রবীন্দ্রনাথ ছোটোগল্প লেখায় হাত দিলেন শিল্পীজীবনের এক বিশেষ পূর্বে। তাঁর জীবনে যে নতুন ভাবাবেগের উচ্ছ্বাস ও মানবপ্রীতি দেখা দিয়েছিল, তা সমকালীন কবিতায়, এবং অন্যান্য রচনায়ও আত্মপ্রকাশ করেছে। রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারি দেখাশোনার উদ্দেশ্যে শিলাইদহে বাস করছিলেন, তখন পল্লিগ্রামকে বাস্তবত নিকট হতে দেখার সুযোগ কবি পেলেন। মানুষের জীবনের বাস্তবরূপ দেখলেন। তাদের ছোটোখাট সুখদুঃখ কবির হৃদয়ে তরঙ্গ তুলল। বিশেষ করে প্রকৃতির মধ্য দিয়ে দেখার ফলে যুগপৎ মানুষ ও প্রকৃতিকে তিনি এক সূত্রে বেঁধে ফেললেন। এরই ফল ফলেছে তাঁর “সোনার তরী”, “চিত্রা”, “চৈতালি” প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ এবং “গল্পগুচ্ছের” গল্পগুলিতে।

রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করায়। এই বিষয়ে ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় যা লিখেছেন তার তাৎপর্য অনুধাবনযোগ্য। ‘অপূর্ব আনন্দময় ও বৈচিত্র্যে ভরপুর এই সময়কার জীবনযাত্রা। বাংলাদেশের একটি নির্জনপ্রান্ত, তার নদীতীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুচর, অবারিত মাঠ, ছায়া সুনিবিড় গ্রাম, সহজ অনাড়ম্বর পল্লিজীবন, দুঃখে জড়িত, অভাবে ক্লিষ্ট অথচ শান্ত সহিষ্ণু গ্রামবাসী, সবকিছুকে কবির চোখের সমুখে মেলে ধরেছে, আর কবি বিমুগ্ধ বিস্ময়ে পুলকে শ্রদ্ধায় ও বিশ্বাসে তার অপরিসীম সৌন্দর্য আকন্ঠ পান করেছেন। এমনি করেই ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পল্লিজীবনের সুখদুঃখের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় হতে আরম্ভ করল; গ্রামের পথঘাট, ছেলেমেয়ে, যুবাবৃদ্ধ সকলকে তিনি একান্ত আপনজন বলে জানলেন। “ছিন্নপত্রে এই সময়কার প্রত্যেকটি চিঠিতে কবি নিজেই বারবার এসব কথা বলেছেন। জীবনের এই সব নানান বেদনা ও আনন্দ যখন তাঁর মনকে অধিকার করে আসল, তখন তাঁর ভাব ও কল্পনার মধ্যে আপনা-আপনি বিভিন্ন গল্প রূপ পেতে আরম্ভ করল। তুচ্ছ ক্ষুদ্র ঘটনা ও ব্যাপারকে নিয়ে এইসব বিচিত্র সুখদুঃখ অন্তরের মধ্যে মুকুলিত হতে লাগল।”

রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের সঙ্গে ইউরোপ এবং আমেরিকার বিশিষ্টতম তিনজন ছোটোগল্প লেখকেরা তুলনা করলেই কবির মেজাজের বৈশিষ্ট্য এবং অপরের সঙ্গে তাঁর স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিটি আবিষ্কার করা যাবে।

