খ্রিষ্টীয় ৩০০ থেকে ৬০০ অব্দ পর্যন্ত ভারতের রাজনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল গুপ্তবংশীয় শাসকদের কীর্তিকলাপ। মৌর্যদের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে প্রথম বৃহত্তর সাম্রাজ্য গঠিত হয়েছিল। মৌর্য বংশের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া প্রায় ভেঙে পড়ে। অতঃপর দীর্ঘকাল ভারতের কিছু অংশে বিদেশীদের আক্রমণ ও ছোট ছোট রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বহিরাগতদের মধ্যে কুষাণবংশীয় রাজারা উত্তর-পশ্চিম ভারতকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী শাসন কায়েম করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। একই সময়ে দক্ষিণ ভারতে সাতবাহনদের নেতৃত্বে একটা আঞ্চলিক রাজ্য গঠনের সম্ভাবনাময় প্রক্রিয়া শুরু হয়েছি।। তৃতীয় শতকে উত্তর ভারতে কুষাণ বংশ এবং দক্ষিণ ভারতে সাতবাহন বংশের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি শিথিল হয়ে পড়ে। ফলে ভারতে পুনরায় রাজনৈতিক অনৈক্য ও অস্থিরতার যুগ শুরু হয়। এই সময় ভারতের নানা প্রান্তে কয়েকটি নতুন রাজবংশের উত্থান ঘটে। এই সময় গুপ্তদের নেতৃত্বে মগধকে কেন্দ্র করে পুনরায় ভারতে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এজন্য গুপ্ত সাম্রাজ্যকে ‘দ্বিতীয় মগধ সাম্রাজ্য’ বলা হয়। তবে প্রাচীন ভারতবর্ষে গড়ে ওঠা এই দুটি সাম্রাজ্যের প্রকৃতিতে কিছু প্রভেদ ছিল। আয়তনে মৌর্য সাম্রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক বৃহদাকার ছিল। দক্ষিণ ভারতে গুপ্তদের কার্যত কোন কর্তৃত্ব ছিল না। মধ্যভারত ও দাক্ষিণাত্যের একাংশে বকাটক বংশীয় শাসকদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় ছিল। খ্রিষ্টীয় ৩০০ থেকে ৬০০ অব্দকে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক ‘গুপ্ত বকাটক পর্ব’ হিসেবে নামাঙ্কিতকরণকে বকাটকদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তির নিদর্শন হিসেবে দেখা যেতে পারে। মৌর্য রাজাদের আমলে ভারতে কেন্দ্রীভূত শাসন কায়েম করার যে কার্যকরী প্রয়াস ছিল, গুপ্তদের আমলে তা দেখা যায় না। তবে রাজনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি মননশীল চর্চার অভূতপূর্ব বিকাশের কাল হিসেবে গুপ্ত শাসনকাল স্মরণীয় হয়ে আছে। ধ্রুপদী সংস্কৃতি (বা মার্গ রীতি)র বিকাশ এবং হিন্দু পুনর্জাগরণের কাল হিসেবেও গুপ্ত শাসনকাল চিহ্নিত হয়।

গুপ্ত সাম্রাজ্য :

গুপ্তযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদান মৌর্য যুগের তুলনায় অনেক বেশী এবং বিচিত্র। এদের অন্যতম হল লেখমালা, মুদ্রা ও সাহিত্যসম্ভার। গুপ্তশাসনকাল সম্পর্কিত লেখর সংখ্যা পায় অর্ধশত। এদের মধ্যে সাতাশটি পাহাড় গাত্রে স্তম্ভের ওপর বা মূর্তির গায়ে উৎকীর্ণ আছে। রাজকীয় প্রশস্তিগুলি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। (সমুদ্রগুপ্তের দু’টি এবং স্কন্দগুপ্তের দু’টি প্রশস্তি ইতিহাসের সূত্র হিসেবে বিশেষত্বের দাবি রাখে) এছাড়া পাওয়া গেছে অসংখ্য তাম্রশাসন। দানপত্র ও রাজকীয় নির্দেশনামা সম্বলিত এই সকল প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সমকালীন ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে স্বীকৃত। জৈনকবি রবিকীর্তি বিরচিত সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলেখ (প্রশস্তি) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কাব্যছন্দ্যে রচিত এই প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের যুদ্ধাভিযান এবং সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির সাথে গুপ্তদের সম্পর্ক বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যে সমুদ্রগুপ্তের স্বতন্ত্র্য বিস্তার নীতির কার্যকারণের আভাস একমাত্র এই লেখ থেকে জানা সম্ভব হয়। এছাড়া তাঁর আমলে খোদিত এরান, নালন্দা ও গয়া লেখ থেকেও বহু তথ্য পাওয়া যায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল সম্পর্কিত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল এরান স্তম্ভলেখ এবং দিল্লীর কুতুব মিনারের নিকট স্থাপিত জনৈক ‘চন্দ্ৰ’ রাজার মেহেরৌলি লৌহস্তম্ভ। তবে লৌহস্তম্ভের ‘চন্দ্র’ রাজার সনাক্তকরণের বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। রাজা প্রথম কুমারগুপ্তের আমলে উৎকীর্ণ চৌদ্দটি লেখ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে মান্দাসোর লেখ, তৃতীয় উদয়পুর গুহালেখ এবং দুটি দামোদরপুর স্তম্ভলেখ ঐতিহাসিক উপাদানে সমৃদ্ধ। স্কন্দগুপ্তের একাধিক লেখর মধ্যে জুনাগড় (সুরাষ্ট্র) শিলালেখ এবং ভিটরি স্তম্ভলেখ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বুধগুপ্তের আটটি লেখর মধ্যে পাহাড়পুর তাম্রলেখ (রাজশাহী), রাজঘাট স্তম্ভলেখ (বেনারস) গুরুত্বপূর্ণ। দামোদরপুর তাম্রলেখ এবং এরান স্তম্ভলেখ দুটিও গুপ্তবংশের ইতিহাস পুনর্গঠনে বিশেষ উপযোগী।

গুপ্ত রাজাদের সমসাময়িক ছোট ছোট রাজ্যগুলির শাসকগণ প্রচারিত লেখমালা থেকেও গুপ্ত শাসনকালের নানা তথ্য পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বকাটক বংশের দ্বিতীয় রুদ্রসেনের ‘নাগপুর লেখ’, কদম্ববংশীয় রাজার ‘তালগুণ্ডা লেখ’ স্মরণীয়। মালবের বর্মনবংশীয় লেখগুলিতে গুপ্ত রাজাদের সার্বভৌম ক্ষমতা কোন স্বীকৃতি নেই। এথেকে অনুমিত হয় যে, বর্মন বংশের ক্ষমতায় উত্তরণ পর্বে গুপ্তবংশের গরিমা অবক্ষয়মুখী হয়েছিল। একইভাবে হূনরাজা তোরমান ও মিহিরকুলের দুটি লেখ যথাক্রমে ‘এরান লেখ’ ও ‘গোয়ালিয়র লেখ’ এবং যশোধর্মনের মান্দাসোর লেখ পতনোন্মুখ গুপ্ত শাসনকালের তথ্যসূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

গুপ্ত আমলে জারী করা অসংখ্য ‘তাম্রপত্র’ পাওয়া গেছে। এগুলি মূলত রাজকীয় অনুশাসন এবং ভূমিদান সম্পর্কিত। ধর্মস্থান কিংবা ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে রাজা এবং পরবর্তীকালে ধনী ব্যক্তিগণ কর্তৃক জমিদান, গ্রহিতার নাম, দাতার নাম, জমির পরিমাপ ইত্যাদি বিষয়ে এই সকল তাম্রপত্রে উল্লেখিত আছে। গুপ্তযুগে ভূমি বন্দোবস্ত, ভূমি সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে এগুলি তথ্য সরবরাহ করে।

নিঃসন্দেহে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের একটি নির্ভরযোগ্য উপাদান হল মুদ্রা। গুপ্তযুগের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত আরো বেশী সত্য, কারণ গুপ্ত রাজারা অসংখ্য মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। সোনা, রূপা ও তামা তিন প্রকার ধাতুতেই গুপ্তরা মুদ্রা চালু করেছিলেন। গুপ্তরাজারা বিপুল সংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন। সম্ভবত রোম-ভারত বাণিজ্যের সূত্রে গুপ্তরা রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশ অর্থাৎ চীনদেশ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে সোনার যোগান পেতেন। এছাড়া দক্ষিণ ভারতের স্বর্ণখনি থেকেও তাঁরা সোনা সংগ্রহ করতেন। কুষাণদের স্বর্ণমুদ্রার তুলনায় গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা কিছুটা স্বতন্ত্র ছিল। স্বর্ণমুদ্রায় ধাতুর পরিমাণ ক্রমশ কম হয়েছিল। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও তাঁর পূর্বসূরীদের মুদ্রায় সোনার পরিমাণ ছিল ৮০ শতাংশ। নরসিংহ গুপ্তর আমলে তা কমে হয়েছিল ৭০-৭১ শতাংশ। আবার শেষ গুপ্তরাজা বিষ্ণুগুপ্তর মুদ্রায় তা কমে হয়েছিল মাত্র ৪৩ শতাংশ। মুদ্রায় সোনার এই ক্রম-হ্রাসমান চিত্র গুপ্তরাজাদের অর্থনৈতিক অবনতির ইঙ্গিত দেয়। গুপ্তদের মুদ্রায় একপিঠে থাকত নানারকম নক্‌শা। রাজার তীরন্দাজ মূর্তি, রাজা-রাণীর যৌথ প্রতিকৃতি, অশ্বমেধের চিত্র ইত্যাদি। অন্য পিঠে থাকত সিংহাসন, সিংহ, পদ্ম ইত্যাদির ওপর উপবিষ্ঠা বা দণ্ডায়মানা দেবীমূর্তি। গুপ্তরাজাদের প্রায় একুশ রকমের নক্শা সম্বলিত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, বাংলাদেশ সহ পূর্বভারত, মধ্যদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে গুপ্তদের স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে।

গুপ্তরাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রথম রৌপ্যমুদ্রা প্রচলন করেন। কুমারগুপ্ত থেকে বুধগুপ্তর আমল পর্যন্ত সেই ধারা প্রচলিত ছিল। গুপ্তদের রৌপ্য মুদ্রাগুলি তারিখ সম্বলিত ছিল। তাই ইতিহাসের সূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলির ওজন, নক্শা ইত্যাদি পশ্চিম ভারতের শক-শাসকদের অনুরূপ ছিল। মুদ্রাগুলিতে রাজাদের উপাধি যেমন, মহারাজাধিরাজ, রাজাধিরাজ, পরমভাগবত ইত্যাদি খোদিত থাকত। গুপ্তদের তাম্রমুদ্রার সংখ্যা খুব কম। প্রাচীন পাটলিপুত্রে সমুদ্রগুপ্তের, রাজগীরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের, এরানপ্রদেশ ও ভিসা অঞ্চলে রামগুপ্তের এবং অহিচ্ছত্র অঞ্চলে প্রথম কুমারগুপ্তের কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রার সাক্ষ্য থেকে গুপ্তযুগের অর্থনৈতিক অবস্থা, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারণা এবং ধর্মভাবনার আভাস পাওয়া যায়।

লেখমালা ও মুদ্রার পাশাপাশি সাহিত্যগত উপাদান ও গুপ্তযুগের ইতিহাসে তথ্যসূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে প্রথমে উল্লেখ করা যায় পুরাণসমূহের নাম। অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে বায়ুপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, মৎসপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পুরাণগুলি থেকে বিভিন্ন রাজবংশের নাম, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমানা, সমকালীন অন্যান্য আঞ্চলিক রাজবংশ ও রাজাদের নাম পাওয়া যায়। নাগ, বকাটক, শক প্রভৃতি সমকালীন রাজ বংশগুলির বিভিন্ন তথ্য পুরাণ থেকে সংগ্রহ করা যায়। পুরাণ গ্রন্থের ইতিহাসগত মূল্য সম্পর্কে পণ্ডিতদের দ্বিধা অবশ্যই আছে। এর বহু কাহিনী প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। রূপকথা ও ইতিহাস এখানে একাকার হয়ে আছে। তথাপি সাবধানতার সাথে গ্রহণ করলে পুরাণের সাক্ষ্য গুপ্তযুগের ইতিহাস পুননির্মাণে যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে।

গুপ্তরাজাদের শাসনপর্বে বহু স্মৃতিশাস্ত্র সংকলিত হয়েছিল। এদের মধ্যে ব্যাস, হারিত, পুলস্ত্য প্রমুখের স্মৃতিগ্রন্থগুলি গুপ্তযুগের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। বজ্জিকা নাম্নী জনৈকা রমণী ‘কৌমুদি মহোৎসব’ নামে একটি পঞ্চাঙ্ক নাটক রচনা (৩৪০ খ্রিস্টাব্দ) করেছিলেন। এই নাটকে বলা হয়েছে। যে, অপুত্রক মগধরাজ সুন্দরবর্মন জনৈক চন্দ্রসেনকে দত্তক পুত্র রূপে গ্রহণ করেছিলেন। লিচ্ছবি রাজকুমারীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। পরে রাজার একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিলে, তাকেই উত্তরাধিকার করার উদ্যোগ শুরু হয়। তখন চন্দ্রসেন রাজাকে হত্যা করে মগধের সিংহাসন দখল করেন। এই রাজা চন্দ্রসেনকে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত বলে সনাক্ত করা হয়। কিন্তু এই নাটকে পরবর্তীকালের কিছু রচনার মিল দেখা যায়। বানভট্টের রচনার প্রভাবও এতে স্পষ্ট। তাই মনে করা হয় যে ‘কৌমুদি মহোৎসব’ নাটকের রচনাকাল ৭০০ খ্রিস্টাব্দের আগে নয়। স্বভাবতই এর ইতিহাসগত মূল্য কিঞ্চিৎ। বিশাখদত্ত বিরচিত সংস্কৃত নাটক ‘দেবীচন্দ্রগুপ্তম’ থেকেও গুপ্তযুগের তথ্যসূত্র পাওয়া যায়। এই নাটকের বিষয়বস্তু হল যে, সমুদ্রগুপ্তের অন্যতম পুত্র রামগুপ্ত সিংহাসনে বসার পর শক্রদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিজপত্নী ধ্রুবদেবীকে শক্‌দের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। রামগুপ্তের এই আচরণে তাঁর ভ্রাতা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি ছদ্মবেশে শক রাজার কাছে যান এবং তাঁকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেন। এই সাহসিকতার জন্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অন্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি পরে রামগুপ্তকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসেন এবং ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করেন। তবে এই কাহিনীর সত্যতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ রামগুপ্তের নাম গুপ্তদের বংশ তালিকায় পাওয়া যায় না। ড. রায়চৌধুরী মনে করেন, সেকালে বিধবা বিবাহ বৈধ ছিল না। তাই সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক ধ্রুবদেবীকে বিবাহের কাহিনী ছিল কল্পনাপ্রসূত। বিশাখদত্তের অপর নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’ থেকেও গুপ্তকালীন ভারতীয় জনগোষ্ঠীগুলির পরিচয় পাওয়া যায়। এটি মৌর্য রাজবংশের ক্ষমতালাভ বিষয়ক নাটক হলেও, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়কালের বিভিন্ন জনজাতি কিরাত, গান্ধার, কম্বোজ, এবং শক্, যবন, মগ ইত্যাদিদের বিবরণ এতে পাওয়া যায়।

কামন্দকের ‘নীতিসার’ গ্রন্থটি গুপ্তদের সমকালীন বলে মনে করা হয়। কৌটিল্যের অন্যতম অনুগামী কামন্দক তাঁর গ্রন্থে গুপ্তদের রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। বানভট্ট এবং আলবেরুণীর রচনা থেকেও গুপ্তদের সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়া চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন, হিউয়েন -সাঙ, ই-ৎসিং প্রমুখের বিবরণীও গুপ্তযুগ সম্পর্কে, বিক্ষিপ্তভাবে হলেও, নানা তথ্য দেয়।

গুপ্তদের বংশ পরিচয় ও আদি নিবাস :

উপাদানের প্রাচুর্য সত্ত্বেও ঐতিহাসিকরা গুপ্তবংশের উৎপত্তি সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে উপস্থিত হতে পারেননি। শুঙ্গ ও সাতবাহন আমলে একাধিক গুপ্তনামীয় শাসকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এরা গুপ্তরাজবংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গুপ্তগণ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্য—কোন্ বর্ণের লোক ছিলেন সে সম্পর্কেও মতভেদ আছে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার বিবাহ হয়েছিল ব্রাহ্মণবংশীয় বকাটকরাজ রুদ্রসেনের সাথে। এ থেকে অনেকে মনে করেন যে, গুপ্তগণও ব্রাহ্মণ ছিলেন। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী এই মত সমর্থন করেন। ডয়েলের মতে, গুপ্তরা কোন এক অভিজাত বংশীয় মানুষ ছিলেন। ড রোমিলা থাপার মনে করেন যে, গুপ্তরা ধনী ভূস্বামী ছিলেন এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আবার রমেশচন্দ্র মজুমদার গুপ্তদের ক্ষত্রিয় বংশজাত বলে মত দিয়েছেন। গুপ্তদের সঙ্গে লিচ্ছবী ও নাগ এই দুই ক্ষত্রিয় বংশেরও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তাই গুপ্তরা ক্ষত্রিয় ছিলেন না, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। পি. এল. গুপ্তের মতে, গুপ্তগণ ছিলেন বৈশ্য। কারণ প্রভাবতী গুপ্তা নিজেকে ধারণগোত্র সম্ভূতা বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও তাঁর স্বামী রুদ্রসেনের গোত্র ছিল বিষুবৃদ্ধ। সেক্ষেত্রে ধারণ নিশ্চয় প্রভাবতী গুপ্তার পিতৃকুলের গোত্র। পাঞ্জাবের জাটগণের মধ্যে বহুল প্রচলিত ধারী গোত্রই ধারণের পরিবর্তিত রূপ বলে মনে করা হয়। সুতরাং গুপ্তগণ ছিলেন জাট এবং স্মৃতিশাস্ত্র অনুযায়ী জাটগণ বৈশ্যবর্ণের থেকে পৃথক নয়। তাছাড়া ব্যাকরণবিদ্ চন্দ্রগোমিনের তথ্যের উপর নির্ভর করে ড. কে. পি. জয়সোয়ালও এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, গুপ্তরা পাঞ্জাবের জাট সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। তবে এক্ষেত্রে পাঞ্জাব গুপ্তদের আদি নিবাস হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এমন কোন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি, যার ভিত্তিতে পাঞ্জাবকে গুপ্তদের আদি বাসস্থান বলা যেতে পারে। যাই হোক্, গুপ্তরা বৈশ্য ছিলেন, এই মতই বেশিরভাগ পণ্ডিত সমর্থন করেন।

বংশ-পরিচয়ের মতই গুপ্তদের আদি বাসস্থান নির্ণয় করাও কঠিন। ড. জয়সোয়ালের মতে, গুপ্তগণ নাগ রাজাদের সামন্ত হিসেবে প্রয়াগ অঞ্চলে বাস করতেন। পরে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পুরাণ প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে আলতেকর-সহ অনেক পণ্ডিত মনে করতেন যে, মগধ ছিল গুপ্তদের আদি বাসস্থান। কিন্তু মগধে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের কোন মুদ্রা পাওয়া না-যাওয়ায় মতটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। গুপ্তদের আদি বাসস্থান নির্ণয় প্রসঙ্গে চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ সিং-এর বিবরণে কিছু তথ্য প্রদত্ত হয়েছে। ইৎ সিং বলেছেন ‘চি-লি-কি-টো’ নামক একজন রাজা চৈনিক তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন ও মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য ২৪টি গ্রাম দান করেন। ঐ মন্দিরটি মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো নামক পবিত্র স্থানের কাছাকাছি কোন স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল, যে মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো আবার নালন্দার ৪০ যোজন পূর্বে গঙ্গাতীরে অবস্থিত ছিল। ইৎ-সিং-এর মতে, মন্দিরটি নির্মিত হয় তাঁর ভারতে আগমনের (৬৭১-৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ) ৫০০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৭১ খ্রিস্টাব্দ নাগদ। এ্যালান এই ‘চি-লি-কি-টো’ কে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পিতামহ ও গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুপ্তের সাথে সনাক্ত করেছেন। কিন্তু এই সনাক্তিকরণের ক্ষেত্রে অসুবিধা এই যে শ্রীগুপ্তের রাজত্বকাল ছিল ঐ মন্দির প্রতিষ্ঠার বৎসর থেকে অনেক পরবর্তীকালীন। অবশ্য ইৎ-সিং ছিলেন বিদেশী এবং তিনি জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে ঐ তারিখের উল্লেখ করেছেন। তাই সাল তারিখের এই অসঙ্গতি অস্বাভাবিক নয়।

