রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধে প্রকৃত সত্য তথা বাস্তব সত্যের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে সাহিত্যকে প্রকৃতির আর্শি বলে স্বীকার করেননি। তিনি বুঝিয়েছেন যে, পরিদৃশ্যমান প্রকৃতিকে কবি নিজের মনে গ্রহণ করে তাকে আপন মনের জারক রসে জারিত করে একটা নুতন রূপদান করেন এবং তাঁর রচিত সাহিত্যে ঘটে যে নব সৃষ্টি প্রতিফলন। রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত এই যে—প্রকৃত সত্যের যথাযথ অনুকরণ সাহিত্যে না হলেও তার বিকৃতি সাধন করা হয় না, মৌল সত্যটিকে অবিকৃত রেখেই কবি প্রতিভার সাহায্যে তাকে মনোমত রূপ দান করেন, তাই সাহিত্য যেমন প্রকৃতির যথাযথ, রূপায়ণ নয় তেমনই অপর কোনও শিল্পকলাকেও প্রকৃতির আর্শি বলে অভিহিত করা যায় না, অর্থাৎ “প্রকৃতিতে যা প্রত্যক্ষ প্রতীতি, শিল্প সাহিত্যে তা পরোক্ষ প্রতীয়মান।”

মানুষের অনুভূতি যতক্ষণ তার নিজের মধ্যে থাকে ততক্ষণ তা স্বাভাবিক এবং সংগত রূপেই বর্তমান, কিন্তু তাকে বাইরে প্রকাশ করতে গেলেই বা অপরের নিকট তাকে গ্রহণযোগ্য করতে গেলেই তাতে একটু সুর চড়াতে হয়। পুত্রশোকাতুরা মাতার বিলাপের বহিঃপ্রকাশ তার শোকের তীব্রতা প্রকাশের জন্যই নয়, তার পুত্রের মৃত্যু জগতের সকলের নিকট যে অবজ্ঞাত হচ্ছে, তাকে প্রকৃতির অবজ্ঞার নয়, এতেও যে জগতের অপার ক্ষতি হচ্ছে সে নিজের শোকের প্রবলতার দ্বারা এই ক্ষতি প্রাচুর্যকে বিশ্বের কাছে ঘোষণা করে তার পুত্রকে সে গৌরবান্বিত করতে চায়। আসলে অনুভূতি প্রকাশের ব্যাপারটি যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের মধ্যে থাকে, ততক্ষণ তার একটা নিজস্ব সংযম বোধ থাকে, কিন্তু যখনই তা পরের কাছে ঘোষণা করতে হয় তখন পরের অসাড় চিত্তকে বিচলিত করার জন্যেই তা যাবতীয় সংগতির সীমা লঙ্ঘন করে উদ্দাম হয়ে ওঠে।

অপরের নিকট গ্রহণযোগ্যতার জন্য অপরের নিকট বিশ্বাস্য রূপে উপস্থাপনার জন্যই বক্তব্য বিষয়কে একটু ভিন্নভাবে প্রকাশ করতে হয়। কোনো শিল্পী বা সাহিত্যিক কীভাবে কলাকৃতি বা সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে আপনার মনোভাবকে অপরের মনের দরজায় পৌঁছে দেন সে বিষয়ে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে হয়। অর্থাৎ অপরের মনে বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য লেখককে একটু উচ্চকণ্ঠ হতে হয়, তাঁর বক্তব্যকে একটু অতিকৃত করে বলতে হয়। কারণ, কোনো বস্তুকে দূর থেকে দেখতে হলে তাকে একটু বড়ো করে না দেখলে তা যে আকারে দেখা দেয় তার তার প্রকৃত রূপ নয়, এতএব সত্যের অনুরোধে দূরস্থিত প্রকৃত সত্যকে বড়ো করে না দেখালে তা মিথ্য হয়ে যায়। আমাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ প্রত্যেকেরই নিজস্ব বলে তার সঙ্গে নিজের কোনো ব্যবধান থাকে না। কিন্তু অপরের নিকট তার দূরের বস্তু বলেই নিজের ভারানুভূতি অপরের নিকট প্রকাশ করার কালে তার অতিকৃতি প্রয়োজন। প্রকৃত সত্যকে কতখানি কেমনভাবে বাড়ালে তার প্রকৃত ভাবরস অক্ষুণ্ণ থাকে, তা নির্ভর করে সাহিত্যের প্রতিভা এবং ব্যক্তিগত কলাকুশলতার উপর।

তবে মুক্তি পরম্পরায় এই সত্যই প্রকটিত হল যে বস্তুসত্য বা প্রকৃত সত্যকে যথাযথভাবে যদি রূপায়িত করা হয় তবে তা সাহিত্য হয় না। কারণ প্রকৃতি জগতে তথা পরিদৃশ্যমান প্রকৃতিকে আমরা যা দেখতে পাই, তাই ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ সত্য, সাহিত্যেও প্রকৃতিরই রূপায়ণ ঘটে, কিন্তু তাহলেও সাহিত্যে দেখা যায় প্রত্যক্ষতার অভাব, প্রত্যক্ষতার এই অভাব মোচনের জন্যই সাহিত্যে প্রকৃতিকে নুতনভাবে সৃষ্টি করতে হয়। প্রকৃত সত্য এবং সাহিত্য সত্যের এই প্রভেদ সাহিত্যরস বোদ্ধাগণ সকলেই স্বীকার করে থাকেন। প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতার কথা উল্লেখ করা চলে, রামচন্দ্রের জীবন কাহিনি রচনায় অনুরুদ্ধ হলে বাল্মীকি যখন বলেছিলেন যে রাম জীবন তাঁর অজ্ঞাত তখন দেবর্ষি নারদ তাঁকে বলেছিলেন যে—যা ঘটে তাই সত্য নয়, বাল্মীকি যা রচনা করবেন তাই সত্য। এখানে যা ঘটে তাকে বাস্তব সত্য এবং বাল্মীকির রচনাকে সাহিত্য সত্য রূপে গ্রহণ করা চলে। এই সাহিত্য সত্যকেই সহামতি অ্যারিস্টটল বলেছেন— Higher truth.

অবশেষে বলতে হয়, পুত্রশোকাতুরা মাতার করুণ বিলাপ অতি প্রত্যক্ষতার জন্যই সহজে গণ্য হয়। কিন্তু তাকে যখন সাহিত্যে রূপায়িত করতে হয় তখন পরিবেশ রচনা, বর্ণনা, ভাষার ব্যঞ্জনা এবং নানা আভাসে ইঙ্গিতে তাকে সত্য করে তুলতে হয়। এই দুই কান্নার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সাহিত্যে বর্ণিত মায়ের কান্নাকেও মিথ্যা বা কৃত্রিম বলা বলা চলে না। প্রকৃত মায়ের কান্না অতি প্রত্যক্ষ বলেই তা আমাদের বিশ্বাসযোগ্য, পক্ষান্তরে সাহিত্যের মায়ের কান্না অপ্রত্যক্ষ বলেই তা উপলব্ধিগণ্য, তা শুধুই প্রতীয়মান হয়। অতএব সাহিত্যকে প্রকৃতির আর্শি বলা চলে না। আর শুধু সাহিত্য কেন কোনো কলাবিদ্যাকেই প্রকৃতির যথাযথ অনুকরণ বলা চলে না।