মৌর্যযুগে গুপ্তযুগের সমাজ:
গুপ্তযুগে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা জাতিবর্ণ প্রথা, নারীর অবস্থা ইত্যাদি জানার জন্য গুপ্তরাজাদের লেখসমূহের পাশাপাশি পর্যটকদের বিবরণ, স্থানীয় সাহিত্য-নাটক এবং বিশেষভাবে বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। ইৎ-সিং, ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙের বিবরণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনজন পর্যটক দীর্ঘকাল ভারতে অবস্থান করে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমকালীন ভারতীয় জনজীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। এছাড়া বিশুদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে বানভট্টের হর্ষচরিত ও কাদম্বরী, হর্ষবর্ধনের নাটকাবলী, কালিদাসের কাব্যসমূহ, বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস গুপ্তযুগের সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান আকরগ্রন্থ। অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মার্কণ্ডেয়, অগ্নি, মৎস, পদ্ম, বায়ু, বিষ্ণুপুরাণ প্রভৃতি এযুগের সামাজিক ইতিহাসের সূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। মনু ও যাজ্ঞবন্ধের পরবর্তীকালে রচিত নারদ, বৃহস্পতি, কাত্যায়ন ও পরাশরের স্মৃতিশাস্ত্র, বৌদ্ধপণ্ডিত বুদ্ধ ঘোষ, ধৰ্ম্মপাল, কচ্চায়ন, মহানাশ প্রমুখের শাস্ত্রীয় টিকামূলক রচনাবলী সূত্র হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
গুপ্ত-পূর্ব যুগে রচিত ধর্মশাস্ত্রগুলিতে চতুর্বর্ণের যে আদর্শ উপস্থাপিত করা হয়েছিল এবং বিভিন্ন বৃত্তিজীবী জাতিকে বর্ণব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল, গুপ্তযুগে তাকে সামাজিকভাবে রীতিসিদ্ধ করার কাজ পূর্ণতা পায়। বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে বিভিন্ন বর্ণের জন্য বসতস্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই সময় কৌলিক বৃত্তি পরিবর্তনের বহু দৃষ্টান্ত দেখা যায়। যেমন, কদম্বরাজ ময়ুরশর্মা ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ তাঁর রচনায় উজ্জয়িনী, মহেশ্বরপুরে ব্রাহ্মণ রাজা, থানেশ্বরে বৈশ্য রাজা এবং সিন্ধুদেশ ও মতিপুরে শূদ্র রাজাদের অস্তিত্ব উল্লেখ করেছেন। চৈনিক বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণদের সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হত। গুরুতর অপরাধ সত্ত্বের ব্রাহ্মণদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হত না। মৃচ্ছকটিকে দেখানো হয়েছে যে, হত্যাকারী অভিযুক্ত চারুদত্তকে তার ব্রাহ্মণত্বের কারণেই প্রাণদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তবে সকল ব্রাহ্মণ সামাজিকভাবে সমান মর্যাদার অধিকারী হতেন না। “অত্রি স্মৃতি’ গ্রন্থে দশ ধরনের ব্রাহ্মণের কথা বলা হয়েছে। দেব-ব্রাহ্মণ, মুনি-ব্রাহ্মণ, দ্বিজ-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্র-ব্রাহ্মণ, বৈশ্য-ব্রাহ্মণ প্রমুখ বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতেন। তুলনামূলকভাবে শুদ্র-ব্রাহ্মণ (বিক্রেতা), নিষাদ-ব্রাহ্মণ (চুরি জাতীয় কাজে অভিযুক্ত), ম্লেচ্ছ-ব্রাহ্মণ (সংস্কার বর্জিত), চণ্ডাল-ব্রাহ্মণ (কোন নিয়ম-নীতি মানে না) কম সম্মানের অধিকারী হতেন।