ইৎ-সিং বর্ণিত মন্দির এবং মিলি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো নামক স্থান শ্রীগুপ্তের রাজ্যের মধ্যেই অবস্থিত ছিল মনে করা যায়। তাই মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নোর অবস্থান নির্ণয় করতে পারলেই জানা যাবে যে, গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুপ্ত কোন্ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন ও স্বাভাবিকভাবেই সেটাই হবে গুপ্তদের আদি নিবাস। স্থানটির অবস্থান নির্ণয় সম্পর্কে পণ্ডিতগণ একমত নন। একটি মত অনুযায়ী এই মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো হল মৃগশিখাবন, যা অবস্থিত মুর্শিদাবাদে। ডি. সি. গাঙ্গুলী এই মতের সমর্থক। কারণ নালন্দা থেকে গঙ্গার তীর ধরে ৪০ যোজন অর্থাৎ‍ ২৪০ মাইল অগ্রসর হলে মুর্শিদাবাদে পৌঁছান যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদারও মনে করেন যে, ঐ স্থান বাংলাতেই অবস্থিত ছিল তবে মুর্শিদাবাদে অর্থাৎ রাঢ় অঞ্চলে নয়, বরেন্দ্রভূমিতে। তিনি মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে এটি হল কেমব্রিজে রক্ষিত পাণ্ডুলিপিতে অঙ্কিত বরেন্দ্রীর মৃগস্থাপনা স্তূপ। আবার সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের মতে, গুপ্তদের আদি নিবাস ছিল মালদায়। তাঁর মতে, নালন্দা থেকে ২৪০ মাইল পূর্বে অগ্রসর হলে মালদায় আসা যায়। দ্বিতীয় মত অনুযায়ী গুপ্তদের আদি নিবাস ছিল উত্তরপ্রদেশের সারনাথ ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে। এই মতের সমর্থকগণ ইৎ সিং-এর বর্ণনার যে অনুবাদ অনুসরণ করেছেন, তাতে, উক্ত স্থানটি নালন্দার ৪০ যোজন পূর্বে অবস্থিত ছিল, এমন কিছু বলা নেই। এঁদের মতে, স্থানটি ছিল নালন্দার পশ্চিমে অবস্থিত বৌদ্ধদের তীর্থস্থান মৃগদাব অর্থাৎ সারনাথ। পুরাণ থেকেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। বায়ুপুরাণে বলা হয়েছে গুপ্তবংশের রাজারা গঙ্গাতীরবর্তী প্রয়াগ (এলাহাবাদ) সাকেত (অযোধ্যা) ও মগধ (দক্ষিণ বিহার) অঞ্চল শাসন করতেন। কোন কোন পণ্ডিতের মতে, অবশ্য এই রাজ্যসীমা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ড. গয়ালের মতেও গুপ্তদের আদি বাসস্থান ছিল এলাহাবাদ অঞ্চল। কারণ সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিসহ গুপ্তদের বহু লেখরই প্রাপ্তিস্থান হল উত্তরপ্রদেশ। তাছাড়া এখানেই তাদের স্বর্ণমুদ্রার ১৪টি ভাণ্ডার পাওয়া গেছে। এইসব তথ্য প্রমাণ সত্ত্বেও গুপ্তদের আদি বাসস্থান ঠিক কোথায় ছিল তা এখনো সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি।

গুপ্তবংশের উত্থানের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি :

কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তর ভারতে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছিল। এদের মধ্যে অনেকগুলি রাজতান্ত্রিক ও কিছু ছিল প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য। তুলনামূলকভাবে প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলি ছিল দুর্বল। রাজতান্ত্রিক রাজ্যগুলির মধ্যে নাগ ও বাকাটক রাজ্য ছিল শক্তিশালী। এছাড়া ছিল অযোধ্যা, কৌশাম্বী, অহিচ্ছত্র প্রভৃতি রাজ্য। নাগগণ, মথুরা, পদ্মাবতী, বিদিশা প্রভৃতি অঞ্চলে রাজত্ব করত। নাগ রাজাদের মধ্যে ভোগী, সদাচন্দ্র, ভবনাগ প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। নাগেদের সাথে সমুদ্রগুপ্তের যুদ্ধ ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা জানা যায়। বকাটক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন বিন্ধ্যশক্তি। তিনি নিজেকে ইন্দ্র ও বরুণের সাথে তুলনা করেছেন। কথিত আছে বাকাটকরাজ প্রবর সেন একাধিক রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ও সম্রাট উপাধি নেন। বাকাটক ও নাগগণ পরস্পরের উপর নির্ভর করে শক্তিবৃদ্ধি করেছিল। বাকাটকদের সাথে গুপ্তদের বন্ধুত্ব সম্পর্ক দীর্ঘকাল বজায় ছিল। মুদ্রা থেকে অহিচ্ছত্র, অযোধ্যা, কৌশাম্বী প্রভৃতি রাজ্যের রাজাদের নাম জানা যায়। যেমন, অহিচ্ছত্রের রাজা ছিলেন সূর্যমিত্র, অগ্নিমিত্র, ফাল্গুনীমিত্র প্রমুখ, নিদেব ও বিশাখদেব ছিলেন অযোধ্যার রাজা। এই সকল রাজ্যে কয়েকজন শক্তিশালী রাজার উত্থান ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে রাজ্যগুলি ছিল ক্ষুদ্র ও দুর্বল।

প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল মালব রাজ্য। আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের সময়ে মালবরাজ্য যথেষ্ট সংহত ছিল। রাজস্থানের অন্তর্গত জয়পুরের নিকটবর্তী মালব নগর ছিল এদের রাজধানী। শকদের বিরুদ্ধে মালবরাজ্য যুদ্ধ করেছিল বলে জানা যায়। ভরতপুর ও আলোয়ার অঞ্চলে স্থাপিত অর্জুনায়ণ রাজ্য শকদের কাছে পরাজিত হলেও পরবর্তী দীর্ঘকাল এরা নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল। এ ছাড়া কাবুল অঞ্চলের কুলাত রাজ্য, যমুনা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে কুনিদ রাজ্যও প্রজাতন্ত্র শাসিত ছিল। পরে এগুলি গুপ্তদের অধীনস্থ হয়ে যায়।

গুপ্তাব্দ : প্রাচীন ভারতের বিক্রম-সম্বৎ, শকাব্দ প্রভৃতির মতই আর একটি অব্দ প্রচলিত ছিল, এটি হল গুপ্তাব্দ। জুনাগড় লেখতে উল্লেখিত ‘গুপ্ত প্রকাল’ ও ‘গুপ্তানাং কাল’ শব্দটি থেকে বোঝা যায় যে, গুপ্তগণ একটি অব্দের প্রচলন করেছিলেন। আলবিরুণীও গুপ্তাব্দের উল্লেখ করেছেন। এখন প্রশ্ন গুপ্তাব্দের সূচনা হয়েছিল কত খ্রিস্টাব্দে এবং কোন্ গুপ্ত সম্রাট এটির প্রচলন করেছিলেন। জানা যায় যে, শকাব্দের ২৪১ বছর পর থেকে গুপ্তাব্দের গণনা শুরু হয়েছিল। সুতরাং গুপ্তাব্দের গণনা শুরু হয়েছিল ৭৮ + ২৪১ = ৩১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে। মথুরা স্তম্ভলেখ উৎকীর্ণ হয়েছিল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বের পঞ্চম বর্ষে, ৬১ গুপ্তাব্দে। অর্থাৎ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত রাজত্ব শুরু করেন ৫৬ গুপ্তাব্দে। সুতরাং প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসনারোহণের সময় থেকে গুপ্তাব্দের সূচনা হয়েছিল বলে মনে করা যায়। তবে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত নিজে এই অব্দের প্রচলন নাও করতে পারেন। কারণ অব্দ প্রচলন ও সেই অব্দ অনুযায়ী শিলালেখতে বিভিন্ন ঘটনার তারিখ উল্লেখকরণের প্রথাটি অভারতীয় শক ও কুষাণদের মধ্যেই অধিক প্রচলিত ছিল। হয়ত তাদের সংস্পর্শে এসে সমুদ্রগুপ্ত বা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ঐ অব্দ প্রচলিত করেছিলেন এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যলাভের সময়টিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এর গণনা শুরু করেছিলেন তাঁদের পূর্ববর্তী সময় থেকে বা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন লাভের বৎসর থেকে।

গুপ্তবংশের রাজনৈতিক উত্থান :

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের শেষ দিকে ভারতের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি গুপ্তদের রাজনৈতিক উত্থানের প্রেক্ষাপট গড়ে দিয়েছিল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ তখনও সাসানীয় বংশের শাসনাধীন ছিল। দাক্ষিণাত্যে বাকাটক বংশের নেতৃত্বে শক্তিশালী রাজতন্ত্র =প্রতিষ্ঠার কাজ চলছিল। দুটি রাজ্যই সীমিত শক্তি ও সম্পদের অধিকারী হওয়ায় বৃহত্তর ভারতে রাজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা করেনি। অন্যদিকে উত্তর-গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে অনেকগুলি ছোট ছোট রাজতান্ত্রিক রাজ্য ছিল। এদের উত্তরে ছিল নেপাল। অন্য তিনদিকে পরিবেষ্টন করেছিল কয়েকটি দূর্বল প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য। গাঙ্গেয় উপত্যকার নিম্নাংশ অর্থাৎ মগধ ছিল মুরুণ্ডদের অধিকারে। এদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য গঠনে নেতৃত্ব দেওয়া অবস্থানগত (ভৌগোলিক) বা সীমিত শক্তির কারণে সম্ভব ছিল না। সেই সুযোগ ছিল ‘অন্তর্বেদী’ এলাকায় (প্রয়াগ, মথুরা, অযোধ্যা ও বেনারসের মধ্যবর্তী অঞ্চল) বসবাসকারী গুপ্তবংশের সামনে। অধ্যাপক এস. আর. গয়ালের মতে, আনুসাঙ্গিক কিছু কারণ গুপ্তদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজ সম্ভাবনাময় করেছিল। ড. গয়াল মনে করেন যে, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি প্রতিবাদী ধর্মমতের উত্থান ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সামাজিক মর্যাদা ও কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন করেছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। প্রতিবাদী ধর্মমতগুলির পৃষ্ঠপোষক বহিরাগত শাসকদের আধিপত্যের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থানের এই চাহিদার পেছনে জাতীয়তাবাদী মনোভাব সক্রিয় ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্তরা সেই পুনরুত্থানের কাজে নেতৃত্ব দেন। ড. গয়াল মৌর্য শাসনব্যবস্থার চরিত্র ব্যাখ্যা করে তাঁর অভিমতকে যুক্তিসিদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, মৌর্য শাসন ও শিল্প কাঠামো ছিল ভীষণভাবে বিদেশী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু গুপ্ত শাসনব্যবস্থা ও সংস্কৃতি ছিল মূলত ভারতীয়। গুপ্তদের শাসনব্যবস্থায় হিন্দু রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রাধান্য দেখা যায়। তাদের শিল্প-স্থাপত্যেও ভারতীয় ঐতিহ্য অনুকরণের প্রয়াস স্পষ্ট। গুপ্তযুগে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে ব্রাহ্মণদের বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃত ছিল। মনুস্মৃতি এবং কামন্দকের নীতিসার গ্রন্থে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ব্রাহ্মণদের আইন, বিচার ও প্রশাসনে অগ্রণী ভূমিকা প্রদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ড. পি. এল. গুপ্ত সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে গুপ্তদের সাম্রাজ্য গঠন প্রয়াসের সাফল্য ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের শেষদিকে ভারতের তিনটি অংশে তিনটি শক্তিশালী শক্তির উত্থান ঘটেছিল। পশ্চিম ভারতে নাগবংশ, দাক্ষিণাত্যে বাকাটক গণ এবং পূর্ব-ভারতে গুপ্তবংশ। নাগ এবং বাকাটকগণ পরস্পরের সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে নিজ নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধি করছিল। অন্যদিকে বাকাটকদের সাথে গুপ্তদের ছিল মিত্রতার সম্পর্ক। ফলে গুপ্তদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের পথে অন্য দুটি শক্তি বাধা সৃষ্টি করেনি। নাগ ও বাকাটকরা তাদের সাফল্য দীর্ঘকাল ধরে রাখতে পারেনি। স্বভাবতই ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গুপ্তদের উত্থান সম্ভব হয়েছিল।

বিষ্ণুপুরাণ, পুনা তাম্রপত্র এবং ঋদ্ধিপুরা তাম্রপত্র থেকে জানা যায় যে, প্রথম তিনজন গুপ্তশাসক ছিলেন জনৈক গুপ্ত (শ্রীগুপ্ত), ঘটোৎকচগুপ্ত এবং প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। পুনা তাম্রপত্রে শ্রীগুপ্তকে গুপ্তবংশের ‘আদিরাজা’ বলা হয়েছে। ড. মজুমদারও মনে করেন যে চৈনিক পর্যটক ইৎ-সিং যে গুপ্ত রাজার উল্লেখ করেছেন তিনি এবং শ্রীগুপ্ত অভিন্ন ব্যক্তি। তবে প্রথম দু’জন ‘মহারাজা’ উপাধি নিয়েছিলেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের উপাধি ছিল ‘মহারাজাধিরাজ’। তাই অনেকে মনে করেন যে, প্রথম দু’জন গুপ্তশাসক সম্পূর্ণ স্বাধীন শাসক ছিলেন না। সম্ভবত এঁরা কারো সামন্ত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু এই মতের সত্যতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ সেকালে বহু স্বাধীন শাসক ‘মহারাজা’ উপাধি গ্রহণ করতেন। তাছাড়া এঁরা কাদের সামন্ত ছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। যাইহোক, স্বাধীন হলেও প্রথম দুই গুপ্তরাজা ছিলেন খুবই সাধারণ। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমল থেকেই গুপ্ত রাজবংশের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল।

প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (আনুঃ ৩১৯/২০-৩৩৫ খ্রিঃ) :

ঘটোৎকচ গুপ্তের পুত্র ও উত্তরাধিকারী প্রথম চন্দ্রগুপ্তকে গুপ্তবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দেওয়া যায়। তাঁর বংশধরদের লেখ থেকে জানা যায় যে, তিনি ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি নেন। তিনি স্বর্ণমুদ্রারও প্রচলন করেছিলেন। এসব কিছুই তাঁর ক্ষমতাবৃদ্ধিকে সূচিত করে। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল লিচ্ছবী বংশের সাথে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। লিচ্ছবী রাজকন্যা কুমারদেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। স্বর্ণমুদ্রা থেকে এই বিবাহ সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। মুদ্রাগুলির একদিকে রয়েছে চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর প্রতিকৃতি ও না। অপর পিঠে রয়েছে সিংহবাহিনী এক দেবীমূর্তি ও ‘লিচ্ছবয়ঃ’ শব্দটি। তাছাড়া সমুদ্রগুপ্ত বিভিন্ন লেখতে নিজেকে “লিচ্ছবী দৌহিত্র’বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অপর কোন গুপ্ত শাসকের ক্ষেত্রেই তাদের মাতৃবংশের নামোল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং এই বিবাহ সম্পর্কের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। এই গুরুত্বকে দুভাবে বিচার করা যায়। স্মিথের মতে, আলোচ্য বিবাহ সম্পর্কের মাধ্যমে চন্দ্রগুপ্ত মগধ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নিজের রাজনৈতিক অধিকারকে সুদৃঢ় করেন। এ্যালানের মতে, প্রাচীন ও বিখ্যাত লিচ্ছবী বংশের সাথে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের দ্বারা চন্দ্রগুপ্ত গুপ্তবংশের সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধি করেন। কিন্তু মনুসংহিতায় ‘ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়’ বলে উল্লেখিত লিচ্ছবীদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের দ্বারা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা কতখানি ছিল, তা চিন্তার বিষয়। তাই এই বিবাহের রাজনৈতিক গুরুত্বই ছিল অধিক। এই সময়ে লিচ্ছবীরা সম্ভবত উত্তর বিহারের কোন অংশে রাজত্ব করত। এই বিবাহের ফলে দুটি সাম্রাজ্য যুক্ত হয়েছিল এবং এই মিলিত সাম্রাজ্যের শাসনভার লাভ করেছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। আবার ড. গয়ালের মতে, রাজনৈতিক শক্তিসাম্য রক্ষার জন্যই এই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। কারণ সেই সময়ে ভারশিব নাগ ও বাকাটকদের মৈত্রীর ফলে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হতে বসেছিল। যাই হোক্‌, আলোচ্য বিবাহ সম্পর্ক গুপ্তদের ক্ষেত্রে লাভজনক হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসনারোহণের কাল নির্ণয় কিছুটা কঠিন। স্মিথ প্রমুখ শ্রীগুপ্ত ও ঘটোৎকচ গুপ্তের রাজত্বের অবসানকাল স্থির করেছেন যথাক্রমে ৩০০ খ্রিঃ ও ৩২০ খ্রিস্টাব্দ। সেই অনুসারে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ৩২০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। কারণ ঐ বছর থেকেই গুপ্তাব্দের গণনা শুরু হয়। তবে তিনি কতদিন পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন তা নিশ্চিত নয়। স্মিথ, এল্যান উভয়েই মনে করেন, ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিজ উত্তরাধিকারী হিসেবে পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে মনোনীত করে যান, যদিও সমুদ্রগুপ্ত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন না। তাঁর এই নির্বাচন যে কতখানি সঠিক ছিল, তা গুপ্তদের পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে জানা যায়, এমন কোন শিলালেখগত উপাদান আমাদের হাতে নেই। তাই এই বিষয়ে আমাদের নানাপ্রকার তথ্য প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে তাঁর ‘মহারাজাধিরাজ’ অভিধা গ্রহণ থেকে মনে হয় যে, তিনি বৃহৎ সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের যে বিবরণ আমরা পাই তার ভিত্তিতে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের বিস্তার সম্পর্কে ধারণা করা যায়। উত্তরে বেনারস থেকে দক্ষিণে মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশ পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। পূর্বে সমতট বাদে সমগ্র বঙ্গদেশ তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। পশ্চিমে তাঁর রাজ্যসীমা বিদিশার বাকাটক রাজ্যকে স্পর্শ করেছিল। পুরাণের একটি শ্লোকেও গুপ্ত রাজত্বের অনুরূপ সীমা প্রদত্ত হয়েছে। শ্লোকটি এইরূপ: “অনুগঙ্গা প্রয়াগাং চ সাকেতং মগধং স্তথা, এতান্ জনপদান সর্বান্ ভক্ষয়ত্তে গুপ্তবংশজা।” তবে এখানে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যসীমারই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যাই হোক্, বিহার, সমতট বাদে বাংলা ও উত্তরপ্রদেশের বেনারস পর্যন্ত অঞ্চল তার রাজ্যভুক্ত ছিল।

সমুদ্রগুপ্ত (আনুঃ ৩৩৫-৩৭৫ খ্রিঃ) :

সমরকুশলী সেনাপতি, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রশাসক, প্রজাহিতৈষী রাজা ও বিদ্যোৎশাহী মানুষ রূপে – সমুদ্রগুপ্তের নাম ভারত ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। গুপ্ত সম্রাটদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান পুরুষ। সমুদ্রগুপ্তের প্রতিভাবলেই একটি আঞ্চলিক শাসন সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। তাঁর রাজত্বকাল সম্বন্ধে প্রধান উপাদান হল, তাঁর সভাকবি হরিষেণ বিরচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি, মধ্যপ্রদেশে প্রাপ্ত ‘এরাণ-লিপি’ সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রাসমূহ এবং চৈনিক পরিব্রাজকদের বিবরণ প্রভৃতি।

সমুদ্রগুপ্তকে তাঁর পিতা চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এই মনোনয়ন সমুদ্রগুপ্তের ভ্রাতাদের মধ্যে যথেষ্ট বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল, এলাহাবাদ প্রশস্তির বর্ণনা থেকে তা বোঝা যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে সমুদ্রগুপ্তকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হলে তাঁর ভ্রাতাদের মুখ হতাশায় ম্লান হয়ে যায়। হয়তো তাদের এই বিক্ষোভ বিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যুবরাজ কাচ। কাচ নামাঙ্কিত বেশ কিছু মুদ্রা পূর্ব-উত্তর প্রদেশে পাওয়া গেছে। আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্পেও কাচের উল্লেখ আছে। অবশ্য অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, ‘কাচ’ সমুদ্রগুপ্তেরই অপর নাম। কারণ কাচ মুদ্রার সাথে সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রার বিশেষ মিল দেখা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায় যে, সমুদ্রগুপ্ত নিজে নাম ত্যাগ করে কাচ নামে মুদ্রা প্রবর্তন করতে গেলেন কেন? কাচ সমুদ্রগুপ্তেরই অপর নাম অথবা কাচ নামে সত্যিই কেউ ছিলেন, এ বিতর্কের মীমাংসা এখনো হয়নি। তবে সমুদ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে যদি কোন বিদ্রোহ ঘটেও থাকে, সমুদ্রগুপ্ত খুব শীঘ্রই তা দমন করে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই।

