সাহিত্য সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে প্রকৃতি বিচিত্রভাবে বিচিত্ররূপে শিল্পী সাহিত্যিকের মনের খোরাক জুগিয়ে আসছে। জয়দেব কালিদাস থেকে একালের রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রকৃতির সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে কাব্য কবিতা লিখেছেন। প্রকৃতিই উন্মোচন করে মানব মনেব বন্ধদুয়ার। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি জীবনেও তা ঘটেছিল। এই জন্যই তিনি ‘জীবন স্মৃতি’তে লিখেছেন—’বিশ্ব প্রকৃতিকে আড়াল আবডাল হইতে দেখিতাম…..সে যেন গারদের ব্যবধান দিয়া নানা ইশারায় …..মিলনের উপায় ছিল না। সেই জন্য প্রণয় আকর্ষণ ছিল প্রবল।” রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সান্নিধ্যেই এসেই তাঁর কবিতা ছোটোগল্পগুলিতে প্রকৃতির চিত্র সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বিশ্বের যে-কোনো কবির কাব্যের বিষয় মানব ও প্রকৃতি। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর সৃষ্টির মূল সূত্র মানবমুখিনতা ও প্রকৃতি প্রেম। প্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের সম্পর্কের এক উজ্জ্বল উদাহরণ ‘সুভা’ গল্পটি। প্রকৃতির সঙ্গে সুভার একটা সম্পর্ক আছে কারণ সুভাও বোবা আর প্রকৃতিও বোবা। সুভাকে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি পটে চিত্রিত করেছেন। তার চোখ দুটি “সুদীর্ঘ পল্লব বিশিষ্ট’ এবং তার ‘ওষ্ঠাধার ভাবের আভাসমাত্রে কচি কিশলয়ের মতো কাঁপিয়া উঠিত।” প্রকৃতি তার মুখের ভাষা পূরণ করে দিত। নদীর কলধ্বনি, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর ইত্যাদি সমুদ্রের তরঙ্গ রাশির ন্যায় তার চির নিস্তব্ধ হৃদয় উপকূলে আছড়ে পড়ত। মধ্যাহ্নে প্রকৃতি স্তব্ধ থাকত তখন সুভা—“রুদ্র মহাকাশের তলে কেবল একটি বোবা প্রকৃতি এবং একটি বোবা মেয়ে মুখোমুখি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত—একজন সুবিস্তীর্ণ রৌদ্রে আরও একজন ক্ষুদ্র তরুচ্ছায়ায়।”
সুভার যৌবন আগমনের ঘটনাকেও রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির পটভূমিতে এঁকেছেন। রাত্রে পূর্ণিমা প্রকৃতির মতো জেগে থাকতো। যেদিন তার বিবাহ সম্বন্ধে কলকাতায় যাবার দিন স্থির হয় সেদিন সুভা নিজের মূক ব্যথা কাউকে বলতে পারেনি। তাই লেখক বলেছেন—“সে দিন শুক্ল দ্বাদশীর রাত্রি। সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয়া তাহার সেই চির পরিচিত নদীতটে শল্প শয্যায় লুটাইয়া পড়িল….. তুমি আমাকে যাইতে দিয়ো না, মা, দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখো।”
প্রকৃতি যেমন মানবমনকে উত্তেজিত করে তেমনি উদাসও করে তোলে। আবার এই উদাসতা জাগায় মনের বন্ধদুয়ারে মুক্তির সন্ধান। ‘মহামায়া’ গল্পে দেখা রাজীব প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখে মহামায়ার মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। লেখকের কথায়— “একদিন বর্ষাকালে শুক্লপক্ষ দশমীর রাত্রে প্রথম মেঘ কাটিয়া চাঁদ দেখা দিল। নিস্পন্দ জ্যোৎস্নারাত্রি সুপ্ত পৃথিবীর শিয়রে জাগিয়া বসিয়া রহিল।” সেদিন রাত্রে রাজীব জানালায় বসেছিল। আকাশের চাঁদের দিকে চেয়ে তার সমস্ত অন্তঃকরণ কোন অজানা দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল। সে মনে করেছিল পূর্ব নিয়ম ভেঙে গেছে। তার মনে হল—“আজ বর্ষারাতির তাহার মেঘাবরণ খুলিয়া ফেলিয়াছে এবং আজিকায় এই নিশীথিনীকে সেকালের সেই মহামায়ার মতো নিস্তব্ধ সুন্দর এবং সুগম্ভীর দেখাইতেছে।” এই জন্য সে সমস্ত বিধি ভেঙে মহামায়ার ঘরে গিয়ে চাঁদের আলোয় তার মুখ দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং মহামায়া তার কথামত চির প্রস্থান করে।
‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিতে বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তপ্রকৃতি দুই মিলে একটা উদাস পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ধারামুখর বর্ষাদিনে শ্যাম বর্ণালী বেষ্টিত নদী, মেঘলিত ক্ষুদ্রগ্রাম যেখানে একটি অন্ধকার আটচালার মধ্যে নতুন স্থাপিত পোস্টঅফিস। ‘অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারিপাড়ে জঙ্গল। বর্ষা প্রকৃতি পীড়িত স্বজনহীন পোস্টমাস্টারের কামনার বস্তু ছিল অনাথা বালিকা রতনের আত্মীয়াধিক পরিচর্যা ও স্নেহবুভুক্ষা। কিন্তু যখন সে রোগশয্যা থেকে বাড়ি ফিরে যেতে চাইল তখন রতনের কথা ভাবল না। তবে নৌকায় উঠে রতনের জন্য সে ব্যথা অনুভব করল। কিন্তু সে দ্বিধা মুহূর্তের জন্য—“কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে। গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে এবং নদী প্রবাহে ভাসমান পথিকেরা উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল…. পৃথিবীতে কে কাহার।” গল্পটি এখানেই শেষ কিন্তু অনাথা বালিকা যে অশ্রু ব্যাকুল ক্রন্দন ধ্বনি তুলল তা জলে স্থলে অন্তরীক্ষে বিশ্ববেদনার সঙ্গে মিলে গিয়ে পাঠক হৃদয়কে আর্দ্র করে তোলে।
‘একরাত্রি’ গল্পে প্রকৃতি মানব হৃদয়ের অব্যক্ত ব্যথাকে জাগিয়ে তুলে মানব-মনের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। সুরবালার জন্য গল্পের নায়ক স্কুলের পাশে পুষ্করিণীর ধারে বসিয়া অন্ধকারে আকাশের তারার দিকে চাহিয়া কোনো দিন হা হুতাশ করে। তার এই হৃদয় যন্ত্রণাকে উপশম করতে প্রকৃতিই ভূমিকা নেয়। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ বর্ষার রাত্রে জলের প্লাবনে যখন নায়ক পুকুর পাড়ে ওঠে তখন অপরদিক থেকে সুরবালাও এসে দাঁড়ায়। সমস্ত রাত্রি দুজনে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। রাত্রি শেষে ঝড় থেমে গেলে সুরবালা চলে যায় কিন্তু গল্পের নায়ক বুঝতে পারে—“আমার পরমায়ুর সমস্ত দিন-রাত্রির মধ্যে সেই একটি মাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।”
পরিশেষে আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের প্রকৃতির পটভূমিকা আলোচনা করে প্রশ্নের উত্তরের ইতি টানতে পারি। ‘অতিথি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ তারাপদকে প্রকৃতির মতো উন্মুক্ত করে এঁকেছেন। কোথাও তাকে ধরে রাখা যায় না। তাই সে বাড়ি থেকে পালিয়ে মতিলালবাবুর নৌকায় যখন পাড়ি দেয় তখন প্রকৃতিকে দুচোখ ভরে দেখতে থাকে—“পর্যায় ক্রমে ঢালু সবুজ মাঠ, প্লাবিত পাটের খেত, গাঢ় শ্যামল আমন ধানের আন্দোলন….. গ্রাম তাহার চোখের উপর আসিয়া পড়িতে লাগিল ।…এই সুবৃহৎ চিরস্থায়ী নির্নির্মেঘ বাক্যহীন বিশ্বজগৎ তরুণ বালকের পরমাত্মীয় ছিল।” এই সুবৃহৎ চিরস্থায়ী চারু শশীর ভালোবাসা তাকে ধরে রাখতে পারেনি। সংসারের সমস্ত বন্ধন, বৈবাহিক বাঁধন ছিন্ন করে আবার সে প্রকৃতির মতো মুক্ত হতে চেয়েছে—“স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্র বন্ধন তাহাকে চিরদিন হইতে সম্পূর্ণ রূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাক্ষ্মণ বালক আসক্তি বিহীন উদাসীন জননী বিশ্ব পৃথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে।”
Leave a comment