রবীন্দ্রনাথের করতে সংশ্চিম দাপ্রধান বিশেষত্ব—রোমান্টিকতা। তিনি বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক গীতিকবিদের অন্যতম। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক তার সমস্ত সৃষ্টিতে এই রোমান্টিক গীতিকবির হাতের ছোঁয়া স্পষ্ট। কবিজীবনের শুরুতেই মুগ্ধ হয়েছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর আপন সুরে। ‘নিসর্গ সন্দর্শনে’ বিহারীলাল গেয়েছেন “প্রণয় করেছি আমি প্রকৃত রমণী সনে/যাহার লাবণ্য ছটা মোহিত করেছে মনে।” রবীন্দ্রনাথও ‘সন্ধ্যাসঙ্গীতে’ লেখেন—
“অনস্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝারে
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার।” (গান আরম্ভ)
বিহারীলাল যে কাব্য ধারার সূচনা করতে চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে তার বিশ্বজয়। তাই ‘বিশ্বকবিই’ রবীন্দ্রনাথের বড় পরিচয়।
নিতান্তই বালক বয়স থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের যে সৃষ্টি শ্রোতধারা অব্যাহত ছিল তাতে কবিতা রচনায় কোথাও বিস্তর ছেদ পড়েনি। আর এই যে গতিধারা তা নিরস্তর পরিবর্তনময়। বালক কবির বিস্ময় ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতিতে, প্রেমে, সৌন্দর্যময়তায়, মৃত্যুচেতনায়, অধ্যাত্ম অনুভূতি, বিশ্বচেতনায়, সর্বোপরি মানব চেতনায় নির্মাণ করেছেন আপন ‘জীবনদেবতা’কে। জন্ম রোমান্টিক কবি বিশ্বভ্রমণ করে দাঁড়িয়েছেন ‘রূপনারায়ণের কূলে’, মানুষের কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের এই সুদীর্ঘ কাব্য জীবনকে সমস্ত রবীন্দ্র সমালোচকই কয়েকটি পর্বে ভাগ করে আলোচনা করে থাকেন—
১) সূচনাপর্ব বা উল্লেখ পর্ব :
এই পর্বে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে ‘কবিকাহিনী’ (১৮৭৮), ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ (১৮৮২), ‘প্রভাত সঙ্গীত’ (১৮৮৩), ‘ছবি ও গান’, (১৮৮৪) ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ (১৮৮৪), কোড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬)। ‘কবিকাহিনী’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। কবিকাহিনী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথই মন্তব্য করেছেন—“যে বয়সে লেখক জগতের সমস্তকে তেমন করিয়া দেখে নাই, কেবল নিজের অপরিষ্ফুট ছায়া মূর্তিটিকে খুব বড় করিয়া দেখাইতেছে, সেই বয়সের লেখা।” এই পর্বে ‘সন্ধ্যাসঙ্গীতে’ আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে।” সন্ধ্যাসঙ্গীতে কবি যে হৃদয় অরণ্যে পথ হারিয়েছিলন ‘প্রভাতসঙ্গীতে’ কবি নিজেকে মুক্ত করলেন। তিনি দেখলেন—
“হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।”
‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ হল কবির। এই পর্বে স্বতন্ত্রসৃষ্টি ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। বৈষ্ণবপদাবলী অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথকে যে কতখানি নাড়া দিয়েছিল এই কবিতাবলীই তার স্বাক্ষর। ‘কোড়ি ও কোমল’ কাব্যে প্রকৃতিচেতনার সঙ্গে এসে মিশল মৃত্যুচেতনা। কবির মর্ত্য প্রেম এখানেই সোচ্চার ভাবে ধ্বনিত হয়েছে।
