মধ্যযুগের ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে গ্রামাঞ্চলে ম্যানর-ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ ম্যানর অঞ্চলগুলিতে ম্যানর-প্রভু ‘ম্যানর হাউস নামে নিজস্ব অট্টালিকায় অবস্থান করতেন। নীচে ম্যানর হাউস ও ম্যানরের অন্যান্য বাসগৃহের বিবরণ দেওয়া হল一
[1] ম্যানর হাউস: ম্যানর এলাকায় সামন্তপ্রভু এবং তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও কর্মচারীদের বসবাসের জন্য পাথরের তৈরি দুর্গের মতাে একটি প্রাসাদোপম বাড়ি থাকত। এটি ম্যানর হাউস নামে পরিচিত। এখানে রান্নাঘর, খাওয়ার হলঘর, শােওয়ার ঘর, উপাসনা কক্ষ, চাকরদের ঘর, আস্তাবল প্রভৃতি সবকিছুই থাকত। রাতে মােমবাতি ও মশাল জ্বালিয়ে বাড়িগুলি আলােকিত করা হত।
[2] অন্যান্য বাসিন্দাদের বাসগৃহ: ম্যানর হাউসে বসবাসকারী সামন্তপ্রভু, তার আত্মীয়-পরিজন, কর্মচারীবৃন্দ ও যাজকরা ছাড়া ম্যানরের বাকি অধিবাসীরা ছিল কৃষক, ভূমিদাস ও অন্যান্য শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ। তারা সপরিবারে জীর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর ঘরে বাস করত। তারা রাতে সাধারণত খড়ের বিছানায় ঘুমােত। বর্ষার জলধারা আর শীতের তুষারপাত তাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলত।
মধ্যযুগের ম্যানরগুলিতে অন্তত ৯০ শতাংশই ছিল কৃষক ম্যানরের এই কৃষকের অবস্থা ছিল খুবই দুর্দশাগ্রস্ত।
[1] অমানুষিক পরিশ্রম: জমিতে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে কৃষকদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত। ফলে কৃষকের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ত এবং যার ফলে তারা অকালেই প্রাণ হারাত।
[2] করের বোঝা: ম্যানর-প্রভু তার প্রদত্ত জমির জন্য নিয়মিত কর ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করতেন। প্রভুর রাস্তাঘাট, জাতাকল, কুয়াে, চুল্লি প্রভৃতি ব্যবহারের জন্য কৃষকরা প্রভুকে কর দিতে বাধ্য ছিল। ভূমিদাসদের ‘হেরিয়ট নামে উত্তরাধিকার কর ও অন্যান্য কয়েকটি কর দিতে হত। কৃষকদের ওপর অত্যাধিক করের বােঝা তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
[3] বেগার খাটা: তিন শ্রেণির কৃষকের মধ্যে স্বাধীন কৃষককে সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন সামন্ডপ্রভুর জমিতে বেগার খাটতে বা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হত। আধা-স্বাধীন কৃষক বা ভিলেইনদের বেগারশ্রম একটু কম করতে হলেও তার পরিবর্তে কিছু ফসল বা মুদ্রা খাজনা হিসেবে দিতে হত। ভূমিদাসরাই সবচেয়ে বেশি বেগার শ্রম দিত। এরকম বেগার খাটার ফলে কৃষকরা নিজের জমিতে কাজ করার যথেষ্ট সময় পেত না।
[4] গির্জার শোষণ: খ্রিস্টান গির্জাগুলি ম্যানরের কৃষকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের শােষণ চালাত। দরিদ্র কৃষকরা গির্জাকে ‘টাইদ’ নামে উৎপাদনের এক-দশমাংশ ধর্মকর, অন্যান্য কর, উপঢৌকন ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দান দিতে বাধ্য হত।
[5] দারিদ্র: সারাদিনের কাজের শেষে সূর্যাস্ত নামলে কৃষকরা কুটিরে খড়ের বিছানায় আশ্রয় নিত এবং পরের দিনের সম্ভাব্য দুঃসহ ছবিগুলি তাদের চিন্তায় ভেসে উঠত। তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখার কোনাে সুযােগই ছিল না অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার ফলে ম্যানরগুলিতে কলেরা, মহামারি ও অকাল মৃত্যু ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
উপসংহার: দ্বাদশ ও ত্রয়ােদশ শতকের ইউরােপে কৃষকরা প্রভুর সেবায় আমৃত্যু প্রাণপণ সচেষ্ট থাকতে বাধ্য থাকত। এজন্য মার্ক ব্লখ বলেছেন যে, “ম্যানরের কৃষকের ‘স্বাধীনতা (Liberty) র বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়।”
Leave a comment