ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) কবি মানসের পালাবদল ঘটেছে বারবার। চেতনার এক বৃত্ত ছেড়ে অন্য বৃত্তে অনুপ্রবেশ ঘটেছে বহুবার। বিশাল রবীন্দ্রকাব্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য- এর অন্তর্নিহিত গতিশীলতা এবং বহিরাঙ্গিক বৈচিত্র্য নিয়ে ক্রমবিকাশের পথে যাত্রা। জীবনের গভীরতর অংশের দিকে- মানবের শাশ্বত সত্যের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসরমান। বাল্যকালের ‘বনফুল’ (১৮৭৫] থেকে ‘কড়ি কোমল’ পর্যন্ত কাব্যে কবি শুধু সুর ও ছন্দের খেলায় মেতেছিলেন। ‘মানসী’ কাব্য থেকে রবীন্দ্র মানসের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা। ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’, ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’ প্রভৃতি কাব্য এ পর্বের বিকাশ। কবির মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে এ পর্যায়ে কবি হৃদয়ের রোমান্টিক কল্পনা, বিশিষ্ট জীবনদর্শন, বিশ্বসত্তার সঙ্গে মিলনাকুতি, জীবনদেবতার লীলাচেতনা এবং এই পর্বের কাব্যে অজস্র চিত্রকল্প, রূপবৈচিত্র্য, ভাষা ও ছন্দগত পরিপক্বতা কাব্যিক পটবর্ণনায় ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া কবির বাঁক পরিবর্তনের পরবর্তী কাব্য ‘বলাকাতে’ [১৯১৫] ধরা পড়েছে বৈশ্বিক পৃথিবীর অস্থির অবস্থা এবং গতিবাদ। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অন্তিম জীবনের উপলব্ধির কথায়- দার্শনিক সত্যের চিরন্তন বাণীরূপে ভরিয়ে তুলেছেন ‘শেষ লেখা’ (ভাদ্র, ১৩৪৮) কাব্যে।

প্রথম পর্যায়-উন্মেষ পর্ব: রবীন্দ্র কাব্যসাহিত্যকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। প্রথম পর্বে পাই ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ (১৮৮২)। তাঁকে কোনো কোনো সমালোচক ‘উন্মেষপর্ব’রূপে চিহ্নিত করেছেন, কেউ কেউ ‘হৃদয় অরণ্য’ নাম দিয়েছেন। এই যুগে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে কবি নিজের নিভৃতচারী হৃদয়ের রোমান্টিক বিষাদ, অনির্দেশ্য ভাবব্যাকুলতা, একাকিত্বের অরণ্যে ঘুরে বেরিয়েছেন, আত্মকেন্দ্রিক দুঃখবেদনাতেই নিমজ্জিত হতে চেয়েছেন।

সন্ধ্যা সংগীত: তবু এই বিষাদমন্থর, হৃদয় অরণ্যে ব্যাকুল পথান্বেষণের তাঁর শিল্পব্যক্তিত্বের কৈশোর কল্পনা যে ক্রমশ অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা থেকে আত্ম আবিষ্কার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তা আমরা লক্ষ করি। ‘সন্ধ্যাসংগীতে এর গোধূলি ছায়াচ্ছন্ন বিষাদের জগৎ থেকে কবি ‘প্রভাত সংগীত’ এর আলোকোজ্জ্বল জগতে এসে নিজের হৃদয় বিস্তারের আনন্দে গেয়ে উঠলেন-

হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি।
‘ ধরার আছে যত মানুষ শত শত
আসিছে প্রাণে মোর হাসিছে গলাগলি।

প্রভাত সংগীত: ‘প্রভাত সংগীত’ এর পর্যায়ে একটা প্রাকৃতিক দৃশ্যের অভিজ্ঞতার সংঘাতে যেভাবে কবি ‘সন্ধ্যাসংগীত’ এর হৃদয় অরণ্য থেকে মুক্ত প্রাণের উল্লাসময় জগতে উত্তীর্ণ হলেন, ‘জীবনস্মৃতি’তে কবি তার বর্ণনা দিয়েছেন, তিনি তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সদর স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন, সেখানেই- “একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগুলোর পল্লবান্তর হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্র তরঙ্গিত আমার হৃদয়ের স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমেষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাকে বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটির মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল।” ‘প্রভাত সংগীত’ এর ‘নির্ঝরের স্বপ্ন’ কবিতাটি ত কবির কাব্যজীবনের নতুন জাগরণেরই রূপক।

ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল: ‘ছবি ও গান’ এর কবিতাগুলো বিভিন্ন খণ্ডচিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে বাতায়নবাসী কবিমনের নিজের পূজার বর্ণসম্ভার দিয়ে দূর থেকে জগৎ ও জীবনের সৌন্দর্য দেখতে ও তাদের এক একটা তুলির আঁচড়ে রাখতে চেয়েছে। “এই আমার প্রথম কবিতার বই যার মধ্যে বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং বহিদৃষ্টিপ্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর প্রথম আমি সেই কথা বলেছি যা পরবর্তী আমার কাব্যের অন্তরে অন্তরে বারবার প্রবাহিত হয়েছে-

‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’,-

যা ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে আর একভাবে প্রকাশ পেয়েছে-

‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।”

‘কড়ি ও কোমল’ রচনার কিছুকাল আগে এক পারিবারিক দুর্ঘটনায় শোকতপ্ত কবিচিত্তে একটা বড়ো দরের পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল বলে মনে হয়। ড. সুকুমার সেন বলেন, “শোকের আঘাত কবিচিত্তে এমন একটি নির্লিপ্ততা আনিয়া দিল যাহাতে দৃষ্টির আত্মপরতা দূর হইয়া সংসারের ছবি উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হইয়া ফুটিল, এই নিরবলেপ স্বচ্ছদৃষ্টিই ‘কড়ি ও কোমলে’র রহস্য।” কোমল’ এ ইন্দ্রিয়চেতনায় বর্ণাঢ্য প্রেম, প্রকৃতিচেতনা এবং বাইরের জগতের রূপৈশ্বর্যের প্রতি কবিহৃদয়ের প্রবল অনুরাগ অনেকটা পরিমাণেই রসনিটোল সংহত রূপ লাভ করেছে-নিম্নোদ্ধৃত পঙক্তিগুলোতে ‘কড়ি কোমল’ এর সৌন্দর্যচেতনা যেভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে তা আমরা লক্ষ করতে পারি-

‘ফেলো গো বসন ফেলো। ঘুচাও অঞ্চল।

পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ

সুর-বালিকার বেশ কিরণ বসন।

পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল,

জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা
বিচিত্র বিশ্বের মতো দাঁড়াও একেলা।’

এই পর্বের ব্যাপারে সমালোচকের ভাষায় বলা যায়, “সন্ধ্যাসংগীত’-এ ‘গোধূলি-বিষাদ’, ‘প্রভাত সংগীত’-এ নবজাগরণের ‘আনন্দ-কাকলী’, ‘ছবি ও গান’-এ গভীর অনুভূতির সহিত নিঃসম্পর্কে রঙ ও সুরের খেলা এবং ‘কড়ি ও কোমল’-এ প্রধানত রূপবিহ্বলতার মধ্য দিয়ে সূক্ষ্মতর অনুভূতির উন্মেষ কবিমানসের অগ্রগতির স্তরগুলোকে সূচিত করে।”

দ্বিতীয় পর্যায় উন্মেষ পর্ব: দ্বিতীয় পর্বের ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৩), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮৯৬) প্রভৃতি কাব্যগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিমানসের ‘নিঃসন্দিগ্ধ স্বরূপ বিকাশ’, ‘পূর্ণ আত্মোপলব্ধির পদক্ষেপ’ লক্ষণীয়। ‘মানসী’র কোনো কোনো কবিতাতে দেখি, কবিচেতনা দ্বিধা ও সংশয়ে এখনও কুণ্ঠিত, প্রকৃতি ও প্রেমে তাঁর অন্বিষ্ট পূর্ণতার আদর্শকে খুঁজে না পেয়ে কবিচিত্ত বিষাদ ব্যাকুল-

আপন প্রাণের গোপন বাসনা

টুটিয়া দেখাতে চাহিরে,-

হৃদয় বেদনা হৃদয়েই থাকে,

ভাষা থেকে যায় বাহিরে।

বুঝিতে বোঝাতে দিন চলে যায়,

ব্যথা থেকে যায় ব্যথা।’