মার্কিন লেখক এড্‌গার অ্যালেন পো ছোটোগল্প রচনায় নিপুণ কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গল্পের ঘটনাগত তীব্রতা এবং চমককে চমৎকার কাজে লাগানো হয়েছে। বিশেষ করে বীভৎস ও ভৌতিক রসসৃষ্টিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মোপাসাঁ ফরাসি সাহিত্যিক। তাঁর গল্পগুলিতে বহিরাঙ্গিক প্রসাধনে নৈপুণ্যের পরিচয় আছে। ঘটনা বিন্যাস যেমন তীব্র তেমনি তীক্ষ্ণ সমাপ্তি অংশ আকস্মিকতায় এবং নতুন তাৎপর্য আবিষ্কারে গল্পের আস্বাদে বৈচিত্র্য আনে। মানবপ্রবৃত্তি, তার দুপ্রতিরোধ্য শক্তি, সমাজবিধি উল্লঙ্ঘনের চেষ্টা মোপাসাঁর ভাবকল্পনার বাহন। ব্যঙ্গদৃষ্টি এবং অন্তর্ভেদী জীবনবোধ তাঁর গল্পের অন্যতম সম্পদ। রুশ সাহিত্যিক চেখভ কিন্তু ঘটনার তুলনায় হৃদয়লোকের অন্দরে প্রবেশের অধিক পক্ষপাতী। বাহিরের আড়ম্বর তাঁকে ততখানি আকর্ষণ করোতে পারেনি। সূক্ষ্ম অন্তর্বেদনা, মৌন হাহাকার, ধূসর উপলব্ধি তাঁর গল্পগুলিতে দেখা যায়।

রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প এদের রচনাধারা হতে একেবারে পৃথক ধরনের। কবি মূলত গীতিধর্মী প্রতিভার অধিকারী। তাঁহার ছোটোগল্পেও এই গীতিরসের প্রভাব নানাভাবে বর্তেছে। বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের গীতিধর্ম হ’ল প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক করে তোলা আকর্ষণীয় সিদ্ধান্তের দিকে কাহিনিকে নিয়ে যাওয়া—রবীন্দ্রনাথের এইরূপ লক্ষ্য ছিল না। তাঁর বেশিরভাগ গল্পে ঘটনাংশে গৌণ অথবা ঘটনাগুলি এতই মামুলী, এতই সামান্য ও নিস্তরঙ্গ ধরনের যে স্বাভাবিকভাবে তাদের কোনো আকর্ষণ থাকবার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ ঘটনার ঘনঘটার অভাব সম্বন্ধে সচেতন, সচেতন ভাবেই তিনি ঘটনার স্থান এনেছেন গীতিরস। বেদনার ঘনীভূত দীর্ঘশ্বাস, করুণ কামনার কম্পন, হতাশার তীব্র আর্তনাদ, অস্পষ্ট চিত্তকম্ভুয়ণ, কিঞ্চিৎ অনির্বচনীয় অনুভূতি তাঁর ছোটোগল্পগুলিতে ঘটনা ও চরিত্রের স্বল্প আয়োজনে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

মানুষের জীবনের প্রতি গভীর মমতা এবং গীতিরসের আবেগোচ্ছ্বাসে জীবনাতীত রহস্যানুসন্ধান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর গল্পগুলির মধ্যে। কবিমানস জীবনের বস্তুরূপের সঙ্গে প্রকৃতিকে আশ্চর্য কৌশলে মিলিয়ে দিলেন। বহুক্ষেত্রে গীতিরস উদ্বেল হয়ে উঠল। মানুষ ও প্রকৃতিকে নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে ফেলা রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তের বিশেষ প্রবণতার ফল। মানবজীবনের বিচিত্র ঘটনা প্রকাশকে প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত করে দেখা তাঁর কবিহৃদয়ের ধর্ম, এটাই তাঁর অদ্ভুত ভাবলোকধ্যান, যার স্পর্শে পৃথিবীর ধুলামাটি, আমাদের ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের যা কিছু তুচ্ছ, ক্ষুদ্র দুঃখবেদনায় ব্যথিত, সমস্তই‌ সোনা হয়ে গেছে, অপূর্ব রূপে রসে অভিষিক্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর এই ধ্যানের স্পর্শে, যে বস্তু নিয়ে তাঁর কারবার, সেই বস্তুরই রূপ অনেক সময়ে একেবারে বদলে গেছে, তাকে দেখে আর চেনা যায় না।

রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক দৃষ্টি অধিকাংশ গল্পেই কল্পনার এক অতিরেক সৃষ্টি করেছে। কোথাও অতীত রোমান্সরাজ্যে অভিসার করেছে। কোথাও কিঞ্চিৎ অতিপ্রাকৃতের স্পর্শ দিয়েছে। এইভাবে দেখা যায়, যেখানেই কবি ঘটনা বিরলতা, গীতিধর্ম প্রকৃতি নৈকট্য বা কোনো ধরনের কল্পনাতিরেককে আশ্রয় করেছেন, সেখানেই তাঁর ছোটোগল্পগুলি আশ্চর্যসুন্দর হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গল্পে সমাজজীবনের বাস্তব সমস্যাও রূপ পেয়েছে। চরিত্রচিত্রণে মনস্তাত্ত্বিকতা বহুক্ষেত্রে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু প্রায়ই তার মধ্যে প্রকৃতিচেতনা, গীতিরস কিছুটা স্থান করে নিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলির মধ্যে মানবপ্রবৃত্তির তীব্র দাবদাহের প্রকাশ বড়ো মেলে না। সর্বত্রই একটা নিবিড় প্রশান্তি যেন বিরাজ করোছে। গভীর অন্তর্বেদনাও অন্তরতম হৃদয়লোকে গুঞ্জরিত হয়ে ফিরেছে।

‘গল্পগুচ্ছে’র প্রথম খণ্ডের প্রধান গল্পগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করে নেওয়া চলে : (১) গীতিধর্মী গল্প—‘পোস্টমাস্টার’, ‘একরাত্রি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘সুভা’, খাতা (২) রোমান্সধর্মী গল্প—‘দালিয়া’, ‘একটা আষাড়ে গল্প’, ‘রীতিমতো নভেল’, ‘জয়-পরাজয়’, ‘অসম্ভব কথা’ (৩) সমাজ ও পরিবার জীবনের কাহিনি ও চিত্র—’দেনাপাওনা’, ‘তারাপ্রসন্নের কীর্তি’, ‘দান প্রতিদান’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘স্বর্ণমৃগ’। (৪) ঘটনাবহুল তথা মনস্তাত্ত্বিক—‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘কঙ্কাল’, ‘সমাপ্তি’।

গল্পগুলি শ্রেণিগতভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানেই রবীন্দ্রনাথ সাফল্যের চরম স্বর্গে পৌঁছেছেন, যেখানে তাঁর কবিপ্রাণ আপনাকে পুরোপুরি প্রকাশ করতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথ মহান সাহিত্যিক, তাঁর সব গল্পের মধ্যেই প্রতিভার স্বাক্ষর কোনো না কোনোদিক হতে পড়বেই। কিন্তু বাঙালির সমাজ ও পরিবারজীবনের ঘনিষ্ঠ চিত্রাঙ্কন, কিংবা ঘটনাবহুল উত্তেজনাপূর্ণ প্রসঙ্গে তিনি সচরাচর বিশেষ ঔৎসুক্য অনুভব করতেন না। আলোচ্য ছোটোগল্পগুলির মধ্যে তাই প্রথম শ্রেণির ছোটোগল্পগুলিতেই কবির বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত।

যেসব ছোটোগল্পে সামাজিক সমস্যার বাস্তব দিকগুলি প্রকাশ করোতে চেয়েছেন কবি, তাদের মধ্যে বড়ো ধরনের কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়নি। কিন্তু যেসব স্থানে মানুষের মনস্তত্বের সূক্ষ্ম জটিলতা তিনি বিশ্লেষণ করিয়াছেন, সেখানে তাঁর রচনা আশ্চর্য শিল্পসমৃদ্ধি লাভ করেছে। উপন্যাসের চরিত্রচিত্রণে যে সামগ্রিকতা প্রয়োজন তা অপেক্ষা আভাসে ইঙ্গিতে চরিত্রের নিগূঢ় সত্যকে চকিত চমকে সত্য করে তোলায় কবির কৃতিত্ব অনেক বেশি।

রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলির আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করবার মতো। গল্পগুলির সমাপ্তিতে একটি চমক সৃষ্টি করবার যে রীতি ইউরোপীয় গল্পকাররা অনুসরণ করেন, রবীন্দ্রনাথের পদ্ধতি তা হতে একেবারে স্বতন্ত্র। কবি যে ধরনের চমক সৃষ্টি করেন, বাইরে তা খুব তীব্রতার সৃষ্টি করে না। তার প্রভাব গূঢ়চারী। ব্যক্তিজীবনের বেদনাকে তা বিশ্বজীবনের সাথে মিল করায়, মানবসমাজের সঙ্গে প্রকৃতিজগতের মিলন ঘটায়।