‘রক্তকরবী’ নাটক
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ আলোড়ন সৃষ্টিকারী নাটক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনবাদী সভ্যতার সর্বগ্রাসী রূপ এখানে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রক্তকরবী’ নাটকে রূপকের মাধ্যমে ধনবাদী সভ্যতার প্রলয়ঙ্করী রূপটাকে বর্ণনা করেছেন।
‘রক্তকরবী’: ‘রক্তকরবী’ নাটকটিতে রক্তকরবী নামক দুলটির দ্বারা রবীন্দ্রনাথ বর্ণবাদী সভ্যতার অক্টোপাস থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘রক্তকরবী’র উজ্জ্বল আভায় তিনি যাবতীয় শোষণ মুক্ত হয়ে নতুন সমাজ সৃষ্টি কামনা করেছেন।
ব্যান্ড: রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে ব্যাঙকে প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে ধনবাদী সমাজ ব্যবস্থায় নিরস্ত র টিকে থাকার সংগ্রামকে বুঝানোর প্রয়াস পেয়েছেন।
বাজপাখী: ‘রক্তকরবী’ নাটকে সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে আগমন ঘটেছে বাজপাখীর প্রতীকটিকে। বাজপাখীর প্রতীকের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ধনবাদী সভ্যতার শোষণটিকে প্রকাশ করেছেন। ধনবাদী সভ্যতার মালিক শ্রেণি যেমন শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ করে নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে তেমনি বাজপাখী ক্ষুদ্র প্রাণীকে ভক্ষণ করে তার নিজের অস্তিত্ব করে তোলে মজবুত।
নীলকণ্ঠ: রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে শিবের মূর্তিকে পরোক্ষভাবে আনয়ন করেছেন। যা রঞ্জনের চরিত্রের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শিব যেমন বিষপান করেছিল, রঞ্জনদত্ত তেমনি সর্বগ্রাসী রূপ ধনবাদী সভ্যতার দুঃখ-যন্ত্রণা ধারণ করেছে।
পৌষের গান: ‘রক্তকরবী’ নাটকে একটি গানকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। গানটি চৈতালী ফসলের গান। এ গানের মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতা থেকে, শোষণ যুক্ত সমাজ ব্যবস্থা, ধনবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার শান্তির নীড়ে আসার অংকন করা হয়েছে।
জাল: এই নাটকে শোষণের কাণ্ডারী হিসেবে রাজা নামক চরিত্রটি এসেছে। রাজা জালের আড়ালে থেকে শোষণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এ জালের রূপকের মাধ্যমে ধনবাদী সমাজের শোষণের চিত্র ফুটে ওঠে। এই রাজাকে ঘিরেই অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার আবর্তিত হচ্ছে।
চরিত্র: এই নাটকে নাট্যকার দুই শ্রেণির চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর প্রকৃত মনোভাব ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথম পক্ষে আছে যাবতীয় অত্যাচার ও অমঙ্গলের প্রতীকী চরিত্র যারা রাজা, সর্দার, অধ্যাপক ও তাদের সহযোগীরা। আবার দ্বিতীয় পক্ষে আছে শোষিত-বঞ্চিতদের চরিত্র যাদের মধ্যে এখনো প্রাণের ছোঁয়া এখনো বিদ্যমান। এরা হলো নন্দিনী, রঞ্জন, বিশু, কিশোর। আর রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্রগুলোর মাধ্যমে ধনবাদী সভ্যতা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজেছেন। নাটকটির কোনো কোনো চরিত্রের সংলাপের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পরোক্ষভাবে তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন যেমন গজ্জু পালোয়ান একবার সর্দারকে উদ্দেশ্য করে বলেছে:
“এরা কোথাকার দানব, জাদু জানে। শুধু জোর নয়, একেবারে ভরসা পর্যন্ত শুষে নেয়। যদি কোনো উপায়ে একবার- হে কল্যাণময়ী হরি- আঃ যদি একবার দয়া হলে কী না হতে পারে- সর্দারের বুকে দাঁত বসাতে পারি।”
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনবাদী সভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী রূপ ও তাদের শোষণ প্রক্রিয়া থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেছেন এই নাটকে। যা রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ পর্যায়ে তিনি কাহিনির পর্যায় ক্রমিক ধারায় রামায়ণের কাহিনিকেও কিছুটা স্মরণ করেছেন। রামায়ণের কাহিনিতে রাবণ যেমন শোষণের কেন্দ্রে অবস্থান করে শোষণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছেন, রাজাও তেমনি এ নাটকের কেন্দ্রে অবস্থান করে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। এই রাজা লঙ্কা রাজার মতোই ধনরত্ন দিয়ে পাহাড় গড়েছেন। নাটকটির পরিশেষে দেখা যায় অত্যাচারের প্রতীক রাজা শোষিতদের পৌষের গানে শরীক হয়েছে এবং শোষণের পতাকা ভেবে দিয়েছে। এখানে রবীন্দ্রনাথ মূলত রূপকের মাধ্যমে ধনবাদী সভ্যতার নিঃশেষিত অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment