প্রশ্নঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের সমালােচনামূলক ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ বিবর্তনবাদ জগতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধীয় একটি মতবাদ। বিবর্তনবাদ অনুসারে, এ বিশ্ব আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়নি। জগতের অসংখ্য জীবজন্তু, কীট-পতঙ্গ তথা সকল জীবন ও অজৈব সত্তা এক সহজ সরল আদিম অবস্থা থেকে বিকশিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। এবং এই বিবর্তনধারা অগ্রসর হয়ে চলেছে নিরন্তর। এ জগৎ এক আবিরাম পরিবর্তনপ্রবাহ। আর এ পরিবর্তনধারায় নিয়ত বদল হচ্ছে জগৎ, জীবন, সমাজ তথা জগতের সবকিছু। এই বিবর্তনবাদ কয়েক প্রকারের; যথা- যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ, উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ, সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ এবং উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ। নিচে আমরা যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ আলােচনা করব।

যান্ত্রিক বিবর্তনবাদঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের মূলকথা হলাে, জগৎ ও এর অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় জীবসহ সবকিছুই ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে যে আবির্ভাব ঘটেছে, তার পেছনে কোনাে বুদ্ধিমান স্রষ্টার কোনাে হাত নেই। জড়শক্তি যান্ত্রিকভাবে জগতের বিবর্তনপ্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে জগৎসহ বিভিন্ন পদার্থের ক্রমবিকাশ ঘটাচ্ছে। অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কেবল জড়ের মধ্যে। এ জগৎ সহ যাবতীয় পদার্থের সৃষ্টি। এর পেছনে কোনাে কর্তা নেই। সবকিছুই যান্ত্রিকভাবে বিকশিত হচ্ছে। যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ব্যাখ্যা করলে এর দুটি রূপ পাওয়া যায়-(১) জড়জগৎ সম্পর্কীয় যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ এবং (২) জীবজগৎ সম্পর্কীয় যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ।

(১) জড়জগৎ সম্পৰ্কীয় যান্ত্রিক বিবর্তনবাদঃ সাধারণত বিজ্ঞানী ও বস্তুবাদী দার্শনিকরাই এ মতের প্রধান সমর্থক। এম্পিডক্লিস, ডেমােক্রিটাস প্রমুখ প্রাচীন বস্তুবাদী দার্শনিককে এ মতের অগ্রদূত বলা যায়। আধুনিককালে এ মতের সমর্থক হিসেবে ল্যাপ্লাস ও হারবার্ট স্পেনসারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। নিচে আমরা ল্যাপ্লাল ও হারবাট স্পেনসারের জড়জগৎ সম্পর্কে তাদের মতামত আলােচনা করব।

(ক) ল্যাপ্লাসের মতঃ ফরাসি বিজ্ঞানী ল্যাপ্লাস বিবর্তনবাদের এক যান্ত্রিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তার মতে, গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টির পূর্বে বিশ্বজুড়ে নীহারিকা পরিব্যাপ্ত ছিল। এই নীহারিকামণ্ডলে ছিল কোটি কোটি নক্ষত্র। এ মতানুসারে নীহারিকামণ্ডল মহাশূন্যে অগ্নিময় দ্রুতগতিসম্পন্ন বাম্প এ মতানুসারে, বিশ্ব অতীতে আগুনের গােলা হিসেবে ছিল। এ আগুন মহাশূন্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করত। তাপ বিকিরণের ফলে ক্রমশ এটি সংকুচিত হয়ে নীহারিকামণ্ডলে রূপান্তরিত হয়ে আপন কক্ষপথে বিচরণ করতে থাকে। নীহারিকামণ্ডল বহু যুগ ধরে বিকিরণের ফলে অংশবিশেষ ঘনীভূত হয়ে অসংখ্য দ্রুতগতিসম্পন্ন নক্ষত্রের সৃষ্টি করে। সূর্যের সৃষ্টিও এভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এই নীহারিকার সংকোচন ও প্রসারণের ফলে সৃষ্টি হয় গ্রহ। এই গ্রহগুলাে পরে শীতল হয়ে মানুষের বসবাস উপযােগী হয়েছে।

(খ) হারবার্ট স্পেনসারের মতঃ হারবার্ট স্পেনসার জড় জগতের উৎপত্তির একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, যে জড় উপাদান থেকে সৌরজগতের উৎপত্তি, তা নীহারিকার মতাে অগ্নিময় গ্যাসীয় পদার্থ বা মেঘের ধূলিকণার মতাে। এ নীহারিকাসদৃশ জড় উপাদান অসংখ্য পরমাণু দ্বারা গঠিত। এ পরমাণুগুলাে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। তারপর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে এগুলাে নীহারিকার কেন্দ্রে ঘনীভূত হয়ে আবর্তিত হতে থাকে। এবং এই পরমাণুগুলাের গতির কারণেই সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন গ্রহের। এই গ্রহগুলাের সংকোচনের ফলে এরও কিছু অংশ আবার দূরে নিক্ষিপ্ত হয়। যেগুলাে উপগ্রহ। নীহারিকার কেন্দ্রে ঘনীভূত পদার্থই সূর্য। এভাবেই অন্যান্য গ্রহের সৃষ্টি।

