রবীন্দ্রনাথ কেবল বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয় বিশ্বের এক বিস্ময়রূপে আবির্ভূত। কোনো ব্যক্তির নামে যখন কোনো যুগের পরিচিতি প্রদান করা হয় তখন বুঝতে হয় সেই ব্যক্তি সাধারণ ব্যক্তি নন; তিনি অসাধারণ এক ব্যক্তি। বিশ্ব সাহিত্যের ন্যায় বাংলা সাহিত্যে এরকম কিছু অসাধারণ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে যুগ-পরিচিতি প্রদত্ত হয়েছিল। আধুনিক যুগে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ শিল্পীদের নামে সাহিত্যের যুগ পর্বের পরিচিত অবশ্যই তাঁদের অনন্যতাকে বলিষ্ঠভাবে ব্যক্ত করেছে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে যখন মধ্যগগনে, যখন তাঁর প্রতিভা প্রখর থেকে প্রখরতর হয়ে উঠেছিল সেই সময় রবি কিরণকে অনেকে আলো না বলে অন্ধকাররূপে দেখাতে চেয়েছিলেন। সফল হয়নি সে প্রয়াস। তরুণের দল অদম্য বেগে রবি চুম্বকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বুদ্ধদেব বসু কীভাবে ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে এই মন্তব্যের সত্যতাকে যুক্তিসহযোগে উপস্থাপিত করেছেন তাকেই এক্ষেত্রে বিশদভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।
রবি কিরণে একটা সময় বঙ্গসাহিত্য-সরস্বতীর সমগ্র অঙ্গন আলোকিত হয়েছিল। বলতে গেলে তখন বঙ্গসাহিত্য-সরস্বতীর সমগ্র আকাশে রবি কিরণের ঔজ্জ্বল্য বিকশিত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সর্বগ্রাসী মোহমায়াতে আকৃষ্ট করেছেন তরুণ প্রজন্মকে। রবীন্দ্র-বাঁশির সুরে মোহাবিষ্ট হয়ে তরুণ শিল্পীরা এই সময় ভাবোন্মত্ত হয়ে ওঠেন। যদিও রবীন্দ্রবিরোধিতার মতো একটি প্রয়াস এই সময় লক্ষ্য করা গিয়েছিল তথাপি রবীন্দ্রঅনুগামী উত্তর-সাধকেরা রবীন্দ্র-সৃষ্টিসম্পদে ডুব দিতে চেয়েছিলেন। কবি-সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর সচেতন দৃষ্টি পড়েছিল এদিকে। তাই তিনি বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন— “একথা বললে কি ভুল হয় যে বিশ শতকের আরম্ভকালে যাঁরা বাংলার কবি-কিশোর ছিলেন স্বভাবকবিত্ব তাঁদের পক্ষে ঐতিহাসিক ছিল, বলতে গেলে বিধিলিপি ? কেন ? অবশ্য রবীন্দ্রনাথেরই জন্য । রবীন্দ্রনাথের মধ্যাহ্ন তখন, তাঁর প্রতিভা প্রখর হয়ে উঠছে দিনে দিনে, আর যদিও সেই আলোকে কালো বলে প্রমাণ করার জন্য দেশের মধ্যে অধ্যবসায়ের অভাব ছিল না, তবু তরুণ কবিরা অদম্য বেগে রবিচুম্বকে সংলগ্ন হয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তেমন কবি নন, যাঁকে বেশ আরামে বসে ভোগ করা যায়; তাঁর ভোগের উপদ্রবের মতো, তাতে শান্তিভঙ্গ ঘটে, খেই হারিয়ে ভেসে যাবার আশঙ্কা তার পদে পদে। তিনি যে একজন খুব বড়ো কবি তা আমরা অনেক আগেই জেনে গিয়েছি, কিন্তু যে-কথা আজও আমরা ভালো করে জানি না—কিংবা বুঝিনা—সেকথা এই যে বাংলাদেশের পক্ষে বড্ড বেশি বড়ো তিনি, আমাদের মনের মাপজোখের মধ্যে কুলোয় না তাঁকে, আমাদের সহাশক্তির সীমা তিনি ছাড়িয়ে যান।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অজস্র অনুরাগী পাঠক তৈরি করেছেন। তাঁর খ্যাতি অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের এই গগনচুম্বী খ্যাতিকে অনেকে মনে নিতে পারেননি। তাদের ধারণা হয় রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে নাম কিনতে হলে রবীন্দ্র-বিরোধিতা ছাড়া উপায় নেই। এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে তারা রবীন্দ্র আলোকে কালো বলে প্রমাণ করার সর্বাত্মক প্রয়াসে ব্রতী হন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রতিভাবলে তরুণ কবিদের চুম্বকের ন্যায় এমনভাবে আকৃষ্ট করেন তা সত্যসত্যই অতুলনীয়। ফলশ্রুতি হিসাবে রবীন্দ্র অনুকরণ ছাড়া উপায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথের উত্তরসাধকেরা রবীন্দ্র-অনুকরণে নিয়োজিত হলেও রবীন্দ্রনাথকে যথার্থভাবে অনুকরণ করতে পারেননি। ফলশ্রুতি হিসাবে কিছুটা বিভ্রাট বিপত্তি যে ঘটেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রবীন্দ্র-চুম্বকে আকৃষ্ট হয়ে রবীন্দ্র-অনুকরণে ব্রতী এই সময়ের কবিশিল্পীদের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল