“রবিতাপে আত্মাহুতি দিয়ে তাঁরা পরবর্তীদের সতর্ক করে গেছেন।”- কারা কেন কীভাবে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন? পরবর্তীদের সতর্কীকরণের ফলে কী হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রাবন্ধিকের বক্তব্য উপস্থিত করো।
রবীন্দ্র-সমকালীন কবিরা যেমন—সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, কিরণধন মুখোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতি কবিদের কথা বলা হয়েছে।
আমাদের অনেক ভাগ্যের ফলেই রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি যিনি একজন বড়োমাপের কবি। কিন্তু তার জন্য আমাদের মূল্যও দিতে হয়েছে প্রচুর। কারণ তাঁর কাব্যের আপাত সরলতায় বিমুগ্ধ কবির দল তাঁর এত কাছে গিয়ে পৌঁছেছিলেন যে সেই সরলতার গভীর স্তরস্থিত আবর্তে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলেন, যেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেন নি। রবীন্দ্র প্রতিভা যখন মধ্য গগনে কাল হিসাবে সেটি বিশ শতকের প্রথম দুই দশক ; করুনানিধান, যতীন্দ্রমোহন, কিরণধন প্রভৃতি শক্তিমান কবিরা তখনই তাঁর অনুকরণে ব্যস্ত ছিলেন। ফলত, একান্তভাবে রবীন্দ্রমণ্ডল মধ্যবর্তী হয়ে তাঁরা রইলেন, কোনো স্বাতন্ত্র্যলাভ করতে পারেননি কেউ–এক থেকে অপরের কোনো পার্থক্য নেই। এঁদেরই সমকালীন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের আরও ঘনিষ্ঠ ও রবীন্দ্রানুসারী, কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাঁর রচনার একটা নিজস্ব চেহারা ছিল, যার ফলে রবীন্দ্রনাথের পাশেও তাঁর রচনাকে পৃথক বলে চিহ্নিত করা চলে। এমনকি এমন একটা সময় ছিল, যখন জনপ্রিয়তায় তাঁর রচনায় রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাও অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ক্ষণস্থায়ী হল। কারণ রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ করতে গিয়ে তিনি যে কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়েছিলেন তা জলের রেখার মতোই ক্ষণকালীন। ফলত, তিনিও রবীন্দ্রমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। এরপর একে একে অনেক কবি এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে নজরুল বাদে আর সমস্ত কবিরা রবীন্দ্র পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু তাঁরা যে রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে কবিতা লিখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন যদিও তা সম্ভব হয়নি তথাপি সেই রাস্তাই পরবর্তী কবিদের জন্য দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন এবং সতর্ক করে গিয়েছিলেন।
কিন্তু নজরুলের এই বিদ্রোহাত্মক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল সমাজ ও রাজনীতি সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহিত্যে নয়। সাহিত্য নিয়ে তাঁর নিজস্ব কোনো অতৃপ্তি বোধ না থাকলেও তা কিন্তু সমকালের কবিদের মনে সংক্রামিত করে দিয়েছিলেন। নিজেরই অজ্ঞাতে তিনি সাহিত্যে একটা নতুন চেতনা নিয়ে এলেন। আর তার ধারক আর বাহক হলেন সমকালীন ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর কবিরা। এঁরাও কিন্তু রবীন্দ্রনুরাগী এবং রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ পাঠক। কিন্তু এদের বিদ্রোহই হল রবীয়ানার বিরুদ্ধে। তাঁদের মনে হল, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নেই বাস্তবের ঘনিষ্ঠ, সংরাগের তীব্রতা, জীবনের জ্বালা যন্ত্রণার চিহ্ন, রবীন্দ্রনাথ বুঝি মানুষের দেহটাকেই অস্বীকার করে গেছেন। অতএব রবীন্দ্রনাথ যে কাজগুলি করেননি, তাদের সাধনেই তাদের যাত্রা হল শুরু। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভালো একটা করা নয়, নতুন একটা কিছু করার দিকেই তাঁদের সর্বপ্রচেষ্টা নিয়োজিত হল। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কথামতোই ফজলি আম ফুরুলে ফজলিতর আম আর চাইবো না, আতা ফলের ফরমাস দেবো, অর্থাৎ নিজের কথা নিজের মতো করে বলা, কারও অনুকরণ নয়, অর্থাৎ রবীন্দ্রোত্তর হওয়াটাই ছিল তাদের প্রধান ধ্যান।
