ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে অনুসারে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বলে বিবেচিত হয়। আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলেও সাধারণভাবে দেখা যায় ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ বা দ্বিতীয় কক্ষ হল- রাজ্যসভা এবং পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হল লােকসভা। উভয় কক্ষের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা সমান হয় না।

রাজ্যসভা: রাজ্যসভা হল কেন্দ্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ বা দ্বিতীয় কক্ষ। ক্ষমতা ও মর্যাদার দিক থেকে রাজ্যসভা লোকসভার সমমর্যাদাসম্পন্ন নয়। উভয় কক্ষের ক্ষমতার বিন্যাসে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করা হয়েছে।

রাজ্যসভার গঠন: সংবিধানের ৮০ নং ধারায় রাজ্যসভার গঠন সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, রাজ্যসভার সদস্য সংখ্যা ২৫০ জনের বেশি হবে না। এদের মধ্যে ১২ জন হলেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত সদস্য। সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা, সমাজসেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি সদস্যদেরকে মনােনীত করবেন। বাকি অনধিক ২৩৮ জন হবেন অঙ্গরাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে পরােক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্য। বর্তমানে রাজ্যসভার মােট সদস্য সংখ্যা ২৪৫ জন। বর্তমানে প্রায় প্রত্যেক দেশের দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার কোনাে একটিমাত্র কক্ষ অধিক ক্ষমতা ভােগ করে। ব্যতিক্রম সুইজারল্যান্ড সে দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভায় দুটি কক্ষই সমান ক্ষমতাসম্পন্ন। ভারতে রাজ্যসভা এবং লােকসভার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি তিনটি দিক থেকে আলােচনা করা হয়। যেমন一

  • ভারতে রাষ্ট্রপরিচালনার কতকগুলি ক্ষমতা ভােগের ক্ষেত্রে রাজ্যসভা এবং লোকসভার সমান ক্ষমতাসম্পন্ন,
  • কতগুলো ক্ষেত্রে লোকসভা রাজ্যসভার তুলনায় বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যসভা লোকসভা তুলনায় বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন।

[1] আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একক প্রাধান্য: ২৪৯ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, জাতীয় স্বার্থে যদি প্রয়ােজন হয় তাহলে কেন্দ্র রাজ্য তালিকাভুক্ত কোনাে বিষয়ে অস্থায়ী আইন প্রণয়ন করতে পারে। এ ব্যাপারে সংবিধানে রাজ্যসভার কেবলমাত্র বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পার্লামেন্ট কেবল তখনই রাজ্য তালিকাভুক্ত কোনাে বিষয়ে এই ধরনের বিধানিক ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে যখন রাজ্যসভায় উপস্থিত আছেন ও ভােট প্রদান করেছেন, এমন সদস্যদের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাধিক্যে সমর্থন লাভ করেছে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা বণ্টন ব্যবস্থার পরিবর্তন একমাত্র রাজ্যসভার প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যেহেতু রাজ্যসভায় একমাত্র উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে এই কারণে লোকসভার কোনাে ক্ষমতা প্রয়ােগের অধিকার থাকে না।

[2] সর্বভারতীয় চাকরি সৃষ্টির ক্ষেত্রে রাজ্যসভার একক প্রাধান্য: সংবিধানের ৩১২ নং ধারায় সংসদকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যে, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির জন্য এক বা একাধিক অভিন্ন সর্বভারতীয় চাকরি সৃষ্টির ব্যাপারে রাজ্যসভায় উপস্থিত ও ভেটো দানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ যদি প্রস্তাব গ্রহণ করে তাহলে জাতীয় স্বার্থে পার্লামেন্ট সে বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু লোকসভার এই বিশেষ ক্ষমতা নেই। এক্ষেত্রেও সংসদের উচ্চকক্ষ বলে পরিচিত রাজ্যসভায় বিশেষ ক্ষমতা ভােগ করে থাকে।

[3] উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির প্রস্তাবের ব্যাপারে রাজ্যসভার প্রাধান্য: রাজ্যসভায় উপরাষ্ট্রপতি পদাধিকারবলে সভাপতিত্ব করে থাকেন। এই উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির প্রস্তাব শুধুমাত্র রাজ্যসভায় উত্থাপন করা যায়, লােকসভায় উত্থাপন করা যায় না। এই কারণের জন্যই রাজ্যসভা লোকসভার থেকে অধিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।

[4] সংবিধান-সংশোধনের ক্ষেত্রে রাজ্যসভার ভূমিকা: রাজ্যসভার গুরুত্ব কতখানি তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল সংবিধান-সংশোধন। ৩৬৮ (২) নং ধারানুসারে কোনাে সংবিধান-সংশােধনমূলক খসড়া তখনই আইনে পরিণত হতে পারে যখন তা সংসদের প্রত্যেক কক্ষে এক বিশেষ সংখ্যাধিক্যে গৃহীত হয়। রাজ্যসভা যদি সংবিধান-সংশােধনের উদ্দেশ্যে আনীত কোনাে খসড়ার বিরােধিতা করে তাহলে তা দূর করার জন্য অনুচ্ছেদ ১০৮ অনুসারে যুক্ত বৈঠকের আশ্রয় নেওয়া যায় না।

সমালোচনা: সামগ্রিক বিচারে রাজ্যসভা লোকসভা থেকে কিছু ক্ষেত্রে অধিক ক্ষমতা ভােগ করে, এর কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি আমাদের নজরে আসে। যেমন- লোকসভা গঠিত হয় জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে অপরদিকে রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচন হয় পরােক্ষভাবে। এই কারণেই জনপ্রিয় কক্ষ হিসেবে লোকসভার ক্ষমতা ও গুরুত্ব বেশি বৃদ্ধি লাভ করেছে। তার ফলে রাজ্যসভার ক্ষমতা কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে রাজ্যসভা তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বর্তমানে রাজ্যসভায় লোকসভা আলােচনারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে মাত্র।

পরিশেষে বলা যায়, প্রকৃত বিচারে রাষ্ট্রপরিচালনার যেসকল ক্ষেত্রে যে কক্ষের ক্ষমতা ভােগ করা উচিত সংবিধানে সেই সমস্ত ক্ষেত্রে সেই কক্ষকেই অধিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তাই রাজ্যসভা লোকসভার থেকে কম ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও রাজ্যসভার নিজস্বতা অতুলনীয় বলে বিবেচিত হয়। ব্রিটেনের লর্ডসভার মতাে ভারতের রাজ্যসভা কখনােই হীনবল বলে প্রতিপন্ন হয়নি। তাই রাজ্যসভার ভূমিকাকে কখনােই অস্বীকার করা যায় না।