এবং কী কারণে তার ইতিহাসে স্থান পেলেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন—“তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ। রবীন্দ্রনাথের অনতি-উত্তর তাঁরা বড্ড বেশি কাছাকাছি ছিলেন; একথা তাঁরা ভাবতে পারেননি যে গুরুদেবের কাব্যকলা মারাত্মকরূপে প্রতারক, সেই মোহিনীমায়ার প্রকৃতি না বুঝে শুধু বাঁশি শুনে ঘর ছেড়ে ডুবতে হবে চোরাবালিতে …রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ করতে গিয়ে তাঁরা ঠিক তাই করলেন যা রবীন্দ্রনাথ কোনোকালেই করেননি। এই ভুলের জন্য, ভুল বোঝার জন্য তাঁদের লেখায় দেখা দিল সেই ফেনিলতা সেই অসহায়, অসংবৃত উচ্ছ্বাস, যা ‘স্বভাবকবির কুলক্ষণ;—শৈথিল্যকে স্বতঃস্ফূর্তি বলে; আর তন্দ্রালুতাকে তন্ময়তা বলে ভুল করলেন তাঁরা ;—আর ইতিহাসে শ্রদ্ধেয় ছিলেন, এই এই কারণে যে রবি-তাপে আত্মাহুতি দিয়ে তাঁরা পরবর্তীকালকে সতর্ক করে গেছেন।”
রবি প্রতিভা অতুলনীয়। বিরোধিতা করে তাঁকে যেমন ম্লান-নিষ্প্রভ করা যায়নি তেমনি আবার যথাযথভাবে অনুকরণ অনুসরণও করা যায়নি। অনেকে অনুকরণ-অনুসরণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। আসলে রবীন্দ্রনাথ অননুকরণীয়, অননুসরণীয়। তাঁর তুলনা শুধু তিনি। রবীন্দ্র-অনুকরণ অসম্ভব জেনেও রবীন্দ্রমোহে অনেকেই মজেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেন একটি শক্তিশালী চুম্বক। এ চুম্বকের আকর্ষণ দুর্বার। সেই আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে তরুণ কবিরা রবীন্দ্রসুরে বিস্ময়-বিহ্বল ও মোহিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রতিভার মধ্যগগনে যখন তাঁর প্রতিভাদীপ্তির প্রোজ্জ্বলতা প্রখর থেকে প্রখরতর হয়ে উঠেছিল তখন থেকেই তাকে ছোটো করে দেখাবার প্রয়াস গৃহীত হয়। না, সেই অপপ্রয়াস সার্থক হয়নি। এই অপপ্রায়সকে অস্বীকার করে তরুণ প্রতিভা রবিচুম্বকে আকৃষ্ট হয়েছে। বাংলা সাহিত্য সমীক্ষায় স্পষ্ট দেখা যায় তরুণ কবিশিল্পীরা অপ্রতিহত অদম্য বেগে রবিচুম্বকে সংলগ্ন হয়েছেন। যদিও আমরা রবীন্দ্রসমকালীন কবিশিল্পীদের অনেকের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের দিক প্রত্যক্ষ করেছিলাম কিন্তু তারাও প্রথমদিকে রবীন্দ্র সুরের ঐন্দ্রজালিক মায়ায় প্রভাবিত হয়ে তাঁদের সৃষ্টি উপহার দিয়েছেন। আসলে তাঁদের কৈশোর ও যৌবনে প্রকাশিত হয়েছে ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘ক্ষণিকা’ ‘গীতাঞ্জলির মতো কাব্য তাঁরা সেই মায়ায় না মজে থাকতে পারেননি। আসলে এই সময় তরুণ প্রজন্ম রবীন্দ্র মায়ায় মজেছেন, রবীন্দ্রসুরে আবিষ্ট হয়েছেন, রবীন্দ্রস্বপ্নে তৃপ্তি পেয়েছেন, রাবীন্দ্রিক স্পন্দনে আলোড়িত হয়েছেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গুণে মুগ্ধ, সুরের সারল্যে আবিষ্ট। রবীন্দ্রমন্ত্রে তাঁরা দীক্ষিত। এভাবে দেখা যায় এই তরুণ কবিরা রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের সৃষ্টির ধ্রুবতারা রূপে গ্রহণ করেছেন।
বিস্ময়কর প্রতিভাবান শিল্পী রবীন্দ্রনাথ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর সার্বিক প্রভাব প্রতিফলিত। সাহিত্যে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী তাঁরাও রবীন্দ্রনাথের এই সর্বগ্রাসী প্রভাবকে অস্বীকার করেননি। রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হওয়ার জন্য এই রবীন্দ্র-পরবর্তী শিল্পীরা প্রাণান্ত প্রয়াস নিলেও অন্তরে অন্তরে তাঁরা রবীন্দ্র অবদানের অভাবনীয় দিক অনুভব করেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধটির মধ্যে প্রাসঙ্গিক যে মন্তব্য করেছেন তার সারস্বত সত্য সমর্থিত। বাস্তবিকপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ যখন মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় দীপ্যমান সেই সময় অনেকে রবীন্দ্র বিরোধিতার মধ্য দিয়ে সাহিত্য সরস্বতীর সাধনায় ব্রতী হলেও তরুণ কবিরা দুর্নিবার প্রবহমানতা নিয়ে ধাবিত হয়েছেন। ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু কথিত আলোচ্য মন্তব্যের সার্বিক সত্যতা সম্পর্কে আমরা নিঃসন্দিহান।
Leave a comment