রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে যেমন বিচিত্র ও বহুবিধ গল্প স্থান পেয়েছে তেমনি সামগ্রিকভাবে প্রত্যেকটি গল্পের কার্যকারণ সূত্র সমন্বিত স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপটের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। কাহিনির ক্ষেত্রে এই প্রেক্ষাপট কেবল অপরিহার্য্যতা নয়, কাহিনি ও চরিত্র বিকাশে, ঘটনার অনুপুঙ্খ আবর্ত রচনায়, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনে গল্পগুলোর গতিপ্রকৃতি এই প্রেক্ষাপটের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। উনিশ বিশ শতকের আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে যুক্তি শৃঙ্খলার পারম্পর্যে স্বীকৃত হয়েছিল, তবে রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের সূচনা পর্বে বোধহয় প্রথম ‘আধুনিক জীবনকে স্ব-স্বরূপে আবিষ্কার করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের আধুনিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তাঁর দৃষ্টির মধ্যে সামাজিক বিধি বিধানকে অস্বীকার করে ন্যায় নীতি বোধকে বড়ো করে তোলার চেষ্টা কিছুটা রক্ষণশীল মনোভঙ্গির পরিচায়ক বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠিক এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জীবনকে দেখেননি, ফলে তাঁর ছোটোগল্প উপন্যাসে আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার একটা পূর্ণ পরিণতি রূপ চোখে পড়ে। আধুনিকতার পূর্ণাঙ্গ ধারণা রবীন্দ্রনাথ থেকে আবর্তিত তা ঐতিহাসিক সত্য, নিশীতে গল্পটি এমন এক অভিধায় ভূষিত। এক্ষণে কেবল ব্যক্তি চরিত্রের স্খলন পতনের প্রসঙ্গ বড়ো হয়ে ওঠেনি, এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা প্রতিস্পর্ধি মানসিকতা। আর এর মধ্য দিয়ে আধুনিকতার স্পর্শ মূর্ত হয়ে উঠেছে।

কোনো কোনো সাহিত্য সমালোচক নিশীথে গল্পের উপাদান বিচার করে এর মধ্যে অতীন্দ্রিয়, অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক রহস্যের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা দরকার, ‘অতি প্রাকৃত’ শব্দটি ইংরেজি পরিভাষায় বলা হয় ‘Super-natural’ এবং অতীন্দ্রিয় শব্দের অর্থ ‘Beyond the range of the senses’ তাহলে সহজেই অনুমেয় অতিপ্রাকৃত ও অতীন্দ্রিয় শব্দ দুটির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। প্রাকৃত বা নৈসর্গিক জীবন অতিক্রম করে যাওয়াই অতিপ্রাকৃতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাই অতিপ্রাকৃতের মধ্যে বাস্তব জীবন বহির্ভূত অলৌকিক জগতের ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় শব্দের অর্থ ব্যঞ্জনায় ইন্দ্রিয়ের দ্বারা স্পর্শ করা ক্ষয় না এমন একটা ভাব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, তাই এই যুক্তি প্রদর্শন করে ‘নিশীথে’ গল্পটিকে অতিপ্রাকৃত গল্প হিসাবে চিহ্নিত না করে অতীন্দ্রিয় আভাস যুক্ত গল্প বলে গ্রহণ করাই শ্রেয়। গল্পের কাহিনি ও চরিত্রের ভিত্তি সূদৃঢ় বাস্তব জীবনের পরেই প্রতিষ্ঠিত আর সেই বাস্তব জীবন কল্পনার নিত্য নতুন রঙে, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যাকে স্পর্শ করা যায় না তাকে ঘিরে চমৎকার অধরা জগৎ তৈরি করে নেয়, সেই জগতের উপর ভিত্তি করে অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনপর্বে উঁকি দিয়ে যায়। নিশীথে গল্পের প্রাসঙ্গিক তাৎপর্য তাই অতীন্দ্রিয় শব্দের অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনায় আভাসিত।

“এই অতি প্রাকৃতের অসীম সাংকেতিকতা আরব্য উপন্যাস বর্ণিত বোতলের মধ্যে আবদ্ধ দৈত্য দেহের ন্যায় সংকীর্ণ পরিধি বাঙালি জীবনের মধ্যে সহজেই স্থান লাভ‌ করিয়াছে….রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য কুহক বলে আমাদের অতিপরিচিত গৃহাঙ্গণের মধ্যে অতিপ্রাকৃতকে আহ্বান করিয়া নিয়াছেন এবং নৈসর্গিকের সীমা ছাড়াইয়া এক পদ ও অগ্রসর হন নাই।” একালের প্রখ্যাত সমালোচক ‘নিশীথে’ গল্প সম্পর্কে এমন এক মন্তব্য করেছেন। তা সত্ত্বেও অতিপ্রাকৃত শব্দের তুলনায় অতীন্দ্রিয় রহস্যানুভূতির উপর অধিক প্রাধান্য দেওয়াই শ্রেয়। কারণ, গল্পের প্রেক্ষাপট ও কাহিনি তেমনই আভাস দেয়।

