অথবা, “যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বিরল, কারণ এর পূর্বশর্ত অনেক”- উক্তিটি আলোচনা কর।
অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থাকে কীভাবে সফল করা যায়? আলােচনা কর।
অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্তসমূহ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ বর্তমানে সরকারের শ্রেণিবিভাগগুলাে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অন্যান্য শাসনব্যবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা অন্যতম। এ শাসনব্যবস্থায় দুই বা ততােধিক রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে বা অন্য কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিলিত হয়ে নিজস্ব সত্তা বজায় রেখে জাতীয় সরকার গঠন করে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠিত হয়। আধুনিক কালে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এ শাসনব্যবস্থা কাম্য হলেও এর সাফল্যের পিছনে কিছু শর্ত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্তসমূহঃ যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের এক সম্মেলন। অধ্যাপক কে. সি. হয়ার (Prof. K. c. Wheare) বলেছেন, “Communities of state must desire to be united, but not to be unitary.” সেজন্য বলা হয়ে থাকে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের জন্য কতকগুলাে পূর্বশর্ত আছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পূর্বশর্তগুলাে নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
১. ভৌগােলিক নৈকট্যঃ যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের জন্য ভৌগােলিক নৈকট্য থাকা একান্ত জরুরি। কারণ এ নৈকট্য ছাড়া ভাবের আদানপ্রদান সম্ভব হয় না। রাজ্যগুলাের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতা ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করতে তাদের ভৌগােলিক নৈকট্য একান্তভাবে প্রয়ােজন।
২. অঙ্গরাজ্যগুলাের মধ্যে সাম্য ও সহযােগিতাঃ যুক্তরাষ্ট্র গঠনকারী অঙ্গরাজ্যগুলাের মধ্যে সহযােগিতা ও সৌহার্দ্যের অভাব ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না। কোন বিশেষ অঙ্গরাজ্যের একক প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না। সাম্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতেই তারা পারস্পরিক সহযােগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সফলতা লাভ করে।
৩. শক্তি সামর্থ্যের ব্যাপারে সামঞ্জস্যঃ সম্পদ, সংগতি ও জনবলের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অঙ্গরাজ্যের সাথে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের খুব বেশি পার্থক্য থাকলে অপেক্ষাকৃত ধনী ও শক্তিশালী রাজ্য কর্তৃক দরিদ্র ও দুর্বল রাজ্যগুলাে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সফলতার পরিপন্থী।
৪. শাসনব্যবস্থার সাদৃশ্যঃ অঙ্গরাজ্যগুলাের মধ্যে শাসনব্যবস্থার সাদৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের স্বার্থে কাম্য। সরকারের গঠন এবং প্রশাসনিক পদ্ধতি বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন রকম হলে অঙ্গরাজ্যগুলাের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা থাকে এবং কালক্রমে তা গৃহযুদ্ধে পরিণত হতে পারে।
৫. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাসনতন্ত্র ব্যাখ্যা করার জন্য এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলাের মধ্যে সম্ভাব্য বিরােধ মীমাংসার জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের প্রয়ােজন।
৬. পক্ষপাতহীন কেন্দ্রঃ কেন্দ্র সকল অঞ্চল ও অঙ্গরাজ্যের প্রতি পক্ষপাতহীন সমান আচরণ করলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সফল হতে পারে। কেন্দ্রীয় আনুকূল্য লাভ বঞ্চিত রাজ্যগুলাের মনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তা যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের পথে একটি বড় বাধা।
৭. রাজনৈতিক চেতনা ও উপযুক্ত শিক্ষা বিস্তারঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে স্বীকার ও সংরক্ষণ করার মত সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক প্রয়ােজন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের শিক্ষাদীক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি এবং একই সাথে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যবােধের সৃষ্টি করতে হবে। আবার জাতীয়তা ও আঞ্চলিকতার মধ্যে অবশ্যই সমন্বয়সাধন করা জরুরি। তবেই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সফলতার মুখ দেখবে।
