বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলী অভিন্নভাবেই যুক্ত—এই অনুমানের ভিত্তিতে অনেকেরই ধারণা বৈষ্ণবপদসাহিত্য একান্তভাবেই চেতন্যোত্তর কালের সৃষ্টি। কিন্তু এই অনুমান এবং অনুমান নির্ভর ধারণা—দুটিই অতিশয় ভ্রান্ত। বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে বৈষ্ণব পদের যােগটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নয় বলেই বিদ্যাপতির মতাে পঞ্চোপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মণ সন্তান এবং মুর্তজা, বশির, আলাওলা প্রভৃতির মতাে মুসলমান কবিগণও বৈষ্ণব পদ-রচনায় কোন দ্বিধাবোেধ করেন নি। আবার মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বৈষ্ণবসাধনার প্রচলিত রীতিসমূহ থেকে একটু সরে গিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করলেও চৈতন্য আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী পূর্ব থেকেই গৌড়বঙ্গে ও সহস্রাব্দকাল পূর্বে ভারতবর্ষে যে বৈষ্ণবধর্ম প্রচলিত ছিল এবং রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী অবলম্বনে বিভিন্ন কাব্য রচিত হয়েছিল, তার বহু প্রমাণ একালেও বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই চৈতন্য-পূর্বকালে প্রচলিত বৈষ্ণব পদ এবং চৈতন্যোত্তর কালে রচিত বৈষ্ণব পদের একটা তুলনামূলক আলােচনা যে কোন সনিষ্ঠ বৈষ্ণব পদ-পাঠার্থীর নিকট অতিশয় প্রাসঙ্গিক বিষয়।
শুধু গৌড়বঙ্গেই নয়, সম্ভবতঃ সমগ্র ভারতবর্ষেই গৌড়েশ্বর লক্ষণসেনের সভাপতি কবিরাজ গােস্বামী জয়দেব-রচিত ‘গীতগােবিন্দ’ কাব্যেই সর্বপ্রথম সুশৃঙ্খলভাবে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী অবলম্বনে পদ ও গীতের সন্ধান পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য, মহাভারতের খিল অংশ ‘হরিবংশ’, ‘শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ’ এবং ‘বিষ্ণুপুরাণ-আদি প্রাচীন গ্রন্থসমূহে সবিস্তারে কৃষ্ণ-কাহিনী গীত হ’লেও শ্রীমতী রাধিকার কোন উল্লেখ এ সমস্ত গ্রন্থে নাই। বিচ্ছিন্নভাবে কোন কোন সংস্কৃত ও প্রাকৃত প্রকীর্ণ শ্লোকে এবং পরবর্তীকালের কোন কোন পুরাণে রাধাকৃষ্ণের প্রেমবিষয়ক কাহিনী পরিবেষিত হলেও জয়দেবের গীতগােবিন্দ’ কাব্যেই বিষয়টি সর্বপ্রথম একটি পালার আকারে লিপিবদ্ধ হয়।
এরপর বড়ু চণ্ডীদাস প্রধানতঃ গীতগােবিন্দের আমলেই তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’- কাব্যটি রচনা করেন। বিস্ময়ের সঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে গীতগােবিন্দ বৈষ্ণবকাব্যরূপে স্বীকৃত হলেও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ অদ্যাবধি বৈষ্ণবকাব্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয় নি। কাব্যটিতে মধুর রসের একান্তই অভাব; এতে কৃষ্ণের ঐশ্বর্যরসই ফুটিয়ে তােলবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এর একান্ত লৌকিকতা এবং গ্রাম্যতা-আদি দোষই সম্ভবতঃ এটিকে বৈষ্ণব সমাজের সমাদর থেকে বঞ্চিত করেছে।
মালাধর বসু ভাগবত- পুরাণে’র দশম ও একাদশ স্কন্ধ-অবলম্বনে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য রচনা করলেও এতে ভিন্নসূত্রে রাধাকাহিনীও সংযােজন করেছেন। কিন্তু এটি আখ্যায়িকা কাব্য এবং স্বয়ং চৈতন্যদেব মালাধর বসুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও বৈষ্ণব সম্প্রদায় এটিকে বৈষ্ণবকাব্যরূপে গ্রহণ করেন নি। মৈথিল কবি বিদ্যাপতি কর্তৃক ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদগুলিই বস্তুতঃ রাধাকৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত প্রথম বৈষ্ণবপদ-রূপে স্বীকৃত হয়ে থাকে।
বিদ্যাপতি যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন, তা থেকে অনুমিত হয়, তিনি সম্ভবতঃ বৈষ্ণব ছিলেন না, হয়তাে বা তিনি ছিলেন পঞ্চোপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মণ সন্তান। তাঁর রচিত পদগুলির ভাষা, ছন্দ, অলঙ্করণের বৈশিষ্ট্য অতিশয় হৃদয়গ্রাহী, এদের বিষয়-বৈচিত্র্যও অসাধারণ ; বৈষ্ণবগণ বিদ্যাপতির পদগুলিকে হৃদয়ের ধন বলেই গ্রহণ করলেও তাতে যেন কবি-আত্মার স্পর্শ নেই।
কবি চণ্ডীদাসই সম্ভবতঃ বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম যথার্থ বৈষ্ণব পদ রচনা করেন। স্বয়ং চৈতন্যদেব বিমুদ্ধচিত্তে বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের পদের স্বাদ গ্রহণ করতেন বলে তার জীবনীকারগণ উল্লেখ করেছেন। এখানে যে সকল কবি এবং তাদের কাব্যের কথা উল্লেখ করা হলাে, এ সকলই চৈতন্য-পূর্ববর্তী কালের বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
চৈতন্য-পূর্ব এবং চৈতন্যোত্তর কবিদের বিভাজনটি অন্যভাবেও করা যেতে পারে। চৈতন্য পূর্ব যুগের কবিদের সাধারণভাবে পঞ্চদশ শতকের এবং চৈতন্য-সমকালীন চৈতন্যোত্তর যুগের প্রথম পর্যায়ের কবিদের সাধারণভাবে ষােড়শ শতকের বৈষ্ণব কবিরাই প্রকৃতপক্ষে গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসশাস্ত্র-সম্মত পঞ্চরসের ভাষ্যরূপে অজস্র পদ রচনা করে বৈষ্ণব সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে উপস্থাপিত করবার মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। গুণগত এবং পরিমাণগত বিচারে ষােড়শ শতকের বৈষ্ণব কবি, যাদের মধ্যে রয়েছে চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গােবিন্দদাস, বলরাম দাস, লােচনদাস প্রভৃতিতারা বৈষ্ণব সাহিত্যকে উৎকর্ষের চরমসীমায় উন্নীত করেন, যার জন্য ষােড়শ শতককে বলা হয়। বৈষ্ণব সাহিত্যের সুবর্ণযুগ।
চৈতন্যের সমকালীন বৈষ্ণব পদ রচয়িতাদের প্রায় সকলেই ছিলেন চৈতন্যদেবেরই সহচর। এঁদের মধ্যে রয়েছে—চৈতন্যদেবের বয়ােজ্যেষ্ঠ ভক্ত ও পরিকর মুরারিগুপ্ত, চৈতন্য-সহাধ্যায়ী মুকুন্দ দত্ত ও তার জ্যেষ্ঠ বাসুদেব দত্ত, নরহরি দাস ঠাকুর, চৈতন্য-সহচর গােবিন্দ, মাধব ও বাসুদেব ঘােষ-ভ্রাতৃত্রয়, বংশীবদন প্রভৃতি। এঁরা অনেকেই রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করলেও অধিকাংশ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদ রচনায়।
চৈতন্যদেবের জীবকালেই হয়তাে জন্মগ্রহণ করেছেন, কিন্তু বৃন্দাবনের ষড়-গােস্বামীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাব্য রচনা করেছে—এরূপ কিছু বিশিষ্ট কবি চৈতন্যোত্তর কালের কবিরুপে গ্রহণ করাই বিধেয়। এদের মধ্যে বলরাম দাস, জ্ঞানদাস, লােচনদাস প্রভৃতি চৈতন্যসহচরদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে এসেছিলেন। এর পরের পর্যায়ে উল্লেখযােগ্য—নরােত্তমদাস, রামচন্দ্রদাস, গােবিন্দদাস, যদুনন্দন, শেখর, গােবিন্দ চক্রবর্তী প্রভৃতি।