বিবাহ সংক্রান্ত স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানসমূহ গুপ্তযুগে খুব কঠোরভাবে প্রযুক্ত হত না। বিভিন্ন জাতির মধ্যে অনুলোম এমনকি প্রতিলোম বিবাহের প্রচলন ছিল। গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার সাথে বাকাটক বংশীয় ব্রাহ্মণ রাজা রুদ্রসেনের বিবাহ হয়েছিল। ব্রাহ্মণবংশীয় কদম্বরাজ কাকুৎসবর্মনের কন্যাদের সাথে গুপ্ত এবং অন্যান্য নিম্নবর্ণীয় ব্যক্তির বিবাহ হয়েছিল। সম্রাট হর্ষবর্ধন বৈশ্য ছিলেন। তবে তাঁর কন্যার বিবাহ হয়েছিল বলভীর ক্ষত্রিয় রাজার সাথে। সমকালীন সংস্কৃত সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা দাসী এমন কি গণিকাদের কন্যাদের বিবাহ করতেও দ্বিধা করতেন না। মৃচ্ছকটিকে ব্রাহ্মণ চারুদত্ত কর্তৃক বসন্ত সেনাকে বিবাহ কিংবা ব্রাহ্মণ সার্বিলক কর্তৃক দাসী মদনিকাকে বিবাহ এর দৃষ্টান্ত বিশেষ। ‘দশকুমারচরিত’ গ্রন্থে এক রাজপুত্র কর্তৃক জনৈকা গণিকা-কন্যাকে বিবাহের উল্লেখ আছে। অনুরূপভাবে চণ্ডাল বা তথাকথিত অস্পৃশ্যদের ক্ষেত্রেও সামাজিকভাবে নমনীয় নীতি গ্রহণ করা হত। ফা হিয়েন, হিউয়েন সাঙ প্রমুখের রচনা থেকে জানা যায় যে, চণ্ডাল বা সমগোত্রীয় জাতিগুলিকে শহর এলাকার বাইরে বাস করতে হত, তবে বাজার এলাকায় প্রবেশাধিকার ছিল। কেবল জনবহুল এলাকায় চণ্ডালদের লাঠি ঠুকে ঠুকে শব্দ করে চলতে হত যাতে অপরে তাকে স্পর্শ না করে। কসাই, ঘাতক, ঝাড়ুদার, শিকারী প্রমুখ এই শ্রেণীভুক্ত ছিল। পুলিন্দ, শবর, কিরাত প্রভৃতি আরণ্যক জাতিগুলির একটা বড় অংশই গুপ্তযুগে জাতিকাঠামোয় স্থান পেয়েছিল।
ভারতবর্ষে ইউরোপের সমতুল্য ক্রীতদাসপ্রথা গুপ্তযুগেও ছিলনা। তবে বিভিন্ন জাতির লোকের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের শ্রম ও সেবা গ্রহণের রীতি গুপ্তযুগেও ছিল। নারদস্মৃতি ও কাত্যায়ন স্মৃতিতে দাসদের বিষয়ে বিস্তারিত বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। নানা কারণে দাসত্ব গ্রহণ করতে হত। যেমন, দাসীর সন্তান, দাস হিসেবে যাদের ক্রয় করা হয়, যুদ্ধবন্দী, অভাবের তাড়নায় দাসত্ব গ্রহণ, দাসীর প্রতি ভালবাসার কারণে দাসত্ব স্বীকার ইত্যাদি। দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের পথও ছিল সহজ। প্রভুর প্রাণরক্ষা করা, ঋণ করা অর্থ পরিশোধ করা ইত্যাদি দ্বারা দাসত্ব মুক্ত হওয়া যেত।
মৌর্যযুগের নারীর অবস্থা :
গুপ্তযুগে উচ্চবংশীয়া নারীরা রাজনৈতিক কাজকর্মে অংশ নিতেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা ও বকাটক মহিষী প্রভাবতী গুপ্তা বকাটক রাজ্যের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বাৎসায়নের রচনায় আদর্শ স্ত্রী বা কুলবধূর গুণাবলীর এবং কর্তব্য-অকর্তব্যের বিবরণ পাওয়া যায়। বলা হয়েছে, দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি দৃঢ় হয় স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য দ্বারা। আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর সুখ-সুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখা, স্বামীর বিনা অনুমতিতে কোন সমাজে, উৎসবে বা যজ্ঞানুষ্ঠানে যোগ না দেওয়া, অসচ্চরিত্রা কোন নারীর সঙ্গে মেলামেশা না করা, নির্জন স্থানে সময় অতিবাহিত না করা ইত্যাদি। তাঁর আরো কর্তব্য শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা করা, স্বামীর বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়ন করা, দাসদাসীদের দিয়ে কাজ করানো, গৃহদেবতার পুজোর যোগাড় করা, সংসারের আয়ব্যয়ের হিসাব রাখা, স্বামীকে মিতব্যয়ী হতে পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। স্বামী প্রবাসে থাকলে স্ত্রীকে সংযত জীবনযাপন করতে হত। মহাকাব্যেও বারবার বলা হয়েছে যে, পতিই নারীর একমাত্র দেবতা এবং তার সেবা করলেই স্বর্গলাভ করা যায়। বাৎসায়নের মতে, স্ত্রী স্বামীর ‘গৃহিনী, সচিব, সখা ও প্রিয়া’। কাত্যায়ন বলেছেন যে, স্ত্রী স্বামী ছাড়া নিজের কোন পৃথক অস্তিত্ব কল্পনা করবে না। মৎসপুরাণে বলা হয়েছে যে, স্ত্রী স্বামীকে সাক্ষাৎ দেবতা জ্ঞান করবে। ব্যাভিচারিণী স্ত্রীকে কঠোর নিয়ম পালনের শর্তে পূর্ব অধিকার ফেরানোর