“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
২) প্রতিষ্ঠাপর্ব বা ঐশ্বর্যপর্ব :
এই পর্বে অর্ন্তভুক্ত হতে পারে—’মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনারতরী’ ১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬) ও ‘চৈতালী’ (১৮৯৬) ইত্যাদি। বাংলা কাব্যসাহিত্যে প্রকৃত অর্থে। রবীন্দ্র কাব্যে এক একটি তত্ত্বরূপ পেয়েছে তার উন্মেষ ‘মানসীতে’ গাজীপুরে লেখা এই কবিতাগুলিতে এসেছে রোমান্টিক সুদূরতার ভাব। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “মানসীর ভালবাসা অংশটুকুই কাব্যকথা। আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে, তাহে ভালবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানসী প্রতিমা।” সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা শুরু হয়েছে ‘সোনারতরী’। জমিদারী পরিদর্শনে কবিকে যেতে হয়েছিল বাংলাদেশে। নদী তীরে নিসর্গ প্রকৃতির অপরূপ মাধুরী কবিকে মুগ্ধ করে। এই কাব্য থেকেই ‘মানসসুন্দরী’ ও জীবনদেবতা তত্ত্বের রূপ গড়ে তোলেন। ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘সোনারতরী’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা। লোকজীবনের ব্যবহারিক বাণীকে রবীন্দ্রনাথ উপেক্ষা করে ঔপনিষদিক মোহ বিস্তার করে চলেছেন—এই অভিযোগ কবি মিথ্যা প্রমাণ করেছেন ‘চিত্রা’ কাব্যে। কবির ব্যবহারিক জীবনের বাণী এখানে উপেক্ষিত হয়নি। ‘জীবনদেবতা’র সঙ্গে আধ্যাত্মিক তত্ত্বের কোন যোগ নেই। ‘ছিন্নপত্রে’ গ্রামবাংলার প্রকৃতির যে বর্ণনা পাই চৈতালীর’ কবিতাগুলিতে তাকেই আমরা কাব্য রূপে পাই।
(৩) অতবর্তী পর্ব :
এই পর্বে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে—‘কথা’ (১৯০০), ‘কাহিনী’ (১৯০০), ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০), ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘স্মরণ’ (১৯০২-৩), ‘শিশু’ (১৯০৬) উৎসর্গ (১৯১৪) এবং ‘খেয়া’ (১৯১০)। এই পর্বের প্রধান উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘কল্পনা’। কল্পনায় একদিকে রয়েছে প্রাচীন ভারত আবিস্কারের ব্যাকুলতা আর একদিকে আছে আঘাত-সংঘাতের মধ্যে দিয়ে বীরবাণ প্রাণশক্তির জয় ঘোষণা।” ঊনবিংশ শতাব্দীর অস্তিম থেকে বিংশশতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে কবিকে মুখোমুখি হতে হয় অনেকগুলি মৃত্যু দৃশ্যের। যাকে একদিন “মরণেরে তুঁহু মম শ্যাম সমান” বলেছিলেন তাই-ই ‘খেয়া’য় চড়ে কবিকে নিয়ে গেল অধ্যাত্ম লোকের পথে।
৪) গীতাঞ্জলি পর্ব :
এই পর্বে অন্তর্ভূক্ত কাব্যসমূহ ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০), ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪) এবং ‘গীতালি’ (১৯১৫)। খেয়ায় চড়ে যে অন্তলোকে কবি যাত্রা করেছেন ‘গীতাঞ্জলি’-তে সেই অর্ন্তলোকের রহস্য ধরা পড়েছে। তিনি তার অস্তরদেবতাকে ‘প্রিয়রূপে’, ‘সখারূপে’, ‘প্রাণেশরূপে’—রূপ ও রসের মধ্যে উপলব্ধি করেছেন। ‘গীতাঞ্জলি’-র এই গানগুলিই কবিকে বিশ্বকবির সম্মান দেয়। ‘গীতালি’তে কিছুটা বৈচিত্র্য দেখা দিল। কবি আপন প্রাণেশের দেখা পেলেন প্রেমিকের বেশে, কবির সঙ্গে লীলারসের সম্পর্ক গড়ে উঠল তার। কবি লিখলেন—“আমার সকলকাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে।” এই অস্তরলোক থেকে মুক্তির বাসনা ‘গীতালি’, ‘গীতিমাল্য’তে অপ্রকাশিত থাকেনি।
