‘সোনার তরী’র একমাত্র আখ্যানধর্মী কবিতা এটি। কবিতাটি ১২৯১ বঙ্গাব্দে ১৪ কার্তিক জোড়াসাঁকোতে বসে লেখা। ১৭৬টি পঙক্তি আটটি স্তবকে সজ্জিত কবিতায় ধ্বংসমৃত্যময় পৃথিবীর উপর মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেমের আসন নির্দেশ করেছেন।

বিশ্বপ্রকৃতি ক্রমশ ধ্বংসের এগিয়ে চলেছে, মানুষের সাথে মানুষের সম্বন্ধ প্রতি মুহূর্তে ছিন্ন হচ্ছে নিষ্ঠুর মৃত্যুর করাল গ্রাসে। কিন্তু মানুষের স্নেহপ্রেম ভালোবাসা মৃত্যুর দ্বারা বাধা পেতে চায় না। কবিতার নিজের জীবনের আখ্যানের সঙ্গে মিলিয়ে সর্বজনীন করেছেন, যার মূল কথা—“আমি ভালোবাসি যারে/ সেকি কভু আমা হতেদূরে যেতে পারে ?”

কবিতাটি আখ্যানধর্মী। তবে আখ্যানধর্মী কবিতা গঠনে কবির দুর্বলতা প্রকটিত হয়েছে। প্রথম পাঁচটি স্তবকে কবিকন্যার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার দৃশ্য অঙ্কন করেছেন, কিন্তু সপ্তম এবং অষ্টম স্তবকের দীর্ঘ তত্ত্ব উন্মোচন বেশ ক্লান্তিকর। কবিতার শুরুতেই আছে বিদায়ের ব্যঞ্জনা—“দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি বেলা দ্বিপ্রহর।” পরবর্তী য়েক লাইনের অসামান্য চিত্রকল্পে এই শূন্যতা স্পষ্টতর হয়েছে। আসলে কবির হাতে রঙ তুলি না থাকলেও সুষম শব্দবিন্যাসে অসামান্য ছবি এঁকেছেন—স্নিগ্ধ অশখের ছায়া/ক্লাস্ত বৃদ্ধ ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি ঘুমায়ে পড়েছে।/যেন রৌদ্রময় বাতি ঝাঁ ঝাঁ করি চারিদিকে নিঃস্তব্ধ নিঃঝুম— / শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম।”

এই বিদায় বাণীর বিপরীতে কবিতার পরবর্তী চারটি স্তবকে ধ্বনি হয়েছে একটিই সুর—“যেতে নাহি দিব”। সপ্তম এবং অষ্টম কবিকন্যার মুখে এই ‘যেতে দিব’ শোনা যায় না আসলে এই সুর এখন সমগ্র সৃষ্টিতে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে—

“দেখিলাম তাঁর সেই ম্লানমুখখানি 

সেই দ্বার প্রান্তে লীন, স্তষ্ক মর্মাহত,

মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো।”

কবিতার বিন্যাস আখ্যানধর্মী হলেও গীতিকবি রবীন্দ্রনাথ চাপা পড়েন নি। অনেকটা এলিয়েটের সুরে বলতে হয়— Who is the third who walks always beside? এর উত্তরে আখ্যান আশ্রিত রবীন্দ্র কাব্য সম্পর্কে বলতে হয়—the lyric poet। কবিতার অসংখ্য চিত্রগীতের একটি নমুনা—“বসুন্ধরা বসে আছেন এলোচুলে/দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে/একখানি রৌদ্রপীত হিরণ-অঞ্চল/বক্ষেটানি দিয়া।” –সমাসক্তি অলংকারের শক্তি এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে শুধু সমাসোক্তি নয় অনুপ্রাস উপমা, উৎপ্রেক্ষা অজস্র প্রয়োগ ঘটেছে এই কবিতায়।