‘চিত্রা’ কাব্যে ‘এবারে ফিরাও মোরে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন :
“বড়ো দুঃখ বড়ো ব্যথা—সম্মুখেতে কষ্টের সংসার,
বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বন্ধ, অন্ধকার।”
অর্থাৎ মানুষের জীবন নিয়ে কবির ভাবনা সুখ দুঃখের দোলায় নিত্য দোলায়িত হয়ে তাঁর সৃষ্টির প্রাঙ্গণ ভরিয়ে তুলেছিল। তিক্ত মধুর জীবন স্বাদের নানান অনুভূতিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রচনা ধারাতে আর গতি সঞ্চার করেছিল। পাশাপাশি ফুটে উঠেছে নিরন্ন গ্রাম্য মানুষের অভাব, অপুষ্টি এবং খাদ্যের জন্য হাহাকারের নানান দৃশ্যপট। কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিরন্ন মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়াস, গ্রামে দুস্থ প্রজা, মুসলমান চাষি, সাধারণ মানুষ ঘুরে ফিরে লেখকের দৃষ্টিপথে আবর্তিত হয়েছে। মানুষের কল্যাণব্রতে উৎসর্গীকৃত প্রাণ রবীন্দ্রনাথের চেতনায় দুঃখের এই দারুণ আঘাতে বেদনার সৃষ্টি করেছিল। মানব জীবনের ‘দুঃখ নিশা’ দূর করার আকুল বাসনা কবির অন্তরে সদা জাগ্রত ছিল। একদিকে এই বাস্তব প্রেক্ষিত থেকে জেগে ওঠা কবিপ্রাণের আকুতি এবং অন্যদিকে মানব জীবন সম্পর্কে অন্তরতম সত্য আবিষ্কারের চেষ্টাতেই কবি ‘ছিন্নপত্র’ রচনায় নিযুক্ত ছিলেন। তাই হয়তো আক্ষরিক ভাবে জগত ও জীবন তাঁর মানস নয়নে প্রতিবিম্বিত হয়ে ওঠেনি, বরং সামান্য উপকরণ রূপে তাঁর মনের গতিকে প্রকৃতি অনুযায়ী চেতনাকে প্রভাবিত ও পরিপুষ্ট করে তুলেছে। রহস্যময় জীবনের স্বরূপ আবিষ্কারে তাঁর আন্তরিক প্রয়াসের বিবরণ ছিন্নপত্রাবলির বেশ কয়েকটি চিঠিপত্রে বিধৃত আছে। নিজের মনের ভেতরকার অপার রহস্য অন্বেষণ করতে বিচিত্র অনুভূতির সম্মুখীন হয়ে এই সকল পত্রের দ্বারস্থ হয়েছেন।
শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনা করা কবির ক্ষেত্রে ছিল উপলক্ষ্যমাত্র। তবে এই সূত্রে প্রকৃতির অত্যন্ত কাছাকাছি আসবার সুযোগ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ এই সৌন্দর্যময় জগতে নিজেকে মেলে ধরবার বিশেষ অবকাশ পেয়েছিলেন। প্রকৃতির সৌন্দর্য তিনি কীভাবে উপভোগ করেছেন, নিঃসঙ্গ প্রবাসের দিনগুলিতে প্রকৃতি তাঁকে কেমনভাবে সঙ্গ দিয়েছে ‘ছিন্নপত্রের’ প্রায় সকল পত্রেই আন্তরিক ভাবে উদ্ঘাটিত হয়েছে। এই জমিদারির কাজ দেখতে এসে তিনি শুধুমাত্র পূর্ববঙ্গের গ্রাম্য প্রকৃতি নদীচর দেখে ক্ষান্ত থাকেননি, দেখেছেন সেখানকার মানুষকে, জেনেছেন তাদের দীনদরিদ্র অবস্থা ও প্রাত্যহিক জীবনের গ্লানিকে। বস্তুত এদের অবস্থা দেখেই লেখকের মনে দ্বন্দ্ব জেগেছিল— তাঁর আসল কাজ কী, তা তিনি স্থির করতে পারছেন না—সৌন্দর্যের জগতে নিরুদ্দেশ বিচরণ, নাকি বাস্তব পৃথিবীর প্রকৃত চেহারা পরিস্ফুটন। তাই অকপটে চিত্তে আবেদন জানিয়েছেন—
“এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে
হে কল্পনে, রঙ্গময়ী।”
এ কোন সংসার? কাদের কাছে তিনি নিজেকে নিয়ে যেতে বলেছেন—তা ছিন্নপত্রের মর্মে মর্মে অনুরঞ্জিত হয়েছে। দুর্বল অসহায় মানুষের জন্যেই সৌন্দর্যলোক থেকে কবি বাস্তব জগতে ফিরে আসবার কথা বারে বারে ব্যক্ত করেছেন। কারণ, গ্রাম-বাংলার প্রকৃত মানুষের জীবনধারায় দুঃখের নিত্য অভিঘাত কবি মনে এক স্বতন্ত্র জীবনঅন্বেষা সৃজন করে গিয়েছিল।
গ্রাম-বাংলার দুঃসহ জীবনযাত্রার চমৎকার বাস্তব ছবি লেখকের অধিকাংশ পত্রেই বিধৃত হয়েছে। ১২১ সংখ্যক পত্রে এমন একটি ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে : “ঘরে ঘরে বাতে ধরেছে, পা ফুলছে, সর্দি হচ্ছে, জ্বরে ধরছে, পিলেওয়ালা ছেলেরা অবিশ্রাম কাঁদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না—এত অবহেলা অস্বাস্থ্য অসৌন্দর্য দারিদ্র্য মানুষের বাসস্থানে কি এক মুহূর্ত সহ্য হয়!” কেবল পল্লিবাংলার এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত জীবন নয়, নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা সম্বন্ধেও যে রবীন্দ্রনাথ অবহিত ছিলেন তা বোঝা যায়। ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ইংরাজ ও ভারতবাসী প্রবন্ধ থেকে—“অপমান সম্বন্ধে আমরা উদাসীন নহি কিন্তু আমরা দরিদ্র এবং আমরা কেহই স্বপ্রধান নহি, প্রত্যেক ব্যক্তিই একটি বৃহৎ পরিবারের প্রতিনিধি। কে না জানে দরিদ্র বাঙালি কর্মচারীগণ কতদিন সুগভীর নির্দেশ এবং সুতীব্র ধিক্কারের সহিত আপিস হইতে চলিয়া আসে। তাহাদের অপমানিত জীবন কী অসহ্য দুর্ভর বলিয়া বোধ হয়।” সুখদুঃখময় মানব জীবনের বিচিত্র তরঙ্গ থেকেই জীবনের গভীরতম উপলব্ধির জগৎ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এই বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। শিলাইদহের প্রকৃতি ও মানবজীবন তার কল্পনাকে ও জীবনদর্শনকে উৎসারিত এবং অনুপ্রাণিত করে দিয়েছিল তা ঐতিহাসিক সত্য। তাই মানুষের সুখ-দুঃখময় জীবনের পাশে প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের সম্পর্ক সংস্থাপিত হয়েছে।
‘মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’ শৈশবের এই মানবজীবন সম্ভোগের পিপাসা স্পষ্ট ও পরিণতি প্রাপ্তি ঘটেছিল ‘ছিন্নপত্র’ পর্বে। সে প্রকৃতি ও মানবজীবন ভাবকল্পনার বিষয় হিসাবে কবিমানসে পুঞ্জীভূত ছিল জমিদারি পরিদর্শনে সুদীর্ঘকাল পল্লিবাংলার নদীতে কাছারি কুঠিতে অবস্থানকালে-মানুষের ঘনিষ্ঠ সংসর্গে তা অনেকখানি বাস্তব ও মৃত্তিকালগ্ন হয়ে উঠেছে। এই বাস্তব অভিজ্ঞতার বুক থেকেই উঠে এসেছে ‘ছিন্নপত্র’র সুখ দুঃখে আন্দোলিত, অভাব অভিযোগ মুখরিত, সারল্যে নির্মলতায় উদ্ভাসিত, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নদীস্রোতের মতো প্রবাহিত প্রকৃতি সংলগ্ন মানুষের অজস্র ছবি। যদিও তিনি বলেছিলেন—“এখানে মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশি ।”(৩৮) তবুও ছিন্নপত্রে ছড়িয়ে আছে নদীতীরবর্তী জনপদবাসী মানুষের অজস্র খণ্ড চিত্র। নদীবক্ষে ভাসতে ভাসতে তার মানস ক্ষেত্রে ভেসে উঠেছে কত আশ্চর্য বিচিত্র মানবলীলা : “নদী পর্যন্ত একটি গড়ানে কাঁচা ঘাট, যেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ নাইছে, কেউ বাসন মাজছে, কোনো কোনো লজ্জাশীলা বধু দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসি কাঁখে জমিদারবাবুকে নিরীক্ষণ করছে।” (১৬) সাজাদপুরের ঘাটে সেই—’গোপাল সা’র মেয়ের স্বামীগৃহে যাত্রার দৃশ্য, শিলাইদহে এক ছোটো নদীর ঘাটে কাদামাখা ছেলেদের উল্লাস, আসন্ন ঝড়ের সংকেতে দ্রতধাবমান কৃষকদের ছবি ছাড়াও আছে—“একজন মেয়ে তার একটি ছোটো উলঙ্গ কালো ছেলেকে এই খালের জলে নাওয়াতে এসেছে, তারপর ভিজে গায়ে সেই উলঙ্গ কম্পিত ছেলের হাত ধরে বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে গেল।”(২০) কখনো বা এই মানুষের ছবি দু-একটি কালির আঁচড়ে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছে “কেউ বা ঘাসের বোঝা, কেউ বা চুপড়ি, কেউ বা একটা বস্তা কাঁধে করে হাটে যাচ্ছে, এবং হাট থেকে ফিরছে….। (২৭)
