প্রশ্নঃ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ মানুষের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রাষ্ট্র বা সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তিগণকে বৃহত্তর বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হয়, যার উপর একটি সংগঠন, সংস্থা বা একটি জাতি নির্ভরশীল থাকতে পারে। সিদ্ধান্তের উপযুক্ততা, শ্রেষ্ঠত্ব ও কুশলতার উপরও নির্ভর করে অনেকের ভাগ্য। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয় আর কমই আছে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সমাজবিজ্ঞানীদের নিকট এক অন্যতম অধ্যয়নের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া (Process of Rational Decision Making): সাইমন বলেন যে, সিদ্ধান্ত হচ্ছে একটি মীমাংসামূলক কার্য (Decision is a matter of compromise)। কারণ একটি সিদ্ধান্তের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য কতিপয় সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্তের বহুমুখী উপাদান জড়িত থাকে। বিশেষ করে, একটি সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বিভিন্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ থাকে যেগুলোর মধ্যে আপোস মীমাংসা করতে হয়। কাজেই বাস্তব ক্ষেত্রে এত সব পার্শ্ব-সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তের উপাদানসমূহ বিবেচনা করে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তা মূলত আপোস-মীমাংসামূলক কার্য। সাইমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন দিক বিচার বিশ্লেষণ করে তিনটি মডেলের কথা উল্লেখ করেছেন এবং উভয়ের মধ্যে তুলনামূলক বিচার করে সবচেয়ে উত্তম মডেলটি গ্রহণ করেছেন। নিচে মডেল তিনটি বর্ণনা করা হলোঃ
১। উপায় লক্ষ্য মডেল (Means-ends Model): সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাযথ উপায় নির্ধারণ ও গ্রহণ করাই এ মডেলের মূলকথা। সাইমন বলেন “সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ঐসব বিকল্পকেই পছন্দ করা হয় যেগুলোকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপযুক্ত উপায় বলে মনে করা হয়” (In the process of decision those alternatives are chosen which are considered to be appropriate means for reaching desired ends)। কাজেই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নৈতিকতা, মূল্যবোধ, বিচার-বুদ্ধি ইত্যাদিকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যাতে লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকর উপায় নির্ধারণ করা যায়। উপরন্তু, লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে সাইমন এ মডেলটিকে পরিত্যাগ করেন।
২। আচরণ বিকল্প মডেল (Behavior Alternative Model): সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই সচেতন বা অসচেতন কিংবা যৌক্তিক বা অযৌক্তিক আচরণ করে। ফলে আচরণের ক্ষেত্রে গুণগত পার্থক্য থাকে। এরূপ অবস্থায় যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সাইমন আচরণের বিকল্প মডেল উদ্ভাবন করেন। মূলত এ মডেলে সবগুলো বিকল্পকে সমান গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় এবং সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণকারী কিভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তা নির্দেশ করা হয়। সাইমন বলেছেন যে, আচরণ বিকল্প মডেলে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী লক্ষ্য থেকে শুরু করে না বরং সব ধরনের বিকল্প কর্মপন্থা এবং এদের ফলাফল বিবেচনা করে। তিনি এ ধরনের মডেলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনটি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেনঃ
(ক) সকল বিকল্পের একটি তালিকা তৈরি করা;
(খ) সকল বিকল্প সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা; এবং
(গ) বিকল্পগুলোর পারস্পরিক গুরুত্ব বিচার-বিশ্লেষণ করে একটিকে বাছাই করা। কিন্তু কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে সাইমন এ মডেলটিকেও গ্রহণ করেন নি।
৩। সীমিত যৌক্তিক মডেল (Bounded Rationality Model): ক্লাসিক্যাল অর্থনৈতিক তত্ত্বে যে ধরনের যৌক্তিকতার কথা বলা হয়েছে সাইমন তার বিপরীতে সীমিত যৌক্তিকতার মডেল (Bounded Rationality Model) বা সন্তোষজনক মডেল (Satisficing Model) উপস্থাপন করেছেন। তিনি মনে করেন যে, একজন মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে যৌক্তিক হওয়া সম্ভব নয়। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিকল্প সংগ্রহ করা সম্ভব নয় বরং প্রাপ্ত বিকল্পসমূহের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। উপরন্তু, সাংগঠনিক লক্ষ্য ও ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের মধ্যে বিরোধিতার ফলে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি অর্জনই সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য একজন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এমন বিকল্পকেই বাছাই করে যেটি তার সর্বাধিক সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে, তবে সেটি যৌক্তিক কি না সেটা বড় প্ৰশ্ন নয়। আর এ কারণেই সাইমন এ মডেলের নাম দিয়েছেন সন্তোষজনক মডেল (Satisficing Model)।
বিষয়টি সাইমন নিজের ভাষায় এভাবে বিবৃত করেছেন, “মানুষ সকল সম্ভাব্য বিকল্প অনুসন্ধান করে না বরং তাদের জন্য যা যথেষ্ট ভাল বা সন্তোষজনক সেটিই গ্রহণ করে। তাদের প্রত্যাশা তাদের অনুসন্ধানকে সীমিত করে এবং যে বিকল্পটি সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্টি দিতে পারবে বলে মনে করে, সেটিকেই তারা গ্রহণ করে” (People accept what is good enough or satisfying to them and do not search for all possible alternatives. Their expectations limit their search and they adopt the most satisfying perceived alternative)। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সীমিত পর্যায়ে যৌক্তিক হয় এবং সে সর্বাধিক সন্তুষ্টি বিধানকারী বিকল্পটি সিদ্ধান্ত হিসেবে বাছাই করে।
সমাপনীঃ রাষ্ট্রীয় বা জাতিগতভাবে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যারা বিশ্বের মানব সম্প্রদায় বিষয়টির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। কারণ যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নির্ভুল ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরো অনেক বেশি অনুভূত হয়ে চলেছে। তাই হার্বার্ট সাইমন (Herbert Simon) সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ‘Heart of Administration’ বলে অভিহিত করেছেন।
Leave a comment