বিংশ শতকের ভাষাবিজ্ঞান ও আধুনিক সমালোচনা পদ্ধতির যৌথ ফসল শৈলীবিজ্ঞান। সাহিত্যে আমাদের ভাবের প্রকাশ ঘটে থাকে, ভাষা তার অনুযায়ী হয়। কিন্তু দৈনন্দিন কথাবার্তায় Communication ঘটে, সাহিত্যে ঘটে Expression । কবিগণ ভাষায় Foregrounding ঘটান সচেতন বা অবচেতন ভাবেই, মূল লক্ষ ভাবের বিস্তার ঘটানো। টার্নারের মতে-রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি আখ্যান আশ্রয়ী, আটটি স্তবকে পরিব্যপ্ত এই কবিতা মানবজীবনের চাওয়া-পাওয়া হারানোর ঘটনাকে তুলে ধরেছে নববোধের আলোকে। কবির ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা এই কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে। প্রথম স্তবকে হেমন্তের দ্বিপ্রহরের ঘটনা এসেছে। এক চিত্রকল্প সৃজন করে দ্বিপ্রহরের এক দিন কে পাঠকের কাছে এনেছেন। ক্লান্ত ভিখারিণী নিদ্রায় রত হলেও কবির চোখে ঘুম নেই। দ্বিতীয় স্তবকে এসেছে ঘুম না পাওয়ার কারণ। পূজার ছুটি শেষে কর্মস্থানে যাওয়ার তাড়া কবি সহ তার পরিবারকে বিষাদে আচ্ছন্ন করেছে। পরের স্তবকে কবির যাওয়ার জন্য গোছগাছের পালা; শেষ হলে, কবি পত্নীর অশ্রুসিদ্ধ নয়ন। চার বছরের ছোটো মেয়েটির কাছে পিতার আহ্বান, কন্যার যেতে না দেওয়া, অভিপ্রায় প্রকাশ। পরের স্তবকে কবির কাতর হৃদয় নিয়ে গন্তব্যস্থলে যাত্রা। পরের স্তবকগুলিতে যেতে না দিতে চাইলেও যেতে যে দিতে হয় সেই কথাই বলা হয়েছে; এ প্রসঙ্গে মানবজীবনের গভীর বিয়োগ ব্যথাকে তুলে ধরেছেন। কবিতাটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ধ্বনিগত মাধুর্য ও গীতিকাব্যে মূর্ছনা; যা কবিতার রসাবেদনের পাশে সহায়ক হয়েছে।

কাছের মানুষকে হারানোর

ঘটনা নিত্য বহমান,

কোনো কিছুকেই ধরে রাখা যায় না। আত্মিক বন্ধনে আমরা কাছের মানুষকে হারাতে চাই না। এই কবিতার প্রথম অংশ কবির দূর দেশে যাত্রা সংক্রান্ত বিষাদ এবং পরবর্তী অংশ মানবজীবনের চিরন্তন বিরহের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

কবিতাটিতে ধ্বনিগত মাধুর্য বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়। কবিতাটিতে কিছু ধ্বনাত্বক শব্দের প্রয়োগও দেখা যায়। যেমন—

‘ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ করে চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম’

শব্দের অনুপুঙ্খ সজ্জায় গীতিময়তা সঞ্চারিত হয়েছে।

‘চারিদিক হতে আজি

অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি

সেই বিশ্ব মর্মভেদী করুণা ক্রন্দন

মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে’

অলংকার প্রয়োগে ক্ষেত্রে আলোচ্য কবিতায় শব্দলংকারের পাশাপাশি অর্থালংকারের সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগে ঘটিয়েছে। কবিতার অস্তানুপ্রাস সর্বাধিক পরিমাণ যেমন—

গিয়েছে আশ্বিন পূজার ছুটি শেষে 

ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূর দেশে

এছাড়া উৎপ্রেক্ষা ও সমাসোক্তি অলংকারের প্রয়োগও লক্ষ করা যায়।

শ্রেষ্ঠ কবিগণ কবিতায় ছবির মালা গাঁথেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববন্দিত কবি, তাঁর প্রায় সব কবিতাতেই পাওয়া যায় চিত্রস্পর্শ। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতা যেন চিত্ররূপময়।

‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর 

হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।

জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়

মধ্যাহ্নবাতাসে।

যেতে নাহি দিব কবিতার প্রথম চার স্তবক গার্হস্থ্য জীবনের কথা, পরবর্তী চার স্তবকে কবির জীবনদর্শন প্রাধান্য পেয়েছে। মৃত্যু মানুষকে পৃথিবী ছেড়ে দূরে নিয়ে চলে যায়। কেউ ধরে রাখতে পারে না। কবিতাতে তাই শেষ পর্যন্ত শোনা গেল বিশ্বজীবনের ক্রন্দনধ্বনি। রবীন্দ্রনাথ ‘বসুন্ধরায়’ পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন—

‘পৃথিবীর মুখে ভারি একটি সুদূরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে-

যেন এর মনে হচ্ছে ‘আমি দেবতার মেয়ে কিন্তু দেবতার 

ক্ষমতা আমার নেই ; আমি ভালোবাসতে আরম্ভ করি,

কিন্তু সম্পূর্ণ রক্ষা করতে পারিনে ;

জন্ম দিই-মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনে’।

কবির এই মানসিকতার প্রতিফলন উদ্দিষ্ট কবিতায় ঘটেছে। এবং সার্থক বাক্য চয়ন, ছন্দ অলংকার সৌন্দর্যে তা এক অসামান্য কাব্যে শিল্পের নজির হয়ে থেকেছে।