কিন্তু এ সত্ত্বেও আমরা দেখি কবি, কবিহৃদয় জীবন ও জগতের পূর্ণতর আদর্শের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে-‘অনন্ত প্রেম’ কবিতাটিতে কবির ব্যষ্টিত হৃদয়ের প্রেমানুভূতিতে নিখিল বিশ্বচেতনা এসে মিলিত হয়েছে।

‘মানসী’র কবিতাগুলোর শব্দযোজনায়, ছন্দোবিন্যাসে পরিণতি চিহ্ন স্পষ্ট; তার ছন্দশিল্পকলা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “পূর্ববর্তী ‘কড়ি ও কোমল’ এর বিশেষ মিল পাওয়া যাবে না। আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নতুন শক্তি দিতে পেরেছি। ‘মানসী’তেই ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিল।”

‘সোনার তরী’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা রচিত হয়েছে উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের পল্লিপ্রকৃতির কোলে বসে। ফলে এই কাব্যে পল্লিপ্রকৃতির একটা বিশেষ রূপ ধরা পড়েছে। ‘সোনার তরী’ ও ‘চিত্রা’র কবিতাগুলোতে সেই জীবনোপলব্ধির ঐশ্বর্যই সঞ্চিত হয়েছে। জীবন ও প্রকৃতির গভীর সম্বন্ধ চেতনার ঐশ্বর্যে এদের কবিতাগুলো সমৃদ্ধ। ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘বসুন্ধরা’ কবিতা কবির মৃত্তিকামমতা, ছন্দ ও চিত্রকরের সম্পদে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

‘চিত্রা’র প্রথম কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যচেতনার বৈশিষ্ট্য চিত্র ও সংগীতের অপরূপ ঐশ্বর্যে অভিব্যক্ত-যে, সৌন্দর্য জগতের বহু বিচিত্ররূপে বিলসিত-

‘জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে

তুমি বিচিত্ররূপিণী।

এই সৌন্দর্যলক্ষ্মীই আবার:

‘অন্তর মাঝে শুধু তুমি একা একাকী

তুমি অন্তরব্যাপিনী।’

জীবনদেবতার অনুভূতি: বাহির অন্তরের এই নিগূঢ় সমন্বয়ে অন্তরের সৌন্দর্যধ্যান ও বাইরের সৌন্দর্যদৃষ্টি সম্মিলিত হয়েই ‘চিত্রা’র কবিতাগুলোতে গীতিকবিতার অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সকল সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা বিরাট সত্তার অনুভূতি থেকেই জীবনদেবতার পরিকল্পনার উদ্ভব, চিত্রার ‘অন্তর্যামী’ কবিতাটিতে আমরা তাই লক্ষ করি। ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘উর্বশী’ একটি অসাধারণ কবিতা। অজিত চক্রবর্তী বলেছেন, “উর্বশীর ন্যায় সৌন্দর্যবোধের এমন পরিপূর্ণ প্রকাশ সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্যে কোথাও আছে কি না সন্দেহ। যে সৌন্দর্য সমস্ত প্রয়োজনের বাইরে সে
আপনাতে আপনি একটি সত্তা।”

তৃতীয় পর্যায়: রোমান্টিক কল্পনা ও বিশিষ্ট জীবনদর্শন, বিশ্বসত্তার সঙ্গে মিলনাকুতি, জীবন দেবতার লীলাচেতনা, প্রেমভাবনার ‘উন্নয়ন’ এ ‘স্বাতন্ত্র্য সমুজ্জ্বল’, ‘সোনার তরী চিত্রা’ পর্বের কবিতাগুলো আর ‘নৈবেদ্য খেয়া গীতাঞ্জলি’র অধ্যাত্মভাবপূর্ণ কবিতার মধ্যে অন্তর্বর্তী পর্বের রচনা হিসেবে ‘কথা’ (১৯০০), ‘কাহিনী’ (১৯০০), ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০) প্রভৃতি কাব্যগুলোকে গ্রহণ করতে পারি। ‘কথা ও কাহিনি’তে কবির দেশের ইতিহাসের মানসপরিক্রমা, প্রাচীন ঐতিহ্যকীর্তির উদাত্ত প্রশস্তি কাহিনির দ্রুতচারিতায় এক বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গি লাভ করেছে। এই পর্বের কবিতাগুলো সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “এক সময়ে গিয়ে পড়েছিলুম ইতিহাসের রাজ্যে। সেই সময়ে এই বহিদৃষ্টির প্রেরণা কাব্যে ও নাট্যে ভীড় করে এসেছিল ইতিহাসের সঞ্চয় নিয়ে। এমনি করে এই সময়ে আমার কাব্যে একটা মহল তৈরি হ’য়ে উঠেছে যার দৃশ্য জেগেছে ছবিতে, যার রস নেমেছে কাহিনিতে, যার রূপের আভাস দিয়েছে নাটকীয়তায়।”

‘কল্পনা’র কোনো কোনো কবিতায় কালিদাসের অপূর্ব চিত্রসৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে-

‘দূরে বহুদূরে,

স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে

খুঁজিতে গেছিনু করে শিপ্রানদীপারে

মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।

‘ক্ষণিকা’ রবীন্দ্রনাথের একটা বিচিত্র অভিনব সৃষ্টি। কথ্যভাষার প্রয়োগে এই কাব্যের ছন্দ ও ভাষাভঙ্গি স্বচ্ছতোয়া। নদীর মতই গতি পেয়ে সজীব হয়ে উঠেছে।

চতুর্থ পর্ব অন্ত্যপর্ব: রবীন্দ্র কাব্যে আধ্যাত্মিকতা-অতঃপর চতুর্থ পর্বে কবি আধ্যাত্মিক ভাবনার জগতে এক বিচিত্র মুক্তির স্বাদ পেলেন। তাঁর জীবনদেবতা কল্পনার মধ্যে যে অন্তরের আভাষ ছিল, তাই এবার প্রত্যক্ষ প্রেরণারূপে এই পর্বের কাব্য ‘খেয়া’ (১৯০৬), ‘নৈবেদ্য’ (১৯০৯), ‘গীতাঞ্জলি’ প্রভৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল, জীবনদেবতা এই পর্বে বিশ্বদেবতায় রূপান্তরিত হলেন। ‘সোনার তরী চিত্রা’য় প্রেমসৌন্দর্যের জগৎ থেকে এই পর্যায়ে অপরূপ অসীমের নিকট আত্মনিবেদনের আধ্যাত্মিক আকুতির জগতে এসে উত্তীর্ণ হলেন। ‘নৈবেদ্য’র প্রথম কবিতাটিতে কবি বিশ্বদেবতার উদ্দেশ্যে তাঁর আত্মার নম্র নিবেদন জানিয়েছেন-

‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী,

দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

করি জোড়কর হে ভুবনেশ্বর

দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

তোমার অপার আকাশের তলে

বিজনে বিরলে হে,

নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে

দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।’

খেয়া’র ‘গীতাঞ্জলি’র অধ্যাত্মচিন্তার আভাস আরও পরিস্ফুট। ‘খেয়া’ নামটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, খেয়া নৌকা নদীর এক তটপ্রান্তে থেকে অন্যপ্রান্তে পাড়ি দেয়। তেমনি কবির ‘সোনার তরী চিত্রা’র প্রেম সৌন্দর্যের জগৎ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’র অধ্যাত্মজগতে যাত্রা ‘খেয়া’র বিভিন্ন কবিতায় ব্যঞ্জিত হয়েছে। ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ শেষ’ দিনান্তের দৃশ্য, কাশের বন, শূন্য নদীর তরী, ঘাট, সন্ধ্যাপ্রদীপ, স্তব্ধ অন্ধকার, শূন্য ঘর’। কবি যে বাইরের বিচিত্র সৌন্দর্য জগৎ থেকে ঘুরে সরে এসেছেন, তার পরিচয় তাঁর আকাঙ্ক্ষাতেই মেলে। তিনি ‘খেয়া’র কবিতাগুলোতে বারবার বলেছেন, ‘এখন কেবল একটি পেলেই বাঁচি’ একতারা একটি তার ফুলবনের একটি কুসুমই তাঁর প্রয়োজন, এখন তাঁকে আবার ক্ষীণ আলোকে মাঠের পথে একাকী চলতে হবে।

‘এখন তোমার তারার ক্ষীণালোকে
চলতে হবে মাঠের পথে একা-

গিরি কানন পড়বে কি আর চোখে,
কুটিরগুলি যাবে কি আর দেখা।”