রাজ্যজয় : অসামান্য সামরিক প্রতিভাবলে সমুদ্রগুপ্ত ক্ষুদ্র রাজ্যকে গুপ্ত সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। হরিষেণের ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ অনুসারে সিংহাসন লাভের কিছুকালের মধ্যেই তিনি দিগ্বিজয়ের সূচনা করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বহুবিধ সামরিক অভিযানের জন্য তাঁর রাজ্যকাল বিখ্যাত। এলাহাবাদ প্রশস্তির রচয়িতা তাই তাঁকে ‘শত সমরে দক্ষ’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রশস্তির রচয়িতা আরো বলেছেন যে, এই সকল সমরের নিদর্শন স্বরূপ তাঁর সমস্ত দেহ অস্ত্রাঘাতের ক্ষতচিহ্নে অলংকৃত ছিল। হরিষেণের এই সকল উক্তি যে কেবলমাত্র কাব্যিক প্রয়োজনে বা অতিশয়োক্তি রূপে প্রশস্তিতে ব্যবহৃত হয়নি, সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় পর্যালোচনা করলে তা নিশ্চিতরূপে বোঝা যায়। হরিষেণের প্রশস্তি থেকেই এ বিষয়ে বিশদ জানা যায়।

যে সমস্ত অঞ্চল সমুদ্রগুপ্ত জয় করেছিলেন তাঁর সবগুলিকেই তিনি সরাসরি নিজ রাজ্যভুক্ত করেননি। বরং বলা যায় যে, এক এক শ্রেণীর রাজ্যের জন্য তিনি এক এক প্রকার নীতি নেন। এলাহাবাদ প্রশস্তিতেও সেই ভাবেই রাজ্যগুলির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশস্তির ১৩-১৪ পঙ্ক্তিতে ও২১-২৩ পঙ্ক্তিতেও আর্যাবর্তের রাজাদের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত তিনি এই সকল রাজাদের রাজ্য সরাসরি অধিগ্রহণ করেছিলেন। কারণ এক্ষেত্রে প্রশস্তিতে ‘উন্মূল্য’ কথাটি উল্লেখিত হয়েছে। এই সঙ্গে আটবীক রাজাদের উল্লেখ রয়েছে, যাদের তিনি পরিচারকের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন। মধ্যবর্তী ১৯-২০ পংক্তিতে রয়েছে দাক্ষিণাত্যের ১২ জন রাজা ও তাদের রাজ্যের নাম। এদের তিনি প্রথমে পরাজিত করে তাদের রাজ্য গ্রহণ করেছিলেন ও তারপর তাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। এঁদের দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত বলা যায়। পাঁচটি প্রত্যন্ত রাজ্যের নরপতি ও নয়টি উপজাতীয় প্রজাতন্ত্র ছিল তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত। এদের কর দিতে হত, আদেশ মান্য করতে হত ও প্রণাম নিবেদন করতে হত। কয়েকটি দূরবর্তী দেশের নরপতি, কয়েকজন বিদেশী শাসক এবং সিংহল ও অন্যান্য দ্বীপবাসীগণ ছিল চতুর্থ পর্যায়ভুক্ত। হরিষেণের প্রশস্তি অনুযায়ী এঁদের আত্মনিবেদন ও কন্যাদান করতে হত।

এলাহাবাদ প্রশস্তি ১৩-১৪ পঙ্ক্তিতে ও ২১-২৩ পঙ্ক্তিতে, দু’বারে আর্যাবর্তের নৃপতিদের নামের তালিকা পাওয়া যায়। ১৩-১৪ পক্তিতে উল্লেখিত যেসব রাজার বিরুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছিলেন তারা হলেন অচ্যুৎ, নাগসেন, গণপতিনাগ ও কোটা পরিবার। এই জয়লাভের পর তিনি পুষ্পনগরে আনন্দ উপভোগ করেন। অচ্যুৎ, নাগসেন ও গণপতিনাগের নাম পুনরায় পরবর্তী তালিকায় উল্লেখিত হয়েছে। কোটা পরিবারের মুদ্রা দিল্লীতে পাওয়া গেছে ও এই পরিবার সেখানেই রাজত্ব করত বলে মনে হয়। পুষ্পনগর বলতে কনৌজ অথবা পাটলীপুত্র যে-কোন একটি নগরকে বোঝানো হয়েছে। পরবর্তী তালিকায় রয়েছে আর্যাবর্তের নয়জন রাজার নাম। এঁরা হলেন রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, চন্দ্রবর্মন, গণপতি, নাগসেন, অচ্যুৎ, নন্দী ও বলবর্মন। এঁদের মধ্যে (১) রুদ্রদেবকে বকাটকরাজ প্রথম রুদ্রসেন, শকক্ষত্রপ দ্বিতীয় রুদ্রদামন বা তৃতীয় রুদ্রসেনের সাথে সনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক। তবে কোন মতটিই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। (২) মতিল ছিলেন উত্তর প্রদেশের বুন্দল অঞ্চলের রাজা। (৩) নাগদত্তকে বিদিশা অঞ্চলের নাগবংশীয় রাজা বলে অনুমান করা হয়। (৪) চন্দ্রবর্মন ছিলেন বাঁকুড়া জেলার পোকর্ণ অঞ্চলের শাসক। (৫) গণপতিনাগ ছিলেন সম্ভবত মন্থরার রাজা। (৬) নাগসেন ছিলেন গোয়ালিয়রের অন্তর্গত পদ্মাবতীর রাজা। (৭) অচ্যুৎ ছিলেন বেরিলী রাজ্যের অধিপতি। (৮) নন্দী ছিলেন মধ্যভারতের ও (৯) বলবর্মন ছিলেন কামরূপের রাজা। ড. স্মিথ, ভাণ্ডারকর প্রমুখ ঐতিহাসিকের চেষ্টায় মোটামুটিভাবে এই সনাক্তিকরণ সম্ভব হয়েছে। এই সনাক্তিকরণের উপর নির্ভর করে উত্তরপ্রদেশের বেশির ভাগ অঞ্চল, মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ ও দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। এইভাবে আর্যাবর্তের বিশাল অংশের উপর নিজ কর্তৃত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি অন্যান্য অঞ্চলে রাজ্যবিজয়ে মনোনিবেশ করেন।

হরিষেণ-প্রশস্তিতে আর্যাবর্তের রাজাদের নামের তালিকা কেন দুইবারে প্রদত্ত হয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। অনেকে মনে করেন যে, সমুদ্রগুপ্ত দুইবার আর্যাবর্তের রাজাদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। প্রথমবারের অভিযানে তিনি প্রথম তালিকায় উল্লেখিত শক্তিগুলিকে কেবলমাত্র পরাজিত করেছিলেন, তাদের রাজ্য গ্রাস করেননি। কিন্তু দ্বিতীয়বারের অভিযানে তিনি পূর্ববর্তী তিনজন রাজাসহ নয়জন রাজাকে পরাজিত করেন ও তাদের রাজ্য সম্পূর্ণভাবে অধিগ্রহণ করেন। আর এই দুই অভিযানের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি দাক্ষিণাত্যে রাজ্যজয়ে ব্যাপৃত থাকেন। কিন্তুএই দুইবার অভিযানের তত্ত্ব মেনে নেবার ক্ষেত্রে কয়েকটি অসুবিধা রয়েছে। প্রথমত, প্রথমবারে উল্লেখিত তিনজন রাজার নাম পরের বারের নয়জন রাজার নামের সঙ্গে পুনরায় উল্লেখিত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমবার তিনি এদের শুধুমাত্র পরাজিত করেন ও পরের বার রাজ্য অধিগ্রহণ করেন এমনও মনে হয় না, যেহেতু প্রথমবারেই এদের প্রসঙ্গে ‘উন্মুল্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সমুদ্রগুপ্তের মত একজন বিচক্ষণ ও সমরকুশলী নরপতি উত্তর-ভারতের উপর নিজের কর্তৃত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত না-করেই দক্ষিণ-ভারত অভিযানে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, একথাও বাস্তবসম্মত নয়। দুব্রেইল প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, হরিষেণের প্রশস্তিতে কালানুক্রমিকভাবে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের বর্ণনা দেওয়া আছে। সেই জন্যই দুইবার আর্যাবর্ত অভিযানের ধারণা করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রশস্তিতে হরিষেণ কালানুক্রম অনুসরণ করেছিলেন, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। পরিশেষে, এ প্রসঙ্গে ড. গয়ালের মত উদ্বৃত্ত করা যায়। তিনি বলেছেন যে, প্রশস্তিতে প্রথম ক্ষেত্রে কেবল অভিযানের বর্ণনা রয়েছে ও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে পরাজিত রাজাদের নাম। যাই হোক্, বিষয়টি এখনো বিতর্কিত।

অতঃপর সমুদ্রগুপ্ত বেশ কয়েকজন জঙ্গল অধিপতির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন। সম্ভবত এই রাজ্যগুলি উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর ও মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। উত্তর-ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি এই মধ্যবর্তী অঞ্চল জয় করেছিলেন বলে মনে হয়।

দক্ষিণ-ভারতের যে বারোজন রাজাকে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত করেছিলেন, রাজ্যসহ সেই বারোজন রাজার নাম প্রশস্তিতে উল্লেখিত হয়েছে। এই বারোজন হলেন কোশলরাজ মহেন্দ্র, মহাকান্তাররাজ ব্যাঘ্র, কৌরলরাজ মত্ত, পিষ্টপুররাজ মহেন্দ্রগিরি, কোত্তুরের স্বামীদত্ত, এরণ্ডপল্পের দমন, কাঞ্চির বিষুগোপ, অবমুক্তর নীলরাজ, বেঙ্গীর হস্তীবর্মন, পলস্কর উগ্রসেন, কুন্তলপুরের ধনঞ্জয় ও দেবরাষ্ট্রের কুবের। এই বারোটি রাজ্যের সঠিক সনাক্তিকরণ সম্ভব হয়নি। ড. রায়চৌধুরী, ড. মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিক রাজ্যগুলির সনাক্তিকরণের চেষ্টা করেছেন। তবে তাঁদের মতও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। যে কয়টি রাজ্যের মোটামুটি সনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে সেগুলি হল কোসল-দুগ, রায়পুর, বিলাসপুর ও সম্বলপুর জেলা, মহাকাস্তার-উড়িষ্যার জয়পুর অরণ্য অঞ্চল, পিষ্টপুরম্ গোদাবরী জেলার পিথাপুরম, এরণ্ডপল্ল–বিশাখাপত্তনমের এনডিপল্লি অথবা এলোর তালুকের এণ্ডোপল্লি, কাঞ্চী তামিলনাড়ুর চিঙ্গলপুট জেলার কাঞ্জীভরম, বেঙ্গী-ইলোরা থেকে সাত মাইল উত্তরে গোদাবরী ও কৃয়া নদীর মধ্যস্থলে অবস্থিত পেদ্দাবেগী। পলব্ধ-গুন্টুর বা নেলোর জেলা, দেবরাষ্ট্র—বিশাখাপত্তনম জেলা, কুত্তলপুর – উত্তর আর্কটের কুত্তালপুর। বাকি তিনটি রাষ্ট্র, অর্থাৎ কুরল, কটুর ও অবমুক্তর পরিচিতি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা খুব বেশি। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, সমুদ্রগুপ্ত মধ্যপ্রদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ দিক ধরে, উড়িষ্যার মধ্য দিয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তারপর অন্ধ্রের উপকূলভাগে বরাবর অগ্রসর হন ও তামিলনাড়ুর কাঞ্ঝীতে পৌঁছান। তাঁর দক্ষিণ ভারত অভিযান পূর্ব উপকূলেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই বিজয় সম্পন্ন করতে তাঁর সময় লেগেছিল তিন বৎসরেরও অধিক। অবশ্য ঐতিহাসিক জে. ডাবরেইউন-এর মতে, সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যে সম্মিলিত প্রতিরোধের সামনে দাঁড়াতে না পেরে অভিযান অসমাপ্ত রেখেই ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু এ মত অধিকাংশ পণ্ডিত অস্বীকার করেছেন।

সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ-ভারত জয় করলেও ঐসব দক্ষিণী রাজ্যকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। উত্তর-ভারতের ক্ষেত্রে যখন বিজিত রাজ্যসমূহকে গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন তখন দক্ষিণ-ভারতের নৃপতিদের আনুগত্যের শপথ নিয়েই তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবত পাটলিপুত্র থেকে সুদূর দক্ষিণ-ভারতের উপর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য রক্ষা করা সম্ভব হবে না বিবেচনা করেই তিনি এইরূপ অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রবর্তন করেছিলেন। এই ঘটনা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। সমুদ্রগুপ্তের আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্য অভিযানের স্বরূপ আলোচনা প্রসঙ্গে এই দুই অভিযানকে দ্বিগ্বিজয় ও ধর্মবিজয়রূপে গণ্য করা যেতে পারে। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আবার সমুদ্রগুপ্তের এই দাক্ষিণাত্য অভিযান ও নীতির পিছনে অর্থনৈতিক কারণও ছিল। দাক্ষিণাত্যের বিজিত রাজ্যগুলির অবস্থান ছিল পূর্ব উপকূল বরাবর। পেরিপ্লাস ও টলেমীর ভূগোল থেকে জানা যায় যে, সেই সময়ে পূর্ব উপকূলে বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সমুদ্রগুপ্তের লক্ষ্য ছিল ঐ সকল বন্দরগুলির উপর নিজ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যের মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলিতে যে সম্পদ জমা হয়েছে তা আহরণ করা। তাঁর এই উদ্দেশ্য সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কারণ এলাহাবাদ প্রশস্তি অনুযায়ী দাক্ষিণাত্য অভিযানের ফলে রাজ্যের প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল।

উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রগুপ্তের সাফল্যে ভীত হয়ে পাঁচটি প্রত্যন্ত রাজ্য তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে করপ্রদানে সম্মত হয়েছিল। এগুলি হল— সমতট, দবাক, কামরূপ, সেপাত্ত ও কীর্তিপুর। সমতট বলতে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ অর্থাৎ মেঘনার পূর্বদিকের অঞ্চল বোঝায়। আসামের কপিলি উপত্যকা অথবা নওগাঁ জেলার দবোক হল দবাক। আসামের গৌহাটি জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলকে বলা হত কামরূপ । নেপালের পরিচয় সকলের জানা। কীর্তিপুর সম্ভবত জলন্ধর জেলার কর্তারপুর, মতান্তরে গাড়ওয়াল-কুমায়ুন অঞ্চল।

প্রত্যন্ত রাজ্যগুলির মতই নয়টি উপজাতীয় গণরাজ্যও সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করে করপ্রদানে সম্মত হয়েছিল। এই উপজাতিগুলি হল— মালব, অর্জুনায়ণ, সৌধেয়, মদ্রক, আভীর, প্রার্জুন, সনাকানিক, কাক, খরপরিক। এই উপজাতিগুলি উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজস্থান ও পাঞ্জাবে এবং মধ্যপ্রদেশে বসবাস করত। এদের মধ্যে মালবগণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে গৌরবজনক স্থান অধিকার করে আছে। আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের সময় এরা ঝিলম ও চেনাব নদীর সংযোগস্থল থেকে রাভি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগে বসবাস করত। তারপর তারা রাজস্থানের দিকে সরে আসে। সমুদ্রগুপ্তের অভিযানের সময় এরা রাজস্থানের মেওয়ার, টংক ও সন্নিহিত অঞ্চল শাসন করত। অর্জুনায়নদের বাসস্থান ছিল জয়পুরের নিকটবর্তী স্থানে। যৌধেয়গণ বাস করত শতদ্রু ও বিপাশার মধ্যবর্তী ভূভাগে। মদ্রকগণের রাজধানী ছিল পাঞ্জাবের শিয়ালকোট। কিন্তু আলোচ্য সময়ে তারা বাস করত রাজস্থানের বিকানীর অঞ্চলে। আভীরগণের বসত ছিল ভিলশা অঞ্চলে। তবে তারা এই সময়ে পাঞ্জাবে বসবাস করত, এমন মতও প্রচলিত আছে। প্রার্জুনগণের বসতি ছিল মধ্যপ্রদেশে অথবা গান্ধারে। সনকানিকগণ ভিলশার নিকটে, কাকগণ ভিলশার উত্তরের কাকপুরে (অথবা কাশ্মীরে) এবং খরপরিকগণ মধ্যপ্রদেশের দামো জেলায় (অথবা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে) বসবাস করত। সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে উপজাতীয় রাজ্যগুলির সম্পর্ক কিরূপ ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। একটি মত অনুযায়ী সমুদ্রগুপ্ত কিছুটা স্বতন্ত্র রীতিনীতি-সম্পন্ন এই উপজাতিগুলিকে সরাসরি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত না করে করদ রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। এই গণরাজ্যগুলি তাঁর সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত থেকে রক্ষাপ্রাচীরের কাজ করবে বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু অপর মত অনুযায়ী তিনি এগুলিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নিজ রাজ্যভুক্ত করেছিলেন, ফলে পরবর্তী সময়ে হুনগণ সহজেই আক্রমণ হানতে পেরেছিল।

কেবল ভারতের মধ্যেই নয়, ভারতের বাইরেও সমুদ্রগুপ্তের কর্তৃত্ব স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে, কয়েকজন বিদেশী নৃপতি এবং সিংহল ও অন্যান্য দ্বীপের বাসিন্দাগণ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলেন। প্রশস্তির যে শ্লোকে এঁদের উল্লেখ রয়েছে সেই শ্লোকটি এইরূপ—“দৈবপুত্রষাহিষাহানুযাহি শকমরুণ্ডৈঃ সৈংহলকাদিভিশ্চ সৰ্ব্বদ্বীপ বাসিভি”। ড. মজুমদারের মতে, শ্লোকের প্রথমাংশ দ্বারা পশ্চিম মালয়া ও কাথিয়াবাড় অঞ্চলের শক শাসকদের এবং পশ্চিম-পাঞ্জাব ও আফগানিস্তানে বসবাসকারী কুষাণ প্রধানদের বোঝানো হয়েছে। এঁরা ব্যক্তিগতভাবে রাজসভায় উপস্থিত থেকে, বিবাহের সূত্রে কন্যাদান করে প্রতাপশালী নৃপতি সমুদ্রগুপ্তের সন্তুষ্টিবিধানের চেষ্টা করতেন। সমুদ্রগুপ্তের কোন অভিযানের ফলশ্রুতি হিসেবে, কিংবা যাতে ঐ ধরনের অভিযানের শিকার হতে না হয়, সেজন্য তাঁর এইরূপ আচরণ করতেন, তা নিশ্চিত নয়। তবে সীমান্তবর্তী এই সকল রাজ্যের উপর যে সমুদ্রগুপ্তের কিছুটা কর্তৃত্ব ছিল, তার মুদ্রাতাত্ত্বিক প্রমাণও রয়েছে। সমুদ্র ও চন্দ্র নামাঙ্কিত কুষাণ মুদ্রার অনুরূপ মুদ্রা পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, পশ্চিমের সিথিয়ান শাসকগণও গুপ্ত মুদ্রার অনুকরণে নির্মিত মুদ্রা ব্যবহার করতেন জানা গেছে। তাই ঐসব শাসকদলের উপর সমুদ্রগুপ্তের সার্বভৌমত্বের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ছিল। না। একইভাবে সিংহল (বিস্তৃত আলোচনা পরে দ্রষ্টব্য) ও ভারত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপগুলির রাজাগণ তাঁর মৈত্রী কামনা করতেন।

সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যবিস্তার পর্যালোচনা করে বলা যায় যে প্রাচীন ভারতে এরূপ বিশাল সাম্রাজ্যের নজীর দুর্লভ। কাশ্মীর, পশ্চিম পাঞ্জাব সিন্ধ, পশ্চিম রাজস্থান ও গুজরাট বাদ দিলে সমগ্র উত্তর ভারত তাঁর শাসনাধীন ছিল। ছত্তিশগড় ও উড়িষ্যার উচ্চভূমি তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দক্ষিণে পূর্ব উপকূল বরাবর চিঙ্গলপুট পর্যন্ত এক বিশাল ভূখণ্ডও তিনি জয় করেছিলেন। প্রত্যন্ত রাজ্য ও উপজাতীয় রাজ্যসমূহের অবস্থান থেকে তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বোঝা যায়। পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ বাদ দিলে সমগ্র বাংলা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ ধরে এর সীমা অগ্রসর হয়েছিল পশ্চিমে পাঞ্জাব পর্যন্ত। দক্ষিণে এই সীমারেখা বিস্তৃত ছিল নর্মদা পর্যন্ত। উত্তর-ভারতের বিশাল অংশ ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনাধীন। উত্তর ও পূর্বে প্রত্যন্ত রাজ্যগুলি এবং উত্তর-পশ্চিমে উপজাতীয় প্রজাতন্ত্রগুলি এই প্রত্যক্ষশাসিত অঞ্চলটিকে সুরক্ষিত রেখেছিল। আবার এরও বাইরে ছিল তাঁর প্রভাবাধীন উত্তর-পশ্চিমের শক কুষাণদের রাজ্য ও দক্ষিণ-পূর্বে সিংহল ও অন্যান্য দ্বীপ। এছাড়া ছিল কৃয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব উপকূলের করদ রাজ্যগুলি। এইভাবে একের পর এক রক্ষাপ্রাচীর নির্মাণ করে তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চলের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন।

