রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্যরূপে কাব্যচর্চা শুরু করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তার রচনার ওপরে গুপ্তকবির প্রভাব পড়েছে। কিন্তু রঙ্গলালের কৃতিত্ব এই যে, তিনি ক্রমে গুরুর প্রভাব অতিক্রম করে স্বাধীনভাবে প্রতিভা বিকাশের পথ করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত আধুনিক শিক্ষার আলােক পাননি। রঙ্গলাল ইংরেজী বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে বাঙলা দেশে যে নতুন শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। তাদের রুচি প্রকৃতি ছিল পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই পাঠকদের তৃপ্তি-সাধনের উপযুক্ত কাব্য-সম্পদ ঈশ্বর গুপ্ত সৃষ্টি করতে পারেননি। তার হালকা রঙ্গ ব্যঙ্গমুখর কবিতা ম্যুর-বায়রন- স্কট পড়া নব্য পাঠকদের পক্ষে রুচিকর না হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। রঙ্গলাল সর্বপ্রথমই রূপান্তরিত রসরুচি-বিষয়ে অবহিত হন এবং সাধ্যমত আধুনিক পাঠকদের জন্য দেশীয় আখ্যান অবলম্বনে ইংরেজী কাব্যের রােমান্স-রস পরিবেশনের আয়ােজন করেন। ঈশ্বর গুপ্তের অগভীর রঙ্গ ব্যঙ্গের পরিবর্তে দেশপ্রেম এবং রােমান্স-রসের কাব্যে রঙ্গলাল যে আবেগের গভীরতা আনলেন—পরবর্তীকালে সেই পথেই বাঙলা কাব্য নতুন যুগে উত্তীর্ণ হয়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ইউরােপীয় কবিদের গভীর ভাববস্তু দেশীয় ভাষায় প্রকাশ করা কিছু অসম্ভব নয়। তিনি প্রশ্ন করেছেন, য়ুরােপীয় উপাদেয় মানসিক ভােজ্য, কবিতা প্রভৃতি কি এতদ্দেশীয় জনগণের রুচি-অনুসারে এতদ্দেশীয় নিয়মে প্রস্তুত করা যাইতে পারে না? করা যে যায় রঙ্গলাল আপন কাব্যকৃতিত্বে তার প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন। উত্তরকালের শক্তিমান কবিদের সকলের রচনাতেই এটা আরও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং বাঙলা কাব্যের পালা বদলের স্পষ্ট সূচনা রঙ্গলাল থেকেই হয়েছিল একথা অসংশয়ে বলা যায়।
রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’কে (১৮৫৮) বলা যায় আধুনিক কালের প্রথম বাঙলা কাব্য। ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে রঙ্গলাল অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। ইতিহাসের উপাদান সম্পর্কে তিনি নিজে কিছু কিছু গবেষণামূলক কাজও করেছিলেন। ইতিহাস বিষয়ে তার এই অনুরাগ কাব্য রচনায় বিশেষ সহায়তা করেছে। টডের রাজস্থানের ইতিহাস থেকে চিতােরের পতন অংশটা তিনি এই কাব্যের কাহিনী গঠনে ব্যবহার করেছেন। যখন পদ্মিনী উপাখ্যান লেখেন তখন পর্যন্ত ইংরেজ শাসনের প্রতি এদেশের শিক্ষিত মানুষের মনে শ্রদ্ধাবােধের অভাব দেখা দেয়নি; স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাও তীব্র হয়ে ওঠেনি। রাজপুত বীরত্বের যে কাহিনী রঙ্গলাল রচনা করলেন তার মধ্যে কোথাও কোথাও স্বদেশপ্রীতি ও স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্ক্ষা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। এর মূলে আছে নব্য-ইংরেজী কাব্যের প্রভাব। ইংরেজী কাব্যের উচ্ছসিত দেশবন্দনা এবং স্বাধীনচিত্ততা শিক্ষিতদের মুগ্ধ করত রঙ্গলাল সেই ভাববস্তু দেশীয় কাহিনীর আধারে পরিবেষণ করে নতুন পাঠক সমাজের চিত্তহরণ করেছিলেন।