বলাকার যুগ-রবীন্দ্রকাব্যের পর্যান্তর: ‘বলাকা’ (১৯১৬), ‘পূরবী’ (১৯২৫), ‘মহুয়া’ (১৯২৫)-পঞ্চম পর্বের এই কাব্যগুলোতে কবিমানসের নতুন দিক্-পরিবর্তন লক্ষণীয়। ‘বলাকা’য় কবির ভাব-কল্পনা নতুন মোড় নিয়েছে। পূর্ববর্তী অধ্যাত্মপর্বে কবির মন যে ভাবে ঈশ্বরানুভূতিতে মগ্ন ছিল ‘বলাকা’য় তা’ আবার ফিরে এল মানব-জীবন-পথে। অবশ্য তারও পূর্বে তিনি ছিলেন মানব-জীবন-পথেই, কিন্তু তার সঙ্গে এবারের পার্থক্য সুস্পষ্ট। এ বিষয়ে অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “মানসী হইতে ক্ষণিকা পর্যন্ত কবির যে রূপ রসের জগৎ-প্রকৃতি ও মানবের সৌন্দর্য মাধুর্য প্রেমের জগৎ সে জগৎ হইতে বলাকার জগৎ একটু ভিন্ন প্রকৃতির। পূর্বের জগৎ প্রত্যক্ষ অনুভূতির জগৎ, ধরণী ও মানবজীবনের রূপচেতনার অকপট, প্রত্যক্ষ প্রকাশের অনাবিল রসোচ্ছল জগৎ-একান্তভাবে কাব্যের জগৎ; আর বলাকার জগৎ, প্রকৃতি ও মানবের সত্যকার গভীর রহস্য ও তাহাদের রূপরসের প্রকৃত তত্ত্বানুভূতির জগৎ-বিশেষভাবে কাব্যদর্শনের জগৎ।”

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘বলাকা’র কবিতাগুলো রচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ‘বলাকা’র কবিতাগুলোতে গতিতত্ত্বকেই কাব্যসত্য করে তুলেছেন। কাব্যরচনার অল্প পূর্বেই কবি ইউরোপ ভ্রমণ করে সমকালের ঘটনার প্রত্যক্ষ পরিচয় ও ভবিষ্যতের আভাস পেয়ে এসেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, উদ্যম ঝড়ের বেগে চলতে না পারলে জীবনসংগ্রামে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই তাঁর কাব্যে শোনা গেল গতিবাদের সুর।

রবীন্দ্রনাথের গতিপথ অপরিণামী নয়। তাছাড়া বাল্যাবধি উপনিষদের মন্ত্রে দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথের নিকট ‘চরৈবেতি’ তত্ত্বও অজ্ঞাত ছিল না। তাঁর ‘প্রভাতসংগীতে’র ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতায় সেই পরিণামী গতিবাদের পরিচয়ও আমরা পেরেছি। ‘বলাকা’র ‘ঝড়ের খেয়া’ কবিতায় কবি বলেন, ‘মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে… তবে ঘর ছাড়া সবে, অন্তরের কী আশ্বাস রবে।” এবং ‘বলাকা’ পর্বের আরও অন্য বহু কবিতায় গতিবাদের একটা সার্থক পরিণতির প্রতি রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত করে গেছেন। অতএব রবীন্দ্রনাথের গতিবাদে যে একটা স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় রয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কবি তাঁর নতুন উপলব্ধি অনুযায়ী তাঁর প্রকাশের ভাষা ও ছন্দকেও নতুনভাবে নির্মাণ করেছেন। ‘বলাকা’র ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো চরণ বিন্যাসের অসমতা-আঠারো মাত্রায় পয়ারের একটি চরণের পর্বগুলো ভেঙে, কখনো একটিমাত্র পর্বেও একটি চরণ গঠিত হয়েছে। আবেগের তরঙ্গোচ্ছাস এবং সংকোচনই চরণগুলোর পরিমাপকে নিয়ন্ত্রিত করে-“বলাকা’র অনিয়মিত, অসম ছন্দবিন্যাসে, ঝড় খাওয়া মনের বিসর্পিত আন্দোলনে, উহার চিন্তাধারার তট হইতে। তটান্তরে প্রহত ভাবতরঙ্গের অস্থির গতি ও দূরব্যাপী বিস্তার, উহার সমাধান অন্বেষণ ও আত্মানুসন্ধানের সংশয়াকুল পদক্ষেপ যেন আপন প্রতিচ্ছবি মুদ্রিত করিয়াছে।”

