কাব্য সাহিত্যে ভাব ও ভাষার অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে থাকে। বিশেষ ভাবকে কবিরা যখন প্রকাশ করেন তখন ভাষার প্রথানুবদ্ধ রীতিনীতি থেকে বেরিয়ে আসেন। ভাষাতাত্ত্বিকেরা একে বলেন Foregrounding বা প্রমুখন।

কবিতার শৈলী বিচার করতে গেলে তাই ভাষার অন্তর্গঠনের বিভিন্নতার দিকটি খেয়াল রাখতে হয়। চ্যাটমান বলেন— ‘শৈলী হচ্ছে ব্যক্তি বা লেখকভেদে বাক্যগঠন এবং শব্দ প্রয়োগের ভিন্নতা।’

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ কবিতায় শৈলী বিচার করতে বসলে এই মতামতের সমর্থন পেয়ে যাব।

‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ কবিতায় কবির অনেকটা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার পরিচয় লক্ষ করি। যেন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে পাশ কাটিয়ে যেতে চান। কবি জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে জীবনকে বেছে নিয়েছেন। এই ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে কবি লৌকিক শব্দের ওপর আশ্রয় করে অপূর্ব নির্মাণ শৈলীর দৃষ্টান্ত রেখেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘কবিতায় যে ভাষায় কথা বলি তার নাম কবিতার ভাষা। মুখ ও মন থেকে সে ভাষার জন্ম। কবিতা মানুষের মুখের ভাষার কাছে যাবে এমন কড়ার করে কেউ কবিতা লিখতে বসবেন, এ ব্যাপারের আমার বিশ্বাস নেই এবং প্রকৃতপক্ষে সুখের ভাষা বলে কবিতার মধ্যে যাকে দেখতে পাই, তা কবিতারই নিজস্ব সহজ লেখন শৈলী—কিছুটা লৌকিক শব্দ প্রযুক্ত’।

কর্তা কর্ম ক্রিয়ার বন্ধন ছেড়ে কবিরা যে ভাযাশব্দ রচনা করেন সেখানে বিচ্যুতি ঘটলেও তা পাঠকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। যেমন—

এতো কালো মেখেছি দু হাতে 

আদর্শ গঠন দুহাতে এত কালো মেখেছি।

বিচ্যুতি (৩৪৫১২)

প্রাগ্-এর ভাষা বিজ্ঞানী মুকারোভাস্কি 1970 সালে Standard Language and Poetic Language গ্রন্থে কবিতায় ভাষার বিচ্যুতির কথা বলেছেন, শক্তির কবিতা বিশ্লেষণে যার প্রমাণ পেলাম।

ছন্দের পাশাপাশি অলংকার নির্মাণেও কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় চমৎকার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। সমাসোক্তি অলংকারের অপূর্ব দৃষ্টান্ত তাঁর এই কবিতায় মেলে—

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে

ক. চাঁদ ডাকে! আয় আয় আয়

খ. এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে

চিতাকাঠ ডাকে; আয় আয়।

কবিতাটির নিবিড় পাঠ করলে মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে এক ছবি ; সমাজের জাঁতাকলে দগ্ধ হতে থাকা এক হতাশ মানুষের নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি— 

এখনও খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে 

চাঁদ ডাকে! আয় আয় আয়

এখনও গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে

চিতাকাঠ ডাকে আয় আয়।

কবিতার শুরু হয়েছে ‘ভাবছি’ এই ক্রিয়াপদ দিয়ে; সেই ভাবনারই প্রকাশ ঘটেছে ‘ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো শব্দগুচ্ছ’। ‘যেতে পারি’ চারমাত্রার আবার ‘কেন যাব’ চারমাত্রার মাঝখানে ‘কিন্তু’ অব্যয় ব্যবহার করা হয়েছে যার মাত্রা দুই এবং যা ‘কেন যাব’ এই দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অর্থাৎ মৃত্যু ও জীবনের অনুপাত হল ৪ : ৬, এ থেকে বোঝা যায় তিনি জীবনের দিকেই বেশি ঝুঁকেছেন। ‘যেতে পারি’ আবার ‘কেন যাব’ এই দুই বিরোধী ভাবনাকে এখানে হাজির করা হয়েছে। প্রথম শব্দগুচ্ছে মৃত্যু চিন্তা এলেও পারে তা খারিজ হয়েছে।

কবিতার সমগঠনে যে-কোনো আন্বয়িত উপাদানের বারবার ব্যবহার করে সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন কবি। ঊনবিংশ শতকের আশির দশকে এই সমান্তরাল বাক্য গঠনের দিকে প্রথম আলোকপাত করেন Koopman এবং Sporticle। এই তত্ত্বে একটি বাক্য হয় Operator এবং অন্য অংশ Parallel Constant এর মতো ভূমিকা নেয়। এই theory- কে Parallel Consistant Operator Binding Theory বলে। এই কবিতাতেও আমরা যার বহিঃপ্রকাশ দেখি।

এই কবিতায় কবি যাওয়া কিংবা না যাওয়ার মধ্যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ‘কিন্তু’ এই অব্যয় দিয়ে। চাঁদের ডাক চিতাকাঠের আহ্বান সবকিছু ভুলে তিনি সন্তানের মুখে চুমো খেয়ে জীবনের ডাককেই শুনতে ও শোনাতে চেয়েছেন। তাই গঠনের ক্ষেত্রে না বৈপরীত্যে ব্যবহার করে কবিতাকে এক অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।