কল্লোল গোষ্ঠীর এই প্রচেষ্টায় ‘কিছুটা’ গলদ প্রথমটা থাকলেও সব কিছু থিতিয়ে যাবার পর পাওয়া গেল সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ এবং বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় নীবনতার প্রচেষ্টার সুফল। নজরুলের চড়া সুরের পর প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যে হৃদ্যতা এবং ক্রমে দেখা দিল বাংলা কবিতায় সংহতি, বৌদ্ধিক ঘনত্ব, বিশেষত বিষয় ও শব্দ চয়নে ব্যতিক্রম ধর্মিতা— যার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠল নতুন স্বাদ—ক্রমশ দেখা দিল গদ্য ও পদ্যের মিলন সম্ভাবনা। কালপ্রভাবে সাহিত্যে পরিবর্তন দেখা দেয়, লেখকদেরও ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের স্ফুরণ ঘটে। মূলত এই কবিদের মানসিকতায় ও রচনায় ব্যবধানও ছিল দুস্তর। একদিকে ছিলেন ইন্দ্রিয়ানুভূতি প্রধান জীবনানন্দ দাশ, অপরদিকে অবক্ষয় চেতন মনন ধর্মী সুধীন্দ্রনাথ, আবার রবীন্দ্রসহচর অমিয় চক্রবর্তী সঙ্গে কারও মিল নেই। তবে সবারই অনন্য লক্ষ্য ছিল— পূর্ব পুরুষের পুঁজি না ভেঙে তাকে বাড়িতে তোলা এবং সাহিত্যে নতুন স্বাদ সৃষ্টি করা যেমনটি রবীন্দ্রনাথেও পাওয়া যায় না।
কল্লোলীয় কবিদের সংগ্রামই ছিল রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে যাওয়ার ফলে কেউ তাঁকে পাশ কাটিয়েছেন, কেউ বা আত্মস্থ করেছেন। এই সূত্রে তাঁরা প্রচুর উপাদান আহরণ করেছেন পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য থেকে আর আধুনিক জীবন যন্ত্রণা থেকে। এঁদের অনেকে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেছেন নানাভাবে—বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী প্রত্যেকেই রবীন্দ্রনাথের নিষ্ঠাবান পাঠক। কিন্তু তাঁর মোহিনীমায়ায় ভুলে না গিয়ে তাঁরা তাঁর কাব্যকে কাজে লাগিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁর সাহিত্য চর্চা গ্রন্থে লিখেছেন—
“….এঁরা রবীন্দ্রনাথের মোহনরূপে ভুলে থাকলেন না, তাঁকে কাজে লাগাতে শিখলেন, সার্থক করলেন তাঁর প্রভাব বাংলা কবিতায় পরবর্তী ধারায়।” আবার বিষ্ণু দে একটি কবিতায় সুন্দরভাবে নতুন যুগের প্রাণ স্পন্দনটি তুলে ধরলেন—“রবীন্দ্র ব্যাবসা নয়, উত্তরাধিকার ভেঙে ভেঙে চিরস্থায়ী জাহ্নবীকে জটাজালে বাঁধি না বরং আমরা প্রাণের গঙ্গা খোলা রাখি, গানে গানে নেমে সমুদ্রের দিকে চলি, খুলে দিই রস আর রং সদাই নূতন চিত্রে গল্প কাব্যে হাজার ছন্দের রুদ্ধ উৎসে খুঁজে পাই খরস্রোত নব আনন্দের।”
তবে একথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের সর্বাতিশায়ী প্রভাব থেকে নতুন যুগের কবিরা মুক্ত হতে পারেননি—যতই স্বতন্ত্র চিন্তা ও ভাবের কথা বলুন রবীন্দ্রনাথের বাগ্ বন্ধ এমনকি কবিতার চরণ পর্যন্ত সুভাষ মুখোপাধ্যায় ব্যবহার করেছেন ভিন্ন অনুষঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের নিকট ঋণ-স্বীকৃতির এই পদ্ধতিতেই প্রকাশ পেয়েছে তাদের আত্মবিশ্বাস ও স্বাবলম্বিতা, তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সত্য-শিব সুন্দরকে তাঁরা গুরুর হাত থেকে উপহার-রূপে পাননি, কাব্যকলা ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়নি—সবই সাধনালব্ধ, শ্রম দ্বারা আয়ত্ত।
তাই নজরুল থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুই মহা যুদ্ধবর্তী কুড়ি বৎসরে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রাশ্রিত নাবালক দশার অবসান ঘটল। কিন্তু ইতিমধ্যে আর একটা বিপদ দেখা দিয়েছে। নবাগত কবিরা প্রাগুক্ত কবিদের আবর্তে পরে তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না। এঁরা টেকনিক নিয়ে বেশি মাথা ঘামালেন, সেটাকে দুলক্ষণ বলেই মানতে হয়। কলা সিদ্ধির প্রাধান্য অস্বীকৃত নয়, কিন্তু তৎকালীন প্রয়োজনে সৃষ্ট কৌশল যে এমন মুদ্রা দোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবিতা তো-স্বর-ব্যঞ্জনের চাতুরী নয়, এর বক্তব্যটাই প্রধান এবং সেটা স্বচ্ছন্দ হওয়া আবশ্যক। রবীন্দ্রনাথ আমাদের রক্তমাংসে মিশে আছেন, এখন আর সম্মোহনের আশঙ্কা নেই ; মনে হয় ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি গড়ার জন্য আবার তাকে আশ্রয় করেই দাঁড়াতে হবে। আর একথা প্রাবন্ধিকও সর্বোতভাবে সমর্থন করেন।
Leave a comment