‘বলাকা’ এবং ‘পূরবী’র মধ্যবর্তীকালে রচিত ‘পলাতকা’য় কবির মর্ত্যপ্রীতি সহজ সরল কথনভঙ্গিতে অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘পূরবী’তে সৌন্দর্যবোধ ও যৌবন স্মৃতিচারণার আবেগের সঙ্গে আসন্ন বিদায়ের করুণ সুল পরিণত বয়সের প্রজ্ঞা মিলিত হয়ে গীতিকবিতার অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। ‘পূরবী’তে একদিকে পাই মৃত্তিকামম আবেগ-

‘যাই ফিরে যাই মাটির বুকে,

যাই চলে যাই মুক্তিসুখে,

ইটের শিকল দিই ফেলে দিই টুটে;
আজ ধরণী আপন হাতে
অন্ন দিলেন আমার পাতে

ফল দিয়েছেন সাজিয়ে পত্রপুটে।’

অন্যদিকে জীবনের আসন্ন অন্তিম লগ্নটির পটভূমিতে কবির বিদায় গ্রহণের প্রস্তুতি বিষাদ-

‘এবারের মতো কর শেষ

প্রাণে যদি পেয়ে থাক চরমের পরম উদ্দেশ;
যদি রাত্রি তার
খুলে দেয় নীরবের দ্বার,
নিয়ে যায় নিঃশব্দ সংকেত ধীরে ধীরে

সকল বাণীর শেষ সাগর সঙ্গমতীর্থ তীরে,

সেই শতদল হতে যদি গন্ধ পেয়ে থাকে তার:

মানসরসে যাহা শেষ বর্ষ শেষ নমস্কার।

 

কবির প্রৌঢ় বয়সের রচনা ‘মহুয়া’য় আমরা এক অপূর্ব, দ্বিতীয় যৌবনের রক্তা। লক্ষ করি-এখানে প্রেমের প্রবল প্রাণশক্তি সংকীর্ণ প্রাত্যহিকতায়, আরামের পঙ্কশয্যায় মলিন ও কলুষ নয়, তা বাঁর্যে, মহ কর্তব্যবোধে, বিশ্বচেতনায় ও অনন্ত গতিপ্রেরণায় উদ্দীপিত এবং উজ্জ্বল।

গদ্যছন্দে কবিতা রচনায় প্রয়াস-‘পুনশ্চ’, ষষ্ঠ পর্বের ‘পুনশ্চ’ (১৯০২), ‘শেষসপ্তক’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬), শ্যামলী’ (১৯৩৭) প্রভৃতি কাব্যগুলোকে এক নতুন দুঃসাহসিক কাব্যকলার পরীক্ষায় রবীন্দ্র কবিমানসের দীপ্ত আত্মপ্রকাশ
লক্ষ করি। নিজের তৃপ্তিবিহীন কবিত্বের দুর্নিবার প্রেরণায় কবি বারবার নিজের কীর্তিকেই অতিক্রম করেছেন। তার আগে ‘বলাকা’য় তিনি মুক্তকে প্রবহমান পয়ার ছন্দের নতুন পরীক্ষা করেছিলেন, আর এই পর্বে গদ্য ছন্দের অভিনব প্রকরণে আধুনিক বাংলা কবিতার বিপুল সম্ভাবনাই উন্যোচিত হলো। ‘পুনশ্চ’য় এই গদ্য কবিতায় প্রথম সূত্রপাত হলো, এখানেই কবি গদ্যছন্দের আঙ্গিকটি প্রথম সুস্পষ্টভাবে নির্মাণ করেন। ‘পুনশ্চ’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথ শুধু ছন্দেই অভিনবত্ব সৃষ্টি করেননি, তার কবিতার বিষয়বস্তু এবং পরিবেশণেও অনেকটা নতুনত্ব এনেছেন।

অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস বলেন, “এর অনেকগুলো কবিতায় কবি সাধারণ মানুষের আনন্দবেদনাকে কাব্যের বিষয়ীভূত করতে চেয়েছেন-যার বাইরে আছে ক্ষুদ্র কাহিনি সর্বত্র বিজড়িত আছে কবিমানসের সহানুভূতি। রবীন্দ্রনাথের যে কবিমানস অতুলনীয় ছোটোগল্পগুলোর সৃষ্টি করেছে, তাই গদ্যছন্দের সুবিস্তৃত বাহন অবলম্বন করে সহজেই কাব্যের ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং বাস্তবতার মধ্যে বিচরণ করেছে। কিন্তু বলা বাহুল্য, এগুলো কাব্যাকারে হয়নি,… কাব্যরূপ বিচার করে বলা যায়, কবি এগুলোকে কাব্যই করতে চেয়েছেন, গল্প নয়।”