সমুদ্রগুপ্ত পৃথিবীর দিগ্বিজয়ী বীরেদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। কিন্তু তাঁর আরো বড় কৃতিত্ব হল, সেই বিজিত সাম্রাজ্যকে সুসংগঠিত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা। “রাজার কর্তব্য রাজ্যজয় করা” —সমুদ্রগুপ্ত এই নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই রাজ্যজয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন বলে স্মিথ মনে করেছেন। কিন্তু কেবলমাত্র ‘রাজ্যজয়ের জন্যই রাজ্যজয়’—এই নীতি সমুদ্রগুপ্তের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আরো গভীর ও ব্যাপক, যা হল এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। আবার এই আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে যে সংযমের প্রয়োজন তা তিনি কখনো বিস্মৃত হননি। অত্যন্ত বিচক্ষণ রাজনীতিজ্ঞের মত তিনি সাম্রাজ্যের সংহতির পক্ষে প্রয়োজনীয় অংশটুকুকেই নিজের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে রেখেছিলেন। সুদূর দক্ষিণের ১২টি রাজ্যের রাজাকে পরাজিত করেও তিনি আবার মুক্তিদান করেছিলেন। এই নীতি দ্বারা তিনি দু’ভাবে উপকৃত হন। প্রথমত, কতৃজ্ঞ রাজারা তাঁকে করদানে সম্মত হয় এবং দক্ষিণে সমৃদ্ধ বাণিজ্য তাঁর করায়াত্ত হয়। ফলে উত্তরের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল আর্থিক থেকে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে না-আনার জন্য ঐ অঞ্চলে বিদ্রোহজনিত বিশৃঙ্খলার সম্ভবনা বিনষ্ট হয়। আবার উত্তর- ভারতের প্রত্যন্ত রাজ্য ও উপজাতীয় গণরাজ্যগুলিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট না করে তাদের তিনি নিজ সাম্রাজ্যের রক্ষাপ্রাচীর হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত যত রাজ্য জয় করেছিলেন, তার অধিকাংশেরই স্বাধীনতা তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁকে কখনই সাম্রাজ্যবাদী আখ্যা দেওয়া চলে না। প্রকৃতপক্ষে শাস্ত্রে বর্ণিত রাজচক্রবর্তী আদর্শের মূর্ত প্রতীক ছিলেন সমুদ্রগুপ্ত। দিগ্বিজয় সমাপনান্তে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান তাই তাঁর সম্রাটসুলভ মর্যাদা ও গরিমারই বহিঃপ্রকাশ ছিল বলা চলে।

সম্রাট হিসেবে, সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের মতই পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন সমান সফল। আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কুষাণ শাসকগণ এবং পশ্চিম-ভারতের শক শাসকগণ ছিলেন তাঁর অধীনস্থ মিত্র। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে সিংহল ও অন্যান্য দ্বীপের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক বজায় ছিল। ওয়াং-হিউ-এন-সির বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সিংহলরাজ মেঘবর্ণ বোধগয়ায় একটি মঠ ও বিশ্রামাগার স্থাপনের জন্য অনুমতি চেয়ে সমুদ্রগুপ্তের কাছে দূত প্রেরণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি বহু মূল্যবান উপহার-দ্রব্যও পাঠান। সমুদ্রগুপ্ত তৎক্ষণাৎ অনুমতি তো দেনই, উপরন্তু ঐ মঠের ব্যয়নির্বাহের জন্য পাঁচখানি গ্রামও দান করেন। প্রশস্তিতে অন্যান্য দ্বীপ বলতে কোনগুলিকে বোঝানো হয়েছে, তা নিশ্চিত নয়। তবে ড. মজুমদারের মতে, এর দ্বারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয় উপদ্বীপ, জাভা, সুমাত্রা ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। কারণ এইসব স্থান এই সময়ে বা এর কিছু আগেই ভারতীয় উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। এইসব স্থানের সংস্কৃতি, স্থাপত্য ভাস্কর্য ইত্যাদির উপর গুপ্তপ্রভাব লক্ষণীয়। তাছাড়া এই সকল দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জের, বিশেষত সিংহলের বাণিজ্যিক গুরুত্বও ছিল সমধিক। তাম্রলিপ্ত ও অন্যান্য বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে দ্রব্যাদি সিংহল হয়ে অন্যান্য স্থানে যেত। এই সক্রিয় বাণিজ্য অব্যাহত রাখার জন্য সিংহলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছিল জরুরী। সমুদ্রগুপ্ত তা উপলব্ধি করেছিলেন ও সিংহলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

সমুদ্রগুপ্ত ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন। মৌর্য্যোত্তর শুঙ্গ যুগ থেকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের যে জয়যাত্রা সূচিত হয়েছিল গুপ্তযুগে তা পরিপূর্ণতা পেয়েছিল বলা চলে। সমুদ্রগুপ্তের প্রবর্তিত পাঁচ প্রকার স্বর্ণমুদ্রায় লক্ষ্মী, দুর্গা, সরস্বতী প্রভৃতি হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি অঙ্কিত রয়েছে। দিগ্বিজয় শেষ করে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। এই উপলক্ষ্যে তিনি বিশেষ এক ধরনের মুদ্রার প্রচলন করেন। এই মুদ্রার একপিঠে যজ্ঞের অশ্বের চিত্র ও “অশ্বমেধ পরাক্রমঃ” কথাটি উৎকীর্ণ রয়েছে। পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটদের লেখ থেকেও এই অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা জানা যায়। তবে অন্য ধর্মের প্রতি তিনি কখনো অবহেলা বা বিদ্বেষ পোষণ করেননি।

নিজ বাহুবলে অসংখ্য সফল অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সমুদ্রগুপ্ত এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। উত্তর-ভারতের অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে নিজ ছত্রছায়ায় এনে তিনি সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আবার বহু দূরবর্তী দক্ষিণের রাজ্যগুলি তাঁর প্রবল পরাক্রমের পরিচয় পেয়েছিল। নিজ রাজ্য ও রাজধানী থেকে বহু দূরবর্তী ও দুর্গম স্থানেও এই প্রকার সাফল্য তাঁর সামরিক প্রতিভার পরিচয় দেয়। পাঁচটি প্রত্যন্ত রাজ্য ও নয়টি উপজাতীয় রাজ্যও তাঁর বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। উত্তর-পশ্চিম ভারত ও সীমান্ত পরবর্তী অঞ্চলের শক-কুষাণ শাসকগণ এবং সিংহল ও অন্যান্য দ্বীপের রাজন্যবর্গ এই প্রবল শক্তির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কেবলমাত্র পররাষ্ট্র অধিগ্রহণ করাই এই মহান সম্রাটের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। দক্ষ রাজনীতিজ্ঞের মতই দক্ষিণের ১২টি রাজ্যের স্বাধীনতা তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কেবল কর প্রদানের শর্তে। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, এত দূরবর্তী অঞ্চল প্রত্যক্ষভাবে শাসন করা অসুবিধাজনক। সমর-কুশলতার সাথে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার এরূপ সঠিক সমাহার পৃথিবীর খুব কম শাসকের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করা যায়। তাছাড়া বহু রাজার রাজত্ব নিজ বাহুবলে জয় করেও কেবলমাত্র মানবিক কারণেই তিনি তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বলে এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায়। এই হিসাবে তাঁকে ধর্মবিজয়ী আখ্যা দেওয়াও অযৌক্তিক হবে না। দিগ্বিজয় সমাপনান্তে তিনি যে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন, তা ছিল তাঁর লক্ষ্য ও আদর্শের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সময়োচিত। R. C. Majumdar বলেছেন, “No historical Indian ruler, either before or after him, had greater justification for performing this time-honoured ceremony and unique method of asserting universal supremacy.”

কেবল সুযোদ্ধা নয়, সুশাসক হিসেবেও সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন খ্যাতির অধিকারী। তিনি বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত এক সম্পূর্ণ ভারতীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। শাসনে রাজার একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও তা ছিল প্রজানুরঞ্জক। তাছাড়া তাঁর শাসনব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসনেরও অস্তিত্ব ছিল। তাঁর সুশাসনে দেশের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও সংহতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। মুদ্রা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তিনি বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন, সম্পূর্ণ বিদেশী প্রভাবমুক্ত মুদ্রার প্রচলন করে। এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে তাঁর অন্যান্য গুণাবলীর পরিচয় পাওয়া যায়। জানা যায় তিনি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী, সুকবি ও সুসঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান ছিল গভীর। কাব্যপ্রতিভার জন্য এলাহাবাদ প্রশস্তিতে তাঁকে ‘কবিরাজ’ অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। তিনি যে সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর বীণাবাদনরত মুদ্রা থেকে। এতসব গুণের জন্যই হরিষেণ তাঁকে একাধারে নারদ ও বৃহস্পতির সাথে তুলনা করেছেন। শিক্ষা ও সাহিত্যের তিনি ছিলেন উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক। সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও পণ্ডিত হরিষেণ ছিলেন তাঁর সভাকবি। বৌদ্ধ পণ্ডিত বসুবন্ধু ছিলেন তাঁর মন্ত্রী। ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি পরধর্মসহিষু ছিলেন। মেঘবর্ণকে বৌদ্ধ মঠ নির্মাণের অনুমতি দান, সেই মঠের জন্য গ্রামদান, বৌদ্ধ বসুবন্ধুকে মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত করা ইত্যাদি তাঁর পরধর্মসহিঞ্চুতার উজ্জ্বল নিদর্শন।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্মিথ সমুদ্রগুপ্তকে সমরকুশলতার জন্য ‘ভারতের নেপোলিয়ন’ আখ্যা দিয়েছেন। বাস্তবিকই তাঁর সামরিক নৈপুণ্য এই তুলনার যোগ্য। কিন্তু কোন কোন দিক দিয়ে তিনি ছিলেন নেপোলিয়ন অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠতর। কারণ তাঁর সমরাভিযানগুলি কেবলমাত্র আগ্রাসী মনোভাব দ্বারা পরিচালিত হয়নি। এর পিছনে কাজ করেছিল একটি নির্দিষ্ট আদর্শ। সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গঠনের সেই লক্ষ্যমাত্রা পরিপূরিত হবার পরে তিনি আর যুদ্ধ করেননি, বরঞ্চ বিজিত অঞ্চলে শান্তি স্থাপনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। সর্বোপরি নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য তাঁর জীবদ্দশাতেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, তাঁকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু সমূদ্রগুপ্ত আজীবন নিজ মর্যাদা ও গৌরবকে অটুট রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর বংশধরদের জন্য এক বিশাল সাম্রাজ্য রেখে যেতে পেরেছিলেন। তাঁর সর্বশেষ কীর্তি ছিল সেই সাম্রাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নির্বাচন, যাঁর মাধ্যমে সমুদ্রগুপ্তের আদর্শ ও স্বপ্ন সার্থকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল।

গুপ্তবংশের রামগুপ্ত :

গুপ্তবংশের লেখগুলিতে সমুদ্রগুপ্তের উত্তরাধিকারী হিসেবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে রচিত ‘দেবীচন্দ্রগুপ্তম্’ নাটকে অন্য এক ঘটনার বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে সমুদ্রগুপ্তের পর সিংহাসনে বসেন রামগুপ্ত। ইনি জনৈক শক রাজার কাছে পরাজিত হয়ে নিজ পত্নী ধ্রুবদেবীকে শকরাজার হাতে অর্পণের শর্তে সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। তিনি শকরাজাকে পরাজিত ও নিহত করে ধ্রুবদেবীকে মুক্ত করেন। অতঃপর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত রামগুপ্তকে হত্যা করে সিংহাসন লাভ করেন এবং ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করেন।

ড. আলতেকর, সিলভা লেভী প্রমুখ ঐতিহাসিক এই কাহিনী সত্য বলে মনে করেন। কিন্তু ড. মজুমদার-এর বিরুদ্ধে মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, প্রথমত, সমুদ্রগুপ্তের অব্যবহিত পরেই গুপ্ত সাম্রাজ্য এতটা হীনবল হয়ে পড়েনি যে একজন শকরাজ গুপ্ত সম্রাটকে পরাজিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিধবা ভ্রাতৃবধূকে বিবাহ করার রীতি এই সময়ে ভারতীয় সমাজে প্রচলিত ছিল না। তাই সামাজিক রীতিবিরুদ্ধ কাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত করবেন এমন ভাবা যায় না। তৃতীয়ত, সমুদ্রগুপ্তের অনুশাসনে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মনোনয়নের উল্লেখ রয়েছে বলে মনে হয়। চতুর্থত, দেবীচন্দ্রগুপ্ত নাটকের রচনাকাল দুই শতাব্দী পরবর্তীকালীন, তাই এর উপর নির্ভর করে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত নয়। আবার ড. এস. চ্যাটার্জী উপরের যুক্তিগুলিকে খণ্ডন করে বলেছেন যে, সম্ভবত, রামগুপ্তের কলঙ্কজনক কাজের ইতিহাস চাপা দেবার জন্যই গুপ্ত অনুশাসনে রামগুপ্তের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তাছাড়া বিধবা ভ্রাতৃবধূকে বিবাহ করার রীতি সমাজে বহুল প্রচলিত ছিল না ঠিকই কিন্তু এ কাজ অশাস্ত্রীয় নয়। বর্তমানে ভিলসা ও ঝাঁসীতে রামগুপ্তের নামাঙ্কিত কিছু তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে। বিদিশায় পাওয়া গেছে ঐ একই নামের লেখ। তাই রামগুপ্তকে আর সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক ব্যক্তি বলে মনে করা যাচ্ছে না। যাই হোক্, এ বিষয়ে এখনো বিতর্কের অবকাশ আছে।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৭৬-৪১৫ খ্রিঃ):

গুপ্ত লেখমালায় সমুদ্রগুপ্তের পরবর্তী সম্রাট হিসেবে দত্তাদেবীর গর্ভজাত পুত্র চন্দ্রগুপ্তের (দ্বিতীয়) নাম পাওয়া যায়। স্কন্দগুপ্তের একটি লেখর সূত্র ধরে কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন যে, সমুদ্রগুপ্ত তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে মনোনীত করে যান। এ সম্পর্কে অবশ্য সকলে একমত নন। চন্দ্রগুপ্ত সম্ভবত ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। কারণ তাঁর পঞ্চম রাজ্যবর্ষের মথুরা লেখর তারিখ ৬১ গুপ্তাব্দ। সুতরাং তিনি (৩২০ + ৬১ – ৫) = ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। সম্ভবত প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করার পর ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নরেন্দ্রচন্দ্র সিংহচন্দ্র, দেবরাজ, দেবশ্রী ইত্যাদি অভিধা গ্রহণ করেছিলেন।

সাম্রাজ্য গঠন ও গুপ্তবংশের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত দুটি নীতি গ্রহণ করেছিলেন। একটি ছিল যুদ্ধ দ্বারা রাজ্যজয় ও দ্বিতীয়টি ছিল সমকালীন প্রভাবশালী রাজপরিবারগুলির সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। তিনি স্বয়ং নাগবংশীয় রাজকন্যা কুবের নাগকে বিবাহ করেন এবং তাঁদের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার সাথে বাকাটক রাজ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের বিবাহ দেন। আবার সম্ভবত কুন্তলের কদম্ববংশের কাকুৎস বর্মনের কন্যাকে নিজ পুত্রবধূ করে আনেন। স্মিথের মতে, এই বৈবাহিক সম্বন্ধ-শৃঙ্খল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের হাত দৃঢ় করেছিল। অবশ্য বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের এই নীতি প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময় থেকেই অনুসৃত হয়ে আসছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়: since the very beginning it was the tradi tional policy of the Guptas to form political alliances by marriage with the more powerful and distinguished royal families of India. স্মিথ মনে করেন, পশ্চিম ভারতের শক, শক্তিকে পরাজিত করার জন্য নাগ ও বাকাটকবংশের সহায়তা চন্দ্রগুপ্তের কাছে জরুরী ছিল। বাস্তবিকই শকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকালে বাকাটকগণ যদি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করত তাহলে অভিযানের পরিণতি চন্দ্রগুপ্তের অনুকূলে না যেতেও পারত। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে বাকাটকগণের কাছ থেকে কোন বাধা তো আসেইনি উপরন্তু জামাতা রুদ্রসেন হয়তো দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে সাহায্যই করেছিলেন। তা ছাড়া বাকাটক মৈত্রী থাকার ফলে ভবিষ্যতে শত্রুশক্তির পক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, বিবাহের অল্পকালের মধ্যে দ্বিতীয় রুদ্রসেনের অকালমৃত্যু ঘটলে প্রভাবতীই বাকাটক রাজ্যের শাসনকর্ত্রী পরিণত হন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বাকাটক রাজ্যে গুপ্তদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য সামরিক কৃতিত্ব হল মালব, গুজরাট ও কাথিয়াবাড় অঞ্চল থেকে শকদের বিতাড়ন। হয়তো রামগুপ্তের রাজত্বকালে শকদের কার্যকলাপ তাঁকে শকশাসন উচ্ছেদে উৎসাহিত করেছিল। শকদের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধযাত্রার প্রমাণস্বরূপ সমকালীন তিনটি লেখর উল্লেখ করা হয়। প্রথমটি হল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সন্ধিবিগ্রহিক বীরসেনের উদয়গিরি গুহালেখ। এই লিপি থেকে জানা যায় যে, যখন তিনি (বীরসেন) তাঁর প্রভুর সাথে উদয়গিরিতে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর প্রভু অর্থাৎ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পৃথিবী জয়ের চেষ্টায় রত ছিলেন। এই ‘পৃথিবী জয়ের চেষ্টায় রত থাকা’ কথাটির মাধ্যমে কোন যুদ্ধবিগ্রহে বা সম্ভাব্য শক যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় লেখটি হল ৪১২-‘১৩ খ্রিস্টাব্দের সাঁচী লেখ। এতে বলা হয়েছে যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সেনাপতি আম্র-কার্দব ‘বহু যুদ্ধ জয়ের খ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন।’ উদয়পুরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অধীনস্থ সামস্ত সোনাকানিক মহারাজের একটি লেখও পাওয়া গেছে। ড. মজুমদারের মতে, পূর্ব-মালব অঞ্চল থেকে একাধিক্রমে গুপ্তসম্রটের মন্ত্রী, সেনাপতি ও সামন্তের লিপি প্রাপ্তির ব্যাপারটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর থেকে মনে করা যেতে পারে যে, শকদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে এক দীর্ঘকালীন সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছিল। ড. মজুমদার মনে করেন যে, শকযুদ্ধে চন্দ্রগুপ্তের জয়লাভের ঘটনাটি মুদ্রার ভিত্তিতেও প্রমাণ করা যায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকদের অনুকরণে চৈত্য, অর্ধচন্দ্ৰ ইত্যাদি অঙ্কিত মুদ্রার প্রচলন শুরু করেছিলেন। চতুর্থ শতকের একেবারে শেষের দিকে অথবা পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে। ঠিক এর আগেই, ৩৮৮ খ্রিঃ নাগাদ শকমুদ্রার ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যায়। তাই মনে করা যায়, চন্দ্রগুপ্ত ঐ সময়ের মধ্যে শকদের পরাজিত করেছিলেন। এইভাবে পশ্চিম-ভারতে প্রায় তিনশ বছর স্থায়ী শক শাসনের অবসান ঘটে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকরাজ তৃতীয় রুদ্রসিংহকে পরাজিত ও নিহত করে শক রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

শকদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সংগ্রাম ও বিজয়ের ঘটনাটির ঐতিহাসিকতা বেশির ভাগ পণ্ডিত স্বীকার করে নিলেও কেউ কেউ এ ব্যাপারে বিরুদ্ধ মতও পোষণ করেন। ড. পি. এল. গুপ্ত শক যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণার বিরোধী। তিনি বলেছেন, চন্দ্রগুপ্তের কোন লিপিতে শক যুদ্ধের বা যুদ্ধ জয়ের কোন উল্লেখ নেই। এমনকি বিজিত রাজ্য গুজরাটে তাঁর কোন লিপিও পাওয়া যায়নি। তাই কয়েকটি পরোক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে শকযুদ্ধ সম্পর্কিত যে ধারণা গড়ে উঠেছে তার ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আবার ড. গয়াল একথা মেনে নিয়েছেন যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও শকদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মতে, শকদের শক্তিসামর্থ্য এই সময়ে এত কম ছিল যে তাদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম চালানোর প্রশ্নই ওঠে না। উদয়গিরি ও সাঁচী অঞ্চলে অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক লেখ প্রাপ্তির বিষয়টিকে তিনি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ঐ সময়ে তাঁর কন্যা, বিধবা বকাটক মহিষী প্রভাবতী গুপ্তার সাহায্যার্থে সামন্ত ও সেনাপতিকে ঐ অঞ্চলে পাঠিয়েছিলেন। যাই হোক্, সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, চন্দ্রগুপ্ত শকদের পরাজিত করেছিলেন। এর ফলে কাথিয়াবাড় ও উত্তর গুজরাট তাঁর অধিকারে আসে এবং গুপ্তসাম্রাজ্য আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