দূর থেকে চলমান মানুষের নানা ছবি দেখে মাঝে মাঝে লেখকের মনে হয়েছে— “মানুষও নানা শাখা-প্রশাখা নিয়ে নদীর মতোই চলেছে”(৩৮)। এই ক্ষুদ্র তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর নিরর্থক জীবনকে দেখেও সেই সব জীবনকে জানার চেনার অনুভব করার একটা দূরত্ত আকাঙ্ক্ষা রবীন্দ্রনাথের মনে জেগে উঠেছিল—“এরা নিতান্তই মাটিরই সন্তান, নিতান্তই পৃথিবীর গায়ের সঙ্গে লেগেই আছে—যেখানে সেখানে জন্মাচ্ছে, পথে পথেই বেড়ে উঠছে, এবং যেখানে সেখানে মরছে—এদের ঠিক অবস্থাটা, ঠিক মনের ভাবটা ভারি জানতে ইচ্ছা করে।” (২০) শুধু এই নাম পরিচয়হীন মানুষদের দূর থেকে দেখাই নয় রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল পল্লিবাসের সূত্রে, জমিদারি কাজের দৌলতে বহু মানুষকে নিকট থেকেও দেখেছেন। তাদের নাম পরিচয় নিয়েই উঠে এসেছে ছিন্নপত্রের পাতায় পাতায়। সাজাদপুরের জনপ্রিয় পোস্টমাস্টার ফটকাভিমুখী স্টিমারের নিত্যসঙ্গী অঘোরবাবু, মেমসাহেব, মৌলবি, সবাই যেন কথাশিল্পের অপ্রধান চরিত্রের মতো সারিবদ্ধভাবে এসে দাঁড়িয়েছে এই পত্রাবলিতে। ছোটোগল্পের-পোস্টমাস্টার, মৃন্ময়ী; ফটিক প্রভৃতি চরিত্রের নিখুঁত অস্তিত্ব পত্রাবলিতে প্রকটিত। সঙ্গে মিশে আছে দরিদ্র মানুষের গভীর জীবন সংগ্রাম কুসংস্কারে ও অশিক্ষায় বন্ধ মানুষের মর্মান্তিক জীবন যন্ত্রণার করুণ রেশ। এই দরিদ্র-অসহায়-দুর্বল মানুষের প্রতি অত্যন্তিক মমতায় প্রতিমুহূর্তে দ্রবীভূত হয়েছিল লেখক জমিদার রবীন্দ্রনাথের মন—“আমার এই দরিদ্র চাষি প্রজাগুলিকে দেখলে আমার ভারি মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরূপায় (৮১)।”
‘ছিন্নপত্র’ তাই মানবজীবন লেখ্য, তবে তা শুধুমাত্র একজন কবির চোখে দেখা রোমান্টিক ছবি নয়। স্বভাবতই এই মানুষের ছবি বাস্তব অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রাপ্ত সুখে দুঃখে, সারল্যে জটিলতায় বিশ্বাসে বিক্ষোভে, প্রাপ্তিতে বঞ্চনায় নরদেবতারই ছবি। ছিন্নপত্রের মানুষ আসলে অপরিচিত পল্লির বাতায়ণ বা কাছারিঘরের দূরত্ব থেকে ক্রমে রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক জীবন চেতনায়, তাঁর কর্মসাধনার, স্বদেশ ভাবনার কেন্দ্রে অন্তরঙ্গ—নরদেবতা রূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। সেই নবদেবতার উদ্দেশ্যে তিনি সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন “পৃথিবীতে যদি দুঃখ থাকে তো থাক, কিন্তু তার মধ্যে এতটুকু একটু ছিদ্র একটু সম্ভাবনা রেখে দেওয়া উচিত যাতে সেই দুঃখ মোচনের জন্য মানুষের উন্নত অংশ অবিশ্রাম চেষ্টা করতে পারে। একটা আশা পোষণ করতে পারে।” এই অকৃত্রিম ধারণার বশবর্তী হয়ে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে সৌন্দর্যের অনুধ্যান করা কবির পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়নি—তাই নিজেকে তিনি বারে বারে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন এই সকল মানুষদের মধ্যে, যে মানুষদের মধ্যেই প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে—
“অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু
সাহস বিস্তৃত বক্ষপট।”
Leave a comment