সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং নজরুল ইসলামের কাব্য-বৈশিষ্ট্য এবং তাদের উপর রবীন্দ্র-প্রভাব বিষয়ে আলোচনা করো।

রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্যগগনে, কালের হিসেবে বিশ শতকের প্রথম দুই দশক, তখন কিছু শক্তিমান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল বাংলা সাহিত্যে। এঁরা প্রত্যেকেই, কেউ বা ব্যক্তিগত কারণে, কেউ বা ঐতিহাসিক কারণে ছিলেন ‘স্বভাবকবি’ অর্থাৎ কেউ আপন প্রতিভাকে স্বশাসনে রাখতে পারেননি। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি নাম-গোবিন্দ দাস। এঁর স্বাতন্ত্র্য ছিল বিস্ময়কর। ঐ কালেও তিনি রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব বিষয়েই যেন অবহিত ছিলেন না। অর্থাৎ রবীন্দ্র-দীক্ষা তাঁর একেবারেই ঘটেনি। অবশ্য ঘটলেও যে খুব একটা ইতর-বিশেষ হতো তা মনে হয় না। কারণ রবীন্দ্রনাথের উত্তর-সাধক, তাঁর একান্ত সন্নিহিত কবিকুলও যে আত্মরক্ষা করতে পেরেছেন, তা নয়। উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রানুসারী করুণানিধান, যতীন্দ্রমোহন, কিরণধন প্রভৃতি; এমন কি রবীন্দ্রানুরাগী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল ইসলামও।

প্রথমোক্ত রবীন্দ্রানুসারী কবিগণ রবীন্দ্র-কাব্যে এমনভাবে নিমজ্জিত ছিলেন যে, তার আপাত-বোধগম্য সরলতাকেই তাঁরা চরম বলে মনে করে এরই মধ্যে দিশেহারার মতো ঘুরে মরছিলেন। এর বাইরে যাবার ক্ষমতাই তাদের ছিল না। এঁরা প্রত্যেকেই শক্তিমান কবি ছিলেন, বিচ্ছিন্ন কবিতা রচনায় অনেক সময় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বড় বেশি কাছাকাছি ছিলেন বলেই তাঁর অনুকরণ করা ছাড়া তাঁদের গত্যন্তর ছিল না, অথচ অনুকরণও ছিল অসাধ্য। এই সমকালীন কবিদের রচনা ছিল ‘এমন সমতলরকম সদৃশ, এমন আশুক্লান্ত, পান্ডুর মৃদুল, করিতে করিতে ভেদচিহ্ন যে এত অস্পষ্ট, একমাত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া কাউকেই পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায় না। অবশ্য সত্যেন্দ্রনাথও ‘ছন্দোরাজ’ রূপেই পাঠকমনে বেঁচে রইলেন।

রবীন্দ্রনাথের মতো এত বড়ো মাপের কবিকে যে আমরা পেয়েছি, তা আমাদের বহু ভাগ্যের ফল। কিন্তু এর জন্য আমাদের মূল্যও দিতে হয়েছে যথেষ্ট। কারণ, রবীন্দ্রনাথের পরই কবিতা লেখার কাজটি যথেষ্ট কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি কবিতার মানকে এমন জায়গায় তুলে দিয়েছেন যে, এই স্তরে না-উঠলে আর সে-জাতীয় কবিতা লেখা সম্ভবপর নয়। অতএব, এই ক্ষেত্রে করণীয় ছিল, এমন একটা কিছু করা—তা যত ক্ষুদ্রই হোক, যা রবীন্দ্রনাথ করেননি। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থ অনুকরণ না করে নতুন কোন পথের সন্ধান করাই ছিল শ্রেয়। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ ও তাঁর সম্প্রদায় এখানেই করলেন প্রকাণ্ড ভুল। তাঁদের মনে হলো– কবিতা লেখার কাজটা রবীন্দ্রনাথ সহজ করে দিয়ে গেলেন। ছন্দ, মিল, ভাষা, উপমা ও বিচিত্র রকমের স্তবকবিন্যাস আয়ত্ত হলেই বুঝি সার্থক কবিতা রচনা করা যায়। এই মোলায়েম মনোভাব নিয়েই তাঁরা কবিতা লেখা আরম্ভ করলেন এবং শেষও হল এইখানেই।

