অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বিশেষত্বগুলাে আলােচনা কর।
অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রকৃতি উল্লেখ কর।
ভূমিকাঃ “Federal state is one in which part of the authority and power is vested in a central institution deliberately constituted by an association of local areas.” [Prof. H. Finer, The Theory and Political of Modern Government, P-112] আধুনিক সরকারের শ্রেণিবিভাগের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় এমনভাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত হয়, যেন উভয় সরকারই স্ব-স্ব এলাকায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কার্যসম্পাদন করতে পারে। সাংবিধানিকভাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার নিজ নিজ শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং কেউ কারাে কাজে হস্তক্ষেপ করে না। আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশেই যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের গঠন প্রকৃতি ও শাসনব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলাে পরিলক্ষিত হয়-
১. দ্বৈত ধরনের সরকার ব্যবস্থাঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনে দু’প্রকার সরকার বিদ্যমান থাকে। যথাঃ একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অপরটি প্রাদেশিক সরকার। উভয় সরকার ব্যবস্থায়ই সংবিধান থেকে ক্ষমতা লাভ করে এবং উভয়েই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং তাদের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে।
২. দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাঃ দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় আইনসভার সাধারণত দুটি কক্ষ যথাঃ উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ। উচ্চকক্ষ সাধারণত জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয় এবং নিম্নকক্ষ প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে থাকে। উচ্চকক্ষ জনসাধারণের এবং নিম্নকক্ষ অঙ্গরাজ্যগুলাের প্রতিনিধিত্ব করে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা যায়।
৩. ক্ষমতার বন্টনঃ জাতীয় স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিধিমতাে ক্ষমতা বণ্টিত হয়। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, মুদ্রা ও পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। অন্যদিকে খাদ্য, শিক্ষা, শ্ৰম, পূর্ত, গৃহনির্মাণ ও অন্যান্য বিষয়াদি প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে।
৪. সংবিধানের প্রাধান্যঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ও পবিত্র দলিল। সংবিধানই উভয় সরকারের ক্ষমতার মূল উৎস এবং সংবিধানের মাধ্যমেই তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয়।
৫. লিখিত ও দুস্পরিবর্তনীয় সংবিধানঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সংবিধান লিখিত ও দুস্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় হলে কোন সরকারই তা যখন তখন পরিবর্তন করতে পারে না। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লিখিত ও দুস্পরিবর্তনীয়।
৬. দ্বি-নাগরিকত্বঃ দ্বি-নাগরিকত্বকেও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করা হয়। সকল নাগরিক একদিকে কেন্দ্রের এবং অন্যদিকে প্রাদেশিক সরকারের নাগরিক। উভয় সরকারের কাছে নাগরিকদের যেমন আছে অধিকার, তেমনি আবার দুটি সরকারের প্রতিও দায়িত্ব পালন ও আনুগত্য স্বীকার করতে হয়।
৭. স্বায়ত্তশাসনঃ স্বায়ত্তশাসন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রদেশগুলাে এখানে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন ভােগ করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশগুলাের কোন সার্বভৌম শক্তি থাকে না।
৮. বিচার বিভাগের প্রাধান্যঃ কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সংবিধানের ধারানুসারে ক্ষমতা বণ্টিত থাকে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কর্তব্য পালন করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্ট এর রক্ষক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
৯. সমমর্যাদাঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় অঙ্গ বা অঙ্গরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সমমর্যাদা বর্তমান থাকে। অর্থাৎ প্রত্যেক অঙ্গরাষ্ট্র এবং এর নাগরিকগণ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সমমর্যাদা ও অধিকার পেয়ে থাকে। এসব ব্যাপারে বৈরী মনােভাব পােষণ করার কোন অবকাশ নেই।
১০. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতঃ যুক্তরাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলাে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত। এ আদালত কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য বিরােধের মীমাংসা দিয়ে থাকে। এটি একটি সর্বোচ্চ আদালত।
১১. দ্বৈত আইনঃ দুটি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণীত থাকে। একটি কেন্দ্রীয় আইন ও অন্যটি হলাে রাজ্য আইন। কেন্দ্রকে প্রদত্ত ক্ষমতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং রাজ্যকে প্রদত্ত ক্ষমতার ভিত্তিতে রাজ্য আইনসভা আইন প্রণয়ন করে থাকে। উভয় সরকারের প্রণীত আইনই নাগরিকদেরকে মান্য করতে হয়।
১২. দ্বৈত বিচার ব্যবস্থাঃ যুক্তরাষ্ট্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলাে দ্বৈত বিচার ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের বিচার ব্যবস্থা পৃথক ধরনের। কেন্দ্রীয় আইনের জন্য কেন্দ্রীয় বিচার ব্যবস্থা এবং রাজ্যের আইনের জন্য অঙ্গরাজ্যের বিচার ব্যবস্থা থাকে।
১৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় মনােভাবঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় জনগণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় মনােভাব অক্ষুন্ন থাকে। এতে প্রাদেশিক সরকারগুলাে যেমন কেন্দ্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে, ঠিক তেমনিভাবে প্রাদেশিক সত্তাকেও সযত্নে অটুট রাখবে।
উপসংহারঃ উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি উৎকৃষ্ট সরকার ব্যবস্থা। অন্যান্য সরকার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্য ভিন্নধর্মী। এ সরকারের প্রকৃত পরিচয় তার বৈশিষ্ট্যগুলাের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।
Leave a comment