‘চির সুন্দর আমি তোরে ভালোবাসি – রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সাধনার এটাই চিরায়ত বাণী। কিন্তু এই সভ্যতার স্পর্শ নিতে হলে আবিষ্কার করা দরকার কবির প্রকৃতি চিন্তা। সেই প্রকৃতি চেতনাকে উপলব্ধি করা প্রয়োজন যা কবির আজন্ম সংস্কার। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক লগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে এর আরাধনা। ভৃত্য রাজতন্ত্রের মাঝখানে বসে সেদিন অপার কৌতূহল বশে আধো চাহনি মেলে তিনি পুষ্করিণীর শোভা নিরীক্ষণ করেছিলেন। সেদিনও তাঁর শিশু মনটিকে নাড়া দিয়েছিল এই প্রকৃতি চেতনা। আর নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই প্রকৃতি প্রেমই রবীন্দ্র সাহিত্যে পরিণতি পেয়েছে। সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে তিনি অসীমের আকর্ষণ উপলব্ধি করেছেন চিরকাল। সীমা ও সীমাহীনের এই অপূর্ব সমন্বয় সাধনাই রবীন্দ্র সাহিত্যর মূল কথা।

ছিন্নপত্র পর্বে কবির এই আজীবন প্রকৃতি চিন্তাতে এক নতুন বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেন মনে হয়—তার উপবাসী প্রাণের নিয়ম ভঙ্গ ঘটেছে এই পদ্মাতীরে বাসের জীবনেই। এর পূর্বে কবির প্রকৃতি চিন্তায় Reality-এর স্পর্শ তেমন ছিল না। শুধুমাত্র কল্পনা ও তত্ত্ব কথার পসরা সাজিয়েই কবি.এই অসম্পূর্ণতার দাবীকে এতকাল ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। খোলা চোখে তাকে স্পর্শ করার অবসর কখনো আসেনি বলেই বোধহয় রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রকৃতিবোধ কিছুটা mystic আবহাওয়াতে পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে।

ছিন্নপত্রের যুগে পদার্পণ করে কবি প্রথম প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষমানতার মাঝে উপলব্ধির করার অবকাশ পেলেন। ইতিপূর্বে ‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থ রচনাকালে চন্দননগরের গঙ্গা তীরে ও প্রাকৃতির প্রতিশোধ রচনার সময় কামোয়োবাড় সমুদ্রতীরে বসবাস ব্যতীত বিশ্বপ্রকৃতির সাথে সহবাসের সৌভাগ্য কবির বেশি ঘটেনি। ছিন্নপত্র পর্বে কবি মূলত জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েই পদ্মাতীরে বাস করতে গেলেন। কিন্তু বৈষয়িক কাজে এলেও এখানে তিনি তাঁর উপলব্ধির অসম্পূর্ণতাকে সুদ সমেত মিটিয়ে দেবার অবসর পান। উদার অসীমের বুকে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি যেন তার অনাবৃত রূপটি উজাড় করে কবির কাছে ধরা দিল। এই উত্তপ্ত সান্নিধ্যের স্পর্শে রবীন্দ্রসাহিত্য দ্রুত সার্থকতার পথে অগ্রসর হয়। ছিন্নপত্রে আমরা কবির সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির অত্যাশ্চর্য গভীর আত্মীয়তার সন্ধান পাই। ছিন্নপত্রের নানা অংশে এই বিস্ময়কর হৃদ্যতার উপাদান ছড়িয়ে আছে। “ওই যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এখন ভালোবাসি—ওর ওই গাছপালা, নদী, মাঠ, কোলাহল, নিস্তব্ধতা, প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা সুদ্ধ হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে নায়ক যেসব ধন পেয়েছে এমনকি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম ?”—(ছিন্নপত্র – ১৮ নং)। “এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলুম—যখন আমার ওপর সবুজ ঘাস উঠতো……. আমার এই চেতনাপ্রবাহ নিবিড় প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে।”–(ছিন্নপত্র-৬৪নং)-এর হৃদ্যতার সঞ্চালন শক্তিতে কবির পুলক ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখে যদি প্রকৃতি সংসর্গের বয়সটাকে Passionate করি তাহলে অন্যায় হয় না।

এক আকস্মিক কার্যকারণের যোগে কবি যেন অকস্মাৎই পদ্মাতীরে ঘর করতে আসা ছলনাময়ী প্রকৃতির সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলেন। ছিন্নপত্রের অসংখ্য পত্রে এই নতুন অভিজ্ঞতার চিত্ররূপে প্রকাশিত হয়েছে। শস্য কাটার পর বিস্তৃত মাঠের রূপটি পরিচিত চিত্রকল্পর মধ্য দিয়েই যেন কবির কাছে ধরা দেয়। “মনে হল, ওইখানে যেন সন্ধ্যার বাড়ি, ওইখানে গিয়ে সে আপনার রাঙা আঁচলটি শিথিলভাবে এলিয়ে দেয়। আপনার সন্ধ্যা তারাটি যত্ন করে জ্বালিয়ে তোলে আপন নিভৃত নির্জনতার মধ্যে সিঁদুর পরে বধূর মতো প্রতীক্ষায় বসে থাকে।” আবার মধ্যাহ্নের প্রকৃতিতে তিনি বহু সন্তানবতী মায়ের নিশ্চল সহিষ্ণুতার ভাব লক্ষ্য করেন, প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য অনুভব করতে করতে কবির মনে হয়, “নবযৌবনা ধরণি সুন্দরীর সঙ্গে কোনো এক জ্যোতির্ময় দেবতার ভালোবাসাবাসি চলছে”। বিস্তৃত মাঠের ওপর শূন্যতার ছবি দেখে কবির মনে হয়, “কেবল নীল আকাশ ও ধূসর পৃথিবী—আর তারই মাঝখানে একটি সঙ্গীহীন গৃহহীন অসীম সন্ধ্যা, মনে হয় যেন একটি সোনার চেলি পরা বধূ অনন্ত প্রান্তরের মধ্যে মাথায় একটুখানি ঘোমটা টেনে একলা চলেছে।”