‘সোন তরী’র ‘বসুন্ধরা’ কবিতাটির পৃথিবীকে জীবনের গভীরে আবাহন করে নেবার আবেগের উষ্ণতার তুলনায় ‘পত্রপুটে’র এই অংশের পৃথিবী-বন্দনার শান্ত, গভীর সুর, আবেগোচ্ছাসের পরিবর্তে দার্শনিকতার স্বাতন্ত্র্য সহজেই কাব্য- পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এ পর্যায়ের কবিতাগুলো-সম্বন্ধে ডা. নীহাররঞ্জন রায় বলেন, “কিন্তু এই কবিতাগুলোতে তীব্র হৃদয়াবেগের প্রাধান্য নাই, কল্পনার উদ্দীপনা কিংবা পঞ্চমরাগে ঝঙ্কারও নাই। এই চিত্তের উদগ্র কামনায় দীপ্তি ও রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতায় বরাবরই অনুপস্থিত। কয়েকটি কবিতায় প্রেমশ্লিষ্ট চিরন্তন সমস্যার অভিঘাত সুস্পষ্ট। অথচ মোটামুটিভাবে এই কবিতাগুলোতে সহজ মৃদু ও শান্ত প্রেমের আকস্মিক অথচ অবিনশ্বর পরিচয়ই বিচিত্র রেখায়, চিরন্তন রহস্যের স্তিমিত উচ্ছলতায় দীপ্তিলাভ করিয়াছে। উদ্বেলিত উচ্ছসিত আবেগ সর্বত্রই যেন সহজ আয়াসে সংযত।”

রবীন্দ্রকাব্যের অন্ত্যপর্ব: অন্ত্যপর্বে ব ধারায় পাই ‘প্রান্তিক’ (১৯৩৮), ‘আকাশপ্রদীপ’ (১৯৩৯), সেজুতি’, ‘নবজাতক’, ‘সানাই’, ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪১) ‘ত ব্লগ’ (১৯৪১) ও ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১)। ‘প্রান্তিকে’র ‘অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলার পটভূমিতে কবি জীবনের পরম সভ্য অন্বেষণ করেছেন, নিজের দেহের ব্যাধিযন্ত্রণা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবসভ্যতার শোচনীয় দুর্গতির পটে কবির জীবনের গভীর মূল্যবোধ ‘রোগশয্যা’, ‘আরোগ্য’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো শ্লোকের মতো কঠিন, সংহত রূপে হীরকদ্যুতিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। রোগজীর্ণ দেহের যন্ত্রণার দহনের মধ্য দিয়েই তিনি শুচিশুদ্ধ জীবনপ্রত্যয়ে স্থিত হন।

রবীন্দ্রনাথের অন্ত্যপর্বে কাব্যগুলোর বিষয়ে অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রবীন্দ্রনাথ এই কাব্যসমূহে এক প্রশান্ত নিরাসক্ত মন লইয়া সমস্ত মোহবন্ধন ও মায়াবিভ্রম ছিন্ন করিয়া, তাঁহার ব্যক্তিজীবনের সমস্ত অর্জিত সম্পদ এমনকি অহংবোধকে বিসর্জন দিয়া অস্তিত্বের পরম সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন; সমস্ত পরিচয় ও বিশিষ্ট চিহ্নবর্জিত এক
চেতনাবিন্দুরূপে জ্যোতিঃসমুদ্রের মহাসঙ্গমতীর্থে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।”

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। তিনি তাঁর য ধারায় বিভিন্ন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রবীন্দ্রনাথ এই কাব্যসমূহে এক প্রশান্ত নিরাসক্ত মন লয়ে সমস্ত মোহবন্ধন ও মায়াবিভ্রম ছিন্ন করে, তাঁর ব্যক্তিজীবনে সমস্ত অর্জিত সম্পদ এমনকি অহংবোধকে বিসর্জন দিয়ে অস্তিত্বের পরম সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সমস্ত পরিচয় ও বিশিষ্ট চিহ্নবর্জিত এক চেতনা বিন্দুরূপে জ্যোতি সমুদ্রের মহাসঙ্গমতীর্থে এসে দড়িয়েছেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।