রবীন্দ্রনাথের নাট্যপ্রতিভার পরিচয়

বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথের নাট্যরচনাগুলিকে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-

গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, নাট্যকাব্য: ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ এবং ‘মায়ার খেলা’ তাঁর দুটি উল্লেখযােগ্য গীতিনাট্য; চিত্রাঙ্গদা তার একটি বহুখ্যাত কাব্যনাট্য এবং ‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’ প্রভৃতি রচনাকে বলা যেতে পারে নাট্যকাব্য।

প্রচলিত রীতির পূর্ণাঙ্গ নাটক: ‘রাজা ও রাণী’, ‘বিসর্জন’, ‘মালিনী’, ‘মুকুট’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’ প্রভৃতি প্রচলিত রীতির নাটকে শেকসপিয়রের রীতিই অনুসৃত হয়েছে। ‘রাজা ও রাণী’-তে কর্তব্যের সঙ্গে প্রেমের, ‘বিসর্জন’-এ আনুষ্ঠানিকতা ও প্রথার প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে হৃদয়ভক্তির, ‘মালিনী’-তে ধর্মের প্রথাবদ্ধ রূপ ও উদার রূপের সংঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের এক আদর্শ রূপের সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

কৌতুক নাট্য: রবীন্দ্রনাথের রঙ্গব্যঙ্গ ও কৌতুকরসের রচনাগুলিতে প্রধান হয়ে উঠেছে পরিমার্জিত বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকের ছটা। ‘গােড়ায় গলদ’, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘হাস্যকৌতুক’, ‘ব্যঙ্গকৌতুক’ প্রভৃতি এই শ্রেণির রচনা।

রূপক-সাংকেতিক নাটক: রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাংকেতিক নাটকে রূপক ও সংকেতের সাহায্যে জীবন ও জগতের বিভিন্ন দিক দেখানাে হয়েছে। ‘রাজা’য় অরূপের সন্ধান, অচলায়তনে প্রথাবদ্ধ ও শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও জীবনের স্থবিরতা থেকে মুক্তি, ‘ডাকঘর’-এ নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের সন্ধান, ‘মুক্তধারা’য় যন্ত্রসভ্যতার ওপরে মানবচৈতন্যের প্রতিষ্ঠা কিংবা ‘রক্তকরবী’তে সৌন্দর্য ও প্রাণের আহ্বান ঘােষণার মধ্য দিয়ে বাংলা নাটকে রবীন্দ্রনাথ অভিনবত্ব নিয়ে আসেন।

রবীন্দ্রনাথের হাস্যরসাত্মক নাটকগুলির পরিচয়

রবীন্দ্রনাথ হাসির নাটক রচনাতেও নিঃসন্দেহে শিল্পসার্থক ও মঞ্চসফল। তাঁর সেরা হাস্যরসাত্মক নাটকগুলি হল-

গােড়ায় গলদ: বাংলাদেশের একান্ত পারিবারিক প্রেক্ষাপটে, কৌতুক ও করুণার সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি মধুর কমেডি হল ‘গােড়ায় গলদ’ (১৮৯২ খ্রি.)।

বৈকুণ্ঠের খাতা: বৈকুণ্ঠের খাতা (১৮৯৭খ্রি.) মাত্র তিন দৃশ্যের অনাবিল এক হালকা হাসির প্রহসন।

হাস্যকৌতুক ও ব্যঙ্গকৌতুক: ‘হাস্যকৌতুক’ (১৯০৭ খ্রি.) ও ব্যঙ্গকৌতুক’ (১৯০৭ খ্রি.)-কৌতুকপূর্ণ বিষয়বস্তু এবং সংলাপের কৌতুকময়তাই এক্ষেত্রে নাটকগুলিকে সার্থক করে তুলেছে। ‘হাস্যকৌতুক’ পনেরােটি ছােটো ছােটো নাটকের সমষ্টি, যেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ দুটি নাটক হল ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ এবং ‘রােগীর মৃত্যু’। ‘ব্যঙ্গকৌতুক’ গ্রন্থে নূতন ‘অবতার’, ‘স্বর্গীয় প্রহসন’-এর মতাে নাটক থাকলেও এই গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল নাটক হল ‘বশীকরণ’।

চিরকুমার সভা: চিরকুমারদের বিয়ে না করার ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা কী করে কিশােরীদের সামান্য স্পর্শেই ভেঙে গেল- তাই কৌতুককরভাবে বর্ণিত হয়েছে ‘চিরকুমার সভা’ (১৯২৬ খ্রি.) নাটকে।

পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর হাস্যরসাত্মক নাটকগুলিতে মূলত উনিশ ও বিশ শতকের কলকাতার নাগরিক জীবনের বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরেই সৃষ্টি করেছেন হাস্যরসের। তবে তা করতে গিয়ে কোথাও তিনি স্থুল রসিকতাকে প্রশ্রয় দেননি।

রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি রূপক-সাংকেতিক নাটক সম্পর্কে আলােচনা

