তিক পত্রের সাহিত্য হয়ে ওঠার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন দেখতে পাই ছিন্নপত্রের ১০নং পত্রে। এখানে ধূ ধূ বালুচরের যে বর্ণনা আছে তা উৎকৃষ্ট সাহিত্যের মর্যাদা অনায়াসেই পেয়ে যায়। যথা—

“প্রকাণ্ড চর ধূ ধূ করছে কোথাও শেষ দেখা যায় না। কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়। আবার অনেক সময় নদীকে বালি বলে ভ্রমও হয়—প্রাণ নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই, বৈচিত্র্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদাবালি।”

এই ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা যে যথার্থ সাহিত্যের মর্যাদায় উন্নীত তার প্রমাণ চতুরঙ্গ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ রেখেছেন। সেখানে দামিনীর জীবনের এক সন্ধিস্থানে বালুচরের যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে এই পত্রের সাযুজ্য অনেকখানি।

ছিন্নপত্র যে একাধারে পত্র এবং সাহিত্য তার উৎসমূলে রয়েছে পত্র লেখক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের অন্তর মানস ও সেই মানসের রসলোকের অসীমতায় উত্তরিত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াটি । পদ্মাতীরের সৌন্দর্য বর্ণনা করে ছিন্নপত্রের ৬৪নং পত্রে যে বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ করেছেন তা আসলে সাহিত্যের রোমান্টিকতারই তথা রোমান্টিক সৌন্দর্য চেতনারই মূর্তরূপ—

“এ যেন এই বৃহৎ ধরণির প্রতি একটা নাড়ীর টান। এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলুম—যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হয়ে থাকত—আমি কত দূরদূরান্তর কত দেশদেশান্তরের জল স্থল পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তদ্ধ ভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম—তখন শরৎ সূর্যোলোক আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস, একটি জীবনীশক্তি, অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকাণ্ড ভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে। আমার এই যে মনের ভাব এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্গুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথা আদিম পৃথিবীর ভাব”।

এখানে পত্র যেন সাহিত্যের মর্যাদায় আসীন। সাহিত্য যেমন সময়, সমাজ ও চরিত্রের অন্তর্লোক বহির্লোকের দর্শনকে বুকে ধারণ করে, ছিন্নপত্রের পত্রাবলি ও তেমনি ব্যক্তিকতার পত্রে পরিবেশিত হওয়ার পর পরবর্তীকালে সময়, সমাজ ও চরিত্রের রূপচিত্র উন্মোচনে মুখর হয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথ পদ্মাতীরে পদ্মানদীতে বিচরণ করার সময় নিতান্ত সহজ সরল যাদের জীবনের চোখ ধাঁধানোর ছড়াছড়ি নেই সেই সব আটপৌরে জীবন একদা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। তাদের জীবনের প্রতি গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর দার্শনিক ও প্রীতিধর্মের ভিত্তিটাকে পোক্ত করে তুলেছিলেন। এমন মানব জীবন ঘনিষ্ঠতার অনবদ্য পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে ছিন্নপত্রের ৩০নং পত্রে। এখানে একটি সরল পল্লিবাংলা রবীন্দ্র মনোযোগের কেন্দ্রে এসেছে—

“আমাদের ঘাটে একটি নৌকা, লেগে আছে, এবং এখানকার অনেকগুলি জনপদ বধূ তাঁর সম্মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। বোধ হয় একজন কে কোথায় যাচ্ছে এবং তাকে বিদায় দিতে সবাই এসেছে। অনেকগুলি কচি ছেলে, অনেকগুলি ঘোমটা এবং অনেকগুলি পাকা চুল একত্র হয়েছে। কিন্তু ওদের মধ্যে একটি মেয়ে আছে। তার প্রতিই আমার মনোযোগটা সর্বাপেক্ষা আকৃষ্ট হচ্ছে। বোধ হয় বয়সে তেরো বারো হবে, কিন্তু একটু হৃষ্টপুষ্ট হওয়াতে চোদ্দো পনেরো দেখাচ্ছে। মুখখানি বড়ো, বেশ কালো অথচ বেশ দেখতে।” নিতান্ত সাধারণ মানবজীবন যে রবীন্দ্রনাথের মানসলোককে কতখানি আকৃষ্ট এই পর্বে তার প্রমাণ এই মেয়েটি। তার স্বামীগৃহ থাকার বর্ণনাকে এই পত্রে অনুপুঙ্খভাবে তিনি জীবন্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, এসূত্রে তিনি গভীর দার্শনিকতায় পৌঁছেছেন।

অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি ছিন্নপত্র যেমন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের পত্র তেমনি তা সাহিত্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তাই পত্র সাহিত্য হিসাবে ছিন্নপত্রের সার্থকতার বিষয়ে কোনো সংশয় থাকে না।