মৌর্যযুগে উৎপাদন-সম্পর্কের পরিবর্তন:

স্মৃতিশাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের বৈধভাবে জমি চাষ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ব্রাহ্মণরা এবং সমাজ মনে করত যে লাঙ্গল চালানো বা কৃষিকাজে দৈহিক শ্রমদান ব্রাহ্মণদের পক্ষে ধর্মবিরোধ কাজ। জমি হস্তান্তরের শর্তগুলিতেও এমন ধারণার প্রতিফলন দেখা যায়। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের ভূমি সনদগুলিতে বলা হয়েছে যে, দানগ্রহিতা অর্থাৎ ব্রাহ্মণ পুরোহিত বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জমি ভোগ করার অধিকারী, অন্যকে সে ভোগ করতে দিতে পারে, নিজে চাষ করতে পারে অথবা অন্যকে দিয়ে চাষ করাতে পারে। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন উল্লেখ করেছেন যে, মঠ ও বিহারগুলিকে ভূমিদানের সঙ্গে সঙ্গে চাষ করার জন্য কৃষক ও গবাদি পশু দান করা হত। লেখমালা থেকে স্পষ্ট যে, দানগ্রহীতারা পুরানো কৃষকদের যেমন রাখতেন, তেমনি মাঝে মাঝে নতুন কৃষক নিয়াগ করে জমি ইজারা দিতেন। অর্থাৎ কৃষক (রায়ত) উৎখাত করার রীতিও অগ্রহার জমির ক্ষেত্রে চালু ছিল।

অগ্রহার ভূমিদান ব্যবস্থার ফলে উৎপাদন সম্পর্কের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল একটি মধ্যবর্তী শ্রেণীর উদ্ভব। খ্রিষ্টীয় ৩০০ শতকের আগে জমির মালিক রাজা এবং কৃষি উৎপাদক কৃষকের মাঝে। কোন কর্তৃপক্ষ ছিল না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে কৃষি উৎপাদনের কাজে রাজা ও কৃষকের উল্লেখই পাওয়া যায়। কিন্তু অগ্রহারের ভূমিদানের ফলে রাজা ও কৃষকের মাঝে একটি নতুন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। যাজ্ঞবল্ক স্মৃতিতে বলা হয়েছে যে, রাজা কৃষককে জমি দেন না। তিনি ভূমি সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনটি স্তর বা শ্রেণীর উল্লেখ করেছেন—’মহীপতি’ (রাজা), ‘ক্ষেত্রস্বামীন্ (ভূম্যাধিকারী) এবং ‘কর্ষক’ (কৃষক)। বৃহস্পতিও এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, মহীপতি ও বাস্তবে যারা জমি চাষ করে অর্থাৎ কৃষক, তাদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করেন ‘ক্ষেত্রস্বামীন্’। এই ‘স্বামী’ বা ভূম্যাধিকারী অস্থায়ীভাবে কৃষককে জমি ইজারা দিতেন। কৃষক শ্রম দিয়ে ফসল উৎপাদন করত এবং মজুরী পেত। তবে এই জমিতে কৃষকের চাষাবাদের অধিকার সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করত ভূম্যাধিকারী ‘স্বামী’র ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর। এই ভাবে অগ্রহার দানের মাধ্যমে কৃষিতে একটি ‘মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর’ আবির্ভাব ঘটে।

অগ্রহার ভূমিদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিণাম হল জমিতে কৃষকের অধিকার বিলোপ। ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে, যারা রাজার জমি চাষ করত এবং রাজাকে ভূমিরাজস্ব প্রদান করত, তারা স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা ও বসবাসের অধিকারী ছিল। কিন্তু যারা অগ্রহার দানভুক্ত জমিতে চাষ করত এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের (স্বামী) রাজস্ব দিত, তাদের স্বাধীনতা ছিল না। যে সকল অঞ্চলে কৃষি কাজের উপযুক্ত মানুষের সংখ্যা কম ছিল সেখানে জমিদানের সাথে কৃষকদেরও হস্তান্তর করা হত। এরা দানগ্রহিতার আদেশ মান্য করতে বাধ্য ছিল। এমনকি বেগার শ্রমও দিতে হত। পুষ্করিণী, নদী-খাল, বনাঞল ইত্যাদিতে গ্রামীণ মানুষের যৌথ মালিকানা ও স্বাধীনভাবে ভোগ দখলের প্রাচীন রীতি চালু ছিল। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী বলপূর্বক এই সকল ক্ষেত্রেও মালিকানা দাবি করলে গ্রামীণ কৃষকদের দূর্দশা বৃদ্ধি পায়। গুপ্তযুগে বলপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করা (বিষ্টি) এবং জবরদস্তিমূলক অতিরিক্ত কর আদায় ব্যবস্থা কৃষকদের দুরবস্থা বাড়িয়েছিল। প্রাক্-গুপ্তযুগে কেবল দাস ও ভাড়াটে মজুরদের জোর করে খাটানো হত। কিন্তু গুপ্তযুগে সবশ্রেণীর মানুষকেই জোর করে খাটানো শুরু হয়। বাৎসায়নের কামসূত্র থেকে জানা যায় যে, কৃষক রমণীদের ঘর-গৃহস্থালির কাজে বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করা হত। এমন কি, রাজার সেনাবাহিনী যখন কোন গ্রামের মধ্য দিয়ে যেত কিংবা তাঁবু খাটাতো, তখন গ্রামের কৃষকদের বিনামূল্যে শ্রম, খাদ্য-পানীয়, দুধ ইত্যাদি যোগান দিতে হত।