(২) প্রাণীজগৎ সম্পর্কে যান্ত্রিক বিবর্তনবাদঃ প্রাণীজগৎ সম্পর্কে যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের অন্যতম দুজন প্রবক্তা হলেন ফরাসি প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ল্যামার্ক এবং চালর্স ডারউইন। আমরা প্রথমে ল্যামার্কের এবং তারপর ডারউইনের মত আলােচনা করব।

(ক) ল্যামার্কের মতঃ উনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে ফরাসি প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ল্যামার্ক প্রাণীর উৎপত্তির যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেন। তার মতে, জীবজগতের বিভিন্ন জাতি-প্রজাতি এক অভিন্ন উৎপত্তিস্থল হতে ক্রমবিবর্তিত হচ্ছে। যেসব কারণে প্রাণীদেহ বিবর্তিত হয় সেগুলাের মধ্যে তিনি পরিবেশের প্রভাব, জৈবিক প্রয়ােজন, অর্জিত দৈহিক পরিবর্তন এবং সেই পরিবর্তনের বংশানুক্রমিক সংক্রমণের কথা বলেন। এসব বিবর্তননীতির প্রভাবেই ঘটে জৈবিক বিবর্তন। তার মতে, আদিতে জিরাফের দীর্ঘ গলা ছিল না। দীর্ঘদিন উচু গাছের পাতা খেতে খেতে ক্রমশ তার গলার কিছুটা পরিবর্তন আসে, আর সেই পরিবর্তন তার বংশধরের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এভাবে বংশপরম্পরায় জিরাফের গলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।

(খ) ডারউইনের মতঃ ডারউইন তার ‘Origin of Species’ গ্রন্থে জীবজগতের উৎপত্তির ব্যাপারে এক যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেন। তার মতে, আদিম জীবকোষ থেকে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। বিবর্তনের এ প্রক্রিয়াকে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে অভিহিত করেন। ডারউইনের মতে, পৃথিবীর প্রাণীকুল বর্তমানে যে অবস্থায় আছে অতীতে এ অবস্থায় ছিল না। এক আদি অপরিপক্ক অবস্থা থেকে ক্রমিক বিবর্তনপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা বর্তমানের জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বিভিন্ন প্রাণী সুকঠিন যুদ্ধে লিপ্ত। পশু-পাখি ও মানুষসহ সব প্রাণীর প্রজননক্ষমতা এত বেশি যে, তাদের সকলের সন্তানসন্ততির ভরণপােষণ পৃথিবীর সীমিত খাদ্য দ্বারা সম্ভব নয়। এ জন্যই আত্মরক্ষার জন্য তারা সকলেই যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুদ্ধে যে জয়ী হয় সে-ই টিকে থাকে। আর যারা হেরে যায় তারা ধ্বংস হয়। এ উদাহরণস্বরূপ; হরিণের দ্রুতগামিতার ওপর তার জীবন নির্ভর করে। যে হরিণ যত দ্রুতগামী তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি।

সমালােচনাঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ যদিও সন্তোষজনক মতবাদ, তবুও এমতের কতকগুলাে ত্রুটি বিদ্যমান। নিচে আমরা এগুলাে আলােচনা করব।

(১) ল্যাপ্লাসের মত সন্তোষজনক নয়ঃ ল্যাপ্লাসের নীহারিকাবাদ সন্তোষজনক নয়। কারণ অনির্দিষ্ট জড়বস্তু হতে জীবন ও মনের আবির্ভাব কীভাবে ঘটতে পারে তা ভেবে পাওয়া যায় না। জড় ও প্রাণ আলাদা বস্ত। জড় থেকে যদি প্রাণের উদ্ভব হয় তাহলে এ জগতের সব কিছুই জড়ের মাধ্যমে সৃষ্টি- একথা আমাদের মানতে হয়। কিন্তু জগতের পেছনে যেকোনাে মহান কর্তার উদ্দেশ্য রয়েছে, এ কথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

(২) স্পেনসারের মতের কোনাে প্রমাণ নেইঃ স্পেনসারের মতবাদ যদিও ব্যাপক তবুও এ মতের তেমন কোনাে প্রমাণ নেই। স্পেনসারের মতে, পদার্থের বিশেষ সংমিশ্রণের ফলে জীবকোষ বা প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। এ মত গ্রহণীয় নয়। কারণ প্রাণ ও জীবনের প্রকৃতি বিচার করলে দেখা যায় যে, প্রাণের এমন কোনাে উপাদান নেই যা জড়ের মধ্যে পাওয়া যায়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের কতকগুলাে ত্রুটি বিদ্যমান তবও এর গুরুতকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। জগতের এই নতুন বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা একদিকে কর্মের ক্ষেত্রে, অন্যদিকে সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের বেলায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে।