সাহিত্য স্রষ্টা এবং সাহিত্য সমালোচক সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে একটি জায়গায় মেলেন। মিলন বিন্দুটির নাম সাহিত্য। স্রষ্টা যিনি তিনি সাহিত্য অর্থাৎ গল্প উপন্যাস কাব্য নাটকাদি রচনা করেন। আর সমালোচক যিনি তিনি সাহিত্য অর্থাৎ গল্প উপন্যাস কাব্য নাটকাদি পাঠ করে জাগতিক বিষয়ের নতুন হয়ে ওঠার কৌশলটিকে বুঝে নেন। এই বুঝে নেওয়ার নানান পদ্ধতি আছে। এই বুঝে নেওয়ার কাজে যে পদ্ধতিটি অবলম্বন করা হোক না কেন সমালোচকের ক্ষেত্রে ওই পাঠ নেওয়া তথা বুঝে নেওয়াটিই বড়ো কথা হয়। কেননা সাহিত্য পাঠের মূল কথা হচ্ছে তার আস্বাদন-রসাস্বাদন। সমালোচকরা সাহিত্যের রসাস্বাদনে মগ্ন হয়েই তার ব্যাখ্যা বিচার-বিশ্লেষণ কিংবা ভালো-মন্দের বিচার করে থাকেন। অর্থাৎ সমালোচনার ক্ষেত্রে পদ্ধতিটির থেকে আস্বাদ যোগ্যতাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেদিকে তাকিয়েই সম্ভবত বলা হয়েছে—যে পদ্ধতিই অবলম্বন করা হোক না কেন, সাহিত্য সমালোচনা আসলে সাহিত্যেরই রসাস্বাদন।
সমালোচক সদর্থে পাঠককে লেখকের মনের সঙ্গে লেখার বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সাহিত্য বা কাব্য আস্বাদনে পাঠককে সহায়তা করাই সমালোচকের কাজ। সাহিত্যিক স্বাধীনভাবে তাঁর সৃজন ক্ষমতাকে অবলম্বন করে একটি গল্প, একটি উপন্যাস, একটি কবিতা বা নাটক লিখতে পারেন সমালোচক তার ভালো মন্দ নিয়ে ভাবিত হন। এই ভাবনার সাহিত্যিক পরিভাষা রসাস্বাদন। যে কারণেই সমালোচক ও সৃজনকর্মের কারিগর। তিনি ভালো-মন্দ নির্ধারণে স্থিত থেকেই নতুন কিছু বলার ও নতুন মূল্যায়নের প্রচেষ্টায় মগ্ন হয়ে পড়েন। সেজন্য বলা চলে—“A good criticism is as much a work of art as a good, poem.” (M. Murry). সৃজনের অঙ্গীভূত সমালোচনা বলেই সমালোচনাকে বলা হয়ে থাকে ‘A creation within creation’. (অস্কার ওয়াইল্ড) অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি সমালোচকের মধ্যেও রস সৃষ্টি ও রসাস্বাদনের বৈশিষ্ট্যই তাৎপর্য হয়ে উঠেছে।
সমালোচনা যে সাহিত্যেরই রসাস্বাদন তা প্রমাণিত হয় সমালোচনার তিনটি পথের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। সমালোচনাকে সম্যক আলোচনা ধরে নিয়ে এর তিনটি পথের নির্দেশ অনেকেই করে থাকেন— ১. ব্যাখ্যান (Interpretation) ২. বিচার বা মূল্য নিরূপণ (Judgement) এবং ৩. উপভোগ বা আস্বাদন (Appreciation)। এই তিনটি পদ্ধতিরই মূল কথা অবশ্যই আস্বাদন জাত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। ব্যাপারটি এই রকম—
১. ব্যাখান পদ্ধতিতে কবিতা-নাটক-গল্প-উপন্যাস অর্থাৎ সাহিত্যের ভাষা ছন্দ তাৎপর্য কলা-কৌশল রসের বিষয় রচয়িতার মানসিকতা পাঠকের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। লক্ষ্য পাঠকের আস্বাদন ক্রিয়াকে সহজ করে নেওয়া। এই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি সমালোচক নিজে আস্বাদন না করলে অপরের আস্বাদন প্রক্রিয়াকে কখনই সহজ করে দিতে পারেন না।
২. বিচার বা মূল্য নিরূপণ মূলক সমালোচনার সমালোচক লেখকের সৃষ্টিকর্মের ভালোমন্দ ত্রুটি ও গুণ নির্দেশ করেন, এই কাজটিও অর্থাৎ সাহিত্যের ভালোমন্দ, ত্রুটি-গুণ নির্দেশও তখনই সম্ভব যখন-সমালোচক কোনো রচনাকে নিজের বিচার বুদ্ধি ও আদর্শ মতে রসাস্বাদন করে তার উৎকর্ষ বা অপকর্ষ সম্বন্ধে অবহিত হন।
৩. উপভোগ বা আস্বাদন পন্থায় সমালোচক কোনো কঠোর রায় দেয় না, ভালো-মন্দের মাপকাঠি স্থির করেন না, আপন ভাষাশৈলীর দ্বারা সমালোচ্য বিষয়কে উপভোগ করতে করতে কার্যত নতুন কোনো রসের সন্ধান দেন। এখানে আস্বাদনই সমালোচনার বড়ো কথা।
গোত্রগত এই তিন বিভাগ ছাড়া রীতিগত দিকেও সমালোচনার নানা ধারা আছে, যথা—
- i) ধারণামূলক ব্যক্তিপন্থী সমালোচনা।
- ii) ঐতিহাসিক সমালোচনা।
- iii) তুলনামূলক সমালোচনা।
- iv) লেখক জীবনভিত্তিক সমালোচনা।
- v) মনোবৈজ্ঞানিক সমালোচনা।
- vi) সংরূপ সমালোচনা বা সাহিত্য শাখাভিত্তিক সমালোচনা।
- vii) রূপগত সমালোচনা।
- viii) শৈলী বিশ্লেষণ মূলক সমালোচনা।
- ix) মার্কসীয় সমালোচনা।
- x) অবয়ববাদী বা গঠনাত্মক সমালোচনা।
- xi) মূল পার্শ্বভিত্তিক সমালোচনা।
- xii) আর্কিটাইপ সমালোচনা।
সমালোচনার বিবিধ পদ্ধতি থাকলেও সমস্ত পদ্ধতিই পূর্ণ হয়ে ওঠে সাহিত্যের আস্বাদ যোগ্যতার মধ্য দিয়ে। ব্যাখ্যা বিচার রস পরিচয় ইত্যাদি বিষয়ে পৃথক পৃথক মানদণ্ড ও দৃষ্টিকোণ এই সব সমালোচনার রীতিতে ব্যবহৃত হলেও সাহিত্যের আস্বাদন নামক একটি জায়গাতেই এরা মেলে। কেননা সমালোচনার কাজে দুটি দিকের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়—তত্ত্বের দিক ও প্রয়োগের দিক। তত্ত্বের দিকের রূপকে বলা হয় সাহিত্য তত্ত্ব। আর প্রয়োগ দিকের রূপকে বলা হয় ব্যবহারিক সমালোচনা। সমালোচনা হল সাহিত্যতত্ত্ব এবং ব্যবহারিক সমালোচনার সামগ্রিকতা। তাই রীতির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও সাহিত্য সমালোচনা আস্বাদন নামক সমগ্রতার মাধ্যমেই পুষ্টি লাভ করে থাকে। এই অর্থে সমস্ত সমলোচনাই আনন্দ মূল্যে স্বীকৃত।
Leave a comment