ড. রামশরণ শর্মার মতে, নিষ্কর ভূমিদানের ফলে সবথেকে বেশী উপকৃত হয়েছিলেন ব্রাক্ষ্মণ শ্রেণী। ‘অগ্রহার’ দানের সূত্রে তাঁরা অর্থসম্পদের অধিকারী যেমন হয়েছিলেন, তেমনি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বিচার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও খবরদারির সুযোগ পেয়েছিলেন। অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ছোট ছোট খণ্ডে জমি দানের প্রবণতার ফলে জমির খন্ডীকরণ অনিবার্য হয়েছিল। নারদ ও বৃহস্পতি সংহিতায় এর উল্লেখ আছে। তাই গুপ্তযুগের মাঝামাঝি বড় বড় যৌথ পরিবারগুলি ভেঙে গেলে জমির খন্ডীকরণ অনিবার্য হয়। কলচুরি-চেদি বা বল্লভীর মৈত্রক বংশের আমলের লেখগুলিতে বৃহদায়তন খামারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। অথচ মৌর্যযুগের লেখতে বৃহদায়তন রাষ্ট্রীয় খামারের উল্লেখ পাওয়া যেত। স্বভাবতই উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল উপরন্তু বিপুল আকারে ভূমিদানের ফলে ভূমি রাজস্ব খাতে রাষ্ট্রের আয়ও অনিবার্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল। এইভাবে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণদের হাতে সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনিক কাজে বেসরকারী কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ, রাষ্ট্রের আয় হ্রাস ইত্যাদি ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়, যা সামন্ততন্ত্রের অনুরূপ বলে অনেকের অভিমত।

ব্রাহ্মণশ্রেণীর প্রশাসনিক ক্ষমতাবৃদ্ধি কিংবা রাজকোশের আয় হ্রাস প্রসঙ্গে অধ্যাপক শৰ্মা, বি. এন. এস. যাদব, কৃষ্ণমোহন শ্রীমানী প্রমুখের বক্তব্যের বিরোধী মতও যথেষ্ট যুক্তিসিদ্ধ। দীনেশ চন্দ্ৰ সরকার, রনবীর চক্রবর্তী প্রমুখের মতে, অগ্রহার ভূমিদানের শর্তাবলী ব্রাহ্মণ বা দানগ্রহীতার কর্মধারা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে যথেষ্ট কঠোর ছিল। আগেই দেখেছি যে, দানগ্রহীতাদের সরকারের স্বার্থ বা কর্তৃত্বের বিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়া প্রসঙ্গে যথেষ্ট কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। প্রবর সেনের আমলে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল যে, রাজার কর্তৃত্ব ও মর্যাদার বিরোধী কাজে লিপ্ত হলে দান করা জমি কেড়ে নেওয়া হবে এবং রাজদ্রোহীতার অপরাধে দায়ী হতে হবে। সুতরাং অগ্রহার দান, অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে (যখন কেবল ব্রাক্ষ্মণ বা দেবস্থান দান পেতেন) রাজার কর্তৃত্ব শিথিল করার উপযোগী ছিল না। দ্বিতীয়ত, অগ্রহার দানের সময় মূলত পতিত, অনুর্বর, জলাভূমি ব্রাহ্মণদের দান করা হত। দান গ্রহীতা সেই জমিকে চাষযোগ্য করে তুলতেন। এর ফলে নিঃসন্দেহে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সবল করেছিল। ড. চক্রবর্তী দেখিয়েছেন যে, প্রাচীন বাংলার জমি ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত আবেদন অনুযোজনের সময় ‘পুস্তপাল’ যুক্তি দেখাতেন যে, এই জাতীয় পতিত জমির হাতবদল ঘটলে রাজার কোনও আর্থিক ক্ষতি হবে না (‘এবম্বিধো‍ প্রতিকর ভূমিদানেন ন কশ্চিৎ রাজার্থ বিরোধ)। অর্থাৎ‍ ভূমিদান ব্যবস্থা প্রচলিত ভূমি-সম্পর্ক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছিল ঠিকই, তবে একইভাবে তা কৃষি অর্থনীতির প্রসারের সম্ভাবনা তৈরী করেছিল।