উত্তর-সাধক কবিরা এইখানেই ভীষণভাবে প্রতারিত হলেন। রবীন্দ্রনাথ যা করেননি, তেমনি কিছু করবার কথা তাঁরা কল্পনায়ও স্থান দিতে পারেননি। অতএব রবীন্দ্রনাথ যা করেছেন, তাঁরাও বুঝি তাই করে। যাচ্ছেন—এমনি একটা মনোভাব নিয়ে তাঁরা আত্মসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ বা অনুসরণ যে তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, তা তাঁদের বুঝতে না পারার কারণও রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রচনায় সেই স্বর্গনরকব্যাপী বিরাট কোন পরিকল্পনা, নেই শেক্সপীয়রের মতো অমর চরিত্রচিত্রণ কিংবা মিল্টনের মতো ভাবগুঢ় বাক্যবন্ধ, তাঁর রচনায় কোন শব্দের অর্থের জন্য অভিধান ঘাটতে হয় না কিংবা আবহমান ইতিহাসও তিনি লুঠ করেননি অথবা পারাপার করেননি বৈতরণী অলকনন্দা, ফলত মনে হতেই পারে যে, কবিতা লেখার কাজটি বড় সহজ, এর জন্য পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই, নেই কোন প্রাক্-প্রস্তুতিরও প্রয়োজন : শুধু ‘ভাব’ হলেই চলতে পারে। অতএব তাঁরা রবীন্দ্রনাথের মতো হতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথেই হারিয়ে গেলেন, কারও আর কোনো পৃথক সত্তা রইলো না, বড় জোর রবীন্দ্রনাথের ছেলেমানুষি সংস্করণ লিখলেন।

কাব্যের উপাদান হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেমানুষি’কে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়েছেন, কিন্তু রচনার রীতি হিসেবে তাকে উপেক্ষাই করে দৈনন্দিন জীবনে তিনি যা কিছু অনুভব করেছেন, সেই সব অনুভূতি, মুহূর্তের বৃত্তের উপর ফুটে-ওঠা পলাতক এক-একটি রঙিন বেদনা—এদেরই তিনি ধরে রেখেছেন তাঁর কবিতায় ও গানে। এইজন্য তাঁর কবিতা বা গান যেন অশরীরী, বিশ্লেষণ-বিমুখ, তার সারাংশ বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

রবীন্দ্রনাথ যে জাতীয় কবিতা রচনা করেছেন, তা জীবনের পক্ষে সম্পদ হলেও যিনি তার অনুকরণ করতে যান, তার পক্ষে বিপদ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুখদুঃখ-অনুভূতিকে এমন সহজভাবে পরিবেশন করেন যে তা সহজেই কবিতা হয়ে ওঠে। আর সেই লোভে অপরেরা নিজেদের সুখদুঃখকে উস্কে দিয়ে কবিতা রচনা করতে গিয়েই বিপদে পড়েন। সে সহজ স্বাচ্ছন্দ্যটুকু আর সেখানে থাকে না, তা একটা কৃত্রিম বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এর একটা উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

সত্যেন্দ্রনাথকে দৃষ্টান্ত-রূপে গ্রহণ করবার কারণ হলো, তিনি সমসাময়িক কবিকুলের মধ্যে সর্বপ্রকারে বিশিষ্ট, এমনকি রবীন্দ্রনাথের পাশে রাখলেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করা যায়। তাঁকে সর্বতোভাবে যুগপ্রতিভূ বলেই গ্রহণ করা চলে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যে পার্থক্য সেটা জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ বা বড় কবি-ছোট কবির নয়, সেটা হল রবীন্দ্রনাথের তুলনায় সত্যেন্দ্রনাথ কতটা খাঁটি। সত্যেন্দ্রনাথের এখানেই রয়েছে গলদ। তিনিও কাব্যের বিষয়-রূপে রবীন্দ্রনাথের মতো একই উপাদান গ্রহণ করেছেন, সেই অন্তরঙ্গ দেশপ্রেম, পল্লীচিত্র। কিন্তু ফুল, পাখি, চাঁদ প্রভৃতি শব্দ বা বস্তুর পিছনে রবীন্দ্রনাথের যে আবেগ, যে প্রাণবন্ত স্পর্শ অনুভব করা যায়, তা তো সত্যেন্দ্রনাথে নেই। তার অনুভূতিটাই যেন কৃত্রিম। রবীন্দ্রনাথের দিব্যদৃষ্টি আর ভাবুকতা সত্যেন্দ্রনাথে দিবাস্বপ্ন আর ভাবালুতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের ছন্দের যে মধুরতা, মদিরতা, আন্তর্লীন শিক্ষা, সংযম, রুচি—তা সব সত্যেন্দ্রনাথের একরকম চঞ্চল ঠুনকো আওয়াজে পরিণত হয়েছে। একটি দৃষ্টান্তে বিষয়টি স্পষ্টতর হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ‘ওগো বধূ সুন্দরী, তুমি মধু মঞ্জুরী’ এবং সত্যেন্দ্রনাথের ‘তুলতুল টুকটুক/ টুকটুক তুলতুল’—কবিতা দুটি প্রায় একই ছন্দে, খেলাচ্ছলে রচিত হয়েছে, কোনটিতেই বিশেষ স্পর্শসহ বক্তব্য নেই—অথচ প্রাণের স্পর্শ থাকায় রবীন্দ্রনাথের রচনাটি একটি উৎকৃষ্ট কবিতা হয়ে উঠেছে আর সত্যেন্দ্রনাথের রচনাটি যান্ত্রিকভাবে তৈরি একটি কাঁচা বালকোচিত লেখামাত্রই হয়ে রইলো। এটিকে একটি ছন্দোঘটিত কসরৎ বলেই অনেকে মনে করেন। কিন্তু এই প্রকরণগত ছেলেমানুষি—যা রবীন্দ্রনাথ কখনও পছন্দ করেননি, সেই গুণেই সত্যেন্দ্রনাথ একসময় ‘ছন্দোরাজ’ আখ্যা পেয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রপ্রতিভা যখন মধ্য গগনে, তখন কিছুকাল সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাব রবীন্দ্রনাথকেও ছাপিয়ে যায়, আর তাঁর অনুকরণকারীদের দৌলতে কিছু নির্দোষ, সুশ্রাব্য কিন্তু অন্তঃসারশূন্য কবিতায় সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠা বোঝাই হতে থাকে। অবশ্য কালের সম্মার্জনী তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এইভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সত্যেন্দ্রনাথের হাতে এবং ক্রমাগত তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যদের হাতে পরিলুত হতে হতে এমন দীনদশায় এসে পৌঁছালো, যখন বাংলা কবিতার মোড় ঘোরানো ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।

রবীন্দ্র প্রভাবের যুগে রবীন্দ্রভক্ত হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন গদ্যে প্রমথ চৌধুরী ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু পদ্যে রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রতিভার দ্বারা গ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ও তৎকালীন কবিগোষ্ঠী। তবে তারা রবীন্দ্রনাথের প্রথম ও প্রচণ্ড ধাক্কাকে সামলে দিয়ে পরবর্তী কবিদের বাঁচিয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁরাও প্রথমে রবীন্দ্রনাথের মোহে আবদ্ধ হয়েছিলেন, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই সর্বপ্রথম সেই মায়াজাল ভাঙলো।

নজরুলও স্বভাব-কবি ছিলেন। তাঁর বহু কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ, এমনকি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তেরও যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। কাব্যে তিনিও অসংযমী, পরিণতির কোন চিহ্ন নেই, তাঁর প্রথমদিকের রচনার সঙ্গে শেষদিকের রচনার কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু এ সমস্ত সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়, তারই জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথের পর প্রথম মৌলিক কবিরূপে পরিগণিত হয়ে থাকেন। শিল্পিতা ও বৈচিত্র্যের বিচারে সত্যেন্দ্রনাথ নজরুল অপেক্ষা কিছুটা এগিয়ে থাকলেও সত্যেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রমণ্ডলের বাইরে চিন্তাই করা যায় না, পক্ষান্তরে নজরুল আকস্মিকভাবেই রবীন্দ্র-বন্ধন ছিঁড়ে বেরুলেন, কোন সাধনা-ব্যতিরেকেই। এটা সম্ভব হয়েছিল নজরুলের জীবন পরিবেশের ভিন্নতার জন্যই। যে পরিবেশে তাঁর জন্ম, শৈশব এবং যৌবন অতিবাহিত হয়েছে, জীবিকানির্বাহের জন্য তাঁকে যে সমস্ত বৃত্তি গ্রহণ করতে হয়েছিল, তারই ফলে কোন সাহিত্যিক প্রস্তুতি-ব্যতীত, শুধু আপন স্বভাব-গুণেই তিনি রবীন্দ্র-প্রভাবের বাইরে এসে বাংলা সাহিত্যে নতুন রক্ত সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। তাঁর রচনায় উত্তেজনার তুলনায় পুষ্টি ছিল কম, তিনি নতুনের আকাঙ্ক্ষা জাগাতে পারলেও, তাঁর প্রভাব স্থায়ী হয়নি। তবে তিনি প্রমাণ করে দিলেন যে রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও কাব্যরচনার অন্য পথও রয়েছে। এরই ফলে নতুনতর ধারা সৃষ্টি করেন মোহিতলাল এবং যতীন্দ্র সেনগুপ্ত। সর্বোপরি ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র আবির্ভাবে বাংলা সাহিত্যের মোড় ফিরলো এই নজরুলেরই কারণে।