চৈতন্যসমকালীন কবিরা চৈতন্যের ভগবৎ-সত্তায় আস্থাবান ছিলেন বলে তারা শ্রীকৃষ্ণের লীলার অনুসরণে গৌরাঙ্গলীলার পদরচনাতেই বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। অধিকন্তু এঁরা বৃন্দাবনের গােস্বামীদের প্রবর্তিত তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হবার সুযােগ পাননি বলেই রাধাকৃষ্ণের লীলায় সখী, দূতী বা বন্ধুরূপে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু উত্তর কালের কবিরা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্বে নিষ্ণাত হায়েছিলেন বলে সনিষ্ঠভাবে তার অনুসরণ করেছেন। ফলে তারা রাধাকৃষ্ণ-লীলায় মঞ্জরী ভাবের অর্থাৎ পরিচারিকার ভূমিকা গ্রহণ করে দূর থেকে সেই লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন।
সমগ্রভাবে চৈতন্যপূর্ববর্তী ও চৈতন্যোত্তর যুগের বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের তুলনামূলক আলােচনা-বুপে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তার ‘বৈষ্ণবপদাবলী ও উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ “রাধাভাবদুতি-সূবলিত কৃষ্ণস্বরূপ চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে যে দুকূলপ্লাবী প্রবাহ দেখা দিয়েছিল, তার পূর্বেই মহাজন পদকর্তাগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে বহু উৎকৃষ্ট পদ রচনা করে ধন্য হয়েছেন। তবে ঐ সকল পদ রচিত হয়েছিল সাহিত্যবােধের প্রেরণায়, এর সঙ্গে বৈষ্ণবধর্ম বা দর্শনের বিশেষ কোন যােগ ছিল না। তাই তখনকার পদাবলীতে মানবিক অনুভূতি এবং প্রেমসন্তোগের চিত্রই প্রাধান্যলাভ করেছে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তাঁর সমকালীন এবং পরবর্তীকালের ভক্তদের মনকে এমনভাবে অভিভূত করেছিল যে চৈতন্যলীলাকেই তারা সারাৎসার-রূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং এর আলােকেই রাধাকৃষ্ণের লীলাকে তারা উপভােগ করেন। তারা যেন লীলাশুক—দুর থেকে মঞ্জরী-অংশ ভাবে ঐ লীলা দর্শনেই তৃপ্ত হাতেন। পূর্ববর্তী কবিদের মতাে তাঁরা কৃষ্ণলীলায় কোন অংশগ্রহণের অধিকারী ছিলেন না। এমনকি মােক্ষবাঞ্ছা কৈতব প্রধান জেনে চৈতন্য-পরবর্তী কোনাে মহাজন কবি বিদ্যাপতির প্রার্থনা পদের মতাে মুক্তি প্রার্থনা করেন নি, অথবা চণ্ডীদাসের নিবেদন পদের মতাে ঐশ্বর্য চেতনারও প্রকাশ ঘটাননি। তাই চৈতন্যোত্তর যুগের কাব্যকে নিছক সাহিত্য রূপে বিচার করা চলে না—একে বলা চলে, বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য। প্রাক্-চৈতন্য কবিগণ লােকায়ত জীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করেছেন। পূর্বযুগের কবিদের রচনায়ও ভক্তির পরিচয় ছিল কিন্তু তা ছিল ঐশ্বর্যভিত্তিক, পরবর্তী কবিদের ভক্তি রাগানুরাগ, মাধুর্যসিক্ত।
এই ভক্তির স্বরূপ বিশ্লেষণ করে আচার্য সুশীলকুমার দে বলেন, “Bengal Vaisnavism seeks to realise in theory and practice what is supposed to be the actual passion of the Deity figured as friend, child, son, father or master and chiefly and essentially as a lover.” ভগবানকে ‘ঈশ্বরবুদ্ধির স্বরূপায়তনে প্রত্যক্ষ না করে চৈতন্যোত্তর কবিগণ মানবীয় সম্পর্কের বাস্তবসীমায় নিয়ে আসার ফলে পরবর্তী সাহিত্যে মাধুর্যরসের প্রবাহের সঙ্গে বাৎসল্য এবং সখ্যরসেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যা পূর্ববর্তীকালে ছিল না।
Leave a comment