কথা বলা হয়েছে। গুপ্তযুগে নারীর বিবাহের বয়স সম্পর্কে বলা যায় যে, এই সময় প্রাপ্তবয়স্কা হলে যেমন তার বিবাহ দেওয়া হত, অপ্রাপ্তবয়স্কাদেরও বিবাহের দৃষ্টান্ত রয়েছে। নারীর সতীত্বকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হত। নারদ ও পরাশর স্মৃতিতে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের অধিকার দেওয়া হয়েছে, অবশ্য মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য তা স্বীকার করেননি। পুরুষের বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। রাজ পরিবারের সদস্য ছাড়াও সম্পন্ন গৃহস্থদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল।
নারীকে সম্পত্তি বলে ভাববার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উদ্ভব ঘটে সতীদাহ-প্রথার। গ্রীক লেখকের রচনায় কোন এক ভারতীয় নারীর সতী হবার ঘটনার উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রধানত খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকেই এই প্রথা সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। ৫১০ খ্রিস্টাব্দে এরাণে (মধ্যপ্রদেশ) প্রথম সতীদাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজস্থানেও সতীদাহের বহু উল্লেখ পাওয়া গেছে। অধ্যাপক রামশরণ শর্মা গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগে সতীদাহের কিছু কারণ দেখিয়েছেন। প্রথমত, তাঁর মতে প্রথাটি উচ্চবর্ণের মধ্যে বহুল প্রচলিত ছিল নিম্নবর্ণের মধ্যে নয়, কারণ নিম্নবর্ণের মধ্যে বিধবা-বিবাহ প্রচলিত থাকায় বিধবাদের নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হত না। কিন্তু উচ্চবর্ণের বিধবা রমণীদের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ঘৃণা করতে থাকে। তাদের জন্য কঠোর জীবনযাপনের নির্দেশ দেয়। ঐ অবস্থায় বেঁচে থেকে দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ভোগ করা অপেক্ষা স্বামীর চিতায় সহমৃতা হবার বিকল্প উপায়কে বরণ করার জন্য বিধবাদের প্ররোচনা দেওয়া হত এবং তারাও এই পথ বেছে নিতেন। দ্বিতীয়ত, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষ হত সম্পত্তির অধিকারী। উত্তরাধিকার সুনিশ্চত করার জন্য পুরুষের বংশাবলী রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা ছিল। তাই নারীর ক্ষেত্রে সতীত্বের প্রশ্নটি ছিল জরুরী। বিবাহিতা নারী সর্বদা এমনকি মৃত্যুতেও পতির অনুগত থাকবেন এই ছিল সমাজের প্রত্যাশা। তাই সহমরণের পুণ্যফল সম্পর্কে নারীদের মনেও উচ্চ ধারণা গ্রোথিত করে দেওয়া হত। তারা এইভাবে আত্মোৎসর্গের মধ্যে দিয়ে স্বর্গলাভ করতে চাইতেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিধবার সম্পত্তি (স্ত্রীধন) তাদের আত্মহননে প্ররোচিত করার কারণ হয়ে দাঁড়াত।
গুপ্তযুগে নারীশিক্ষার বিষয়ে পূর্বাপেক্ষা উদারতার দৃষ্টান্ত আছে। এযুগে সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা বিদ্যাচর্চার যথেষ্ট সুযোগ পেতেন। ‘কামসূত্রে বলা হয়েছে যে, রাজকুমারী ও সম্ভ্রান্ত মহিলারা সামাজিক মর্যাদার কারণে শাস্ত্রচর্চা ও তত্ত্বমূলক আলোচনায় অভ্যস্ত ছিলেন। সাধারণ মহিলাদের জন্য শিক্ষামূলক বিষয়ের একটি তালিকাও এই গ্রন্থে আছে। এগুলি ‘অঙ্গবিদ্যা’ নামে পরিচিত। কবিতা আবৃত্তি করা, শ্লোকের পাদপূরণ করা, শব্দার্থ আয়ত্ত করা, ছন্দ ও অলঙ্কারের জ্ঞান অর্জন করা মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মনে করা হত। ধনী নাগরিকদের গৃহিণীদের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের অগ্রিম হিসেব প্রস্তুত করতে হত। তাই গণিতশাস্ত্রে তাদের শিক্ষা দান করা হত। এছাড়া সঙ্গীত, নৃত্যকলা, অঙ্কন বিদ্যা, সূচীশিল্প ইত্যাদি বিষয়ে তাদের দক্ষতা অর্জন করতে