লক্ষ করা যাবে, তিনটি দৃষ্টান্তেই কবি যে চিত্র কল্পের আশ্রয় নিয়েছেন তার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি সুন্দরভাবে মানবায়িত বা Personified হয়ে উঠেছে। কবি যে কাব্য রচনার আঙিনায় উচ্চ রোমান্টিকতায় আরোহণ করেছেন, মনের কল্পনাকে মানব গ্রাহ্য শরীরী রূপ দেওয়ার ক্ষমতা যে তার করায়ত্ত উল্লিখিত দৃষ্টান্তে তারই প্রমাণ আছে। মনে পড়ে যায়, কবির কাব্য সাধনার ও পত্র রচনার পরস্পর পরিপূরকভাবের কথা। কাব্যছন্দে বহু ভঙ্গিমায় লীলায়িত হয়েছে পদ্মাতীরের কাব্য। সেই কাব্যরসেই জারিত হয়ে উঠেছে তা। কে যে কার উৎস বা প্রেরণা তা পৃথক করার বোধহয় উপায় নেই।

ছিন্নপত্রে প্রকৃতির বিচিত্র রূপের ছলনার অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কবির সম্মুখে কখনো তিনি সংকুচিতা বধূর মতো অবগুণ্ঠন টেনে বসেন, আবার কখনো তিনি প্রণয়িনীর মতো বিগলিত হয়েই যেন কবিরই গায়ের ওপর ঢলে পড়েন। কখনো বা তিনি স্নেহময়ী জননীর মতো সাহায্যে সকল আবদারকে সহ্য করেন। বিশ্বপ্রকৃতির এই সামগ্রিক পরিচয়ের মধ্যে পদ্মা যেন একটুকরো জ্বলন্ত দীপ্তি। পদ্মার উচ্ছ্বসিত তরঙ্গলীলায় কবি কখনো দেখতে পান উন্মত্ত যৌবনা সাঁওতাল রমণীর নৃত্য, আবার কখনো এ যেন ক্রূর সর্বনাশীর তীব্র ভ্রুকুটি।

সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর এই সময়ের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব আছে। পদ্মার উন্মুক্ত ধারা প্রতীকায়িত হয়ে উঠেছে কবির কাছে। রোমান্টিক পর্বে যে উধাও কল্পনার বেগে রবীন্দ্রনাথ নিখিলমুখী হয়ে উঠেছিলেন, তার পাঠ যে এখান থেকেই নেওয়া, সন্দেহ নেই। সমগ্র বিশ্বের এক চরাচর গ্লাবিতার সত্যকে স্পষ্ট করে তোলে নদীর সচল গতিরেখা। ‘সোনার তরী’ কাব্যর বসুন্ধরা কবিতায় নিখিল সৌন্দর্যে অবগাহনের পিছনে রহস্যময়ী পদ্মার যে একটা ভূমিকা আছে তাতে সন্দেহ নেই।

ছিন্নপত্রের প্রকৃতি শুধু বাহ্য সৌন্দর্যসর্বস্ব মনোহারী বস্তু সন্নিবেশ নয়, এখানকার প্রকৃতি এক নব অভিব্যক্তির নাম। মানব জীবনের প্রতি প্রকৃতির মধুময় স্নেহরস ও লালন সুধারও খবর দেয় এই গ্রন্থর অনবদ্য পত্ররাজি। অনেকটা Wordsworth-এর Patern-এর মতো মাতৃরূপা প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের একটা সুদৃঢ়শায়ী নাড়ীর যোগ আছে। মায়ের সযত্নে পরিচালনার পরিপুষ্ট জীবনরস অস্থির প্রাণচাঞ্চল্যে সাবলীলভাবে ধরা যায়। কবি বোটের ওপর বসে এইসব দৃশ্য মগ্নভাবে লক্ষ্য করেছিলেন। জলের সঙ্গে মেয়েদের জীবনধর্মের নিগুঢ় মিল উনি লক্ষ্য করেছেন। অথচ স্নান তৎপর পুরুষেরা কেমন উদাসীন। এই বৈপরীত্য থেকেই তিনি নিষ্কাশন করে নিয়েছেন পুরুষ প্রকৃতির নিজ সম্বন্ধের সত্য রূপটিকে। “যেতে নাহি দিব” কবিতা যার সজীব অভিব্যক্তি। ফটিকের প্রাণচাঞ্চল্যের সংবাদ একইভাবে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছেন আর একভাবে। পরিচিত ছকের বাইরে ছন্নছাড়া এইসব চরিত্র যেন প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া সৃষ্টি। ফটিক, তারাপদ, প্রভা, মৃন্ময়ী এই আবেদন নিয়েই শরীরী হয়ে উঠেছে তাঁর গল্পে।

কাজেই ছিন্নপত্রের প্রকৃতিকে দৃশ্যরাজির ব্যবহারিক মূল্যে ধরলে মস্ত ভুল করা হবে। এখানকার প্রকৃতি কবি-সৃষ্টির ধাত্রী।