ইত্যাদি অংশ পরবর্তীকালে স্বাদেশিকতার উদ্বোধনে প্রভূত উদ্দীপনা যুগিয়েছে। রঙ্গলালের দ্বিতীয় কাব্য ‘কর্মদেবী’ প্রকাশের পূর্বেই বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে মধুসূদনের আবির্ভাব হয় এবং স্বভাবতই রঙ্গলালের কাব্যের গুরুত্ব কমে যায়। কিন্তু পদ্মিনী উপাখ্যান বিষয় এবং ভাববস্তুর দিক থেকে একটা নতুন পথের নির্দেশ দান করেছিল।
ছারটি সর্গে সম্পূর্ণ ‘কর্মদেবী’ (১৮৬২) কাব্যের বিষয়ও রাজপুত ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। রাজপুত-কাহিনী নির্ভর তার তৃতীয় কাব্য ‘শূরসুন্দরী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে। ১৮৬৯ স্ত্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত কাঞ্চী কাবেরী নামক কাব্যটি বিষয়ের দিক থেকে একটু অভিনব। উড়িষ্যার একজন প্রাচীন কবি পুরুষােত্তম দাসের রচনা থেকে রঙ্গলাল কাঞ্চী কাবেরী’র কাহিনীটা সংগ্রহ করেছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং মধুসূদনের মধ্যবর্তী সংক্ষিপ্ত সময়টুকুতে রঙ্গলাল বাঙলাদেশের প্রধান কবিরূপে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। আজ তাঁর কাব্যের রসমূল্য বিচার করতে গেলে মনে হবে। যতােটা খ্যাতি তিনি অর্জন করেছিলেন, কাব্য-প্রতিভায় তিনি ততাে বড় কবি সত্যই ছিলেন না। সত্যকার প্রতিভাসম্পন্ন কবির রচনায় দেখা যায় কাব্যের এবং প্রকাশরীতি-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আপন কাব্যের উপযুক্ত আঙ্গিক উদ্ভাবনের নিরলস প্রচেষ্টায় বড়াে কবিরা সমগ্রভাবে কাব্যের ইতিহাসের গতিমুখ নতুন নতুন পথে প্রবাহিত করে দেন, যেমন দিয়েছেন মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথ। রঙ্গলাল এদিক থেকে কোন বিশিষ্ট শিল্প-চেতনার পরিচয় দিতে পারেন নি। তিনি নতুন ভাববস্তু প্রকাশ করতে চেয়েছেন, নতুন ধরনের কাব্য রচনায় উৎসাহ বােধ করেছেন, কিন্তু ভাষা, ছন্দ এবং প্রকাশরীতির ক্ষেত্রে একান্তভাবেই তিনি প্রাচীন রীতির অনুবর্তন করেছেন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে তিনি বাঙলা কাব্যে পালাবদলের সূচনা করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু কাব্যের আত্মিক রূপান্তর ভিন্ন যে তা সম্ভব হয় না রঙ্গলাল তা বােঝেন নি। বিশুদ্ধ কাব্যের বিচারে তাঁর কাব্যসৃষ্টির মূল্য খুব বেশী নয়। এতকাল দেবতা এবং ধর্মই ছিল কার্বের বিষয়, রঙ্গলালই সর্বপ্রথম তার পরিবর্তে ঐতিহাসিক কাহিনীকে অবলম্বন করে ‘আখ্যায়িকা কাব্য’ রচনা করলেন। অতঃপর হেমচন্দ্র, নবীন এবং পরবর্তীকালের বহু কবিই এই ধারার অনুসরণ করে গেলেন। তাতে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, তা’ গুণগত; রূপগতভাবে রঙ্গলালই এই ধারা-প্রবর্তকের মর্যাদার অধিকারী।
অধ্যাপক সুকুমার সেন রঙ্গলালের কাব্যকৃতির মূল্যবিচার প্রসঙ্গে লিখেছেন, “রঙ্গলালের নব-রােমান্টিক কবিত্ব প্রত্যুষান্ধকারে অকাল-জাগ্রত এক বিহঙ্গের অস্ফুট কাকলির ন্যায় অপূর্ণকণ্ঠ এবং দ্বিধাগ্রস্ত। রঙ্গলালের বাণী যাহাদের অন্তরের মৌন স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল সেই নব প্রবুদ্ধ ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালীর ভবিষ্যতের আশা তখনাে যেমনি অস্ফুট তেমনি সংশয়-বিজড়িত ছিল। পদ্মিনী উপাখ্যানে শিক্ষিত বাঙালী আপনার চিত্তের নিগূঢ় অনুভূতিকে বাত্ময় দেখিয়া আশ্বস্ত হইল। রঙ্গলালের রচনার কাব্যিক মূল্য বেশি নয়। কিন্তু তাহার দ্বারা নিশীথিনীর মৌন যবনিকা অপসারণের প্রথম সংকেত ধ্বনিত হইয়াছিল বলিয়া ইতিহাসে তাহার বিশিষ্ট মূল্য আছে। কাব্য রঙ্গভূমিতে মধুসূদনের প্রবেশের পূর্বে রঙ্গলাল নান্দী গাহিয়াছিলেন।”
Leave a comment