হত। গুপ্তযুগে মহিলা কবি ও লেখকের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। হর্ষচরিত, শকুন্তলা, রত্নাবলী, মালতীমাধব, উত্তর রামচরিত প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে নানাক্ষেত্র পারদর্শিনী নারীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, অনুসূয়া ইতিহাসে দক্ষ ছিলেন, নৃত্যগীত ও চিত্রাঙ্কনে অগ্রণী ছিলেন রাজ্যশ্রী, মালবিকা, সাগরিকা প্রমুখ ছিলেন দক্ষ কলাবিদ। কামন্দকী পুরুষ শিক্ষার্থীদের সাথে একত্রে বসে বহু বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন। ‘অমরকোশ’ গ্রন্থে মহিলা শিক্ষিকাদের ‘উপাধ্যায়া’ ও ‘আচার্যা’ বলা হয়েছে। ‘আচার্য’ পদাধিকারী বেদ পাঠের সাথে যুক্ত থাকতেন। তাই ধরে নেওয়া যায় যে, বেদ পাঠ সাধারণ নারীদের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হলেও, কেউ কেউ অর্থাৎ ‘আচার্যা’গণ বেদপাঠের অধিকারী ছিলেন।
মৌর্যযুগের বিবাহ রীতি :
বিবাহ বিষয়ে গুপ্তযুগে স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। তবে স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে বিবাহকালে পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বয়সের যথেষ্ট ফারাক রাখার কথা বলা হলেও, গুপ্তযুগে এই রীতি অনুসরণ হত না। পুরাণ মতে, পাত্রের বয়স পাত্রীর তিনগুণ হওয়া উচিত। কিন্তু বাৎসায়নের কামসূত্রে বলা হয়েছে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ফারাক তিন বছর হওয়া বাঞ্ছনীয়। অঙ্গিরস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে স্ত্রী স্বামীর থেকে দুই থেকে পাঁচ বছরের ছোট হওয়া উচিত। বাৎসায়ন একজায়গায় যৌবন লাভের পূর্বেই মেয়েদের বিবাহের কথা বলেছেন। তবে অন্যত্র তিনি প্রাক্-বিবাহ প্রণয় এবং বিবাহ পরবর্তী সংসার জীবনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা আগের উক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
হিউয়েন সাঙ লিখেছেন যে, সপিণ্ড ও সগোত্র বিবাহ বাঞ্ছনীয় নয়। তবে একই বর্ণের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক কাম্য নীতির দিক থেকে বাৎসায়নও সবর্ণ-বিবাহের কথা বলেছেন। অসবর্ণ বিবাহের ক্ষেত্র আগের থেকে সঙ্কুচিত হয়েছিল। প্রতিলোম বিবাহ সমর্থন করা হত না। বাৎসায়ন অনুলোম বিবাহের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট রক্ষণশীল ছিলেন। তাঁর মতে, পারিবারিক স্বার্থে অনুলোম বিবাহ এড়িয়ে চলা উচিত। তবে কেউ যদি সজ্ঞানে তা অগ্রাহ্য করে তবে তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। পাঁচজন পূর্বাচার্যের মত উল্লেখ করে বাৎসায়ন বলেছেন যে, বিবাহিতা নারী, সাধিকা, গণিকা কন্যা, বিধবা নারী বা স্বাধীন রমণী যদি স্বেচ্ছায় পুরুষ-সঙ্গে লিপ্ত হয় এবং উভয়পক্ষের সম্মতি থাকে, সেক্ষেত্রে বিষয়টিকে কঠোরভাবে ধর্মবিরোধী বলা যাবে না। সাধারণভাবে পাত্র ও কন্যাপক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে বিবাহ সম্পর্কের আয়োজন করা সেকালে গুরুত্ব পেত। পিতামাতাই পাত্রী নির্বাচন করতেন। পাত্রী নির্বাচনের সময় খুবই সাবধানী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাৎসায়ন।
পাত্রী নির্বাচনের পর চার ধরনের বিবাহকে বৈধতা দেওয়া হত—ব্রায়, প্রজাপত্য, আর্য এবং দৈববিবাহ। তবে সবাই যে শাস্ত্রের বিধান মানতেন না, তা বাৎসায়ন স্বীকার করেছেন। এমনকি, পাত্র-পাত্রীর নিজেদের মধ্যে প্রণয় দ্বারা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকেও তিনি মেনে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মেয়েদের তিনি যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পাত্রের রূপ, খ্যাতি, সম্পদ প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয়; বরং দেখা দরকার ঐ ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র সবল কিনা, সে ভালবাসার মর্যাদা দিতে আন্তরিক কিনা। এই প্রসঙ্গে বাৎসায়ন মদ্যপ, জুয়াড়ী বা বিবাহিত ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। বাৎসায়নের মতে, গান্ধর্ব বিবাহ শ্রেষ্ঠ। কারণ এতে পাত্র-পাত্রী উভয়ের ইচ্ছা মর্যাদা পায়। গান্ধর্ব বিবাহের পর আনুষ্ঠানিক বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হত। পৈশাচ ও রাক্ষস বিবাহের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন হত না। পূর্বতন শাস্ত্রকারদের থেকে বাৎসায়ন পৈশাচ বিবাহকে শ্রেষ্ঠতর মনে করেন। কারণ এই জাতীয় বিবাহে হিংসার স্থান ছিল না। তবে রাক্ষস বিবাহ আদৌ কাম্য ছিল না। গুপ্তযুগের সাহিত্যে রাজা বা নায়কদের ক্ষেত্রে গান্ধর্ব বিবাহের বহু দৃষ্টান্ত আছে। কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলা নাটকে ঋষি কন্যাদের গান্ধর্ব বিবাহের বহু উল্লেখ আছে। অন্যদিকে পিতামাতা দ্বারা সম্বন্ধ করে বিবাহও প্রচলিত ছিল। তেমন দৃষ্টান্ত হল হর্ষচরিত গ্রন্থে বর্ণিত রাজ্যশ্রীর সাথে গ্রহবর্মার বিবাহ। আবার কাদম্বরী ও মালতীমাধব নাটকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের প্রেমজ বিবাহের প্রতি বিতৃস্না প্রকাশ পেয়েছে। ‘মালতীমাধব’ নাটকে কামন্দকী বিরহ কাতরা নায়িকাকে বলছেন যে, কন্যার বিবাহ দানের অধিকার তার পিতার এবং দেবতার। ‘দশ কুমার চরিতে’ বলা হয়েছে যে, পাত্র-পাত্রীর জন্মের আগেই তাদের পিতামাতা বিবাহের সম্পর্ক স্থির করে রাখেন।
মৌর্যযুগে সম্পত্তির অধিকার :
দুটি মহাকাব্য মহাভারত ও রামায়ণ এবং পুরাণ গ্রন্থে বারবার নারী ও সম্পত্তি সুরক্ষার জন্য সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়েছে। প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রের (রাজন) উৎপত্তির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে স্ত্রী ও সম্পত্তি সংরক্ষণের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। রামায়ণে বলা হয়েছে যে, রাজাহীন রাজ্যে সম্পত্তির ওপর অধিকার রক্ষা করা যায় না এবং স্ত্রীও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মহাভারতের শান্তি পর্বেও অনুরূপ মনোভাব উল্লিখিত আছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, রাজাহীন রাজ্যে সম্পত্তি, পুত্র ও পত্নী নিরাপদ থাকে না। তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে অধ্যাপক রামশরণ শর্মা বর্ণিত কলিযুগের অমঙ্গলজনক সংকেত সম্পত্তি, পরিবার ও বর্ণব্যবস্থার সংরক্ষণের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্ষণশীল নিয়মকানুন জোরদার করা হয়।
গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগে পুরোহিত ও রাজকর্মচারীদের ব্যাপকভাবে ভূমিদান (অগ্রহার ও অন্যান্য) শুরু হলে সম্পত্তির ওপর অধিকার ও সম্পত্তি বণ্টনের রীতিনীতিতে জটিলতা দেখা দেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাচীনতম আইন গ্রন্থগুলিতে প্রধানত সম্পত্তি অর্জনের উৎস এবং সম্পত্তির ওপর নানারকম অধিকারের প্রসঙ্গে বেশি আলোচনা করা হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভ, সম্পত্তি ক্রয় এবং দানপত্র সূত্রে সম্পত্তি অর্জন করা যেত। একজন ক্ষত্রিয় যুদ্ধজয় দ্বারা সম্পত্তি অর্জন করতে পারত। একইভাবে একজন ব্রাহ্মণ তাঁর গুরুদক্ষিণা, একজন বৈশ্য কৃষিকাজ ও গবাদিপশু প্রতিপালন কিংবা একজন শূদ্র তার সেবাদানের মজুরি বাবদ সম্পদ-সম্পত্তি অর্জন করতে পারত। প্রাচীনতম আইনের পুঁথিগুলিতে সম্পত্তি হিসেবে জমির উল্লেখ পাওয়া যায় না। যাজ্ঞবল্ক্য প্রথম সম্পত্তি হিসেবে জমির উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে গুপ্তযুগে ‘কাত্যায়ন স্মৃতি ও ‘বৃহস্পতি স্মৃতিতেও ভূসম্পত্তির স্বীকৃতি আছে। তাঁরা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিভাজন ও উল্লেখ দ্বারা জমিকে সম্পত্তির অংশ হিসেবে গ্রহণ করার রীতি স্বীকার করেছেন। গৌতম, কৌটিল্য, মনু বা নারদ প্রমুখের ধর্মসূত্রে স্থাবর সম্পত্তির বা জমির প্রকৃতি বিষয়ে বিশেষ উল্লেখ নেই। এঁরা মূলত আলোচনা করেছেন সম্পত্তির ওপর অধিকার রক্ষা বা হারানোর বিষয়টিতে। আদি লেখকদের মতে, কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি দশ বছর ত্যাগ করলে, উক্ত সম্পত্তির ওপর তাঁর অধিকার হারাতেন। স্বাভাবিকভাবেই এঁদের আলোচনায় জমির অস্তিত্ব ছিল না। কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্য প্রথম সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে ধনসম্পদ ও ভূসম্পত্তির বিষয়টি পৃথকভাবে উল্লেখ করেন। লক্ষ্মণ যোশী শাস্ত্রী সম্পাদিত ধর্মকোষ গ্রন্থের ভাষ্য অনুসারে দশ বছর দাবিহীন ধনের ওপর কেউ পূর্ব অধিকার দাবি করতে পারে না। গুপ্তযুগে সম্পত্তির অধিকার রক্ষার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইতিপূর্বে সম্পত্তি হিসেবে জমির অধিকার অনেকটাই কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন তা বৃদ্ধি পায়। কাত্যায়ন সম্পত্তির অধিকার ক্ষেত্রে কুড়ি বছর দাবিহীন শর্তটিকে রাজা ও ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। জমির দাতা, কৃষক কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিস্বত্বভোগীদের হাত থেকে ব্রাক্ষ্মণ ও রাজাকে রক্ষা করার জন্য প্রচলিত বিধান থেকে তাঁদের নিষ্কৃতি দেওয়া হত। এমনকি, ধর্মসূত্রের ব্যাখ্যায় এমনও বলা হয়েছে যে, কুড়ি বছর দাবিহীন সম্পত্তির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তার উৎপাদনের অধিকার হস্তান্তরিত হতে পারে, মূল ভূমির স্বত্ব পূর্ববৎ বহাল থাকে। নারদের মতে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ শত বছরেও হারায় না, যতক্ষণ এটি স্বত্ববিহীন ভোগ করা হয়।
নারীর সামাজিক স্বাধীনতা বা অধিকারের মতোই তাদের অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়টিও অসাম্য ও পুরুষতান্ত্রিকতার আধিপত্যে সংকুচিত হয়েছিল। প্রাচীনকালের প্রচলিত ধারা অকিঞ্চিৎকর পরিবর্তন ছাড়া মধ্যযুগেও প্রায় অব্যাহতই ছিল। মনু ও যাজ্ঞবল্ক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নারীর বিশেষ অধিকার হিসেবে ‘স্ত্রীধন’ ভোগের বিধান উভয়েই স্বীকার করেন। বিবাহকালে আত্মীয় পরিজন-বন্ধুবান্ধব প্রদত্ত উপহারাদি, পিতার দান (পিতৃদত্ত), ভায়ের সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ দান (ভাতৃদত্ত) ইত্যাদির ওপর নারীর অধিকার এবং পরবর্তীকালে সেই সম্পদের ওপর অবিবাহিতা কন্যার অধিকার প্রাচীনকালে প্রচলিত ছিল।
স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর সরাসরি কোনো অধিকার ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী পতির সম্পত্তির অংশীদারিত্ব পেতেন না। তবে স্বামীর জীবদ্দশায় সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা হলে পুত্রসন্তানদের অনুরূপ পত্নীও অংশ পেতেন। স্বামীপরিত্যক্তা নারী অবশ্য স্বামীর সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পাবার অধিকারী ছিলেন। (অপুত্রক অবস্থায় স্বামী মারা গেলে, তার সম্পত্তির ওপর বিধবা পত্নীর অধিকার বর্তাত বলে যাজ্ঞবল্ক্য উল্লেখ করেছেন। মৌর্যযুগের নারীর সম্পত্তির অধিকারের হ্রাসবৃদ্ধি প্রায় ঘটেনি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও স্ত্রীধনের কথা বলা হয়েছে, যার শর্তাবলি প্রাক্-মৌর্যযুগের থেকে খুব বেশি নতুন কিছু ছিল না। গুপ্তযুগে