অর্থনৈতিক দিক থেকে শকবিজয়ের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তৎকালীন বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র ও বন্দর ভৃগুচ্ছর উপর গুপ্তদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। ভারতের সাথে রোমের বাণিজ্য চলত মূলত এই বন্দরের মধ্য দিয়ে। রোম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নগরগুলিতে সে সময়ে ভারতীয় রেশম, মশলা ইত্যাদির চাহিদা ছিল ব্যাপক। তাছাড়া মধ্য-এশিয়া ও চীন থেকে পণ্য দ্রব্য ভারত হয়ে এই বন্দরের মধ্য দিয়ে বাইরে চালান যেত। তাই ভৃগুচ্ছ অধিকৃত হবার সাথে সাথে এই বিশাল লাভজনক বাণিজ্যও গুপ্তদের হাতে আসে। এ প্রসঙ্গেও কিছু পণ্ডিত একটি বিরুদ্ধ মতের অবতারণা করেছেন। তাঁদের মতে, এই সময়ে বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিয়েছিল। গথ জাতি রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করায় তাদের সক্রিয় বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছিল, এর প্রভাব পড়েছিল ভারতেও। মান্দাসোর লিপি অনুযায়ী বেশ কিছু রেশম শিল্প গুজরাট ছেড়ে দাসপুরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। কয়েকজন রেশমশিল্পী অন্যত্র সরে গিয়েছিলেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। না যে সামগ্রিকভাবে বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বরঞ্চ বিভিন্ন সূত্র থেকে এর বিপরীত চিত্রই পাওয়া যায়। জানা যায় গথ সেনাপতি নিজেই ভারতীয় মশলা ও রেশমের দাবিদার ছিলেন। তাই বলা যায়। ভৃগুচ্ছ অধিকার করার ফলে গুপ্ত অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়েছিল। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে উজ্জ্বয়িনী নগরীর গুরুত্ব বেড়েছিল। ক্রমে এই নগরী শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিল।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পিতার সাম্রাজ্যসীমা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। শকযুদ্ধে জয়লাভের দ্বারা তিনি সেই সাম্রাজ্যকে পশ্চিমে সম্প্রসারিত করেছিলেন। কিন্তু অন্য কোন রাজ্যজয়ের কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়া যায় কিনা তা নিশ্চিত নয়। এ প্রসঙ্গে অনেকে মেহেরৌলি লৌহস্তম্ভ লেখর উল্লেখ করে থাকেন। ঐ লেখতে চন্দ্র নামের একজন রাজার দিগ্বিজয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। লেখর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, রাজা চন্দ্র—(১) বঙ্গদেশে সমবেত শত্রুদের পরাজিত করেন। (২) সিন্ধুর সপ্তমুখ বা সপ্তসিন্ধু অতিক্রম করে বাহ্লীক জয় করেন। (৩) তাঁর যশসৌরভ দক্ষিণ সাগর অর্থাৎ ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। (৪) লেখর শেষ শ্লোক অনুযায়ী এই চন্দ্র ছিলেন বৈষুব। এই মেহেরৌলী লেখর চন্দ্রের সঠিক সনাক্তিকরণ ইতিহাসের একটি জটিল সমস্যা। এ প্রসঙ্গে চন্দ্ৰ নামধারী সমস্ত রাজার সম্ভাব্যতা ঐতিহাসিকদের দ্বারা আলোচিত হয়েছে। এই তালিকায় প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, শুশুনিয়া লেখয় উল্লেখিত চন্দ্রবর্মন, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখের নাম রয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রথম দুইজন রাজার পক্ষে উপরের বর্ণনা একেবারেই প্রযুক্ত হতে পারে না। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ক্ষেত্রে লেখর তথ্যগুলি কতদূর প্রযুক্ত হতে পারে, তাই আমাদের আলোচ্য। অধিকাংশ পণ্ডিতই (R. K. Mukherjee, D. C. Sircar, R. C. Majumdar প্রমুখ) মনে করেন যে, মেহেরৌলি লেখর চন্দ্র ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। কারণ, একমাত্র তিনি ছাড়া অন্য কোন রাজার পক্ষে একাধারে বঙ্গ ও সিন্ধু-পরবর্তী ভূভাগে অভিযান চালানো সম্ভব ছিল না বা বলা যায় এই ধরনের সুযোগ তাঁরই ছিল। তবে এই সনাক্তিকরণের ক্ষেত্রেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন, আমরা জানি যে, সমুদ্রগুপ্ত বঙ্গজয় করেছিলেন ও সমতট ছিল তাঁর সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত প্রদেশ। তাই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কেন পুনরায় বঙ্গজয়ের উদ্যোগ নেবেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যায়। এই প্রসঙ্গে ড. মজুমদারের বক্তব্য হল, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সম্ভবত, বঙ্গের বিদ্রোহী রাজাদের পরাজিত করেছিলেন কিংবা সমতটকে নিজ রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে সিন্ধু-পরবর্তী বাহ্লীক বা ব্যাকট্রিয়া অভিযানকে কেন্দ্র করে। এক্ষেত্রেও বলা হয়ে থাকে যে, এখানে বাহ্লীক বলতে ব্যাকট্রিয়া বোঝায় হয়নি। কারণ হিন্দুকুশ পরবর্তী অঞ্চলে অভিযান চালানো ও তাতে সফল হওয়া দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পক্ষেও অসম্ভব ছিল। তাই ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই বাহ্লীক ছিল নিম্ন সিন্ধুর পশ্চিমস্থ বেলুচিস্তান অঞ্চল। আবার লেখয় উল্লেখিত চন্দ্র রাজার মতই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তও ছিলেন বৈষুব। মেহেরৌলি লেখর চন্দ্রের সনাক্তিকরণ সম্পর্কে ড. গয়ালের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নতর। তাঁর মতে, ‘চন্দ্র’ শব্দটি এখানে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এই বিশেষণ প্রযুক্ত হয়েছে সমুদ্রগুপ্তের প্রতি। কারণ সমুদ্রগুপ্ত বঙ্গজয় করেছিলেন, এলাহাবাদ প্রশস্তিতে ‘দৈবপুত্র শাহী শাহানুশাহী’ অর্থাৎ‍ কুষাণ রাজাদের সাথে তার সম্পর্কের উল্লেখ আছে, দাক্ষিণাত্য অভিযানের দ্বারা তাঁর খ্যাতি ভারত মহাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল এবং তিনিও বৈয়ব ছিলেন। যাই হোক্, এ প্রসঙ্গে এটুকু বলা যায় যে মেহেরৌলী লেখর উপর নির্ভর করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের এরূপ সামরিক প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এ বিষয়ে আরো তথ্য প্রমাণের প্রয়োজন।

ভারতে গুপ্তবংশের ইতিহাসে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তিনি ছিলেন বীর যোদ্ধা ও সুদক্ষ শাসক। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর বহুমুখী প্রতিভার প্রশংসা করে বলেছেন, দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যে বিশাল সাম্রাজ্য তিনি পরবর্তী বংশধরদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন, তা তাঁর অনন্য সাধারণ সামরিক প্রতিভা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও দৃঢ় ব্যক্তিদের পরিচায়ক। তাঁর ভাষায়, “The peaceful and well knit empire which Chandragupta II left as a legacy to his son must have been the fruit of long endeavour not only of a great general and able statesman but also of striking personality” দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রশংসা করে স্মিথ বলেছেন, “Probably India has never governed better after the oriental manner than it was during the reign of Vikramaditya.” রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পাশাপাশি সে সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির যে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল, তার কৃতিত্ব দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রাপ্য। সম্ভবত অমর কবি কালিদাস তাঁর সমকালীন ছিলেন। কিংবদন্তীর নবরত্নের কয়েকজন রত্ন বা পণ্ডিত তাঁর রাজসভায় ছিলেন। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের বিবরণ (পরে দ্রষ্টব্য) থেকেও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রমাণ পাওয়া যায়। ড. রোমিলা থাপারের মতে, গুপ্তযুগের সভ্যতা ছিল উপরতলার লোকেদের জন্য সৃষ্ট। সাধারণ মানুষের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। অবশ্য এজন্য এককভাবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে দায়ী করা যায় না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক মহত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণকে পূর্ণতা দান করে তিনি গুপ্ত শাসনকে অমর করে তুলেছেন। ড. মজুমদারের ভাষায় : “He brought to the maturity the new era of political greatness and won a place in the hearts of the people.”

কিংবদন্তীর জনপ্রিয় রাজা বিক্রমাদিত্য এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত অভিন্ন কিনা—এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য ‘শকারি’ অর্থাৎ শক নিধনকারী ছিলেন এবং উজ্জ্বয়িনীকে কেন্দ্র করে তাঁর কীর্তি-কাহিনী গড়ে উঠেছিল। এছাড়া কালিদাস প্রমুখ নবরত্নের উপস্থিতিতে তাঁর রাজসভা অলংকৃত হয়েছিল। এই তথ্যগুলির সাথে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অনেক মিল পরিলক্ষিত হয়। যেমন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তও শকদের পরাজিত করেছিলেন এবং উজ্জয়িনী তাঁর সময়ে গুপ্তদের দ্বিতীয় রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছিল। তাছাড়া, তাঁর রাজসভায় কালিদাসের উপস্থিতি ছিল। পক্ষান্তরে, নবরত্নের সবাই চন্দ্রগুপ্তের আমলে ছিলেন—এ প্রমাণ পাওয়া যায় না। তা ছাড়া, কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য ‘বিক্রম-সম্বৎ’ নামে একটি অব্দের প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কোন অব্দ প্রচলন করেছিলেন কিনা তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। আর যদি করেও থাকেন, তা কখনই বিক্রম-সম্বৎ নয়, গুপ্তাব্দ। এইসব কারণে আধুনিক ঐতিহাসিকরা অভিমত দিয়েছেন যে উজ্জ্বয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (যিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন) এ ব্যক্তি নন। যাই হোক্, বিষয়টি এখনো বিতর্কিত হয়ে আছে। তাই ড. মজুমদার বলেছেন, “বিক্রম-সম্বৎ ও বিক্রমাদিত্যের যথার্থ পরিচয় ভারত-ইতিহাসের একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন।”

ফা-হিয়েনের বিবরণ :

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারতে আসেন। তাঁর ভারতে আসার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বৌদ্ধ তীর্থগুলি পরিভ্রমণ এবং বিনয়-পিটকের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ। আনুমানিক ৩৯৯ (মতান্তরে ৪০০) খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে তিনি ভারতের নানা স্থান পর্যটন করেন। তিনি পেশোয়ার, মথুরা, কনৌজ, শ্রাবস্তী, বারাণসী, কপিলাবস্তু, কুশীনগর, বৈশালী, সারনাথ, পাটলিপুত্র ও অন্যান্য স্থান পরিদর্শন করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময়ে তিনি তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং সিংহল ও যবদ্বীপ হয়ে স্বদেশে ফিরে যান। ফা-হিয়েন তাঁর ‘ফো-কুয়ো-কি’ নামক গ্রন্থে ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন।

ফা-হিয়েন তাঁর গ্রন্থে ভারত সম্পর্কে এক চিত্তাকর্ষক বিবরণ দিয়েছেন। তিনি পাটলিপুত্রে তিন বছর অবস্থান করে সংস্কৃত শিক্ষা করেন। তখন এই শহরে দুটি বিশাল বৌদ্ধমঠ ছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্ররা এখানে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে আসত। পাটলিপুত্রে অশোকের বিশাল রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দেখে তিনি বিস্মিত হন। তাঁর মতে, এত বড় ও সুন্দর প্রাসাদ মানুষের দ্বারা তৈরি করা অসম্ভব। তিনি পাটলীপুত্রের নাগরিকদের সততা ও দানশীলতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ধনীব্যক্তিরা জনহিতকর কাজে অকাতরে অর্থ সাহায্য দিতেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

ফা-হিয়েন গুপ্ত শাসন-প্রণালীর প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখেছেন, গুপ্ত রাজারা ছিলেন প্রজাদরদী। রাজকর্মচারীরা ছিল সৎ ও দায়িত্বশীল। গুপ্ত রাজারা গুরুদণ্ড দিতেন না। প্রাণদণ্ড সম্পূর্ণ রহিত ছিল। সাধারণ অপরাধের জন্য অর্থদণ্ড ও রাজদ্রোহের মত গুরুতর দণ্ডের জন্য অঙ্গচ্ছেদের বিধান ছিল। তাও একাধিকবার রাজদ্রোহ করলে তবেই এই দণ্ড দেওয়া হত। উৎপন্ন ফসলের একাংশ রাজস্ব হিসেবে দিতে হত। বিচারব্যবস্থা ছিল নিরপেক্ষ। ফা-হিয়েন গুপ্ত শাসনব্যবস্থাকে ‘সুনিয়ন্ত্রিত ও প্রজাকল্যাণমূলক’ আখ্যা দিয়েছেন। দেশের জনগণ ছিল সুশৃঙ্খল ও সৎ। তাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল না। দেশের মধ্যে জনগণ অবাধে বিচরণ করতে পারত। দেশে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল না বললেই চলে। গৃহস্থরা দরজা-জানালা উন্মুক্ত রেখে নিশ্চিত্তে নিদ্রা যেত। উচ্চবর্ণের লোকেরা নিরামিশাষী ছিল। তারা পেঁয়াজ রসুনও খেত না। এমনকি সুরাপানও করত না। নিম্নশ্রেণীর মানুষ মদ, মাংস ইত্যাদির অনুরাগী ছিল। সমাজে বর্ণভেদ প্রথার কঠোরতা ছিল। চণ্ডাল প্রমুখ অস্পৃশ্যরা সমাজের মধ্যে বাস করতে পারত না। যৌথ পরিবার জনপ্রিয় ছিল। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ কর্তা হিসেবে মর্যাদা পেতেন। পিতার সম্পত্তিতে সকল পুত্রের সমান অধিকার মান্য হত। অসবর্ণ বিবাহের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়েছিল। ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে আরও জানা যায় যে, পাঞ্জাব, বঙ্গদেশ ও মথুরাতে বৌদ্ধধর্ম জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু মধ্যদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রাধান্য ছিল। ধর্মপালনের ক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। গুপ্ত রাজাগণ ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও পরধর্মসহিষু ছিলেন। কারণ তাঁরা বৌদ্ধমঠগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করতেন। এই সময়ে কাশী, কাঞ্ঝী, নালন্দা প্রভৃতি শহর ছিল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। বৌদ্ধশাস্ত্র, হিন্দুদর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, ছন্দ, ব্যাকরণ, অলঙ্কার, তর্কশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে পাঠ্যগ্রহণের ব্যবস্থা ছিল। তাম্রলিপ্ত ছিল অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যবন্দর। গুপ্তযুগে ভারতের সাথে সিংহল, মালয়, যবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন চলত।

ফা-হিয়েনের বিবরণে ভারতবাসীর সার্বিক নৈতিক চরিত্রের যে উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা বিস্ময়কর। তাঁর বক্তব্যে আতিশয্য থাকলেও, তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নৈতিকতার যে বিশেষ মূল্য ছিল, তা স্পষ্ট।

প্রথম কুমারগুপ্ত (৪১৫-৪৫৫ খ্রিঃ) :

প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র কুমারগুপ্ত। কুমারগুপ্তের মাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের প্রধানা মহিষী ধ্রুবদেবী। তিনি সম্ভবত ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। কুমারগুপ্তের রাজ্যারম্ভের পূর্বেই গুপ্ত সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করেছিল। তাই সম্ভবত কুমারগুপ্ত নতুন কোন রাজ্যজয়ের পরিকল্পনা নেননি। তবে পিতৃপিতামহের গড়ে তোলা সাম্রাজ্যসীমাকে তিনি অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। প্রথম কুমারগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং মহেন্দ্রাদিত্য উপাধি নিয়েছিলেন। তাঁর প্রিয় দেবতা ছিলেন কার্তিকেয়, তাঁর কুমার নামটি থেকে ও মুদ্রা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি এক নতুন ধরনের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন যার একদিকে ময়ূরবাহন কার্তিকের প্রতিকৃতি রয়েছে। অন্যদিকে ময়ূরকে খাদ্যপ্রদানে রত স্বয়ং রাজার প্রতিকৃতি। তাছাড়া তাঁর প্রচলিত রৌপ্যমুদ্রায় তিনি গুপ্তদের প্রচলিত গরুড় প্রতীকের পরিবর্তে ময়ূর প্রতীক উৎকীর্ণ করান।

প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে গুপ্ত সাম্রাজ্য হিমালয় থেকে নর্মদা নদী ও উত্তর বাংলা থেকে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রথম কুমারগুপ্ত ‘ব্যাঘ্র-বলপরাক্রম’ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। এর থেকে ড. রায়চৌধুরী মনে করেন, তিনি সম্ভবত নর্মদা নদীর পরবর্তী ব্যাঘ্রসংকুল অরণ্যদেশ জয় করেছিলেন। কুমারগুপ্তের কিছু মুদ্রা সাতারা ও বেরারে পাওয়া গেছে। এই ঘটনাকে অনেকে তাঁর নর্মদা পরবর্তী ভূভাগ জয়ের প্রমাণ বলে মনে করেন। তবে এ বিষয়ে কোন নির্ভরযো্য প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।

কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষদিকে গুপ্ত সাম্রাজ্য এক অভাবিত বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। এক দুর্ধর্ষ বিদেশী জাতি গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল। স্কন্দগুপ্তের ভিতারী লেখ থেকে জানা যায় যে, এরা ছিল পুষ্যমিত্রগণ। পুরাণ অনুযায়ী নর্মদা উপত্যকার মেকল অঞ্চল ছিল এদের বাসস্থান। এই আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ বিস্তৃতির পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের মতে, কুমারগুপ্ত বকাটক রাজ্যের বিরুদ্ধে যে অভিযান করেছিলেন, তার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বকাটকদের উদ্যোগে পুষ্যমিত্র জাতি গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল। তবে রোমিলা থাপার, এন. কে. শাস্ত্রী প্রমুখ ঐতিহাসিকের মতে, এই আক্রমণকারীরা হুন ছাড়া কেউ ছিল না।

বিভিন্ন লেখমালা থেকে জানা যায়, প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে গুপ্ত শাসনব্যবস্থা খুবই উন্নত ছিল। তাঁর রাজত্বকালের দামোদরপুর লেখ, তুমাইন লেখ, কর্মদণ্ড লিঙ্গ লেখ ইত্যাদি থেকে এ যুগের শাসনব্যবস্থার একটি বিশদ চিত্র পাওয়া যায় (পরে দ্রষ্টব্য)। ড. মজুমদারের মতে, দীর্ঘ ৪০ বছরের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেও কুমারগুপ্ত রাজকীয়-বাহিনীর কর্মক্ষমতা ও উদ্যম নষ্ট হতে দেননি। এর প্রমাণ ঐ সেনাবাহিনী তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই সংঘটিত হুন আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করেছিল। এজন্য কুমারগুপ্তের কৃতিত্ব কম ছিল না। ধর্মীয় ও জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যও তাঁর রাজত্বকাল ছিল উল্লেখযোগ্য। ‘বিলসর’ ও ‘গাধোয়া’ লেখ থেকে রাজ্যে বহু সত্র প্রতিষ্ঠার কথা এবং সেই সব সত্রকে চালু রাখার জন্য অর্থদানের কথা জানা যায়। কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে কার্তিকেয়র মন্দির, জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি, সূর্যমন্দির প্রভৃতি নির্মিত হয়েছিল। এই সময়ে কার্তিক ও শিবের উপাসনা জনপ্রিয় ছিল। প্রথম কুমারগুপ্ত নিজেকে ‘পরম ভাগবত’ বলে উল্লেখ করেছেন।

স্কন্দগুপ্ত (আনুঃ ৪৫৫-৪৬৭ খ্রিঃ) :

