‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতায় কবি বুদ্ধদেব বসু কীভাবে রবীন্দ্র স্মরণ করেছেন তা উপযুক্ত উদ্ধৃতি সহ বুঝিয়ে দাও।
আধুনিক বাংলা কাব্যের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮)-র ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর প্রথম রবীন্দ্র জন্মতিথিতে ১৯৪২ সালে রচিত হয়। ১৯৪১ সালে ঘটে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু; বুদ্ধদেব মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে সভ্যতার এই দুঃসহ গ্লানি ভরা অবস্থা থেকে তার উত্তরণের জন্য যথার্থ মানব সমাজের প্রতিষ্ঠা ঘটানোর জন্য একজন দেশনেতার পাশাপাশি একজন মহান কবির ও প্রয়োজন কিছু কম নয়। ক্রান্তদর্শী কবিই জাতির দুঃসময়ে সাধারণ মানুষকে ও দেশনেতাকে পথ দেখিয়ে যথার্থ ঠিকানা পৌঁছে দিতে পারেন। আর এমন কবিকেই-বা হাত পাতেন কবিগুরু ছাড়া ? আর তাই-ই জাতির এমন দারুণ দুর্দিনে বুদ্ধদেবের এই রবীন্দ্র স্মরণ—
তোমারে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে
হে বন্ধু, হে প্রিয়তম। সভ্যতার শ্মশান শয্যায়
সংক্রমিত মহামারী মানুষের মর্মে ও মর্জ্জয়ে ;
প্রাণলক্ষ্মী নির্বাসিতা।
কবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের বীভৎস রূপ দেখে শঙ্কিত কবি, রবীন্দ্রনাথকে জাতির এই দারুণ দুর্দিনে বন্ধ, প্রিয়তম মনে করে স্মরণ করেছেন। সভ্যতাকে শ্মশান শয্যায় যখন সংক্রমিত মহামারী মানুষের মর্ম ও সজ্জা থেকে প্রাণলক্ষ্মী নির্বাসিতা, তখন ইতিহাসের মহান পুরোহিত মহাঋষি, রবীন্দ্রনাথের বাণী মেনে আসাই স্বাভাবিক। রক্তপাষীদের উদ্ধত সাঙিনে সুন্দর হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। পুষ্পরথে উড়ে বেড়ানো অত্যাচারী রাক্ষসেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব করতে আপশে-সমুদ্রে দেশে বিদেশে নির্বাচারে বোমা নিক্ষেপ করে জীবনে সোনার হরিণকে করে তুলছে ভীত-সন্ত্রস্ত। কবির ভাষায়—
‘….রক্তপাপী উদ্ধৃত সঙিনে
সুন্দরের বিদ্ধ করে, মৃত্যুবহ পুষ্পকে উড্ডীন
বর্বর রাক্ষস হাঁকে, ‘আমি শ্রেষ্ঠ সবচেয়ে বড়ো।
দেশে দেশে সমুদ্রের তীরে তীরে কাঁপে থরো থরো
উন্মত্ত জন্তুর মুখে জীবনের সোনার হরিণ।
কবি বিস্মিত হতবাক অত্যাচারী ফ্যাসিস্তদের লোভ ও অত্যাচারের ক্রমবর্ধমান পারদ দেখে, রুদ্ধ প্রাণ, সুক্ত প্রাণ এই ফ্যাসি বাদীরা চেয়ে যেন-তেন প্রকারে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। মানব সভ্যতার এই দুঃসহ যন্ত্রণা ও অবমনন বুদ্ধদেবের পথে সহ্য করা সম্ভব হত না, যদি না তাঁর হৃদয়ে চেতনায় জুড়ে রবীন্দ্রনাথের হৃদয় মন্ত্র বিদ্ধ হয়ে থাকত। কবির দৃঢ় বিশ্বাস রবীন্দ্রবাণী তো আমায় মন্ত্রের মতো; তাই তিনি এও জানেন যে জাতির সমস্ত রকম অন্ধকার দূর করে নব-প্রত্যুষের সূচনা করতে পারে রবীন্দ্রবাণী ; রবীন্দ্র বেদমন্ত্রই পারে রাত্রির গভীর বৃত্ত থেকে ছিঁড়ে আনার শক্তি যোগাতে ফুটন্ত সকালকে। রবীন্দ্রনাথের মন্ত্রকে কবি তাই অন্তরে লালন করেন। সে অস্তর লিপ্ত রবীন্দ্রবাণীই সভ্যতার সংকট মুক্তির পথ দেখাবে এ স্থির বিশ্বাস কবির। জীবনের জয় হবেই এই দৃঢ় প্রত্যয় কবির।
প্রসঙ্গত বুদ্ধদেব বসুর ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’—কবিতা দুটির সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে। কারণ শুধু শীর্ষনামে-ই নয়, দুটি কবিতারই মূল বিষয়ীও রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুজ কবির শ্রদ্ধা নিবেদন। তবে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় রবীন্দ্রের বাণী মন্ত্রের উল্লেখ আছে; কিন্তু কোনো প্রত্যয় ব্যবহার নেই। অন্যদিকে কিশোর কবি সুকান্তের কবিতায় কবি সুকান্ত রবীন্দ্রনাথকে প্রতি নিভৃতক্ষণে স্মরণ করেন ; উপলব্ধি করেন তাঁর উপস্থিতিকে। এই ‘উজ্জ্বল উপস্থিতি’-ই তাকে সুধা ও দুর্ভিকের রক্তচক্ষু, ‘জীবের নিঃশব্দ ভ্রুকুটি’ ভুলিয়ে দেয়। কবি মনের গভীরে রবীন্দ্র সৃষ্টির সজীবত নিত্য অনুভব করেন। রবীন্দ্র অনুধাবন করতে বসে কবি রবীন্দ্র ভাবনার স্রোতে অবগ্রহণ করেন— অবশেষে মানব দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে কবি দিয়ে বিশ্বাসে জাগরিত হন। আর সেই বিশ্বাস পরিস্ফুট হয় রবীন্দ্রবাণীর প্রত্যয় উচ্চারণ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘দাননের সাথে সংগ্রামের তরে…’ আর কিশোর কবি সেই ডালের দিয়েছেন—‘প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে। রবীন্দ্রবাণীকে স্মরণ করে কবি গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করেছেন। এভাবে সুকান্ত জীবনের জয়গান গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয় দীপ্ত উচ্চারণে, অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের লালন করেছেন অন্তরে অন্তরে সযত্নে লালন করেই তিনি জীবনকে জয়গান গেয়েছেন।
Leave a comment