৫) বলাকা পর্ব :
এই পর্বে অর্ন্তভুক্ত কাব্যসমূহ—’বলাকা’ (১৯১৬), ‘পূরবী’ (১৯২৫) এবং ‘মহুয়া’ (১৯২৯) উল্লেখযোগ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে ইউরোপ ভ্রমণে মানবের চূড়ান্ত অপচয়কে দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন কবি। এই মহাবিপদ থেকে মুক্ত হতেই কবি জয়গান গাইলেন যৌবনের। নতুন করে জেগে উঠলেন কবি। জীর্ণ-জরা ঝরিয়ে দিয়ে, স্থবিরত্বকে ঘুচিয়ে মহাবিজয়ের শঙ্খ তুলে নিতে পারে সবুজের দল। ঝিলামের নদী তীরে বসে বলাকার পক্ষসঞ্চালনে কবি সেই অবিরাম গতিকেই প্রত্যক্ষ করলেন। ঊপনিষদের ‘চরৈবেতি’ ‘চরৈবেতি’ মন্ত্র যে প্রাণাবেগ সঞ্চার করেছিল কবিমনে তা নতুন করে গতিময় হয়ে ধরা দিল ফরাসী দার্শনিক বার্গস ‘Elan Vital’ গতিতত্ত্বের মিশ্রণে। ‘ঝড়ের খেয়া’ কবিতায় ভয়ঙ্কর বিশ্বযুদ্ধের বিবরণ দিচ্ছিলেন এপারে বসে, আর উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন সেই দুর্মদ যাত্রীদের—“যাত্রাকর, যাত্রাকর, যাত্রীদল, এসেছে আদেশ।” এই কাব্যে মুক্তকছন্দের ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ। ‘পূরবী’ তে কবি আবার লীলাসঙ্গিনীর হাতছানি লক্ষ্য করলেন। তাপোভঙ্গ’ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির মধ্যে একটি। ‘মহুয়া’ কাব্যেও সেই একই ঊজ্জীবনের সুর।
৬) অন্ত্যপর্ব :
এই পর্বে লেখা কাব্যের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়—‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘বিচিত্রিতা’ (১৯৩৩), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘বীথিকা’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬), ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬), ‘ছড়া ও ছবি’ ১৯৩৭), ‘আকাশ প্রদীপ’ (১৯৩৯), ‘নবজাতক’ (১৯৪০), সানাই’ (১৯৪০), ‘রোগশয্যা’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১), ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১) এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘ছড়া’ (১৯৪৩), ‘শেষলেখা’ (১৯৪১)। ‘পুনশ্চে’ কবি জীবনের দৈনন্দিন জীবনের ছবি এঁকেছেন গদ্যে লেখা কাব্যে। আবিষ্কার করেছেন গদ্যছন্দ। একেবারে অন্তিমপর্বে লেখা কাব্যগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য, তার বিচিত্র সুর। চারিদিকে বিশ্বযুদ্ধের প্রেতছায়াকে দেখে কবির মনে হয়েছে সুদীর্ঘ জীবনধরে প্রেম, রোমান্টিকতা প্রকৃতি ও অধ্যাত্মচেতনার মধ্যে বসে তিনি যা রচনা করেছেন, তার সঙ্গে দুঃখহত জন-জীবনের কোন যোগ নেই। নিজের পূর্বতন কবিজীবনকে ব্যর্থ বলেচেন। মানুষের মাঝে ফিরে আসতে চাওয়ার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের সমাপ্তি ঘটেছে।
Leave a comment