গুপ্তবংশের শেষ শক্তিশালী রাজা হিসেবে স্কন্দগুপ্তের নাম স্মরণীয়। তিনি সম্ভবত ৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তবে তাঁর সিংহাসনারোহণের কাহিনী কিছুটা রহস্যাবৃত। এ প্রসঙ্গে তিনটি মত প্রচলিত। প্রথম মতানুযায়ী পিতা কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর স্কন্দগুপ্ত সরাসরি সিংহাসনে বসেছিলেন। ড. রায়চৌধুরী এই মত সমর্থন করেন। দ্বিতীয় মতানুযায়ী কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর মহিষী অনন্তদেবীর পুত্র ও সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারী পুরুগুপ্তকে পরাজিত করে স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। তৃতীয় মতানুযায়ী কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর, অল্পদিনের জন্য হলেও ঘটোৎকচ গুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন। তুমাইন লেখতে, বৈশালীর একটি সীলে ও লেনিনগ্রাড মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি স্বর্ণমুদ্রায় (ঘটে….. গুপ্ত’ এইভাবে) ঘটোৎকচ গুপ্তের নাম পাওয়া গেছে। তাছাড়া বায়ানার গুপ্তমুদ্রার ভাণ্ডারে ‘ক্রমাদিত্য’ শব্দ উৎকীর্ণ ছত্র প্রতীকযুক্ত একটি মুদ্রা পাওয়া গেছে, ওজনের দিক দিয়ে বিচার করলে যেটির সাথে স্কন্দগুপ্তের মুদ্রার কোন মিল পাওয়া যায় না। আবার কুমারগুপ্ত বা তার আগের কোন গুপ্তসম্রাট ক্রমাদিত্য উপাধি নেননি। তাই অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মুদ্রাটির প্রবর্তক কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের মধ্যবর্তী শাসক ঘটোৎকচ গুপ্ত। তবে ঘটোৎকচ গুপ্ত সিংহাসন অধিকার করে থাকলেও অতি অল্পদিনের জন্যই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকতে পেরেছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ঘটোৎকচ গুপ্ত সিংহাসন অধিকার করুন বা না করুন গুপ্ত সিংহাসনের উপর স্কন্দগুপ্তের বৈধ অধিকার কতখানি ছিল—এ প্রশ্ন অন্য নানা কারণে থেকেই যায়। ড. মজুমদার এই প্রসঙ্গে ভিতারি লেখর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই লেখতে স্কন্দগুপ্তের পূর্বপুরুষগণের নাম ও তাঁদের রাণীদের নাম উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে স্কন্দগুপ্তর নিজের মায়েরই নামের কোন উল্লেখ নেই। স্কন্দগুপ্ত নিজেকে ‘সুতয়ম্’ বা পিতার পুত্র বলে পরিচয় প্রদান করেছেন। এ থেকে মনে হয় যে, স্কন্দগুপ্তের মাতা কুমারগুপ্তের প্রধানা মহিযী ছিলেন না, কিংবা হয়তো তিনি তাঁর বিবাহিত মহিষীই ছিলেন না। এজন্যই স্কন্দগুপ্ত মাতৃপরিচয় দেননি এবং প্রকৃত ঘটনা যদি এই প্রকার হয় তবে সিংহাসনে তাঁর হয়তো কোন বৈধ অধিকারও ছিল না। এই একই কারণে তিনি নিজের সঙ্গে কুমারগুপ্তের সম্পর্কের উল্লেখ করতে গিয়ে কখনো প্রচলিত ‘তৎ-পাদানুধ্যাতা’ বা পিতার দ্বারা মনোনীত শব্দটি ব্যবহার করেননি। এই হীনমন্যতা থেকেই তিনি বারংবার নিজের সম্পর্কে ‘গুপ্ত বংশৈক বীরঃ’ কথাটি ব্যবহার করে নিজেকে গুপ্তবংশজাত বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন এবং কুমারগুপ্তের সঙ্গে তাঁর পিতাপুত্রের সম্পর্কটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এই প্রসঙ্গে জুনাগড় লেখর পঞ্চম শ্লোকটির উল্লেখ করা যায়। এখানে বলা হয়েছে যে, “রাজ্যের রাজলক্ষ্মী স্বয়ং রাজ্যাভিষেকে অনুপযুক্ত রাজকুমারবৃন্দের দোষগুণসমূহ বিবেচনা করে এই স্কন্দগুপ্তকে যোগ্য বলে বিবেচনা করলেন ও পরিশেষে তাকে বরণ করে নিলেন।” এই বর্ণনা ভ্রাতৃবিরোধেরই ইঙ্গিত দেয়। পরিশেষে বলা যায়, কুমারগুপ্তের পরবর্তী বৈধ অধিকারী যিনিই হোন না কেন, সিংহাসন লাভের অধিকারকে যদি যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করতে হয়, তবে সন্দেহাতীত ভাবে, স্কন্দগুপ্ত ছিলেন এ বিষয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি।

স্কন্দগুপ্ত প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষদিকে অথবা নিজ রাজত্বের প্রথমদিকে সাফল্যের সঙ্গে পরুষ্যমিত্রদের আক্রমণ প্রতিহত করে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র সাফল্য ছিল না। বারো বছরের রাজত্বকালে তাঁকে আরো বহু প্রকার প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। জুনাগড় লেখর দ্বিতীয় শ্লোকে বলা হয়েছে যে, উদ্যত ফনা সর্পের মত শত্রু রাজাদের তিনি গরুড়ের মত স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাহায্যে দমন করেছিলেন। এখানে শত্রু রাজারা কারা বা যেসব স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাহায্যে তিনি তাদের দমন করেছিলেন তারাই বা কারা ছিল, সে সম্পর্কে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এখানে শত্রুরাজা বলতে পশ্চিম মালবের বিদ্রোহী বর্মনদের ও মিত্র রাজা বলতে দাসপুরের প্রভাকরকে বোঝানো হয়েছে।

‘ভিতারি লেখ’ থেকে জানা যায় যে, স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে হূনগণ গুপ্ত সাম্রাজ্যে আক্রমণ করেছিল। লেখটি তারিখবিহীন হওয়ায় এই হুন আক্রমণ কোন্ সময়ে ঘটেছিল তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় না। ‘জুনাগড় লেখ’র তৃতীয় পংক্তিতে বলা হয়েছে ম্লেচ্ছদেশীয় শত্রুগণ তাঁর কাছে মাথানত করতে বাধ্য হয়েছিল। অনেকে মনে করেন, এই ম্লেচ্ছগণই ছিল ভিতারি লেখয় উল্লেখিত হূনগণ। এই মতকে সঠিক বলে ধরে নিলে বলতে হয় যে, স্কন্দগুপ্তের রাজত্বের প্রথম দিকেই হুন আক্রমণের ঘটনাটি ঘটেছিল। কারণ জুনাগড় লেখর তারিখ ৪৫৬/৪৫৮ খ্রিস্টাব্দ। যাঁরা ভিতারি লেখর হূনগণকে জুনাগড় লেখর ম্লেচ্ছদের সাথে অভিন্ন বলে মনে করেন না, তাঁরা বলেন যে, এই ম্লেচ্ছগণ ছিল কিদার কিষাণগণ যাই হোক্, বহিরাগত হূন আক্রমণ প্রতিহত করে স্কন্দগুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্য তথা ভারতবর্ষকে এক বিশাল বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। মধ্য-এশিয়ার আদি বাসিন্দা স্থূনগণের একটি শাখা রাশিয়া অতিক্রম করে ইউরোপে আক্রমণ চালায়। ‘শ্বেত হূন’ নামে পরিচিত অপর শাখা পারস্য আক্রমণ করে সাসানীয় সম্রাট ফিরোজকে পরাজিত ও নিহত করে এবং হানা দেয় ভারত সীমান্তে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখা যে কতখানি প্রয়োজনীয় ছিল, তা সম্ভবত পূর্ববর্তী গুপ্ত সম্রাটগণ অনুধাবন করেননি। এজন্যই ঐ পথে হুনদের পক্ষে ভারতে প্রবেশ করা সহজ হয়েছিল। স্কন্দগুপ্ত হুন আক্রমণ প্রতিরোধে সমর্থ হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, এই সময়ে হুনদের বিশাল ও শক্তিশালী অংশই ইউরোপে ও পারস্যে তাদের তাণ্ডবলীলা চালাতে ব্যস্ত ছিল। ভারতে যে হুনগণ প্রবেশ করেছিল, সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের মতে, তারা ছিল সমুদ্রস্বরূপ হুন-শক্তির একটি তরঙ্গমাত্রা। তাছাড়া গুপ্তসম্রাটগণ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সঠিক সুরক্ষার ব্যবস্থা না করলেও পর্বতমালার অবস্থিতি প্রাকৃতিক রক্ষাপ্রাচীরের কাজ করেছিল। এই দুর্গম প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করে হুনবাহিনী যখন ভারতে এসে পৌঁছেছিল, তখন তারা অনেকটাই হীনবীর্য হয়ে পড়েছিল। অবশ্য এই সব যুক্তি স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় যে, স্কন্দগুপ্ত হুনদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরাক্রম প্রকাশ করেছিলেন। হুনদের সাথে যুদ্ধটি যে সাংঘাতিক রকম হয়েছিল তা ভিতারি লেখর বর্ণনা থেকেই পরিস্ফুট হয়। স্কন্দগুপ্তের হাতে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে হুনগণ পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে তারা আর ভারত আক্রমণে সাহসী হয়নি। স্কন্দগুপ্তের এই সাফল্যের জন্য আর কে. মুখার্জী তাঁকে ‘দ্বিগ্বিজয়ী বীর’ অভিধায় ভূষিত করেছেন। ড. মজুমদার তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘ভারতের রক্ষাকর্তা’ বলে।

সুশাসক হিসেবেও স্কন্দগুপ্ত ছিলেন যথেষ্ট কৃতিত্বের অধিকারী। কৃষির উন্নতির জন্য তিনি বিখ্যাত সুদর্শনহৄদের সংস্কারসাধন করেছিলেন। ‘জুনাগড় লেখাতে বলা হয়েছে যে, তাঁর রাজ্যকালে একটি প্রজাও ধর্মভ্রষ্ট হয়নি। আর্ত, পীড়িত, কদর্য (কৃপণ) এমনকি দণ্ডিত ব্যক্তিও যাতে না অত্যন্ত পীড়িত হয়, তা দেখা হত। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, সক্রাদিত্য (স্কন্দগুপ্তের অপর নাম) নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয়, তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম ও বিদ্যা প্রসারলাভ করেছিল। চীন সম্রাটের কাছে দূত পাঠিয়ে (৪৬৬) খ্রিস্টাব্দ) তিনি চীনদেশের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেছিলেন। পূর্ণদত্ত, চক্রপালিত, সর্বনাগ প্রমুখ যোগ্য ব্যক্তিবর্গ স্কন্দগুপ্তকে শাসনকার্যে সহায়তা করতেন। কে. পি. জয়সোয়াল স্কন্দগুপ্তকে ‘শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও ধর্মপরায়ণ রাজা’ বলে অভিহিত করেছেন।

পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটগণ :

স্কন্দগুপ্তের পরবর্তীকালীন গুপ্ত সম্রাটগণের লেখতে প্রথম কুমারগুপ্তের পরবর্তী সম্রাট হিসেবে অনন্তদেবীর পুত্র পুরুগুপ্তের নাম পাওয়া যায়। এঁর সময় থেকেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভাঙন প্রকটরূপ নিতে থাকে। পরবর্তী রাজা ছিলেন দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত। এরপর বুধগুপ্ত কিছুকালের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে উদ্যোগী হন। তাঁর সময়ে গুপ্তশাসন বাংলা থেকে মালব পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দামোদরপুর, সারনাথ এরাণ প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত লেখগুলি ঐসব অঞ্চলের উপর তাঁর কর্তৃত্বের প্রমাণ দেয়। তবে এই সময় থেকেই সুবিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি মাথাচাড়া দিতে থাকে। বলভীর মৈত্রকগণ, বুদেলখণ্ডের পরিব্রাজক মহারাজা, উচ্চকল্পের রাজা জয়নাথ প্রমুখ গুপ্তদের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করতে থাকে। বুধগুপ্তের পরেও নরসিংহগুপ্ত, বৈন্যগুপ্ত, ভানুগুপ্ত প্রমুখ গুপ্তরাজাদের নাম পাওয়া যায়। এঁদের সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছিল। এই ভাঙনকে সম্পূর্ণ করেছিল হন আক্রমণ। পরিশেষে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে মগধেও গুপ্ত-কর্তৃত্ব বিনষ্ট হলে গুপ্তবংশের অবসান ঘটেছে ধরা যেতে পারে।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ :

সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে বৃহৎ গুপ্ত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, অল্পকালের মধ্যেই তা পতনের পথে ধাবিত হয়। কোন সাম্রাজ্যের উত্থান যেমন একদিকে বা আকস্মিকভাবে হয় না, তেমনি পতনও একদিনে বা একটিমাত্র কারণে ঘটে না। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পিছনেও তাই একাধিক কারণের সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রথমত, দুর্বল ও অযোগ্য উত্তরাধিকার গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার অর্থাৎ রাজার যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি রাজ্যের উন্নতি ও সংহতির প্রধান শর্তরূপে বিবেচিত হয়। স্কন্দগুপ্তকে এই বংশের শেষ শক্তিশালী সম্রাট বলে অভিহিত করা যেতে পারে। পরবর্তী শাসকরা ছিলেন দুর্বল। স্কন্দগুপ্ত বা বুধগুপ্ত কিছুটা শাসন-দক্ষতা দেখালেও একটা বৃহৎ সাম্রাজ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার মত পারদর্শিতা পরবর্তী শাসকদের ছিল না। যোদ্ধা হিসেবে বা শাসক হিসেবে কোনরকম দক্ষতাই তাঁরা প্রদর্শন করতে পারেননি। ফলে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল, তেমনি বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, গুপ্ত রাজপরিবারে কোন সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার আইন ছিল না। ফলে সিংহাসন নিয়ে বারবার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রগুপ্তের সময় থেকে শুরু করে স্কন্দগুপ্ত পর্যন্ত এই ভ্রাতৃবিরোধ বজায় ছিল। পরাক্রান্ত সম্রাটদের আমলে এর ক্ষতিকর দিকটি না বোঝা গেলেও পরবর্তী সময়ে এই ত্রুটি প্রকট হয়ে ওঠে। স্কন্দগুপ্তের রাজত্ব শেষ হবার পর থেকে (৪৬৭ খ্রিঃ) ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে একজন গুপ্ত নৃপতির নাম পাওয়া যায়, যা রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রকেই ফুটিয়ে তোলে।

তৃতীয়ত, গুপ্ত সম্রাটগণ ক্রমেই আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি বেশি করে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। কুমারগুপ্তের ‘অপ্রতিঘ’’ নামাঙ্কিত মুদ্রা থেকে অনুমিত হয় যে, বৃদ্ধ বয়সে তিনি সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হয়তো তিনি বৌদ্ধধর্মও গ্রহণ করেছিলেন। গুপ্তরাজ পরিবারে ক্রমশই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ বিষয়ে বৌধ পণ্ডিত বসুবন্ধু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বালাদিত্যের আচার্য। এই বালাদিত্যই মায়ের অনুরোধে পরাজিত ও বন্দী হননেতা মিহিরকুলকে মুক্তি দেন। এটি তাঁর মনের উদারতা প্রকাশ করলেও সাম্রাজ্যের পক্ষে ছিল চরম ক্ষতিকর। কারণ পরবর্তীকালে মিহিরকুল অত্যাচার করে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন, তা যশোবর্মন, প্রভাকরবর্ধনের স্বাধীনতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল।

চতুর্থত, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতাকামিতা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। গুপ্ত শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে প্রাদেশিক শাসকদের স্বাধীনতা বহুলাংশে মেনে নিয়েছিল। সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত কিছু রাজাকে নিয়মিত করদান ও আনুগত্যের বিনিময়ে হৃতরাজ্য ও ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে এই ধারার সূচনা করেছিলেন। অবশ্য তাঁর সময়ে ‘সামন্ত’ কথাটি ব্যবহৃত হয়নি এবং ঐ ধরনের শাসকরা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে এই ধরনের সামন্ত রাজাদের সংখ্যা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্কন্দগুপ্ত তাঁর ১২ বছরের শাসনকালে এদের নিয়ন্ত্রণে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। সামন্ত নৃপতিগণ তাঁদের লেখতে গুপ্ত সম্রাটদের নাম পর্যন্ত বাদ দিতে থাকেন। যেমন গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত এলাহাবাদ ও রেওয়া অঞ্চল থেকে প্রচারিত মহারাজা লক্ষ্মণের লেখতে তৎকালীন গুপ্তসম্রাট বুধগুপ্তের নামের কোন উল্লেখ নেই। এই সমস্ত সামন্ত রাজাদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ঘোষণা করলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ঐক্য বিনষ্ট হয়। বলভীর মৈত্রক, কনৌজের মৌখরী, বানেশ্বরের বর্ধন প্রভৃতি একে একে গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

পঞ্চমত, ত্রুটিপূর্ণ ভূমিদানব্যবস্থা গুপ্তবংশের দুর্বলতাকে ঘনীভূত করেছিল। মৌর্যযুগে দানকৃত ভূমির নীচে অবস্থিত খনিজ পদার্থে রাজার অধিকার বজায় থাকত। একইভাবে দানকৃত গ্রামের প্রশাসনিক কর্তৃত্বও থাকত রাজার হাতে। কিন্তু গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্য বা কোন সংস্থাকে ভূমিদান করলে, সেই ভূমির উপর রাজার কোন দাবি থাকত না। এমনকি ঐ ভূমির প্রশাসনিক কর্তৃত্বও দানগ্রহীতার উপর বর্তাত। এর ফলে গুপ্তযুগে একশ্রেণীর নতুন ভূম্যধিকারীর সৃষ্টি হয়েছিল, যারা কালক্রমে রাজার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে শুরু করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এরাণের বিষয়পতি মহারাজ উপাধিধারী মাতৃবিষ্ণু।

ষষ্ঠত, বাকাটকগণ ছিল গুপ্তদের সমসাময়িক একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এই বাকাটকগণের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই মৈত্রীতে ফাটল ধরেছিল, সম্ভবত কুমারগুপ্ত কর্তৃক বাকাটক রাজ্য আক্রমণের মাধ্যমে। বাকাটকরাজ নরেন্দ্র সেন গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণকারী পুষ্যমিত্রদের সাহায্য করেছিলেন প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে। আবার তিনি কোশল-মেকল-মালবের উপর নিজ প্রভুত্ব বিস্তার করেছিলেন বলে ‘বালাঘাট লিপি’ থেকে জানা যায়। অবশ্য ড. রায়চৌধুরীর মতে, ঐসব অঞ্চলের উপর স্কন্দগুপ্তের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। তবে বাকাটকদের সঙ্গে গুপ্তদের সম্পর্ক যে এই পর্বে মৈত্রীপূর্ণ ছিল না, তাতে সন্দেহ নেই। ‘জুনাগড় লেখায় উল্লেখিত বৈরী রাজাগণ ছিলেন সম্ভবত এই বাকাটক ও তাদের সহযোগী সামন্তগণ। এই অবস্থা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক ছিল।

সপ্তমত, গুপ্তযুগে রাজাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে কোন সুগঠিত সেনাবাহনী ছিল কিনা, তা জানা যায় না। এমনকি হরিষেণ-প্রশস্তিতেও গুপ্ত সৈন্যবাহিনীর কোন উল্লেখ নেই। তা ছাড়া গুপ্তযুগে সৈন্যদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের মান সম্পর্কেও সঠিক জানা যায় না। পুষ্যমিত্র বা হুন আক্রমণকারীদের ব্যবহৃত উন্নত অস্ত্রের মোকাবিলা করার মত অস্ত্র খুব সম্ভব গুপ্তদের ছিল না। তাছাড়া, সম্ভবত গুপ্ত রাজাদের বাহিনীর জন্য সামন্ত রাজাদের উপর নির্ভর করতে হত। এই ধরনের নির্ভরতা যে রাজ্যের শক্তির প্রমাণ বহন করে না, তা বলাই বাহুল্য।

অষ্টমত, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ছিল এই সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। এই বিপর্যয় ছিল প্রধানত বাণিজ্যকেন্দ্রিক। বহির্বাণিজ্য সক্রিয় থাকলেও গুপ্তযুগে অন্তর্বাণিজ্য ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিল। এর প্রমাণ গুপ্তযুগে রৌপ্য মুদ্রায় স্বল্পতা। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের এই দুরবস্থার প্রধান কারণ ছিল এই যে, এযুগে গ্রামগুলিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ একক হিসেবে ধরা হত। ফলে গ্রামের কৃষক কারিগরগণ ঐ গ্রামের প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্যাদি উৎপাদনে উৎসাহী হত না। উদ্বৃত্ত উৎপাদন না-থাকায় বাণিজ্যও সক্রিয় ছিল না। তাছাড়া গুপ্তযুগে দ্রব্যের মাধ্যমে কর আদায়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেই দ্রব্যকে নগদ অর্থে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনগ্রসর বাণিজ্য। অথচ সেনাদলের বেতন দেবার জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। আবার সক্রিয় বহির্বাণিজ্যও শেষদিকে অক্ষুণ্ণ ছিল না। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে রোমের সাথে ভারতের বাণিজ্য প্রচণ্ডভাবে হ্রাস পেয়েছিল। উপরন্তু রোমানরা চীন দেশ থেকে রেশম তৈরি শিখলে ওদেশে ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদা অনেক কমে যায়। এইভাবে বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে আগত অর্থের পথ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী গুপ্তযুগে খাদমেশানো মুদ্রা সে যুগের আর্থিক অসচ্ছলতার প্রমাণ দেয়।