রচিত ‘নারদস্মৃতি’, ‘কাত্যায়নস্মৃতি’ ও ‘বৃহস্পতিস্মৃতি’ সমূহে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এঁরাও প্রচলিত স্ত্রীধনের ওপর নারীর অধিকার স্বীকার করেছেন। মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য বর্ণিত ছয় প্রকার (অধ্যগ্নি, অধ্যবাহনিক, প্রীতিদত্ত, পিতৃদত্ত, মাতৃদত্ত, ভ্রাতৃদত্ত) স্ত্রীধন-এর সঙ্গে আরও তিন প্রকার সম্পত্তিকে স্ত্রীধনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এগুলি হল: শুষ্ক, অন্বাধেয় এবং সৌদায়িক।) গুপ্ত-পরবর্তী যুগের স্মৃতিকাররাও নারীর সম্পত্তি বলতে মূলত স্ত্রীধনের উল্লেখ করেছেন। মেধাতিথি’র বর্ণনা থেকে একালের নারীর সম্পত্তিগত অধিকারের কথা জানা যায়। তাঁর মতে, নারী অনূঢ়া অবস্থায়, বিবাহের সময় এবং বিবাহের পরে পিতামাতা, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যে সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও দ্রব্যসামগ্রী লাভ করে, তা সবই স্ত্রীধন হিসেবে পরিগণিত হয়। স্ত্রীধনের ওপর মূলত অনুঢ়া কন্যার অধিকার থাকে। নারী অন্যান্য সৎপথেও অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। তবে স্বামীর জীবিতাবস্থায় উক্ত সম্পদ বা সম্পত্তি বিক্রয়ের অধিকার নারীর থাকত না। এই সময় শর্তসাপেক্ষে পতির সম্পত্তিতে পত্নীর অধিকার স্বীকার করা হত। যেমন, স্বামী তার জীবদ্দশায় সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করলে স্ত্রীকে একটা অংশ দিতে পারতেন। স্বামীর মৃত্যুকালে স্ত্রী সন্তানসম্ভবা থাকলে, সেই বিধবা নারী পতির সম্পত্তির ভাগীদার হতে পারতেন। আবার কন্যা যদি ‘পুত্রিকা’ হয়, অর্থাৎ পুত্রের দায়িত্ব গ্রহণ করে পিতৃপুরুষের যাবতীয় পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে, তাহলে সে পিতার সম্পত্তির অধিকারী হবে।
মৌর্যযুগের শিক্ষা ব্যবস্থা : নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়
সমকালীন চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ এবং গুপ্তযুগে রচিত সাহিত্যে সেই যুগের শিক্ষা ব্যবস্থার একটা ধারণা পাওয়া যায়। গুপ্তযুগে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মূলত প্রাতিষ্ঠানিক। তবে পূর্ব-প্রচলিত গুরুগৃহে বসবাস করে শিক্ষালাভের ব্যবস্থাও অব্যাহত ছিল। হিউয়েন সাঙ শিক্ষাগুরুদের বিদ্যাবুদ্ধির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গুরুরা সাধারণত ব্রাহ্মণ শ্রেণীভুক্ত হতেন। চৈনিক বিবরণ মতে, সেকালে ভ্রাম্যমান গুরুদের অস্তিত্ব ছিল। এঁরা গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে এক একটি কেন্দ্রে কিছু ছাত্রকে সমবেত পাঠদান করতেন। ইৎ সিং লিখেছেন যে, ছাত্ররা নিয়মিত গুরুর ভালমন্দের দিকে নজর রাখত এবং তাদের সেবা করত। আবার গুরুও ছাত্রকে স্নেহশীল চোখে দেখতেন। সাধারণ বিদ্যালয়েও পাঠদান করা হত। কদম্বরাজ ময়ুরশর্মা কাঞ্চিতে একটি বিদ্যালয়ে (ঘটিকা) শাস্ত্র পাঠ করেছিলেন। দশকুমার চরিতে রাজপুত্রদের শিক্ষার উল্লেখ আছে। পাঠ্যসূচীর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেদ, বেদাঙ্গ, লিপি, ভাষা ইত্যাদি। এছাড়া নাট্যতত্ত্ব, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ন্যায়শাস্ত্র, সংগীত, যুদ্ধ বিদ্যা, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হত। এমন কি, চোর্যবৃত্তি, তকতা, জুয়াখেলা ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হত। রাষ্ট্রপরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে দক্ষ করে তোলার জন্য রাজপুরুষদের এসকল বিষয়ে শেখানো হত।
বৌদ্ধগ্রন্থ থেকে বিহারে পাঠগ্রহণের বিবরণ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ বিহারগুলিতে দু’ধরনের শিক্ষার্থী থাকত—(১) একদল যারা বৌদ্ধশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করে বৌদ্ধ সংঘে দীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হত। (২) আরেক দল, যারা ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়সমূহে শিক্ষাগ্রহণ করত। কিছু কিছু বৌদ্ধবিহার কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। দেশ এবং দেশের বাইরে সুখ্যাত এমন একটি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’। বর্তমান বিহার রাজ্যের অন্তর্গত রাজগীরের সন্নিকটে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। হিউয়েন সাঙ, ইৎ সিং প্রমুখের বিবরণ থেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা তথ্য পাওয়া যায়। গুপ্ত ও গুপ্ত পরবর্তী রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠেছিল। নালন্দায় যেসব রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকদের কথা হিউয়েন সাঙ লিখেছেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন গুপ্তরাজা শত্রুাদিত্য, বুধগুপ্ত, তথাগত গুপ্ত, বালাদিত্য, বজ্র এবং মধ্যভারতের একজন সাধারণ রাজা হর্ষ। কয়েক সহস্ৰ ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন যে, নালন্দার অধ্যাপকদের বিদ্যার খ্যাতি সারা ভারতবর্ষে, এমন কি ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই বহির্দেশ থেকেও বহু ছাত্র এখানে অধ্যয়নের জন্য আসতেন। কঠিন ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের গ্রহণ করা হত। নালন্দার ধ্বংসাবশেষ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাটত্ব অনুমান করা যায়। হিউয়েন সাঙের মতে নালন্দার ছাত্রসংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। কিন্তু ইৎ-সিং বলেছেন যে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ছাত্র পাঠগ্রহণ করত। হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি বড় বড় হলঘর ছিল। ইৎ সিং এই সকল হলঘর ছাড়াও তিনশোর বেশী কক্ষ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনটি গ্রন্থাগারের নাম ছিল—রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক।
প্রাথমিকভাবে নালন্দা ছিল মহাযান বৌদ্ধদর্শন চর্চার বিদ্যাপীঠ। কালক্রমে চতুর্বেদ, হেতুবিদ্যা বা তর্কশাস্ত্রে, শব্দবিদ্যা বা ব্যাকরণ, চিকিৎসাবিদ্যা, সাংখ্য, যোগ, ন্যায় ইত্যাদি নানা শাস্ত্রে পাঠদান শুরু হয়েছিল। বহু বিখ্যাত পণ্ডিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ রূপে খ্যাত ছিলেন নাগার্জুন, শীলভদ্র, জিন মিত্র, বসুবন্ধু, দিল্লাগ, ধর্মপাল, প্রভামিত্র, চন্দ্রপাল প্রমুখ। দেশ বিদেশের ছাত্ররা, বিশেষত বৌদ্ধধর্মের অনুরাগীরা, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণের জন্য আকূল হয়ে থাকতেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ করে বহু ভিক্ষু-পণ্ডিত তিব্বত, চীন প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যাত্রা করেছিলেন। এঁদের অন্যতম ছিলেন শান্তিরক্ষিত, পদ্মসম্ভব, স্থিরমতি, বুদ্ধকীর্তি, কুমারজীব, ধর্মদেব, পরমার্থ প্রমুখ। হিউয়েন সাঙ, ইৎ-সিং প্রমুখ দীর্ঘকাল ধরে নালন্দায় শিক্ষালাভ করেছেন। হিউয়েন সাঙ-এর সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন শীলভদ্র। এছাড়াও চন্দ্রকীর্তি, শান্তিদেব, শান্তিরক্ষিত আচার্য হিসেবে খ্যাতির অধিকারী ছিলেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের প্রধান উৎস ছিল রাজকীয় অনুদান। বিভিন্ন বরাদ্দীকৃত গ্রামের রাজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় পেত এবং তা থেকেই ছাত্র-শিক্ষকদের ভরণপোষণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করা হত।
Leave a comment