৮. সমজাতীয়তার মনােভাবঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষা সংস্কৃতি, আচার আচরণ ও রীতিনীতিগত অভিন্নতা এবং সমজাতীয়তার মনােভাব যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধনকে দৃঢ় করে। বাহ্যিক উপাদানের সমজাতীয়তার সাথে ভাবগত ঐক্য বা মানসিক ঐক্যানুভূতির ভিত্তিতে এক জাতীয় ভাবের সৃষ্টি হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়।
৯. সমপ্রতিনিধিত্বের নীতিঃ ক্ষুদ্র, বৃহৎ এবং জনবহুল, জনবিরল নির্বিশেষে সকল অঙ্গরাজ্য থেকে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়ও এ সমপ্রতিনিধিত্বের নীতি মেনে নেয়া বাঞ্ছনীয়। সকল অঙ্গরাজ্যের এ সমপ্রতিনিধিত্বের নীতি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য অপরিহার্য।
১০. রাজ্যগুলাের আর্থিক সংগতিঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় অঙ্গরাজ্যগুলাের স্বাতন্ত্রের স্বার্থে রাজ্যগুলাের উপযুক্ত অর্থনৈতিক সংগতি বা আর্থিক সচ্ছলতা থাকা বাঞ্ছনীয়। অঙ্গরাজ্যগুলাের প্রয়ােজনীয় আর্থিক সংগতির অভাব এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র রাজ্যের সুস্থ সম্পর্ককে বিপন্ন করে তােলে।
১১. গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতি শ্রদ্ধাঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সাথে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের স্বার্থে নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক আদর্শ, মূল্যবােধ প্রভৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবােধ থাকা একান্ত জরুরি।
১২. যােগ্য নেতৃত্বঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্য উপযুক্ত নেতৃত্বের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিবেচক, বিচক্ষণ এবং সৎ ও সাহসী নেতৃত্ব জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের ভাব সৃষ্টি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যকে সুনিশ্চিত করে। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন নেতারা যদি অঙ্গরাজ্যের অধিবাসীদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে অক্ষম হন তাহলে কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক চিড় ধরতে বাধ্য। এ কারণে অধ্যাপক কে. সি. হুয়ার (K. c. Wheare) যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের সাথে যােগ্য নেতৃত্বের উপর জোর দিয়েছেন।
১৩. উত্তম বিধানঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্ষমতা বণ্টন, প্রাদেশিক সরকারের অধিকার রক্ষা ও নাগরিক চেতনাবােধ গড়ে তােলার জন্য একটি উত্তম সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সফলতার জন্য যা খুবই প্রয়ােজন।
১৪. সংবিধানের প্রাধান্যঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারে শুধু একটি সংবিধান থাকলেই হবে না, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ ও পবিত্রতম আইন বলা হয়। সুতরাং এটা দুষ্পরিবর্তনীয় হওয়াই প্রয়ােজন।
১৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতাঃ কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে কোনরূপ দ্বন্দ্ব দেখা দিলে যাতে সঠিক বিচারের মাধ্যমে মীমাংসা, সংবিধানের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সেজন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ থাকা প্রয়ােজন।
উপসংহারঃ উপযুক্ত আলােচনা শেষে বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার শর্তাবলি পূরণ করা কঠিন। এ কারণে বিশ্বের অল্প কয়েকটি রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কে. সি. হুয়ার (K. c. Where) মন্তব্য করেন, “Federal government is very rare because its pre-conditions have so bounds.” যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা তখনই সফলতা অর্জন করে যখন সেখানে শাসকদের সুমনােভাব বিরাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা তখনই সফলতা অর্জন করবে যখন শাসক ও শাসিত শ্রেণি উভয়েরই সুন্দর মানসিকতা সেখানে যুক্ত হবে।
Leave a comment