প্রথমত, কাহিনির প্রধান চরিত্র–দক্ষিণাবাবুর জীবন কথায় প্রথমা পত্নীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনযাপনের কাহিনি প্রত্যক্ষ বাস্তব, রসে পরিস্ফুট, স্বামীর মনে জেগে ওঠা আবেগ ও হৃদয় উজাড় করা কালিদাসীয় শ্লোক আবৃত্তি এবং দক্ষিণাবাবুর স্ত্রীকে ভালোবাসার প্রবল দাবি প্রথমা পত্নীর নীরব হাসিতে অর্থহীন বলে মনে হয়। দক্ষিণাবাবুর অগভীর ভালোবাসা স্ত্রীর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল। তবু স্বামীর প্রতি কর্তব্য ও সেবা পরায়ণতারা প্রথমা পত্নী অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তারপর এলাহাবাদে বায়ু পরিবর্তনের সময় মনোরমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় ক্রমেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সংশয় ঘনীভূত হয়েছে। অন্ধকার গৃহকোণে চিররুমা প্রথমা পত্নীর ঘরের বাইরে আগন্তুকা মনোরমার দিকে তাকিয়েই সেই যে ভয়ার্ত কণ্ঠ—তা প্রিয়জন বিচ্ছেদের ইঙ্গিত দেয়। এই স্ত্রীর এই ভয়ার্থ আতঙ্ক দক্ষিণাবাবুর মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েও মনস্তাত্ত্বিক কারণে তা অস্বীকার করা মনোবিকারেরই নামান্তর।

দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় পত্নী মনোরমার সঙ্গে দাম্পত্য জীবনযাত্রায় প্রথমা পত্নীর সেই ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর দক্ষিণাবাবুকে সর্বদা তাড়িয়ে নিয়ে গেছে, অবদমিত অপরাধবোধ থেকে তাঁর আতঙ্ক ধীরে ধীরে ব্যাপ্ত হয়ে মস্তিষ্কের গভীরে প্রবেশ করেছে, মাঝে কিছুটা মনোরমার সঙ্গলাভে আনন্দ পেলেও—জনমানব শূন্য নিঃসঙ্গ ব-দ্বীপের মতো স্থান থেকে উড়ে যাওয়া চরবিহারী জলচর পাখির ডাকে দক্ষিণাবাবুর অবদমিত অপরাধবোধ অসুস্থ প্রথমা পত্নীর আত্মজিজ্ঞাসাকে প্রতিধ্বনিত করে দিয়ে গেছে।

তৃতীয়ত, গল্পের শেষাংশে, দক্ষিণাবাবুর সমগ্র সত্ত্বা দিয় মৃত পত্নীর জিজ্ঞাসাময় আতকে অনুধাবন করা, রাত্রির অন্ধকারে মৃতপত্নীর অট্টহাসি, ছায়ামূর্তি কখনো বা দিগন্ত বিস্তৃত হাসির তরঙ্গ তাঁকে রক্ত হিম আড়ষ্ট ভয়ার্ত মানুষে পরিণত করল, বার বার মনে হল ঘরে রাখা ঘড়িটা সজীব প্রাণবন্ত হয়ে মনোরমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলছে : “ওকে, ওকে, ওকে গো ?” এ থেকেই দক্ষিণাবাবুর মনে ভয় বিহ্বলতার শুভ সূচনা।

এ থেকেই বলা যায় প্রথমা স্ত্রীকে অবহেলা দেখিয়ে মনোরমার প্রতি আবেগ তাড়িত হয়ে গোপনে আসক্ত হওয়া তাঁর মানসিক বিকৃতির অন্যতম কারণ, অবচেতন মনের অপরাধবোধ তাঁকে শঙ্কিত ও লজ্জিত করেছে। কিছু লৌকিক বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, পরিবার ও সমাজে প্রচলিত রহস্যময়তা ও অলক্ষ্য চেতনাকেন্দ্রিক অস্পষ্ট ভয়ে আশঙ্কায় অনেক সময় বিব্রত আতঙ্কিত হতে হয়। মৃতা পত্নী দক্ষিণাবাবুর ভালোবাসার অর্থহীন অঙ্গীকার ব্যঙ্গ বিদ্রূপে স্ত্রীর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল অন্তিমলগ্নে, যখন মনোরমার সঙ্গে তার একটা নৈকট্য রচিত হতে চলেছে। অসামঞ্জস্যের এই আবেগতাড়িত চরিত্র স্বভাবে দক্ষিণাবাবুও অপরাধী এবং উত্তরকালের মনোরমা কেন্দ্রিক জীবনে মনস্তাত্ত্বিক জীবন জিজ্ঞাসার সূত্রে অন্তরের অপরাধ ও ভয়ার্তভাবনা বহির্বিশ্বে ব্যপ্ত হয়ে অন্তরেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। অতি প্রাকৃত বা অলৌকিক উপাদান নয়, দক্ষিণাবাবুর অনুভূতিতে যে অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সঞ্চার ঘটেছিল তার যথার্থ কার্যকারণ সূত্র দক্ষিণাবাবুর স্বভাবের মধ্যেই সুপরিস্ফুট।

পূর্ণাঙ্গ বাস্তবতার মধ্যে মানুষের জীবন বিধৃত নয়। তার মধ্যে কল্পনা ও অতীন্দ্রিয়ের রহস্য প্রতিনিয়তই আভাসিত। মানুষের মন নামক পদার্থকে কেন্দ্র করেই বহু দূরবর্তী কল্পনা নামক বিষয়টি আমাদের জীবনকে করে বসে। তাই একার্থে বাস্তব জীবন নয়। তবুও নিশীথে গল্পের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা বলিষ্ঠভাবেই প্রকাশিত। পূর্ব পত্নীর প্রতি দক্ষিণাবাবুর আচরণ, অর্থহীন প্রতিশ্রুতি এক সংকটময় মুহূর্তের সৃষ্টি করেছে, ভীতি বিহ্বল আতঙ্কিত দক্ষিণাবাবু কেবল রাত্রিতেই গভীর ও গাঢ় অন্ধকারে পত্নীর উপহাস করা হা হা ধ্বনি এবং আতকণ্ঠস্বর শ্রবণ করেছেন। দিনের নেশায় মানবমন স্বভাবতই দুঃস্বপ্ন প্রশ্রয় দেয় না। তাই মৃতা পত্নীর অশরীরী সত্ত্বা ও আচরণ মানস নেত্রে ফুটে উঠেছে রাত্রিকালীন পরিবেশে। তাই অতীন্দ্রিয়, রহস্যময় চেতনালোকে দক্ষিণাবাবুর চরিত্রগত ব্যাখ্যায় মনস্তত্ত্ব সম্মতভাবে আবিষ্কার করা গেলেও গল্পের পরিবেশ রচনার কৌশলে এই ভাবনাটি বিশেষ গভীরতা পেয়েছে। নিশীথে গল্পে তাই অন্ধকারময় পরিবেশের এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

তাই বলতে হয়, গল্পকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিল্প রচনার অনবদ্ধ কৌশলে অতিপ্রাকৃত বা ভৌতিক নয় অতীন্দ্রিয় ভাবনাগুলিকে সন্নিবিষ্ট করেছেন মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে। দক্ষিণাবাবু সেই মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় অবদমিত মনের অপরাধ প্রবণতায় মৃতা পত্নীর অলক্ষ্য উপস্থিতিকে প্রত্যক্ষ করেছেন অতীন্দ্রিয়, রহস্যময়তায়, মনের গভীরে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এক অপরাধী মনের বিকার কীভাবে তাঁর সমগ্র চেতনায় আশ্লিষ্ট হয়ে পড়লো তাই প্রকাশ পেয়েছে। একদিকে রহস্যময় জগতের নিবিড় ভয়ার্ত পরিবেশ, রাত্রিকালে ব্যক্তি চৈতন্যের অপরাধবোধ থেকে যার জন্ম, মনস্তাত্ত্বিকতার অবচেতন মনের এই স্বাভাবিক পরিণাম এবং অন্যদিকে দিনের আলোয় দক্ষিণাবাবুর মনের পরে চেপে বসা অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তার অবসান গল্পটিকে অনন্য মাত্রা দান করেছে। সমালোচক ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় : দক্ষিণাবাবুর–“মনোবিকারটুকু ঘটা হতে লেখকের বিশেষ আয়োজন বাহুল্য করিতে হয়। নাই—একটা উপনগর স্থিত বাগানবাড়ির ম্লান, জ্যোৎস্নালোকিত বকুলবেদী বা পদ্মার তটে কাশবন—পরিপ্লুত, নির্জন বাহুতটের মধ্যেই অতিপ্রাকৃতের শিহরণ জাগিয়া উঠিয়াছে।”