নবতম, বিলাস-ব্যসনের আধিক্য গুপ্ত রাজপুরুষদের বহুলাংশে কর্মবিমুখ ও অনর্থক শক্তিকামী করে তুলেছিল। ব্যবসাবাণিজ্যের বৃদ্ধির ফলে মধ্য-গুপ্তযুগে অভিজাত ও সামন্তদের বিলাস-বৈভব অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। যে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে থেকে অতীতে বিচক্ষণ মন্ত্রী ও সুদক্ষ যোদ্ধার সৃষ্টি হয়েছিল, তারাই পরবর্তীকালে বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবার ফলে দেশ ক্ষাত্রশক্তিশূন্য হতে শুরু করে।

দশমত, গুপ্ত শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীদের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু কালক্রমে মন্ত্রীপদ বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। এমনকি বেশকিছু উচ্চপদেও বংশানুক্রমিক তার প্রবণতা দেখা যেতে থাকে। প্রধানত মন্ত্রিণ, সচিব, অমাত্য ইত্যাদি পদগুলি বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। কেমন ধ্রুবভূতি ও তার পুত্র হরিযেণ উভয়েই ছিলেন মহাদণ্ডনায়ক। এছাড়া বীরসেন, পৃথিবীসেন, চিরাতদত্ত প্রমুখের পরিবার থেকেও ক্রমান্বয়ে উচ্চপদে নিয়োগের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর ফলে একদিকে অযোগ্য ব্যক্তিত্বে প্রশাসন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে ঐসব পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। কেন্দ্রের সামান্য দুর্বলতার সুযোগে এরাই স্বাধীন রাজত্বের জন্য সচেষ্ট হয়। প্রমাণ হিসেবে সুরাষ্ট্রের মৈত্রবংশের উত্থানের কথা বলা যায়।

একাদশত, ক্রমাগত হূনজাতির আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকে অনিবার্য করে তুলেছিল। মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ হন উপজাতি স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল। হ্রদগুপ্ত সাফল্যের সঙ্গে ঐ আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু স্কন্দগুপ্তের পরবর্তীকালে হূনগণ আবার আক্রমণ হানে তোরমানের নেতৃত্বে। তিনি প্রথমে পাঞ্জাবের উপর নিজের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন, তারপর আক্রমণ হানতে থাকেন। গুপ্ত সাম্রাজ্য এই সময়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দীর্ণ। ফলে তোরমান খুব সহজেই বিস্তৃত অঞ্চল জয় করতে সমর্থ হন। এরপর আক্রমণ হানেন তাঁর পুত্র মিহিরকুল। তবে মালবের স্থানীয় শাসক যশোধর্মন তাঁকে পরাজিত করেন। তা সত্ত্বেও হূন আক্রমণের একাধিক ক্ষতিকর দিক লক্ষ্য করা যায়। যেমন ঐ আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে রাজকোষে অর্থাভাব প্রকট আকার ধারণ করেছিল, তাছাড়া বহিরাক্রমণের সুযোগে সামন্ত রাজারা কেন্দ্রীয় শক্তিকে অস্বীকার করতে শুরু করেছিল।

গুপ্ত শাসনব্যবস্থা :

কেবল বৃহৎ সাম্রাজ্য গঠন নয়, সেই সাম্রাজ্যকে সুশাসনের দ্বারা সংহত ও সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রেও গুপ্ত রাজারা যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। গুপ্তদের সুদক্ষ শাসনে সারাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা, আর্থিক সাচ্ছল্য, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্থিরতা পরিলক্ষিত হয়েছিল।

গুপ্ত শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হলে প্রধানত গুপ্ত শিলালিপিগুলির উপর নির্ভর করতে হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘দামোদরপুর লিপি’, ‘গুনাইঘর লিপি’, ‘মল্লসরূল লিপি’, ফরিদপুরে প্রাপ্ত কয়েকটি লিপি, ‘বসরাশীল লিপি’, বিভিন্ন ভূমিপট্টলী ইত্যাদি। এছাড়া স্মৃতিশাস্ত্র, ফা-হিয়েনের বিবরণ ইত্যাদি থেকেও প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাওয়া যায়।

কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা : গুপ্ত শাসনব্যবস্থায় প্রধান পুরুষ ছিলেন সম্রাট। তিনি ছিলেন আইন, বিচার ও প্রশাসনের সর্বময় প্রভু। কেন্দ্র ও প্রদেশের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীগণকে তিনি নিয়োগ করতেন। তিনি ছিলেন প্রধান বিচারক ও সেনাবাহিনীর প্রধান। তাঁর ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ ও অপ্রতিহত। গুপ্ত রাজারা সম্রাটের দৈবসত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। তাঁর পরম ভট্টারক, অচিন্ত্যপুরুষ, পরমেশ্বর, মহারাজাধিরাজ প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করতেন। সমুদ্রগুপ্ত নিজেকে ইন্দ্র, বরুণ প্রভৃতি দেবতার সাথে তুলনা করেছেন। অবশ্য এ সত্ত্বেও তাঁরা রাষ্ট্র ও প্রজাসাধারণের কল্যাণসাধনকে নিজেদের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন। এই কর্তব্য যথাযথ পালনের জন্য তাঁদের কঠোর পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের উপযুক্ত করে তুলতে হত। এযুগে রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক। তবে রাজার উত্তরাধিকারী মনোনয়নের অধিকারও ছিল। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও গুপ্ত রাজারা স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। কিংবা বলা যায় তৎকালীন পরিস্থিতি নানাভাবে রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রিত করত। যেমন প্রথমত, বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী ও মন্ত্রীরা শাসনকাজে বিশেষ কর্তৃত্ব ভোগ করতেন। রাজা তাঁদের ক্ষমতায় অপ্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করতেন না। দ্বিতীয়ত, গুপ্ত রাজাগণ সামরিক প্রয়োজনে তাঁদের সামন্তদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হতেন। ফলে তাদের কিছুটা প্রাধান্য রাজাকে মেনে নিতেই হত। তৃতীয়ত, রাজা ইচ্ছামত আইন প্রণয়ন করতে পারতেন না। ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী শাসন-রীতি গ্রহণে তিনি বাধ্য ছিলেন। চতুর্থত, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলি বা বণিক কারিগরদের নিগমগুলি স্থানীয় ও স্ব স্ব স্বার্থ-সংক্রান্ত কাজে যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করত। পঞ্চমত, এযুগে রাজারা নানাপ্রকার দৈব অভিধা গ্রহণ করলেও রাজাকে দেবতার মত অভ্রান্ত ভাবা হত না। স্মৃতিশাস্ত্রে রাজাকে সম্মান জানানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজা যদি কোন অন্যায় কাজ করতেন তবে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার প্রজাদের ছিল।

শাসনকার্যে রাজাকে সাহায্য করতেন মন্ত্রী, যুবরাজ ও রাজকর্মচারীগণ। কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের মধ্যে মন্ত্রীদের স্থান ছিল শীর্ষে। তবে এই মন্ত্রীগণের সম্মিলিতভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা শাসন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণের অধিকার সম্ভবত ছিল না। কারণ গুপ্ত লিপিসমূহে মন্ত্রীপরিষদের কোন উল্লেখ নেই। এই যুগের মন্ত্রীদের মধ্যে সন্ধি বিগ্রহিক পদটিতে কিছুটা নতুনত্ব পাওয়া যায়। কারণ ইনি ছিলেন যুদ্ধ ও শান্তির ভারপ্রাপ্ত। অর্থাৎ এঁকে একই সাথে সামরিক ও বেসামরিক দায়িত্ব পালন করতে হত। মন্ত্রী ছাড়াও মহাবলাধিকৃতি বা প্রধান সেনাপতি, মহাপ্রতিহার বা দ্বাররক্ষক, মহাদণ্ডনায়ক বা সেনাপতি, অক্ষ-পটলাধিকৃত বা সরকারি দলিল লেখক ইত্যাদি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর কথা জানা যায়। গুপ্ত যুগে মন্ত্রীপদ তো বটেই, এমনকি এইসব উচ্চপদের ক্ষেত্রেও বংশানুক্রমিক নির্বাচনের রীতি প্রবর্তনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মন্ত্রীপদ যে বংশানুক্রমিক ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় উদয়গিরি লেখ থেকে, যেখানে মন্ত্রী বীরসেন নিজেকে ‘অন্বয় প্রাপ্ত সচিব্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই ব্যবস্থার পরিণতি সব সময়ে ভাল হয়নি। কারণ বংশানুক্রমিক নির্বাচন রীতির ফলে মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের যোগ্যতা বিচার করা যেত না। গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য লোক নিযুক্ত থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই, গুপ্ত শাসনব্যবস্থার বাঁধন ক্রমশ শিথিল হচ্ছিল। এই যুগের শাসনব্যবস্থার অপর বৈশিষ্ট্য ছিল একই ব্যক্তি একাধিক পদে নিযুক্ত হতে পারতেন। যেমন এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে, হরিষেণ ছিলেন একাধারে মহাদণ্ডানায়ক ও সন্ধিবিগ্রহিক।

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতেন কুমারামাত্য ও আয়ুক্ত নামক কর্মচারীগণ। কুমারামাত্য বলতে ঠিক কাদের বোঝাত তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে, যেমন যুবরাজের অমাত্য, কুমার অবস্থা থেকে যিনি অমাত্য পদে নিযুক্ত ইত্যাদি। তবে এঁরা জেলা ও প্রদেশ শাসনেরও ভারপ্রাপ্ত হতেন। আয়ুক্তদের কাজ ছিল গুপ্ত সম্রাটগণ কর্তৃক বিজিত রাজাদের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা। তাঁরা জেলা ও নগরগুলিরও ভারপ্রাপ্ত হতেন।

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা : প্রাদেশিক শাসনকার্যের ব্যাপারে গুপ্তগণ তাদের পূর্ববর্তী মৌর্যদের অনুসরণ করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নততর ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধা ও সাম্রাজ্যকে কয়েকটি শাসনতান্ত্রিক বিভাগে ভাগ করেছিলেন। এই বিভাগগুলিকে বলা হত দেশ বা ভুক্তি। যমুনা ও নর্মদার মধ্যবর্তী ভূভাগের বিভাগগুলিকে বলা হত দেশ (সুকুলি দেশ) আর গাঙ্গেয় উপত্যকার বিভাগগুলিকে বলা হত ভুক্তি (পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি, তীরভুক্তি, শ্রাবন্তীভুক্তি ইত্যাদি)। দেশের শাসনভার গোপত্রি এবং ভুক্তির শাসনভার উপরিক মহারাজ নামক কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত ছিল। দেশের শাসনভার মাঝে মধ্যে রাজকুমারদের হাতে দেওয়া থাকত। এঁরা মহারাজপুত্র দেবভট্টারক উপাধি গ্রহণ করতেন। উপরিকগণের কাজ ছিল নিজ নিজ রাজ্যে নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও জনকল্যাণমূলক কার্যের দ্বারা দেশগুলির উন্নতিসাধন করে জনগণের সহানুভূতি লাভের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ় করা।

প্রতিটি প্রদেশ আবার একাধিক বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। বিষয়ের শাসনভার ছিল বিষয়পতি বা আয়ুক্তদের উপর। কয়েকটি ক্ষেত্রে সম্রাট স্বয়ং বিষয়পতিদের নিযুক্ত করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা প্রাদেশিক শাসকদের দ্বারা নির্বাচিত ও নিয়ন্ত্রিত হতেন। যেমন প্রথম কুমারগুপ্তের ‘দামোদরপুর লেখ’ থেকে জানা যায় যে, তিনি স্বয়ং পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির উপরিক চিরাতদত্তকে নিয়োগ করেছিলেন। আবার ঐ ভুক্তির অন্তর্গত কোটিবর্ষ বিষয়ের বিষয়পতি বেত্রবর্মনকে নিযুক্ত করেছিলেন চিরাত্দত্ত। এর থেকে বোঝা যায় যে, গুপ্তযুগে বিকেন্দ্রীকরণ নীতি কতটা অগ্রসর হয়েছিল। বিষয়পতিদের শাসনকার্যে সাহায্য করার জন্য প্রতিটি বিষয়ে একটি বেসরকারি পরিষদ ছিল। একে বলা হত অধিষ্ঠানাধিকরণ। এর সভ্য হতেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা, যাঁরা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বার্থরক্ষা করতেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নগর শ্রেষ্ঠী স্বার্থবাহ, প্রথম কুলিক প্রমুখ। বুধগুপ্তের দামোদরপুর তাম্রশাসনে এই অধিষ্ঠানাধিকরণ ও তার সদস্যদের উল্লেখ আছে। এই লেখ থেকে জানা যায় যে, কোটিবর্ষ বিষয়ের অধিকরণের সদস্য ছিলেন নগরশ্রেষ্ঠী ঋভুপাল, স্বার্থবহ বসুমিত্র, প্রথম কুলিক বরদত্ত ও প্রথম কায়স্থ বিপ্রপাল। এই সকল সদস্য মনোনীত হতেন কিংবা নির্বাচিত হতেন, তা সঠিক জানা যায় না। তবে এই ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে গুপ্ত রাজাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। গুপ্ত সম্রাটরা সাধারণত প্রদেশ বা জেলা শাসনে হস্তক্ষেপ করতেন না। বিষয়পতিগণ রাষ্ট্রীয় জমি বিক্রয়েরও অধিকারী ছিলেন। এ বিষয়ে বিষয়-অধিকরণ তাঁকে সাহায্য করতেন। অথবা অষ্টকুলাধিকরণ, গ্রামিক, কুটুম্বিক, মহোত্তর প্রমুখ ব্যক্তিদেরও সাহায্য নিতে হত।

গুপ্ত শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম। এর শাসনভার ছিল গ্রামিক বা গ্রামাধ্যক্ষ নামক কর্মচারীদের উপর। গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে গঠিত সভা ‘পঞ্চমণ্ডলী’ নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে গ্রামিকদের সাহায্য করত। এরাও স্থানীয় বিষয়াদি যথা—শিক্ষা, পথ, শান্তি প্রভৃতি বিষয়ে নজর রাখত। বৃহৎ নগরগুলিতে এক ধরনের স্থানীয় প্রতিনিধি সভা মারফত শাসন পরিচালনা করা হত। এগুলিকে বলা হত নিগম সভা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এই সভায় প্রতিনিধিত্ব করতেন। নগরবাসীদের সুখসুবিধার ব্যবস্থা করাই ছিল এই সভার কাজ। এই সভার পরামর্শক্রমে পুরপাল নগরশাসন পরিচালনা করতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে ‘পুরপাল-উপরিক’ উপাধিকারী কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

গুপ্তযুগে ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিচার পৃথকভাবে সম্পন্ন হত। প্রদেশ ও জেলাসমূহে সরকারী বিচারালয় স্থাপিত ছিল। গ্রামের বিচার নিষ্পত্তি করত গ্রাম সভাগুলি। এই যুগে কাত্যায়ন, বৃহস্পতি, যাজ্ঞবল্ক্য প্রমুখ আইনগ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেছেন। আইন মানা রাজা ও বিচারকের পালনীয় কর্তব্য ছিল। রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। গুপ্তযুগে এক ধরনের গণ-আদালতের অস্তিত্ব ছিল। ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে জানা যায়, সে যুগে দণ্ডদানের কঠোরতা হ্রাস পেয়েছিল। অঙ্গচ্ছেদ বা প্রাণদণ্ড দেওয়া হত না। (The king governed without decapitation and corporal punish ment-Fa-hien)। তবে গবেষণার ফলে এ ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে প্রাণদণ্ড বা বধ্যভূমির উল্লেখ পাওয়া যায়। স্কন্দগুপ্তের ‘জুনাগড় লিপি’ থেকেও নিষ্ঠুর শাস্তিদানের কথা জানা যায়।

গুপ্তযুগে রাজস্ববিভাগের সাথে যুক্ত যেসব কর্মচারীর নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন উপনিকা, দশপরাধিকা, দাণ্ডকা, গৌলমিকা রাজুক প্রভৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই সব কর্মচারীরাই পুলিশী বিভাগটিরও তত্ত্বাবধান করতেন। রাজস্ব হিসেবে উৎপন্ন ফসলের এক ষষ্ঠাংশ জমা দিতে হত। একে বলা হত ভাগ। কর্মচারীদের বেতন দানের জন্য গ্রহণ করা হত ভোগকর। বাণিজ্য ও শিল্পদ্রব্য থেকে আদায়ীকৃত করের নাম ছিল ভূত প্রত্যয়। এছাড়া ফেরীঘাট, খনি ইত্যাদি থেকেও কর সংগ্রহ করা হত। ‘বিষ্টি’ নামক বেগার গ্রহণের রীতি ছিল। যুদ্ধ ইত্যাদি প্রয়োজনে ‘মল্লকর’ নামক অতিরিক্ত কর আদায় করা হত।

গুপ্ত রাজাদের এক সুবিশাল সুশিক্ষিত ও সুনিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী ছিল। পূর্বের মত এই বাহিনী পদাতিক, অশ্ববাহিনী, হস্তিবাহিনী ও নৌবাহিনী—এই চারভাগে বিভক্ত ছিল। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীদের মধ্যে মহাদণ্ডনায়ক, মহাবলাধিকৃত, সন্ধি-বিগ্রহিক প্রভৃতি ছিলেন প্রধান। সে যুগে প্রধান যুদ্ধাস্ত্র ছিল বর্শা, তীর-ধনুক, কুঠার, তরবারি প্রভৃতি। গুপ্তযুগে নৌবাহিনী যে বেশ শক্তিশালী তা সংহত ছিল তার প্রমাণও পাওয়া যায়।

উপরের আলোচনা থেকে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, গুপ্ত শাসনব্যবস্থা ছিল সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসংগঠিত। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। এইভাবে জনপ্রতিনিধিদের উপর শাসনভার ন্যস্ত করে গুপ্ত রাজারা এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এইরূপ জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা থাকার ফলেই দীর্ঘকাল বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।

গুপ্তোত্তর যুগে উত্তর-ভারত :

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। মৌর্য বা গুপ্তবংশের উদ্যোগে সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্টা সফল হলেও তার স্থায়িত্ব ছিল না। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের সময়, সেই ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে ওঠা একাধিক স্বাধীন আঞ্চলিক রাজ্যের অভ্যুত্থান ছিল ভারতের রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্বর হুনদের আক্রমণ গুপ্ত শাসনের পতন অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। উত্তর-ভারতে গড়ে উঠেছিল মৈত্রক, মৌখরী, পুষ্যভূতি প্রভৃতি বংশের অধীনে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য। এরা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যে উত্তীরণের কোন উদ্যোগ নেয়নি, পরন্তু নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত থেকে ভারতের অগ্রগতিকে কেবল রুদ্ধ করেছে।

হুন আক্রমণ : হিয়ুং-নু বা হূনগণ ছিল মধ্য-এশিয়ার এক দুর্ধর্ষ বর্বর জাতি। আনুমানিক খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকে হুনরা চীন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে অপর এক যাযাবর জাতি ইউ চি`দের বিতাড়িত করে ঐ স্থান দখল করে এবং কিছুদিন পরে তৃণভূমির সন্ধানে হুনরা আবার পশ্চিমদিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই সময় হুনরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। এদের একটি দল ইউরোপে প্রবেশ করে এবং রোমান সাম্রাজ্যকে বিধ্বস্ত করে। এরা কৃষ্ণ-হুন (Black Hunas) নামে পরিচিত হয়। অপর দলটি এগিয়ে চলে ইক্ষু নদীর দিকে। এদের পরিচয় হয় শ্বেত-হুন (White Hunas) নামে। শ্বেত-স্থূনরা পারস্যের সাসানীয় বংশের সম্রাট ফিরোজকে পরাজিত করে (৪৮৫ খ্রিঃ) পারস্য ও কাবুলে হুনরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। এই বিজয় হুন-শক্তির দ্রুত প্রসারে সহায়ক হয়। বলখকে কেন্দ্র করে বিশাল হন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে।