মৌর্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের বিকাশ :

চতুর্থ শতকের পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের বিকাশের বিষয়টি আধুনিক ইতিহাসচর্চায় গুরুত্ব পেয়েছে। মার্কসবাদী ইতিহাস চর্চায় এই বিষয়টিকে প্রথম তুলে ধরা হয়। তবে তাঁদের মূল্যায়নও একমাত্রিক নয়। ‘এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি’ হিসেবে কার্লমার্কস স্বয়ং বলেছেন যে, প্রাচীন ভারতীয় অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কৃষি ব্যবস্থা, জমিতে ব্যক্তি মালিকানার অভাব, নগরের অভাব, স্বনির্ভর গ্রাম, উপজাতীয় গোষ্ঠী মালিকানা ইত্যাদি। তাঁর মতে, এই উৎপাদন পদ্ধতি সমাজকে গতিহীন এবং রাষ্ট্রকে স্বৈরাচারী হতে সাহায্য করে। তবে মার্কসবাদী ঐতিহাসিক ডি. ডি. কোশাম্বি বা রামশরণ শর্মা এই ব্যাখ্যা এবং প্রাচীন ভারতীয় সমাজের স্থানুত্বের তত্ত্ব মানতে অস্বীকার করেছেন। তবে আদি-মধ্যযুগের সূচনা পর্বে ভারতে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে কোশাম্বি ও শর্মার বক্তব্যে সূক্ষ্ম প্রভেদ আছে। উভয়েই একমত যে, গুপ্তযুগের অন্তিম পর্বে নগরের অবক্ষয়, বাণিজ্যের গতিহীনতা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি স্পষ্ট হয়েছিল। উভয়েই একমত যে, খ্রিষ্টীয় শতকের শুরু থেকে রাজারা জমিতে তাঁদের রাজস্ব ও শাসন সংক্রান্ত অধিকার হস্তান্তর করতে শুরু করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে কোশান্তি সামন্ততান্ত্রিকতার দুটি পর্যায় নির্দিষ্ট করেছেন। প্রথম পর্যায়ে ভারতীয় রাজারা ভূসম্পত্তির রাজস্ব ও প্রশাসনের অধিকার তাঁদের অধীন রাজন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ফলে স্থানীয় শাসকরা কৃষি-অর্থনীতির পরিচালকে উন্নীত হয়েছিলেন। এই ব্যবস্থাকে কোশাম্বি ‘উপর থেকে সামন্ততন্ত্র’ বলেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ গুপ্ত আমল ও হর্ষবর্ধনের শাসনকালে ব্যাপক ভূমিদানের ফলে রাষ্ট্র ও কৃষকের মাঝে এক নতুন ভূস্বামীশ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। এই মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী কৃষকদের শোষণ করে নিজেদের শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধি করেছিলেন। এই পদ্ধতিকে কোশাম্বি ‘নিচু থেকে সামন্ততন্ত্র’ বলেছেন।

অধ্যাপক শর্মা ভারতীয় সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে এই দ্বি-স্তর বিন্যাস মেনে নেননি। তাঁর মতে ব্রাহ্মণ, মন্দির ও বিহারকে ভূমিদানের ফলেই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল। প্রাচীন লেখতে ভূমিদাস ব্যবস্থার উদ্ভবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তৃতীয় শতকের একটি পল্লব-লেখতে জনৈক ব্রাহ্মণকে ভূমিখণ্ড দানের সঙ্গে সঙ্গে উক্ত ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত চারজন কৃষককেও হস্তান্তর করা হয়েছিল। ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকেও এর সমর্থন মেলে। তিনি লিখেছেন যে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য মঠের ঘরবাড়ি তৈরীর সময় কৃষক ও গবাদি পশুর জন্যও ঘর তৈরী করা হত। মধ্যভারত, গুজরাট ও উড়িষ্যার খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে উৎকীর্ণ লেখতেও বলা আছে যে অন্যকে ভূমিদান করার পরেও ভূমির সাথে যুক্ত কৃষকরা সেই জমিতেই থেকে যেত। তবে উত্তর ভারতে কৃষকদের হস্তান্তরের কোনও তথ্য লেখ থেকে পাওয়া যায় নি। একই সঙ্গে একথাও সত্য যে, অষ্টম শতকে নগরায়ণ সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়নি, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয় নি বা মধ্যবর্তী ভূস্বামীরা রাজক্ষমতা সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে নেননি।