‘শারদোৎসব’ (১৯০৮ খ্রি.), ‘রাজা’ (১৯১০ খ্রি.), ‘ডাকঘর’ (১৯১২ খ্রি.), ‘অচলায়তন’ (১৯১২ খ্রি.), ‘ফাল্গুনী’ (১৯১৬ খ্রি.), ‘মুক্তধারা’ (১৯২২ খ্রি.), ‘রক্তকরবী’ (১৯২৪ খ্রি.), ‘রথের রশি’ (১৯৩২ খ্রি.) এবং ‘তাসের দেশ’ (১৯৩৩ খ্রি.)-মােট এই নয়টি রূপক-সাংকেতিক নাটক লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

শারদোৎসব: প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধ তৈরি হলে মানবহৃদয় কীভাবে সংকীর্ণতামুক্ত ও উদার হয়—তাই ই দেখানাে হয়েছে।

রাজা: মধুরভাবের সাধনার দৃষ্টিকোণ থেকে মানবাত্মার সঙ্গে বিশ্বাত্মার সম্পর্ক উদঘাটিত হয়েছে।

ডাকঘর: সুদূরের প্রতি মানবমনের সুতীব্র উৎকণ্ঠা ও পিপাসা তথা মানবাত্মার সঙ্গে বিশ্বাত্মার সম্পর্ক এই নাটকের বিষয়।

অচলায়তন: ‘অচলায়তন’ নাটকে নিষ্ঠুর প্রথা ও প্রাণের দ্বন্দ্বের শেষে প্রাণের জয় ঘােষণা করা হয়েছে।

ফাল্গুনী: শীতের মধ্য দিয়ে বসন্তের আবির্ভাব—এটাই তত্ত্বনাটক ‘ফাল্গুনী’র উপাখ্যান-ভাগ।

মুক্তধারা: ‘মুক্তধারা’ নাটকে যন্ত্রের উপরে বন্ধন-অসহিষ্ণু মুক্তপ্রাণের অবাধ লীলাকে জয়যুক্ত করা হয়েছে।

রক্তকরবী: এই নাটকে যন্ত্রের সঙ্গে কৃষির সংঘাত, পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক সভ্যতার সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের সংঘাতে ঘােষিত হয়েছে প্রেম ও প্রাণের জয়।

রথের রশি: মানবতার অপমানে মহাকালের রথ যে অচল হয়ে যায়—কবি তাই এই নাটকটির মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন।

তাসের দেশ: ‘তাসের দেশ’ নাটকে জড়তা থেকে মুক্তির কথা, গতির মহিমা প্রচার ও যৌবনের জয়গান করা হয়েছে।

বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভূমিকা/কৃতিত্ব নিরূপণ

রবীন্দ্রনাথের সমকালে আবির্ভূত নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩ খ্রি.)। দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে-

প্রহসন: দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সমাজবিভ্রাট ও কল্কি অবতার’, ‘বিরহ’, ‘ত্র্যহস্পর্শ’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘পুনর্জন্ম’, ‘আনন্দবিদায়’ প্রভৃতি প্রহসন একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। নাটকগুলির অন্যতম সম্পদ এর হাস্যরসাত্মক গান।

পৌরাণিক নাটক: তিনটি পৌরাণিক নাটক—‘পাষাণী’, ‘সীতা’ এবং ‘ভীষ্ম’-তে কাহিনি ও চরিত্রকে তিনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরেছেন।

সামাজিক নাটক: দ্বিজেন্দ্রলালের দুটি সামাজিক নাটক—‘পরপারে’ এবং ‘বঙ্গনারী’-তে আমাদের প্রচলিত মূল্যবােধ গুরুত্ব পেয়েছে।

ঐতিহাসিক নাটক: ‘দুর্গাদাস’, ‘নূরজাহান’, ‘মেবার পতন’, ‘সাজাহান’ প্রভৃতি নাটকে রাজপুত বীরত্ব ও মােগলযুগের কাহিনি পরিবেশনে দ্বিজেন্দ্রলাল অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। হিন্দুযুগের পটভূমিতে তিনি রচনা করেছেন ‘চন্দ্রগুপ্ত’ এবং ‘সিংহল বিজয়’।

অপেরাধমী নাটক: দ্বিজেন্দ্রলালের একটিমাত্র অপেরাধর্মী নাটক ‘সােরাব-রুস্তম’-এ নাট্যরসের যথেষ্ট অভাব থাকলেও এই নাটকের সংগীতগুলি একসময় বেশ লােকপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

বাংলা নাটকে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রধান কৃতিত্ব নাট্যভাষা ও গদ্য-সংলাপ সৃষ্টি। তিনি তাঁর নাটকে স্বগতােক্তি বাদ দিয়ে চরিত্রদের অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মাধ্যমে নাট্য-আবেদন সৃষ্টিতে সচেষ্ট থেকেছেন। ভক্তিপ্রাধান্য এবং আবেগসর্বস্বতা থেকে বাংলা নাটককে মুক্ত করার কৃতিত্ব দ্বিজেন্দ্রলালেরই প্রাপ্য। নাটকের সংলাপে কাব্যগুণ সংযােগ করাই হল তার অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব।