কবিতার নাম ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব ?’ একদিকে ‘যেতে পারি’ অন্যদিকে ‘কেন যাব’। উভয়েই সমমাত্রিক চার মাত্রার। উভয়ের সংযোজক সেতুবন্ধন করেছে ‘কিন্তু’ অব্যয়। তাঁর ‘কিন্তু’-র আগে পড়েছে প্রথম ছেদ (কমা) চিহ্ন। সুতরাং ‘কিন্তু’ র গুরুত্ব ‘যেতে পারি’-র উপর নয়, ‘কেন যাব’ এই প্রশ্নের উপর। সেদিক থেকে নামের শেষের প্রশ্নসূচক চিহ্ন যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করেছে। ‘যেতে পারি’ গুরুত্ব হারিয়ে ‘কেন যাবই গুরুত্ব লাভ করেছে। সেই সূত্রে—

  • (১) কবিতার প্রথম স্তবকে এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা।

  • (২) দ্বিতীয় স্তবকে আছে ‘চাঁদ’ অর্থাৎ ‘জীবন’ এবং ‘চিতাকাঠ’ অর্থাৎ ‘মরণে’র মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব।

  • (৩) তৃতীয় স্তবকে ‘কিন্তু’ অব্যয় প্রয়োগে কবি না যাবার কথা প্রকারান্তরে ঘোষণা করেছেন এবং সন্তানের মুখ ধরে চুমু খাওয়ার মধ্যে জীবনের প্রতি ভালোবাসাই ব্যক্ত করেছেন।

  • (৪) শেষ স্তবকে অসময়ে যে যাবেন না, সে কথাই দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন।

কবির স্তবকে স্তবকে বিষয় বিন্যাসের মধ্যে আমরা জীবন চেতনার সুরই খুঁজে পাই। নামকরণে এই জীবনচেতনার সুরই প্রতিফলিত হয়েছে। জীবন ও মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে শেষে কবি জীবনকেই বেছে নিয়েছেন—

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে

চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়

এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে

চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়

যেতে পারি

যে-কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি

কিন্তু, কেন যাবো? 

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো’

যে কোনো দিকে চলে যেতে পারেন, এই ধারণা কবির মনে কেন এসেছে? এর উত্তর কবি প্রথম স্তবকেই দিয়েছেন—

‘এত কালো মেখেছি দু হাতে

এত কাল ধরে।

কখনো তোমার করে তোমাকে ভাবিনি।

তখন পাপ ও অন্যায়ের অন্ধকারে কবি যেভাবে ডুবেছিলেন, তাতে প্রিয়জনকেও প্রিয় বলে ভাবতে পারেন নি। সকালের সূর্য, সন্ধ্যার আকাশ, তটিনীর জল, বসন্ত বাতাস, সুগন্ধ নিশ্বাস, পূর্ণিমার রাত, শরতের সকাল, তরুতল, অরণ্যের ছায়া, অবসন্ন দিনের আলো, ঘন পল্লবিত কুঞ্জবন, সরোবর তীর, আকাশের নীল, কোনো কিছুই তখন কবিকে আকর্ষণ করেনি। তখন সুন্দর ও অসুন্দর সবই কবির চোখে সমান ঠেকেছিল। জীবনানন্দ বলেছেন—

‘..শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন

অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ 

বীতকাম হয়ে যাতে-এ জীবন ধীরে ধীরে বীতশোক হয়,’

ক্লান্তি আর বিষন্নতাবোধের ক্রন্দন শক্তিও শুনেছেন। তখন জীবনধারণ তাঁর কাছে মারাত্মক যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা বহন করে এনেছে। কবি তখন একা। ভালোবাসা, ঘৃণা, অবহেলা, সব তখন এক হয়ে গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই কবি আত্মানুসন্ধানে বসে রক্তের ক্ষুধাকে অনুভব করেছেন। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর কোনো দুঃখকেই তখন আর দুঃখ বলে মনে হয় নি। চারপাশে যেদিকে তাকিয়েছেন সেদিকই মনে হয়েছে সুন্দর—

‘আকাশ-ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, 

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান।

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।।

ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে 

ফুলের গন্ধ চমক লেগে উঠেছে মন মেতে, 

ছড়িয়ে আছে আনন্দেরি দান, 

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।

কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, 

ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি

জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। (রবীন্দ্রনাথ)

মানুষ তখন বাঁচতে চায়। শুধু বেঁচে থেকে জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে চায়। সন্তান-সন্ততির মুখে চুমু খেয়ে ধন্য হতে চায়। তখনই অনুভূত হয় সন্তান কত প্রিয়জন, সন্তান কত ভালোবাসার ধন। প্রেম তখন মৃত্যুকে অস্বীকার করে অট্টহাসি হাসে। তখন মনে হয়—‘কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নাই। সন্তানের মধ্যেই কবি তখন নিজেকে অনুসন্ধান করেন। সন্তানের মধ্য দিয়ে কবি তখন তাঁর নিজের ইচ্ছাকে পূরণ করেন। সন্তানের জন্য বাঁচার আস্বাদ বেড়ে যায়। মৃত্যু নয়—জীবন চেতনাই বড়ো হয়ে ওঠে। তাই কবি ঘুরে দাঁড়ান। তাই কবি বলেন ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?’ তখন সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, সৃষ্টি-প্রলয় স্বর্গ-নরক, বিশ্বাস-সন্দেহ, অনুভব-অনুমান, সৌন্দর্যের অপার রহস্য, প্রেমের অতল অতৃপ্তি বিন্দু বিন্দু মোমের ফোঁটার মতো গলে-গলে পড়ে। চোখ ছাপিয়ে পড়ে অন্দাশ্রু—

‘মানবহৃদয়—সিন্ধুতলে 

যেন নব মহাদেশ সৃজন হতেছে পলে পলে, 

আপনি সে নাহি জানে, শুধু অর্থ অনুভব তারি 

ব্যাকুল করেছে তারে, মনে তার দিয়েছে সঞ্চারি 

আকারপ্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা 

প্রমাণের অগোচর, প্রত্যক্ষের বাহিরেতে বাসা। (সমুদ্রের প্রতি)