সূচনা: মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামােয় ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করত। এই রকম এক বা একাধিক গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠত ‘ম্যানর’। গ্রামে সামন্তপ্রভুর অধীনস্থ জমি চাষ করার জন্য ইউরােপে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে ম্যানর ব্যবস্থা বলা হত। ফ্রান্সে ম্যানর ব্যবস্থা সেইন্যরি (Seigneurie) নামে পরিচিত ছিল।

ম্যানর-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

মধ্যযুগের ইউরােপে গড়ে-ওঠা ম্যানর-ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল নিম্নরূপ一

[1] ম্যানর হাউস: প্রতিটি ম্যানর অঞ্চলে ম্যানর প্রভুর খামার বাড়ি অর্থাৎ ম্যানর হাউস থাকত। এটি ছিল সামন্তপ্রভুদের স্থানীয় প্রশাসনিক কেন্দ্র। ম্যানর হাউসে খাওয়ার হল-ঘর, শােওয়ার ঘর, উপাসনা কক্ষ, ভৃত্যদের ঘর, ঘােড়ার আস্তাবল প্রভৃতি সবকিছুই থাকত।

[2] অর্থনৈতিক দিক: ম্যানরে সামন্তপ্রভুর অধীনে কৃষক ও ভূমিদাসরা উৎপাদন কার্যে অংশ নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখত। তবে এখানকার অর্থনীতি ছিল একেবারেই অঞ্চলভিত্তিক।

[3] জমির চরিত্র: প্রতিটি ম্যানরের যে বিপুল পরিমাণ জমি ছিল তার মধ্যে ছিল চাষের জমি, পশুচারণ ভূমি, জলাভূমি, পতিত জমি, জঙ্গল, কৃষকের গৃহ, গির্জা ও শ্রমিক- কারিগরদের বাসগৃহ ইত্যাদি। এখানে মূলত দুপ্রকার জমি ছিল—[i] ডিমিন বা প্রভুর খাস জমি এবং [ii] কৃষকের বসতি, আবাদি ও পশুচারণ জমি।

[4] জমির বন্টন: আবাদি জমির কিছু অংশ সামন্তপ্রভু নিজের দখলে রেখে বাকি জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন৷ সামন্তপ্রভু তাঁর নিজের দখলে রাখা জমিতে স্বাধীন কৃষক আধা-স্বাধীন কৃষক বা ভিলেইন এবং ভূমিদাস বা সার্ফদের বেগার শ্রমের দ্বারা উৎপাদন কার্য চালাতেন। অবশিষ্ট জমি ম্যানরে বসবাসকারী অন্তত বারো থেকে ষাটটি কৃষক পরিবারের মধ্যে বণ্টিত হত। প্রভুকে বার্ষিক বিভিন্ন ধরনের কর ও বেগার শ্রম দিয়ে তারা এই জমি ভােগ করতে পারত।

[5] উৎপাদন ব্যবস্থা: ম্যানরের জমিতে প্রথমদিকে বছরে দুটি এবং পরে তিনটি চাষ হত। উৎপাদন হত মূলত গ্রামের প্রয়ােজনের ওপর ভিত্তি করেই।

[6] রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ: ম্যানরগুলি ছিল রাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। এর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ম্যানর হাউস-এ প্রভু বসবাস করতেন। এখানে থেকে প্রভু ম্যানরে বসবাসকারী তার অধীনস্থ প্রজাদের ওপর শাসন ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন। ম্যানর অঞ্চলে প্রভুর ক্ষমতাই ছিল চূড়ান্ত।

[7] স্বয়ংসম্পূর্ণতা: প্রতিটি ম্যানর ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিভিন্ন পেশার মানুষ যেমন ম্যানরে বাস করত তেমনি নিত্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রীও ম্যানরেই পাওয়া যেত। ম্যানরের প্রয়ােজনমতােই এখানকার যাবতীয় উৎপাদন কার্য চলত।

উপসংহার: মধ্যযুগের ইউরােপে প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে উঠেছিল। এই কাঠামাের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ভূস্বামীর খামার বাড়ি, দুর্গ এবং গির্জা। সামন্তপ্রভুরা শিকার, যুদ্ধ ও অন্যান্য আনন্দ করে দিন যাপন করত।আর সমগ্র দেশের জন্য প্রয়ােজনীয় কৃষি উৎপাদন সম্পন্ন করত ম্যানরের কৃষকরা।