ভারতে হুন আক্রমণের সূচনা হয় গুপ্ত-সম্রাট স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে। কিন্তু স্কন্দগুপ্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই দুর্ধর্ষ রক্তলোলুপ শ্বেত-হুনদের আক্রমণ প্রতিহত করেন (৪৫৫ খ্রিঃ)। ড. আর, কে. মুখার্জী এই কৃতিত্বের জন্য স্কন্দগুপ্তকে ‘দিগ্বিজয়ী বীর’ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক কে. পি. জয়সওয়ালের মতে, এই অনন্যসাধারণ কৃতিত্বের জন্য স্কন্দগুপ্তকে ‘শ্রেষ্ঠ গুপ্ত-সম্রাট’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। যাইহোক, প্রাথমিক পরাজয়ের পর হুনরা কিছুকাল ভারত আক্রমণ থেকে বিরত থাকে।

ষষ্ঠ শতকের প্রথমভাগে হুনরা পুনরায় ভারত আক্রমণ করে। এই সময় হুনদের নেতা ছিলেন তোরমান। পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশ বিস্তীর্ণ অঞ্চল হুনদের অধিকারভুক্ত হয়। ‘এরাণ-লিপি’ থেকে জানা যায় যে, ভানুগুপ্তের সেনাপতি গোপরাজ হুন আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে ব্যর্থ ও নিহত হয়েছিলেন। ‘কুবলয়নামা’ নামক জৈন গ্রন্থ থেকে জানা যে, ৫১০ খ্রিস্টাব্দে ভানুগুপ্তের কাছে তোরমান পরাজিত হয়েছিলেন।

তোরমানের মৃত্যুর (৫১৫ খ্রিঃ) পর তাঁর পুত্র মিহিরকুল হুনদলের নেতা হন। তাঁর রাজধানী ছিল শকল বা শিয়ালকোট। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান চালান। হিউয়েন সাঙ-এর ‘বিবরণ’, কল্‌হণ-এর ‘রাজতরঙ্গিনী’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, মিহিরকুল ছিলেন অত্যাচারী ও নৃশংস প্রকৃতির মানুষ। নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার চালিয়ে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করে এটিলা যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিলেন, মিহিরকুলের অত্যাচারও তার থেকে কম ছিল না। এই কারণে কেউ কেউ তাঁকে ‘ভারতের এটিলা’ বলে অভিহিত করেছেন। কাশ্মীর, গান্ধার, সিংহল ও দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ মিহিরকুলের রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।

মিহিরকুলের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করেন গুপ্তরাজ বালাদিত্য এবং মান্দাশোরের (পশ্চিম মালব) অধিপতি যশোধর্মন। যশোধর্মন সম্ভবত গুপ্তদের সামন্তরাজা ছিলেন। গুপ্তসম্রাটের দুর্বলতার সুযোগে তিনি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন করেছিলেন। যাইহোক্, বালাদিত্য এবং যশোধর্মন একই সাথে মিহিরকুলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, নাকি স্বতন্ত্রভাবে হুন নেতাকে পরাজিত করেছিলেন সে বিষয়ে মতভেদ আছে। মোটামুটিভাবে মনে করা হয় যে, ৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মিহিরকুল পরাজিত ও বিতাড়িত হয়েছিলেন। মিহিরকুলের মৃত্যুর (৫৪২ খ্রিঃ) পর যোগ্য নেতার অভাবে হূনদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। তবে জনৈক খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী ইণ্ডিকোপ্লেউস্‌টেস্ হুন রাজা গল্লাস ও মিহিরকুলকে অভিন্ন ব্যক্তি বলে বর্ণনা করে মতপ্রকাশ করেছেন যে, তিনি ৫৪৭ খ্রিঃ পর্যন্ত ভারতের একাংশে রাজত্ব করেছিলেন (“….if he (Mihirkula) is identified with Gollas, ‘the lord of India’, mentioned by … cosmos indicopleustes, in 547 A.D., he may have continued to exercise authority over a limited territory by that time. – R. S. Tripathi)”। যাইহোক্ কনৌজের মৌখরী ও থানেশ্বরের পুষ্যভূতি রাজবংশের সাথে কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর ভারতে হূন-আধিপত্যের সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। অতঃপর এদেশে বসবাসকারী হুনরা ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে ভারতীয় সভ্যতার সাথে মিশে যায়।

ফলাফল : পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের হুন আক্রমণ উত্তর ও পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বহুল পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। ঐতিহাসিক স্মিথের ভাষায়: “The bar barian invasions of the 5th and 6th centuries constitute a turning point in the history of Northern and Western India, both political and social.” 

প্রথমত, হুনদের আক্রমণ ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়। ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের মতই ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্য হুন আক্রমণের ফলে বিধ্বস্ত হয় এবং রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়। অতঃপর ভারতে আবার গড়ে ওঠে একাধিক আঞ্চলিক রাজ্য। 

দ্বিতীয়ত, হুনদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ ভারতে বহু প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেছিল। বহু বৌদ্ধ ও জৈন মঠ, মৌর্যযুগের এবং গুপ্তযুগের বহু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-নিদর্শন হুনদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনকি বহু ঐতিহাসিক দলিলপত্রও তারা বিনষ্ট করে দেয়।

তৃতীয়ত, হন-আক্রমণ দ্বারা ভারতের সামাজিক জীবন গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। হুনদের সাথে মধ্য-এশিয়া থেকে আরও অন্যান্য উপজাতির মানুষ ভারতে প্রবেশ করেছিল। হুনদের সাথে এরাও ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে ঐসব বিদেশীয়দের সভ্যতার সমন্বয়ে ভারতে সাংস্কৃতিক জীবনে পরিবর্তন আসে। বিদেশীদের সাথে ভারতীয়দের এবং বিদেশীয়দের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে ভারতে সংকরজাতির সৃষ্টি হয়; যেমন—রাজপুতগণ। তাছাড়া, এর ফলে ভারতীয় সমাজে বর্ণভেদের কঠোরতা অনেক হ্রাস পায়।

মান্দাশোর বংশ : মালবের যশোধর্মন : তোরমান ও মিহিরকুলের নেতৃত্বে হুন আক্রমণ, গুপ্ত সাম্রাজ্যকে বহুধাবিভক্ত করেছিল। বিশেষত বুধগুপ্তের মৃত্যুর পর বিভিন্ন প্রাদেশিক সামন্ত নেতারা ক্রমশ ক্ষমতা দখল করতে থাকে এবং একে একে নিজেদেরকে ‘স্বাধীন রাজা’ বলে ঘোষণা করতে থাকে। বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে এই সময়ে অত্যন্ত ঘনঘন বিভিন্ন যুদ্ধের কথা জানা যায়, যা এক অস্থিতিশীল ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির ইঙ্গিত বহন করে।

মালব প্রদেশেও এই রকম রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গুপ্ত সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যশোধর্মন নামে এক সমরকুশলী সামন্ত শাসক মালবে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমশ তিনি এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে মিহিরকুলকে পরাজিত করেন ও গুপ্তদেরও সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন।

যশোধর্মনের বংশ-পরিচয় সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। সম্ভবত তিনি মালবের কোন সামস্ত বংশোদ্ভূত ছিলেন, যারা পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে গুপ্ত রাজাদের অধীনে মালবের শাসনকার্যে নিযুক্ত ছিল। যশোধর্মন হুনরাজ মিহিরকুলকে পরাজিত করে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং মান্দাশোরে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। মান্দাশোরে প্রাপ্ত দুটি অনুশাসন থেকে যশোধর্মনের সামরিক কীর্তিকলাপের বিবরণ পাওয়া যায়। এই লেখ অনুসারে যশোধর্মনের রাজ্যসীমা -উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে মহেন্দ্র পর্বত পর্যন্ত এবং পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে আরবসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লেখতেও দাবি করা হয়েছে যে, সমস্ত রাজা গুপ্ত বা হুনদেরও বশ্যতা স্বীকার করেননি, তারাও যশোধর্মনের আধিপত্য স্বীকার করেছিলেন। সন্দেহ নেই রাজ্যসীমার এই বিবরণ ও বিভিন্ন দাবির পিছনে প্রশস্তি রচয়িতাদের অতিশয়োক্তি কাজ করেছে। তবে এই অতিশয়োক্তিটুকু স্বীকার করে নিয়েও একথা সাধারণভাবে বলা যায় যশোধর্মন একজন সমরকুশলী নরপতি ছিলেন। বিশেষত একথার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তিনিই পরাক্রান্ত হুন নৃপতি মিহিরকুলকে পরাজিত করেছিলেন এবং মালবকে হুন শাসন থেকে মুক্ত করেছিলেন। যশোধর্মনের এই হুনবিজয়ই সম্ভবত তাকে রাজ্যবিস্তারে উৎসাহী করেছিল।

অনেকের মতে, যশোধর্মন এবং ‘শকারী বিক্রমাদিত্য’ একই ব্যক্তি। এই দাবির ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ যশোধর্মন হুনদের পরাজিত করলেও কখনও শকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হননি। অন্যদিকে যশোধর্মনের রাজধানী ছিল মান্দাশোরে, উজ্জয়িনীতে নয়। তাঁর প্রভাবে গুপ্ত-শাসিত রাজ্যগুলির প্রাদেশিক শাসকগণ ক্রমশ স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেও যশোধর্মনের কোন উত্তরাধিকারী না থাকায়, তাঁর পর আর্যাবর্তে কোন শক্তিশালী রাজাকে পাওয়া যায় না। যশোধর্মনের শক্তি ছিল স্বল্পকালীন। ৫৩০ থেকে ৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে যশোধর্মনের উত্থান ও পতন ধূমকেতুর মত। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর সাম্রাজ্যেরও অবলুপ্তি ঘটে।

• পরবর্তী গুপ্ত রাজবংশ : গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর মগধ ও মালব অঞ্চলে পরবর্তী গুপ্ত নামধারী বেশ কিছু সংখ্যক রাজা রাজত্ব করেছিলেন। এঁদের সাথে মূল গুপ্তবংশের কি সম্পর্ক ছিল, তা অনিশ্চিত। অনেকে মনে করেন যে, এঁদের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল। আবার অনেকে মনে করেন যে, মৌখরীদের মতই এঁরা ছিলেন গুপ্তবংশের অধীনস্থ সামন্ত। গুপ্তদের দুর্বলতার যুগে এরা স্বাধীন রাজত্বের সূচনা করেছিলেন। ড. মজুমদার এই মতের সমর্থক। পরবর্তী গুপ্তদের ইতিহাস জানা যায় আফসাদ শিলালিপি, দেও-বারণার্ক শিলালিপি ইত্যাদি থেকে। পরবর্তী গুপ্তদের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রধান উপজীব্য বিষয় হল মৌখরীদের সাথে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম।

‘আফসাদ লেখ’ থেকে এই বংশের যেসব রাজার নাম জানা যায় তাঁরা হলেন কৃয়গুপ্ত, হর্যগুপ্ত, জীবিতগুপ্ত, দামোদরগুপ্ত, মহাসেনগুপ্ত, মাধবগুপ্ত ও আদিত্যসেন। সম্ভবত কৃয়গুপ্ত ছিলেন এই বংশের প্রথম স্বাধীন নৃপতি। এই বংশের চতুর্থ রাজা কুমারগুপ্ত মৌখরীরাজ ঈশানবর্মনকে পরাজিত করেন। তিনি প্রয়াগ পর্যন্ত অগ্রসর হন ও সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর পুত্র দামোদরগুপ্তও মৌখরীদের পরাজিত করেন কিন্তু সেই যুদ্ধে তিনি নিজেই নিহত অথবা সাংঘাতিকভাবে আহত হন। মৌখরীদের বিরুদ্ধে পরবর্তী গুপ্তগণের সাফল্যের দাবি অযৌক্তিক ছিল না বলেই মনে হয়। কারণ মৌখরীগণ কোথাও-ই পরবর্তী গুপ্তদের বিরুদ্ধে সাফল্যের দাবি করেননি। যাইহোক্, এর দ্বারা পরবর্তী গুপ্তগণ মালবে ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশে নিজেদের দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দামোদরগুপ্তের পুত্র মহাসেনগুপ্তর আমলে পরবর্তী গুপ্তগণের সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তৃত হয়েছিল। তিনি কামরূপরাজ সুস্থিতবর্মনকে পরাজিত করেন ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। হর্ষচরিতে তাঁকে ‘মালবের রাজা’ বলা হয়েছে। সুতরাং মালব ও বাংলার অন্তত কিছু অংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তবে তাঁর এই গৌরব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। চালুক্যরাজ কীর্তিবর্মন তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেন। অন্যদিকে শশাঙ্ক গৌড় ও মগধ অধিকার করে নেন। এই অবস্থায় মহাসেনগুপ্ত তাঁর দুই নাবালক পুত্রকে থানেশ্বর রাজ প্রভাকরবর্ধনের দরবারে প্রেরণ করেন। কারণ মহসেনগুপ্তের ভগ্নীকে বিবাহ করার সূত্রে’ প্রভাকরবর্ধন ছিলেন তাঁর আত্মীয়। মহাসেনগুপ্তের পুত্র মাধবগুপ্ত ছিলেন সম্ভবত রাজ্যবর্ধনের সহচর। তাঁর পুত্র আদিত্যসেনগুপ্ত পুনরায় পিতৃরাজ্য উদ্ধার করেন। তিনি ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিও গ্রহণ করেন।

পরবর্তী গুপ্তদের অপর এক রাজা দেবগুপ্তও মালবে রাজত্ব করতেন। এই দেবগুপ্তের সঙ্গে থানেশ্বরের পৃষ্যভৃতি রাজাদের সম্পর্ক ছিল শত্রুতাপূর্ণ। তাই দেবগুপ্ত গৌড়রাজ শশাঙ্কের সাথে মিলিত হয়ে থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্ধনের জামাতা কনৌজরাজ গ্রহবর্মনের রাজ্য আক্রমণ করেন। অবশ্য একে মৌখরী পরবর্তী গুপ্তদের দীর্ঘকালীন বিবাদের একটি পর্যায়ও বলা চলে। যাইহোক, দেবগুপ্ত গ্রহবর্মনকে পরাজিত ও নিহত করেন। যদিও প্রভাকরবর্ধনের পুত্র রাজ্যবর্ধনের হাতে তিনি পরাস্ত হন। পরবর্তী গুপ্তবংশের শেষ রাজা ছিলেন জীবিতাগুপ্ত। যাঁর রাজত্বকাল ছিল অষ্টম শতকের প্রথম দিক। পরিশেষে মালব পর্যন্ত গৌড় সাম্রাজ্য বিস্তৃত হলে পরবর্তী গুপ্ত বংশের অবসান ঘটে।

বাকাটক বংশ :

বেরার ও মধ্যপ্রদেশের কতকাংশকে কেন্দ্র করে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাকাটক রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই বাকাটকদের বংশপরিচয় ও আদি বাসস্থান অনিশ্চিত। ড. সরকারের মতে, বা-কট অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে এদের নাম হয় বকাটক বা বাকাটক। তাঁর মতে, এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিন্ধ্যশক্তির নাম থেকেই বোঝা যায় যে, এরা বিন্ধ্য পর্বত সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস করত। লেখর সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় যে, মধ্যপ্রদেশের নাগপুর ও বেরারের আকোলা ছিল বাকাটক শক্তির মূল কেন্দ্র। বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল সম্ভবত শাসন করতে বাকাটকদের অধীন কোন সামন্ত।

বাকাটক বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিন্ধ্যশক্তি ছিলেন বিষুবৃদ্ধ গোত্রের ব্রাহ্মণ, বেলোরা তাম্রফলকে তাঁকে ‘বংশকেতু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তিনিই ছিলেন এই বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। বিন্ধ্যশক্তির পুত্র ছিলেন মহারাজ প্রথম প্রবরসেন (আনু. ২৭৫-৩৩৫ খ্রিঃ)। তিনি রাজ্যসীমা বিস্তৃত করেন ও চারটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। তাঁকেই এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দেওয়া যায়। প্রবরসেন তাঁর পুত্রের সঙ্গে শক্তিশালী নাগবংশের রাজা ভবনাগের কন্যার বিবাহ দেন। এই শক্তিশালী আত্মীয়ের সহায়তায় তিনি উত্তরে বুন্দেলখণ্ড থেকে দক্ষিণে হায়দ্রাবাদ পর্যন্ত ভূভাগ বাকাটক রাজ্যের অধীনে আনেন। প্রবর সেন ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যধর্মের সমর্থক। অশ্বমেধ ছাড়াও বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম, অতিরাত্র ইত্যাদি যজ্ঞের অনুষ্ঠান তিনি সম্পন্ন করেছিলেন।

প্রবরসেনের মৃত্যুর পর বাকাটক বংশ অন্তত দুটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। প্রধান শাখাটি নাগপুরকে কেন্দ্র করে রাজত্ব করতে থাকে। এই শাখার রাজা হন প্রথম রুদ্রসেন। অন্যদিকে সর্বসেনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাকাটকদের বৎসগুল্প শাখা। রুদ্রসেন সম্ভবত ৩৩৫-৩৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। মাতামহ ভবনাগের সাহায্যে ইনি পিতামহ প্রবরসেনের সাম্রাজ্যের বিশাল অংশের উপর নিজ কর্তৃত্ব রক্ষায় সক্ষম হন। সম্ভবত নাগবংশের প্রভাবেই তিনি মহাভৈরব অর্থাৎ শিবের উপাসক হন। অনেকে মনে করেন, সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক বিজিত নয়জন আর্যাবর্ত রাজার একজন ছিলেন প্রথম রুদ্রসেন, এলাহাবাদ অঞ্চলে লেখয় যাঁকে ‘রুদ্রদেব’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বুন্দেলখণ্ডের বিস্তৃত অঞ্চল রুদ্রসেনের পুত্র প্রথম পৃথিবীসেনের অধীনস্থ ছিল। তাই ঐ সনাক্তিকরণ সঠিক নাও হতে পারে।

রুদ্রসেনের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন প্রথম পৃথিবীসেন। তিনি কুম্ভল দেশ জয় করেন। তাঁর পুত্র যুবরাজ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সাথে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতীগুপ্তার বিবাহ হয়। দ্বিতীয় রুদ্রসেন রাজত্ব করেন ৩৮৫ থেকে ৩৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তাঁর উপরে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের যে যথেষ্ট প্রভাব ছিল তার প্রমাণ তিনি পিতা ও পিতামহের শৈব ধর্মত্যাগ করে বৈয়ব ধর্মগ্রহণ করেছিলেন। এই বিবাহ সম্পর্কের ফলে বাকাটকগণ শকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। তাছাড়া রুদ্রসেনের আকস্মিক মৃত্যুর পর নাবালক পুত্রদের অভিভাবিকা হিসেবে প্রভাবতীদেবী বাকাটক রাজ্যের শাসন পরিচালনা করেছিলেন। ফলে বাকাটক রাজ্যে গুপ্ত-প্রভাব বৃদ্ধি পায়। প্রভাবতী দীর্ঘকাল বাকাটক রাজ্য শাসন করেন। এমনকি তাঁর পুত্র দিবাকর সেনের ষোলো বছর বয়সের পরও তিনি তাঁর কর্তৃত্ব ত্যাগ করেননি। দিবাকর সেন সম্ভবত তাঁর পিতার সিংহাসনে বসার সুযোগ পাননি। কারণ একটি লেখতে তাঁকে মহারাজ দামোদরসেন ও প্রবরসেনের (দ্বিতীয়) মাতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দামোদরসেন বেশ দীর্ঘ সময় ধরে রাজত্ব করেছিলেন। এরপর রাজা হন দ্বিতীয় প্রবরসেন। ইনি সম্ভবত পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে সিংহাসনে বসেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় থেকে ২৭-তম রাজ্যবর্ষের মধ্যবর্তী সময়ের বহু লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির প্রাপ্তিস্থান হল ওয়ার্ধা, ছিন্দওয়ারা, নাগপুর, বালাঘাট, আজৌতি, বেতুল ইত্যাদি। এ থেকে বোঝা যায় যে, প্রবরসেনের রাজত্ব চেরার ও মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমের জেলাগুলি নিয়ে গঠিত ছিল। ইনি সেতুবন্ধ কাব্যের রচয়িতা হিসেবেও প্রসিদ্ধ।

দ্বিতীয় প্রবরসেনের পর রাজা হন নরেন্দ্রসেন। তিনি এক কুন্তল রাজকন্যাকে বিবাহ করেন। কোশল, মেকল ও মালবের রাজারা তাঁর আদেশ মান্য করতেন বলে জানা যায়। এই বংশের শেষ বিখ্যাত রাজা ছিলেন নরেন্দ্রসেনের পুত্র দ্বিতীয় পৃথিবীসেন। ‘বালাঘাট লিপিতে’ তাঁকে ‘পরম ভাগবত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর পরে এই বংশের ইতিহাস আর জানা যায় না।

বাকাটকদের বৎসগুল্ম শাখার বিখ্যাত রাজারা ছিলেন সর্বসেন, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি, দ্বিতীয় প্রবরসেন, দেবসেন ও হরিষেণ। এই শাখার প্রতিষ্ঠাতা সর্বসেন ‘হরিবিজয়’ নামে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন।