ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের উদ্ভব ঘটে। অধ্যাপক কে সি হােয়ার-এর মতে, যুক্তরাষ্ট্র বলতে সেই শাসনব্যবস্থাকে বােঝায় যেখানে সংবিধান কর্তৃক কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারগুলির মধ্যে এমনভাবে ক্ষমতা বণ্টন করা হয় যাতে উভয় সরকার নিজ নিজ প্রশাসনিক এলাকায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্চ যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হল সেই শাসনব্যবস্থা যেখানে যাবতীয় ক্ষমতা একটি কেন্দ্রীয় সরকার ও কয়েকটি আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে এমনভাবে বন্টিত হয় যাতে এই দুধরনের সরকার পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং নিজেদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে উভয়ই প্রত্যক্ষভাবে জনগণকে শাসন করতে পারে।
প্রসঙ্গত বলা যায়, সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্র গড়ে ওঠে। একটি হল বিভক্তিকরণের প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনাে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত হয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে। অন্যটি হল সংহতিসাধনের প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কয়েকটি সার্বভৌম রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে।
এক বিশেষ ধরনের শাসনব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
[1] দু-ধরনের সরকারের উপস্থিতি: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক—এই দুধরনের সরকারের সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। সমগ্র দেশের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। অন্যদিকে, বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনের দায়িত্ব থাকে বিভিন্ন আঞ্চলিক বা অঙ্গরাজ্যের সরকারের হাতে।
[2] ক্ষমতা বণ্টন: ক্ষমতা বণ্টন যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। এখানে লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলির মধ্যে শাসনক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টন করা হয়।
[3] লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান: কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলির মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতা বণ্টনের প্রশ্ন থাকায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানকে অবশ্যই লিখিত হতে হয়। লিখিত সংবিধানে উভয় সরকারের ক্ষমতাসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত থাকায় উভয় সরকারই নিজ নিজ এলাকায় কারও হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় হওয়াও বাঞ্ছনীয়। এই ধরনের সংবিধান সহজে সংশােধনযােগ্য না হওয়ায় কোনাে সরকারের পক্ষেই সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্য সরকারের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করা সম্ভব হয় না।
[4] সংবিধানের প্রাধান্য: সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ মৌলিক আইনের স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকার করা হয়। এখানে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক উভয় সরকারই সংবিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতে বাধ্য। সংবিধানই এখানে সমস্ত ক্ষমতার উৎস।
[5] যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত: সংবিধানের অভিভাবক ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতা সম্পর্কিত বিষয়ে সৃষ্ট যে-কোনাে বিরােধের চূড়ান্ত মীমাংসাকর্তা হল এই আদালত। উভয় সরকারের কাজকর্ম সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্বও যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের।
[6] দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার আর একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। আইনসভার নিম্নকক্ষ হল জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ, আর উচ্চকক্ষ হল অঙ্গরাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ (যেমন—ভারতে লােকসভা হল নিম্নকক্ষ আর রাজ্যসভা হল উচ্চকক্ষ)। উচ্চকক্ষে ছােটো বড়াে নির্বিশেষে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের সমসংখ্যক প্রতিনিধিত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নীতি বলে মনে করা হয়।
[7] স্বতন্ত্র রাজস্বব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক উভয় সরকারেরই পর্যাপ্ত আর্থিক সংগতি থাকা প্রয়ােজন। নতুবা কোনাে সরকারের পক্ষেই সুষ্ঠুভাবে দায়দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। সেজন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের জন্য স্বতন্ত্র রাজস্বব্যবস্থার উল্লেখ যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
[8] স্বতন্ত্র সংবিধান: অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য পৃথক সংবিধানের অস্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের জন্য ৫০টি স্বতন্ত্র সংবিধান আছে। অবশ্য অঙ্গরাজ্যের সংবিধানকে জাতীয় সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হয়।
[9] দ্বৈত নাগরিকত্ব: বিশ্বের কোনাে কোনো যুক্তরাষ্ট্রে (যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত। দ্বৈত নাগরিকত্ব বলতে একই সঙ্গে সমগ্র দেশের ও নিজ নিজ রাজ্যের নাগরিকত্বকে বােঝায়। অবশ্য দ্বৈত নাগরিকত্বকে অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করা হয় না।
Leave a comment